মানব ধর্ম

আপডেট: ১৫ Jun ২০২২, ১৫:২৫

মানব ধর্ম


বিকেলে অফিস ছুটির পর কর্পোরেট অফিস বিল্ডিং থেকে নেমে অফিসের সামনে লম্বা সিড়ির ধাপের উপর দাঁড়িয়েছি গাড়ীর অপেক্ষায়। সিড়ির সামনেই ফুট পাথের গা ঘেঁসে প্রশস্ত রাস্তা। এখানে দাঁড়িয়েই অফিসের সবাই আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যারেজ থেকে আসা গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে।
অফিসের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারাও একই ভাবে আশে পাশে দাঁড়িয়ে নিজ নিজ গাড়ির জন্য অপেক্ষারত।
সদা ব্যস্ত রাস্তা, গ্যারেজ থেকে আসা গাড়ী এখানে বেশীক্ষণ দাঁড়ানোর উপাই নেই, তাই গাড়ী আসলেই উঠে পড়ে সকলে। অফিস ছুটির সময় যানবাহনের চাপ বেড়ে যায়। ফুট পাথ ধরে হাটা মানুষ, গাড়ির হর্ন সব মিলে কেউ কারো সাথে কথা বলার অবস্থা থাকে না। আশেপাশে অপেক্ষারত কলিগদের সাথে ঈশারাই ভাব বিনিময় করে সবাই নিজ নিজ গাড়ীতে উঠে পড়ে।
নিত্যদিনের ঘটনা এটা।
বিকেল বেলা ঘরে ফেরার তাড়াই ব্যস্ত সবাই।
এরই মধ্যে ফিস ফিস করে বৃষ্টি শুরু হল। তাতে করে সকলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে যাদের কাছে ছাতা আছে সেটা খুলে তার নিচে বা একে অপরের ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়ে দাঁড়ালো।
অফিস বিল্ডিঙের পাশ দিয়েই একটা গলি রাস্তা ঢুকেছে ভিতরে আবাসিক এলাকায়। রাস্তাটাতে মেরামতের কাজ চলছে। এ গলি রাস্তার মুখেই মেইন রোডের সাথে অর্থাৎ আমরা যেখানে অপেক্ষা করছি ঠিক তার ডান দিকে সদ্য নির্মিত ড্রেনের উপরের ঢাকনা স্লাবটা গলি রাস্তার থেকে বেশ উচু করে তৈরী যেটা আড়াআড়ি ভাবে একটা হাম্প সৃষ্টি করেছে। মেরামত শেষ হলে হয়তো ওটা রাস্তার একই সমতলে আসবে।
এ অবস্থাই কোন গাড়ী বা পথচারীদের যাতায়াতের একটু অসুবিধা হলেও ওই হাম্পটা পার হতে বাধা সৃষ্টি করছে না। কিন্তু বাধা সৃষ্টি করলো রড বোঝাই একটা ঠেলার জন্য।
বৃদ্ধ একজন মানুষ সেটা টানছে আর একটা বাচ্চা একটা ছেলে পিছন থেকে ঠেলে সেটা ওই হাম্পটা পার করতে প্রাণান্তকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। গায়ে গতরে জোর কমে যাওয়া বৃদ্ধের টান আর অন্য প্রান্তে কাচা শরীরের ছেলেটার ঠেলা দেয়ার সম্মিলিত জোর কিছুতেই রড ভর্তি ভারী ঠেলা গাড়ীটা হাম্পটা পার করতেই পারছে না। ছোট খাট একটা ভিড় সৃষ্টি হয়ে চলমান ও অপেক্ষারত সবার দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষিত হয়েছে।
ওই দুটো অসহায় মানুষের শারীরিক গঠন বা পরিহিত জামা কাপড় দেখে ওরা নিচক খেটে খাওয়া মানুষ ছাড়া ওদের কারোরি কোন জাত ধর্ম বোঝার কোন উপাই নেই।
আমাদের মত যারা বুদ্ধিবৃত্তি করে জীবন চালাই তারা স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় বিভিন্ন ধরনের পোশাক আসাক পরে। সেটাকে ড্রেস কোড বলা যায়; অফিসে একরকম ড্রেস, দাওয়াতে গেলে একরকমের ড্রেস, আবার উপাসনালয়ে যাওয়ার জন্য এক রকমের ড্রেস। তাই ড্রেস দেখে আমাদের মত মানুষদের মোটামুটি চিহ্নিত করা যায়।
কিন্তু জাতপাত নির্বিশেষে খেটে খাওয়া মানুষের সবসময় একটাই ড্রেস- ছেড়া ফাটা বড় লোকদের বাদ দেয়া বা ফূট পাথ থেকে সস্তাই কেনা জামা কাপড়।
আমি সুট টাই পরা, সারা দিন অফিসে বসে কাজ করার ফলে যেটুকু এলোমেলো হয়েছিল সেটুকুও বেরনোর আগে পরিপাটি করে নিয়ে বেরিয়েছি।
বই পুস্তক আর জীবন থেকে অর্জিত জ্ঞানে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি ঠেলাটা হাম্প পার করার জন্য ওদের সাহায্যের প্রয়োজন আর সাহায্য করার সে সামর্থ্য এ মুহূর্তে আমার আছে।
কিন্তু কোন একটা অদৃশ্য শক্তি সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিতে আমাকে দ্বিধান্বিত করছে।
-ভাবছি আরো অনেকেই তো আছে তারা ওদেরকে সাহায্য করবে নিশ্চয়।
ভিজতে থাকা একজন রিকশাওয়ালা এগিয়ে গেল ঠেলাটাকে ধাক্কা দিতে। কিন্তু তার অতিরিক্ত বলটুকু যোগ করেও কিছু হল না।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপেক্ষারত আমার দুজন জুনিয়র কলিগের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হল।
দৃষ্টিতে কথা বলে ভাব বিনিময় করা যায় জানি কিন্তু সে মুহূর্তে কার দৃষ্টিতে কি ছিল তা সঠিক ভাবে বলতে পারবো না। তবে আমার জুনিয়র কলিগ দুজন সময় নষ্ট না করে ছাতা মাথায় দিয়ে দ্রুত ঠেলা গাড়ীটার কাছে যেয়ে ওঠাকে ঠেলে পার করে দিল।
ঠেলাটা পার করে জমে ওঠা ভিড়ের মধ্যে কাউকে কিছু না বলে গায়ের যত জোর ছিল তা কাজে লাগিয়ে ওরা গলি পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
জুনিয়র কলিগ দুজন ফিরে এসে আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার নিজ স্থানে দাঁড়ালো।
ততোক্ষণে আমার গাড়ীটা এসে দাড়িয়েছে। আমি একটু হেসে ওদেরকে হাত নাড়িয়ে বাই বলে গাড়ীতে উঠে বসলাম দিন শেষে বাসায় ফিরতে।

অন্য দিন গাড়ীতে উঠেই এই আধ ঘন্টার মত সময় কাটাতে নেট অন করে মোবাইলে চোখ রাখি। কিন্তু সেদিন মোবাইলে চোখ রেখে সময় টুকু পার করতে একদম মন চাইল না।
গ্লাস বন্দ গাড়ীর কাচের মধ্য দিয়ে বাইরেটা দেখতে লাগলাম।
এই বৃষ্টির মধ্যেও ভিজে ভিজে কত মানুষ কাজ করছে, কেউ রিকশা চালাচ্ছে, কেউ ঠেলা, কেউ বা যানজটে গাড়ী থামলে ভিজতে ভিজতে গাড়ীর জানালার ওপার থেকে তাদের বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী বিক্রির জন্য শুখনো মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে।
ভাবছি এই ব্যস্ত রাস্তাই একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় যে আমার মত ভাল কাপড়ে গাড়ীর জানালা বন্দ করে বসে থাকা মানুষের সংখ্যার চেয়ে বাইরে ভিজে ভিজে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা ঢের বেশী।
নিজের মধ্যে কছুটা অস্বস্তি বোধ ভর করলো। হাম্পে অসহায় ভাবে আটকে যাওয়া ঠেলা গাড়ীটার কথা বারবার মনে হতে লাগলো।

-আচ্ছা, আমি কেন এগিয়ে গেলাম না ঠেলাটাকে একটু ধাক্কা দিয়ে ওদের ওই অসহায়ত্বতা থেকে মুক্তি দিতে!
-আমার পোশাক ভিজে যাওয়ার ভয়ে! নাকি আমার এই পোশাকে অমন একটা গাঁয়ে খাটা কাজ খুব বেমানান লাগবে বলে! নাকি বিপদে পড়া মানুষ দুটোর জাত ধর্ম না জানার ফলে!
ভেবে কোন বিশ্বাসযোগ্য উত্তর খুঁজে পেলাম না।
-আচ্ছা, তাহলে ওই রিকশাওয়ালা কি ভেবে ওদেরকে সাহায্য করতে গেল! ওরা একই শ্রেণী ভুক্ত ভেবে, না কি ওরা স্বজাতি বলে!
-আর আমার দুজন জুনিয়র কলিগ, ওরাই বা কেন গেল সাহায্য করতে! ওরাও তো পোশাকে আসাকে আমার মতই ছিল! যেতে একটু দেরী করলেও আমার সাথে দৃষ্টি বিনিময় হওয়ার পর ওরা আর একটুও দেরী না করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। ওরা কি আমার চোখের ভাষা বুঝল যে আমি ওদেরকে সাহায্য করতে বলছি!
-কিন্তু ওটা তো অফিসের কোন কাজ ছিল না যে ওরা আমার কথা শুনবে? আর তেমন কিছুতো আমার মনের মধ্যে ছিল না। চোখের ভাষা আছে মানি তবে ভাবটাতো মনের মধ্যে আসতে হবে তবেইতো সেটা ছোখে প্রকাশ পাবে। আমি নিজেই যখন সাহায্যের জন্য এগিয়ে যায়নি তখন আমারই সম গোত্রীয় ওদেরকে সাহায্য করার কথা বলার প্রসঙ্গটা মনের মধ্যে আসার প্রশ্নই ওঠে না।
-আমার জুনিয়র কলিগ দুজন ঠেলাটাকে পার করে যখন ফিরে আসলো তখন ওদের দেহ ভঙ্গিমায় তৃপ্তির ভাবটা আমি পরিষ্কার লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ফিরে এসেই ওদের চোখ দুটো কেন জানি আমাকেই খুঁজছিল বলে মনে হয়েছিল।
-ওরা কেনই না আমাকে খুজছিল! আমি ওদের সাহায্য করার ঘটনাটা লক্ষ্য করেছি কিনা সেটা যাচাই করার জন্য!
-আর শেষে আমি যখন হাত নেড়ে ওদেরকে বাহবা দিলাম তখন ওদের তৃপ্তিটা যেন বেড়ে গিয়েছিল।
-আমি অনেকবার ছোট ছোট বাচ্চাদের গান প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান দেখেছি। গান গাওয়ার সময় ফাঁকে ফাঁকে প্রায় সব বাচ্চাই বিচারকদের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে তাঁদের রিএকশান দেখে নিয়ে নিজেদের পারফরম্যেন্সটা যাচাই করে নিতে চাই। তাতে ওদের নিজেদের পারফরম্যেন্সের দিক থেকে একাগ্রতা সরে যেয়ে গানটা খারাপ হবে ভেবে বিচারকেরা তাদেরকে বারবার সেটা না করার জন্য সতর্ক করে দেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শুধু বাচ্চাদের না, কোন ভাল কাজ দেখিয়ে করার প্রবনতা সব মানুষের একটা সীমাবদ্ধতা।
নিজ নিজ ভাল কাজের স্বীকৃতি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা যেন সব মানুষের মজ্জাগত।
ভাল কোন কাজের স্বীকৃতি যদি নিজের কাছ থেকে আসে তবে কৃত কর্মের জন্য মানুষ নিজের বুকের গভীরে অর্থাৎ অন্তরে তৃপ্তির স্বাদ পাই আর সে অনুভবটা বাকি জীবনের জন্য থেকে যায়। কালে কালে ঘটনাটা বিস্মৃত হলেও স্বাদটা রয়ে যায়।
আর স্বীকৃতি যদি বাইরে থেকে আসে তবে সে স্বাদটা হয়তো মনে গেঁথে থাকে কিন্তু মনের দুয়ার পার হয়ে হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারে না। এসব ক্ষেত্রে যার বা যাদের কাছ থেকে স্বীকৃতিটা এসেছে তিনি বা তারা জড়িয়ে থাকে ওই প্রাপ্তির সাথে। আর তাই পরবর্তীতে স্বীকৃতি দাতার ক্রিয়া কলাপের সাথে স্বীকৃতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে। ঘটনার সাথে সে স্বাদটাও মুছে যায় এক সময়।
খারাপ কাজের বেলাও ব্যাপারটা একই রকম।

-স্যার, সারাদিন না খেয়ে আছি, কয়েকটা টাকা দিবেন।
কাচ বন্দ গাড়ীর জানালার ওপার থেকে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে একজন কাক ভেজা বৃদ্ধ ভিক্ষুকের কাঁচের উপর করা ঠুক ঠুক শব্দে সম্বিত ফিরে পেলাম।
নিতান্তই ছোট্ট এবং নিত্যদিনকার একটা ঘটনা, কিন্তু সেটা আমার হৃদয়ে গেঁথে অনেকগুলো উপলন্ধির জন্ম দিয়েছে। সে ভাবনাই ডুবে থেকে গাড়ীটা কখন সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। বাইরে অঝরে তখনো বৃষ্টি ঝরছে।
ওকে কিছু দেয়ার একটা তাড়া অনুভব করলাম ভিতর থেকে। পকেট থেকে মানি ব্যাগটা বের করার প্রয়াস পেলাম। কিন্তু ইতিমধ্যেই আরো কয়েকজন ভিক্ষুক এসে তার পাশে দাড়াল।
দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লাম।
-আমি একা কতজনকে ভিক্ষে দেব! দিতে শুরু করলে পাছে আরো ভিক্ষুক এসে জড় হয়।
বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠলো। কি করবো এ অবস্থাই ভেবেই পেলাম না।
ইত্যবসরে আরো গাড়ী এসে পাশে দাড়িয়েছে। আমার ইতস্তত ভাব দেখে ভিক্ষুকগুলো মনে হল সময় নষ্ট না করে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য গাড়ীগুলোর জানালায় হাত পাতলো। কাচ নামিয়ে অনেককে ভিক্ষে দিতে দেখলাম।
আমি ওভাবে ইতস্তত হয়ে বসে থাকা অবস্থায় লাল সিগন্যাল উঠে যাওয়াই গাড়ীটা চলতে শুরু করল।
ভাবলাম –দুঃখে পড়া মানুষদের প্রতি তাৎক্ষনিক ভাবে কোন জাতপাত না বিচারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়ার যে স্বতঃস্ফূর্ত তাড়না মানুষের ভিতর থেকে উত্থিত যে ঈশারার বলে অনুভূত হয়, সেটাকে সাধারণ কথাই যদি মানব ধর্ম বলা যায়, তাহলে আজ যে ঘটনা ঘটলো তাতে করে আমি নিজেকে আর যাই হোক সার্বিক বিচারে ধার্মিক দাবী করতে পারি না।