জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -২১।

আপডেট: ২১ অগাস্ট ২০২২, ১৪:২৭

অমৃতের সন্ধানে -২১ 

 

ফেরীতে উঠার আগে শেষ সূর্যটা দেখতে দেখতে শেষ আশ্রয়স্থলে পৌছাতে দিনমনি গাছের ডাল পালার ফাঁক ফোঁকর উঁকি ঝুঁকি দিতে দিতে শেষ কথাগুলোও না বলেই আস্তাচলে ডুবে গেল। ওর শেষ কথাগুলোও না বলাই রয়ে গেল।
তাতে ওর সমস্যা নেই। দিনমনি তার না বলা কথা বলার জন্য অন্য কোন দিন ক্ষন বা অন্য কাউকে ঠিকই খুজে নেবে। আবার সকাল হবে আবার নতুন করে শুরূ হবে সব। কিন্তু মানিকের শেষ ফেরীটা কাল ধরতেই হবে।
সামনে একটা গেট নজরে পড়লো। উচু প্রাচিরঘেরা বিশাল দুর্গ সমান প্রবেশের জন্য প্রধান ফটকটা বেমানানই লাগলো। ছোট তোরনের মাথায় একটা কম পওয়ারের বাল্ব জ্বলছে। আলো আঁধারীতে লেখাগুলো কোনমতে পড়া যাচ্ছে- হাসপাতাল ও আশ্রম। কোন জায়গার নাম নেই বা প্রতিন্ঠানটার নাম ও নেই।
পরিপূর্ণতার অভাব আছে বলে মনে হয়।
গেটটা আটকানো। গেটের দুধারে লম্বা ঝাকড়া দুটো গাছ দাড়িয়ে। অন্ধকারটা গাঢ়ো হওয়াই আগেই গাছ দুটো তাদের সবুজ পাতার আবরণে দুপাশ আধারে ঢেকে দিয়েছে। কি গাছ অন্ধকারে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। একটা মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেষে আসছে। ফুরফুরে বাতাসে হাত নেড়ে নেড়ে সুবাস ছড়িয়ে গাছ দুটো আমাদেরকে মনে হলো খোস আমদেদ জানাচ্ছ।
গন্ধটা খুবই মিষ্টি এবং পরিচিত লাগছে। ফুল গুলোর চেহারাও ভেষে উঠছে মানসপটে। কিন্তু কিছুতেই নামটা মনে পড়ছে না।
গাড়ীর আলোয় আমাদের আগমনটা টের পেয়ে কেউ একজন এদিকে আসছে মনে হলো। স্বল্প আলোয় যতটুকু দেখা গেল তাতে মনে হলো পাতলা লম্বা ছিপছিপে গড়নের একটা মানুষ লাঠি ভর করে হেটে আসছে। আলো আধারীতে ওকে অনেকটা দোকানীর মত লাগলো।
ও গেটটা খুলে হাতের ঈশারায় গাড়ীটার পাকিং এর জায়গা দেখিয়ে দিল।
গাড়ীটা থামিয়ে পার্ক করতে করতে আমার সহযাত্রিরা সব হই হল্লা করতে করতে নেমে গেল। খুব খুশী ওরা, জনহীন প্রান্তরে এমন একটা জায়গা পেয়ে। অপ্রত্যাশিত কিছু পেয়ে যাওয়ার আনন্দটায় আলাদা।
গাড়ীর ষ্টার্ট বন্দ করে নামতে নামতে গেট খুলে দেয়া লোকটাকে সাথে নিয়ে ওরা চলে গেল।
নেমে দাড়ালাম। চারিদিকে অন্ধকার কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। সবই অচেনা। মৃদু মন্দ বাতাসে পরিচিত ফুলের গন্ধটায় কেবল আলিঙ্গন করছে।
গাছ পালা সব ভেদ করে অন্ধকারকে দুরে ঠেলে দিগন্ত ফুড়ে গোল চাঁদটা উঠছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা।
ধীরে ধীরে আঁধার কেটে সব পরিস্কার হতে লাগলো। চোখের সামনে মাত্র কয়েক গজ দুরে আন্ধকারের বুক চিরে সন্তোর্পনে বেরিয়ে আসলো পুরনো ঈট সুড়কির বিশাল এক অট্টালিকা।
একদম রোমাঞ্চকর! এত কাছে দাড়িয়ে তবুও বোঝা যায়নি একটু আগেও।
পুরনো আমলের বিশাল কোন জমিদার বাড়ীর মত। সামনের অংশটা আবছা দেখা যাচ্ছে। বেশ ঝকঝকে তকতকে।
প্রতি মুহুর্তে একটু একটু করে শত বছরের সাক্ষ্য বহনকারী ইমারতটি চাদের আলোয় জীবন্ত হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে এখনই গভীর নিদ্রার জাল ছিড়ে ঈট পাথর আর সুড়কির দেয়াল ভেদ করে বাসিন্দারা সবাই বেরিয়ে আসবে এক এক করে। তাদের কোলাহলে এই নিস্তব্দতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে।
কম করে হলেও দুশো গজের মত পূর্ব পশ্চিম লম্বা উত্তর দিক মুখ করা পুরোটায় দোতলা। মনে হলো বিল্ডিং এর সামনে মাঝামাঝি জাইগায় দাড়িয়ে আমি। সামনেই মুল বিল্ডিং। ভিতরে ঢুকার জন্য ইমারতের ভিতর দিয়ে বড় একটা গেট। এটাই বোধহয় প্রধান প্রবেশ দ্বার। এদিকটা একেবারে নিস্তব্দ। কিছু জানালা নজরে পড়লেও কোথাও কোন বাতির আলো চোখে পড়ছে না।
এক সারি মোটা লম্বা পাম ট্রি বিল্ডিংটার গা ঘেসে দাড়ানো। অনেক পুরোনো গাছগুলো। বিল্ডিংটার মতই।
বাড়ীর সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। যতটুকু দেখা যায় তাতে বোঝা যাচ্ছে আমরা যে গেট দিয়ে প্রবেশ করেছি ওটার সাথে দশ ফুটের মত উচু ঈটের পাচিল দিয়ে জায়গাটা ঘেরা। যতটুকু নজরে পড়ছে তাতে মনে হয় অনেক জায়গা নিয়ে হাসপাতালটা।
বাদিকে বেশ খানিকটা দুরে আলোকিত লম্বা লম্বা দোতলা কয়েকটা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। নতুন ধাচের বিল্ডিং, মনে হয় পরে তৈরী। দুর থেকে বারান্দায় মানুষের কিছু চলাফেরাও নজরে পড়ছে। ওটাই বোধহয় হাসপাতাল।
হাসপাতালের বিল্ডিং গুলোর মাঝখান দিয়ে আরো একটু দূরে আরো বেশ কিছু আলাদা আলাদা একতলা দোতলা বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। হয়তোবা ডাক্তার আর নার্সদের থাকার কোয়াটার।
আনেক বড় জায়গা নিয়ে কোন পুরানো জমিদার বাড়ীকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটি বানানো হয়েছে।
চাঁদটা বেশ খানিকটা উপরে উঠে এসেছে। দিগন্ত ছেড়ে নিজ ছন্দে অগ্রসর হচ্ছে চাঁদটা । জোৎস্নার আলোতে পুরো জায়গাটা স্বপ্নীল মনে হচ্ছে। মৃদু বাতাসে ডালপালার নড়াচড়া এখন পরিস্কার চোখে পড়ছে।
চাঁদনী বাতাস ঐ পরিচিত ফুলের গন্ধটা বয়ে এনে মানিকের চোখ মুখ সারা শরীরে মাখিয়ে দিচ্ছে। মানিকের মনে হচ্ছে যেন ওর নিজের মনের অব্যক্ত স্বপ্নের বাস্তব রূপ ওর চোখের সামনে।
-চমৎকার একটা ছিলেকশান! শ্রদ্ধায় এর প্রতিষ্ঠাতার প্রতি মাথা নত হয়ে আসে। ভাবলো মানিক।
-স্যার আসেন। মানিক চমকে ফিরে তাকালো।
খ্যাস খ্যাসে গলায় কথা গুলো বলতে বলতে হাড্ডিসার লোকটা অন্ধকার ভেদ করে বেরিয়ে এলো।
মুখটা হাসি মাখা বোঝা যায়, তবে মুখের বা কপালের রেখা গুলো ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছ না, তায় ওর হাসিটার স্বরূপ বোঝা গেল না।
খুক খুক করে কাসতে কাসতে ও পথ দেখিয়ে চললো। মানিক নীরবে ওকে অনুসরন করে প্রধান ফটক দিয়ে সামনের পুরনো অট্টালিকার চত্তরে ঢুকলো।
ঢুকতেই নজরে পড়লো বিল্ডিংয়ের অন্য অংশগুলো যা সামনে থেকে চোখে পড়েনি।
বিল্ডিংটা আয়তকার। চরিদিকে সামনের মত দোতলা। মাঝখানটায় সবুজ ঘাসের চত্তর, কম করে হলেও একটা ফুটবল ফিল্ডের অর্ধেক পরিমান জায়গা। সবুজের মাঝখানে গোলাকৃতি অতি পুরনো একটা ফোয়ারা। কাছে যেতেই বুঝলাম ওটা জীবন্ত। বাইরেটা পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখলেও ভিতরের দিকটাতে এযুগের ছাপ সুস্পষ্ট।
আমাকে একটু দাড়াতে বলে দারোয়ান কোথায় যেন গেল।
চাঁদটা তখনও পূর্ব দিগন্তে তাই ওদিককার বিন্ডিং এর পাশটাতে একটু ছায়া বাদে বাকি চত্তরটা জোৎস্নালোকিত। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কোন ঘরে কোন আলো নেই।
জোৎস্না রাতে আলো যেন জ্বালতে মানা। কি একচ্ছত্র পদচারনা প্রকৃতির।
দারোয়ানের টর্চের আলোয় যেন মোহ ভঙ্গ হলো।
ওকে অনুসরন করে একটা লোহার সরূ পেচানো সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে আসলাম। এ চত্তরে বোধহয় কারেন্টের সংযোগ নেই। আলো আধারীতে যা বোঝা যায় তাতে মনে হলো, ভিররের দিকে চওড়া বারান্দার গা ঘেসে সব রূমগুলো দাঁড়ানো।
কোনার একটা রূমের দরজা ঠেলে খুলে দারোয়ান বললো- থাকতি বোদহয় কষ্ট হবে স্যার।
ঘরের কোনায় টেবিলের উপর একটা হারিকেন জ্বলছে মিট মিট করে।
একেবারে নির্জন। কারো কোন সাড়াশব্দ নেই।
শুধু ওর খ্যাস খেসে কন্ঠস্বর নীরবতাকে যেন বিরক্ত করছে। অল্প আলোতে ওর চোখ মুখ কিছুই দেখতে পেলাম না।
-উনারা আপনার পাশের রূমেই থাকপেন। সবাই একটু ঘুরে দেখতি গেছে। পাড়া গা, সন্ধ্যের পর পরই অনেক রাত্রি হয়ে যায়।
একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো- স্যার খাওয়াতে কোন বাছাবাছি আছে।
আমি মাথা নেড়ে না বললাম।
-অমি এদিকেই আছি ডাকলিই পাবেন।
কথাটা সেরে খুক খুক করে কাসতে কাসতে চলে গেল লোকটা।
একটা সিংগেল খাট, বালিশ চাদর কাঁথা সবই পরিপাটি। এক কোনায় কাঠের একটা টেবিল আর চেয়ার। দুপাশেই দেয়াল বোধহয় দুদিকেই এধরনের কামরা। সামনের দিকটার দেয়ালে দরজা বাদে একটা জানালা, আর সোজাসুজি পিছনের দেয়ালে আরো দুটো জানালা।
পিছনের দুটো জানালায় খোলা, মৃদু বাতাসে পর্দগুলো ফুরফুরিয়ে উড়ছে।
মানিক জানালার পাশে যেয়ে দাড়ালো। দূরে আলোকিত বিল্ডিং গুলো নজরে পড়লো।
বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস টেনে খাটের উপর গাটা এলিয়ে দিল। হাতের তালুদুটো ভাজ করে তাতে মাথা রেখে চিৎ হয়ে একটু বিশ্রাম করবে বলে মনস্ত করলো।