জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২২।

আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১২:২৫

অম্বরাবনী -২২ 

 

নিউ ইয়র্ক থেকে মোজামবিকে ফেরার প্লেনটা কাল ভোর বেলা।
তখন প্রায় বিকেল। কর্মক্লান্ত দিন শেষ করে দিনমণি বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কি করবে কোথায় যাবে এখন কিছুই যেন ঠিক করতে পারছিলো না অবনী।
ডালবেহারার কথা দারূন ভাবে মনে পড়তে লাগলো।
কিন্তু কোথায় পাবে তাকে? তিনি তার নিজের মত করে গড়া জগত ছেড়ে চলে গিয়েছে।
ইতিপূর্বে সময় কখনো এত ভারী আর মত্থর হয়নি কখনো ওর জীবনে।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে আল্টানটিকের পাড়ে গত রাতের জায়গাটায় গিয়ে বসলো। কি করবে কাল সকাল পর্যন্ত, তার কিছুই ঠিক করতে পারছিলো না। পরিচিত দুএকজনের কথা ভাবলেও নিজের উপর প্রচন্ড বিতৃষ্ণায় কারো সাথে আর দেখা করতে মন চায়লো না।
আল্টানটিকের ঢেউগুলো একের পর এক আছড়ে পড়ছে। গোঁ গোঁ স্যাঁ স্যাঁ শব্দ করে শত সহস্র বছরের বেদনার ইতিহাস ব্যক্ত করছে। বিধাতা তার শত সহস্র চোখ মেলে নীরবে নির্দ্বিধায় তা অবলোকন করছে।
কতক্ষন আল্টানটিকের পাড়ে বসে ছিলো ঠিক জানে না ও। তবে রাত বেশ গভীর হয়েছে বোঝা গেল। মানুষের আনাগোনা খুবই কম দেখা যাচ্ছে। হাতের ঘড়িটা দেখতে একদম ইচ্ছে করলো না।
ধারে কাছে কোন ক্যাবও দেখা যাচ্ছে না। রাত অনেক হয়েছে তায় ক্যাব পাওয়ার সম্ভাবনা কম, ভাবলো অবনী। হোটেলটা খুব একটা দূরে না। ফুট পাথ ধরে হাটলে হয়তো ঘণ্টা খানেকের মত লাগতে পারে। বেশী লাগলেও অসুবিধা নেই ওর।
নির্জন ফুটপাথ দুএকটা মানুষ আর রাস্তা দিয়ে স্যাঁ স্যাঁ করে মাঝে মধ্যে একটা দুটো গাড়ী যাওয়া ছাড়া আর কোন কর্মতৎপরতা চোখে পড়ছে না।
ষ্ট্রিট লাইটগুলো কেবল হা করে বোকার মত দাড়িয়ে দাড়িয়ে অবনীকে দেখছে। উত্তপ্ত বাতির চারপাশে পতঙ্গের দল ভীড় জমিয়েছে আত্মহুতির জন্য। এ যেন নিঃশ্বেস হয়ে যাওয়ার উন্মাদনা।
এই মুহুর্তে ওর নিজের ছায়াটা বাদে অবনীর সাথে আর কেউ নেই। কোথাকার অবনী এই গভীর রাতে নিউইয়র্কের রাস্তায় অনেকটা সর্বস্বান্তের মত হাটছে। সব কিছু ভাবতে অবনীর কাছে স্বপ্নের মত লাগলো।
জীবনের সাথে এত লড়াই করে এই কি ওর প্রাপ্য! প্রকৃতই কি এসবের ভাগীদার ও!
নিজের ছায়াটাও যেন ওর সাথে লুকোচুরী খেলছে। হাটতে হাটতে এক একটা ষ্ট্রিট লাইটের আলো যতই ক্ষীন হচ্ছে ওর ছায়াটা ততোই ওর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। আবার পরবর্তি ষ্ট্রিট লাইটের আলোর কাছে আসতেই ছায়াটা কোথা থেকে ছুটে ওর কাছে আসছে। ও যখন ষ্ট্রিট লাইটের একদম নিচে অর্থাৎ পুরোপুরি ঝলমলে আলোর মধ্যে ওর ছায়াটা তখন ঠিক পোষা কুকুরের মত একদম পায়ের নিচে আহালাদে লুটোপুটি খাচ্ছে। আলো সরে গেলে ছায়াটাও সরে যাচ্ছে।
আজ এই মুহুর্তে সর্বস্বান্ত অবনীর কাছে মনে হচ্ছে ওর নিজের ছায়াটাও ওর সাথে যেন ছলচাতুরী খেলছে। অবনী যখন আলোর নিচে অর্থাৎ সাথীর খুব একটা প্রয়োজন নেই তখনই ছায়াটা গায়ে পড়ে ওকে সঙ্গ দিচ্ছে। আর ও যখন অন্ধকারে পথ হারিয়ে একটা সাথির জন্য ব্যকুল তখন ওর নিজের ছায়াটাও ওকে ছেড়ে যাচ্ছে।
এইতো জীবন, এভাবেই জীবন এগিয়ে যায়! ভাবলো অবনী। জীবনটা সত্যিই যেন এক মরিচিকার পিছনে ছোটা।

হোটেলে ফিরে এল অবনী। সিদ্ধান্ত নিল ফিরে যাবে একদম উৎপত্তির কাছাকাছি। ওর এত সাধের গড়া প্রথিবীটা ফেলে ও পালানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠলো।
কোথায় যাবে, ও জানে না সেটা। তবে এই পৃথিবীতে আর এক মুহুর্তোও নয়। এখানকার সব কিছুই বিষময়, শ্বাসরূদ্ধকর। এখান থেকে দূরে বহু দূরে চলে যাবে অবনী।
ইণ্টারভিউয়ের রেজাল্ট কি হয়েছিল অবনী জানে না। খোজও নেয়নি।
পরদিন সকালে মোজাম্বিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
সব মিলিয়ে প্রায় বারো ঘণ্টার জার্নি। মনে পড়লো মাকে সাথে নিয়ে দেখা কবিরাজ দাদুর মোটা গ্লাসের চশমা পরা মুখটা। বৃদ্ধ সেদিন কি বলেছিলেন তা সঠিকভাবে মনে নেই অবনীর। তখন অত বোঝার মত বয়সও ওর হয়নি, আর বৃদ্ধ কাপা কাপা গলায় কিছুটা আঞ্চলিক টানে কথাগুলো বলেছিলেন।
খুব চেষ্টা করলো অবনী ওর কথাগুলো মনে করতে। অনেক কষ্টে স্মৃতির ছিড়ে যাওয়া পাতা উল্টিয়ে মনে হলো তিনি ওর মাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন - তোর ছেলে সবাইকে ছেড়ে যাবে।
ওর কথায় মা খুব আশ্বস্ত হয়েছিলেন সেদিন। খুশীতে মায়ের চোখদুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল।
বৃদ্ধের কথার অর্থটা সেদিন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছে অবনী। কথাটা বলেই বৃদ্ধ মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন, বোধহয় আতঙ্কে। সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার স্বরূপটা বোধহয় বৃদ্ধ তার দিব্য দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। মা হয়তো কথাটার অর্থ পুরোপুরি না বুঝে আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলেন।
সত্যিইতো অবনী সবাইকে, অর্থাৎ আপন বলতে যা বুঝাই তাদের সবাইকে এমনকি দেশ ছেড়েও চলে এসেছে। ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা ওর কোনদিনই ছিল না।
এই মুহুর্তে অবনী বিধাতাকে ধন্যবাদ জানালো। কারণ ওর সম্পর্কে বৃদ্ধ কবিরাজ দাদুর ভবিষ্যৎ বানীর কথাগুলো ভুল ভাবে শোনার জন্যই ওর মা অন্ততঃ মনে একটু শান্তি নিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে পেরেছেন।

মোজাম্বিকের নামপুলায় পৌছেই চাকুরীতে ইস্তফা দিল। অবশিষ্ট কাজ দায়িত্ব আর দেনা পাওনা যা ছিল সব বুঝিয়ে দিয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার মনস্ত করল অবনী।
মনে মনে ভাবলো ডালবেহারা ভীরূ কাপুরূষ। তায় জীবনের হিসেবটা মিলাতে ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু অবনী মিলিয়ে দেখবে হিসেবটা। সবকিছু সামনে এনে একটা একটা করে একদম গোড়া থেকে।
ওর পাওনাগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য সবাই কয়েকটা দিন দেরী করার কথা অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অবনী বললো - হাতে সময় খুবই কম। পাওনাটার আর কোন দরকার নেই ওর, অনেকতো পাওয়া হলো, ওটা দিয়ে দেনা গুলো শোধ হলেই ওর চলবে।
স্বপ্নের জগতে বিচরন করতে করতে হটাৎ স্বপ্ন ভেঙে গেলে অন্ধকার ঘরে যেমন সব কিছু অপরিচিত মনে হয় অবনীর বেলায় অনেকটা সেরকম হল। বাতিটা না জ্বালানো পর্যন্ত সব কিছুই ওলট পালট লাগে। বাতি যদি না আসে তবে অন্ধকারের সাথে মানিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে নতুন করে পুরনো সব কিছুর সাথে খাপ খাওয়াতে হয়।
পুরনো সব কিছুকে পিছে ফেলে অবনী চেয়েছিল অজানা এক স্বপ্নের পৃথিবীতে নিজের একটা নতুন পরিচিতি সৃষ্টি করে সেখানে একটা স্থায়ী জায়গা করে নিতে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা বোধহয় তাতে সায় দেয়নি।
ওর বাপ দাদার ভিটেতে বাবার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তাঁর বিশেষ অনুরোধে বেশ বড়সড় একটা বাড়ী তৈরী করেছিল অবনী। চারিদিকে উচু বারান্দা ঘেরা দোতলা বাড়ী। পাচিল দিয়ে ঘেরা আর তার মধ্যে নানা জাতের গাছ গাছালী। বাড়ীটা ভারী পছন্দের অবনীর। প্রথম দিকে বছরে অন্ততঃ একবার হলেও আসতো। প্রকৃতি এখানে কথা বলে।
গত প্রায় বছর পাচেক একদম আসা হয়নি ওর।
বাবা বেচে থাকার সময় থেকেই একজন বৃদ্ধ বয়সের কেয়ারটেকার থাকে। সেই সব দেখে শুনে আগলে রাখে।
তার বয়সটা কম করে হলেও সত্তর ছাড়িয়েছে। প্রায় ছয় ছয় ফুটের মত লম্বা লিকলিকে শরীরটা বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে। আল্লারাখা ওর নাম। কে দিয়েছিল ওকে ওই অদ্ভুত নামটা তা জানে না সে। আপন বলতে যাদেরকে বুঝায় সে রকম কেউই নেই এ তল্লাটে ওর। বাল্যের কোন স্মৃতিই মনে নেই ওর। সবাই বলে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আসাম বা ত্রিপুরার কোন জায়গা থেকে কেউ ওকে কুড়িয়ে এনেছিল।
ওর গায়ের রঙটা আশে পাশের আর দশ জনের মত হলেও চোখে নাকে কোথায় যেন মনে হয় ও এখানকার কেউ না। আল্লারাখা যখন আনমনে একাকী উদাস হয়ে বসে গুনগুনিয়ে গান গায় তখন মনে হয় এ পৃথিবীতে বড্ড একা ও। গলার ভিতরকার ছোট্ট জিহবটায় জন্মগত সমস্যা ওর তায় অনেকগুলো উচ্চারণ ও পরিস্স্কার ভাবে করতে পারে না। বাবার মত আল্লারাখা অবনীকে খোকা বলে ডাকে। ওর অসুদ্ধ উচ্চারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে খোকার কা বিকৃত হয়ে ও অবনীকে খোড়া বলে ডাকে। তা নিয়ে বরাবরই ও হাসির পাত্র হয়।