জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্অয পিঠ' পর্ব -৪।

আপডেট: ০৪ Jun ২০২৩, ১১:২৪

জীবনের অন্য পিঠ-৪ 

 

বেশ কয়েকদিন পর একদিন প্রত্যুষে জমিদারের গাড়ীতে করে সদর থেকে পাশ করা ডাক্তার আসলো।
পুরনো ডাক্তারখানাটা ইতিমধ্যে যথাসম্ভব মেরামত করে ওটাকে ঝেড়ে মুছে নতুন চেয়ার টেবিল লাগানো হয়েছে। কয়েকদিন আগে একজন কম্পাউন্ডার যোগ দিয়েছে নাম করিম। তার নির্দেশেই সব কিছু সাজানো গোছানো হয়েছে।
কম্পাউন্ডারের প্রয়োজন মত ডাক্তারখানার মূল তিনটে ঘর খালি করে রামদয়াল ওর জিনিসপত্রগুলো বিল্ডিংটার পিছনে ছাপড়া ঘরটাতে রেখেছে। খালি করে দেয়া ঘরগুলোর একটিতে ডাক্তারের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

জমিদারের সাথে আলাপ করে নতুন ডাক্তার তার সময়সূচি বলে দিলেন।
প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বিকাল চারটা, মাঝখানে একটা থেকে দুটো পর্যন্ত খাওয়ার জন্য বিরতি। শুত্রবার ছুটি।
কম্পাউন্ডার সময়সূচি কাগজে লিখে ডাক্তার খানার সামনে লেপটে দিল। ঢেড়া পিটিয়ে প্রচারের ব্যবস্থাও করলেন জমিদার।
ডাক্তারকে জমিদার মাসিক বেতন দিবেন আর সদর থেকে ওকে আনা নেয়ার জন্য জমিদারের গাড়ীটা ব্যবহার করবে ডাক্তার।
সদর খেকে ইঞ্জিনিয়ার এনে এখানেই বড় হাসপাতাল তৈরীর পরিকল্পনা জমিদার ইতিমধ্যেই প্রনয়ন করেছেন।

বর্তমান চৌধুরী জমিদারের দায়িত্ব গ্রহন করার পর একটু সময়ও যেন নষ্ট করতে চায় না। ইতিমধ্যেই চারিদিকে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরূ করেছে।
জমিদারের কথা অনুযায়ী আধুনিক হাসপাতালের সাথে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার একটা ব্যবস্থাাও তিনি রাখবেন বলে জানিয়েছেন। সে লক্ষ্যেই রামদয়ালকে বিভিন্ন পরিসংখ্যানও লিপিবদ্ধ করতে বলেছেন।
কবে আবার তিনি রামদয়ালকে তলব করেন তার জন্য বলতে গেলে সবসময়ই ও একটা আশঙ্কার মধ্যে থাকে।
আজকাল রামদয়াল ডাক্তার খানায় বসে না। বসবে কোথায়। আর এখনতো পাশ করা ডাক্তার এসেছে।
সর্বপরী আয়ুর্বেদকে আধুনীকরনের জন্য পরিসংখ্যান সংগ্রহ কি ভাবে শুরূ করবে তা নিয়েই রামদয়াল চিন্তিত। কিভাবে কোন বিষয়টা দিয়ে শুরূ করবে সে চিন্তায় সব সময় মগ্ন থাকে রামদয়াল।
ভোরেই ঘুম ভেঙ্গে যায় রামদয়ালের আগের মতই। তবে রোগীদের ডাকাডাকিতে নয়, অভ্যাসের ধাক্কায়। জমিদার ইতিমধ্যেই তার লোক দিয়ে পাশ করা ডাক্তারের ব্যপারে ঢেড়া পিটিয়ে দেয়ার সময় একই সাথে আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থা আধুনীকরনের জন্য আপাতত বন্দ বলেও সবাইকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে।
সকালে উঠে কোন কাজ না থাকায় রামদয়াল ওর আয়ুর্বেদ বাগানটার ভিতর ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেয়।
আজীবনের অভ্যাসটা পুরোপুরি ভুলতে বোধহয় সময় লাগবে রামদয়ালের।

সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই রামদয়াল সরাসরি ডাক্তারখানার দিকে গেল হাটতে হাটতে। নতুন রং করা ডাক্তার খানার চকচকে দেয়ালের দিকে নজর পড়ায় ও থমকে দাড়ালো একটু। তবুও কিছুটা আত্মবিসৃত হয়ে এগিয়ে গেল।
আগের মতই অনেক রোগীর ভীড়। সব রোগী ওর চেনা। ওকে দেখে সবাই শুভেচ্ছা বিনিময় করল। স্বভাবসুলভ হাসিমাখা বদনে রামদয়াল সকলের বিভিন্ন কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
রামদয়াল রোগী দেখা শুরূ করার আগে বেশ কিছু সময় ধরে অপেক্ষারত রোগীদের সাথে কুশস বিনিময় করতো। এ সময়টাতে ও রোগের কথা না জিজ্ঞেস করে সবার পরিবার পরিজন সম্পর্কে খোজ খবর নিত। রামদয়াল ওর বাবাকে দেখে শিখেছিল ব্যাপারটি।
কারো মেয়েটার বয়স হয়েছে কিন্তু ভালো ছেলে না পাওয়াই বিয়ে দিতে পারছে না। কারো বা ছেলেটা বড় হয়েছে কথা শুনতে চায় না। কারো বা বেগুনের জমিতে পোকা লেগে সব গাছ মরে যাচ্ছে বা মোরগ মুরগীর মড়ক লেগেছে। এরকম কত কথা।
কথাগুলো সবাই রামদয়ালকে বলতো, তবে কোন সমাধানের আশায় নয়। সমস্যায় পতিত কোন মানুষ যে উদ্দেশ্য নিয়ে একান্ত আপন কারো সাথে মনের কথা গুলো বলে, ওদের উদ্দেশ্যও সেরকম।
কিছু কিছু ব্যপারে স্বতঃস্ফূর্ত সমাধান বেরিয়ে আসতো। যেমন কোন পিতা বা অভিবাবক ওদের উপযুক্ত ছেলের কথা জানাতে যেয়ে উপযুক্ত মেয়ের খবরটাও পেয়ে যেত। বা ক্ষেতের পোকা মারার পদ্ধতিও হয়তো করো অভিজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে আসতো। রামদয়াল কোন সমাধান দিত না তবে সমাধানগুলো তার উছিলায় বেরিয়ে আসত।

বেশ কিছুক্ষন ধরে কথা বলতে বলতে রামদয়াল ওর বসার ঘরটার বারান্দায় উঠে দাড়ালো। উপস্থিত রোগীরা এবং রামদয়াল নিজেও যেন পুরোপুরি ভাবেই ভুলেই গেল যে এখানে নতুন ডাক্তরের চিকিৎসা শুরূ হয়েছে।
জমিদারের গাড়ীর হর্ন ওদেরকে আৎকে দিল। সবাই সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে নতুন ডাক্তারকে বহনকারী জমিদারের গাড়ীকে সাইড দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো।
রামদয়াল ততোক্ষনে ডাক্তারের রূমের দরজায় পৌছে গিয়েছে। একটু অবাক হয়ে সবার মত সেও তাকালো গাড়ী থেকে হাতের জিনিস পত্র নিয়ে ব্যস্ত ভাবে নামতে থাকা নতুন ডাক্তারের দিকে।
বয়সে তরূন কালো স্যুট পরিহিত নতুন ডাক্তার গাড়ী থেকে নামলেন। বসার কক্ষটার দিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করে হাটছেন তরূন ডাক্তার। বুকটা ফুলিয়ে ঘাড়টা সোজা করে হাটছেন, হাটার ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাস আর অভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। পাচ ফুট দশ ইঞ্চির মত লম্বা, গায়ের রং ফর্সা।
সবার সালামের জবাবে কখনো ডান হাতটা একটু উচিয়ে আবার কখনো মাথাটা একটু নাড়াচ্ছেন।
সবাই লাইন সোজা করে দাড়িয়েছে। কারণ লাইন বাকা করা বা লাইন ভাঙ্গা ডাক্তার ভীষণ অপছন্দ করেন।
রামদয়াল ততোক্ষনে অন্যান্যদের সাথে রোগীদের লাইনে দাড়িয়ে সবার সামনে।
এতোক্ষনে সবাই ভাবলো রামদয়ালও ডাক্তার দেখাতে এসেছে ওদের মতোই। আর হতভম্ভ রামদয়াল ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই যেন বুঝতে পারছিলো না।
ডাক্তার বসলো তার চেয়ারটাতে।
বয়সটা ত্রিশের কোটা ছাড়িয়েছে বলে মনে হয়। সুঠাম দেহ শান্ত অবয়ব। নাম অনিরূদ্ধ।
কম্পাউন্ডার রোগী দেখার সরঞ্জামাদি টেবিলে সাজিয়ে রেখে পাশের চেয়ারে মোটা রেজিষ্টারগুলো সামনে নিয়ে বসলো।
মোটা ফ্রেমের চশমা পরা রামদয়াল। কালো প্যান্টের উপর সাদা পাঞ্জাবী পরা। মাথার চুলগুলো বরাবরের মত উস্কোখুস্কো, বেশ কয়েকদিন শেভ না করায় মুখভর্তি কাচা পাকা দাড়িগুলো উকিঝুকি দিচ্ছে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা, চোয়ালদুটো বসা। মনে হয় কয়েকদিন যাবত ভাল ঘুম হয় না।
কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে চেয়ারে বসা তরূন ডাক্তারকে। ওর চোখ মুখের উদ্দিপ্ততা আর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর তৎপরতা রামদয়ালকে আবিভূত করেছে।
কম্পাউন্ডার করিম রামদয়ালের দিকে তাকিয়ে অনিরূদ্ধর কানে কানে কি একটা যেন বললো।
অনিরূদ্ধ এতোক্ষনে তাকালো দাড়িয়ে থাকা রামদয়ালের দিকে।
ওর উচ্চতা প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। হালকা পাতলা গড়ন, নাকে মুখে অবাঙালীর ছাপটা একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়।
-আমি রোগী না, এমনিই এসেছিলাম।
ইতস্ততঃ করে কথাগুলো বলে চলে যেতে উদ্যত হলো রামদয়াল।
ব্যস্ত হয়ে উঠে দাড়ালো অনিরূদ্ধ।
-ঠিক আছে, আপনি আসুন আমার সাথে।
রামদয়ালের পিঠে হাত রেখে অনিরূদ্ধ ওকে পাশের রূমে নিয়ে গেল।
এ রূমটাতে রামদয়ালের অসুদপত্র থাকতো। রূমটার ঈট বের হওয়া দেয়ালগুলো মেরামত করে রং করা হয়েছে। বেশ কয়েকটা কাচের কপাটওয়ালা নতুন আলমারী, ওষুধ ভর্তি। পাশে একটা ছোট বেড সাদা চাদর বিছানো।
রূমটা পরিবর্তন হয়ে একদম যেন অচেনা হয়ে গেছে। তবুও ভালো লাগলো রামদয়ালের।
অনিরূদ্ধ স্বযত্নে একটা চেয়ার টেনে ওকে বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো অন্য একটা চেয়ারে।
-রামদয়ালবাবু আপনাকে আমি এমনিতেই খবর দিতাম। আপনি এসেছেন আমি খুব খুশী হয়েছি। প্রতিদিন আপনি এখানে আসবেন, যখন আপনার হাতে সময় থাকে। এই রূমটাতেই বসবেন আপনি। সব রোগীদের সাথে কথা বলবেন আগের মত।
রামদয়াল একটু অবাক হয়ে তাকালো এই তরূন ডাক্তারের দিকে। কম্পাউন্ডার করিম ওকে যৎসামান্যই চেনে। তবে ওর সম্পর্কে কে বললো এই নতুন ডাক্তারকে!
-তাহলে জমিদার অমর চৌধুরী! ভাবল রামদয়াল।
-ওরা সবাই আপনার কথা বলে। এ কয়েক দিনেই আমার বিশ্বাস জন্মেছে যে আপনার মুখের কিছু কথা ওদের রোগের যে উপশম দেবে আমার এ আলমারী ভর্তি ওষুধ তার ধারে কাছে পৌছাতে পারবে না।
একটু যেন অপ্রস্তুত হলো রামদয়াল।
-না না, তা কি করে সম্ভব। আমিতো পাশ করা ডাক্তার নয়, মানুষের শরীর আর তার জটিলতা সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই নেই। জীবিকার তাগিদে বাপ ঠাকুর দাদারা যে পেশাটা বেছে নিয়েছিলেন, ওদের রক্ত থেকেই তার ছিটে ফোটা পেয়েছি।
অনিরূদ্ধ চেয়ারে গাটা একটু এলিয়ে দিয়ে বসলো।
-রামদয়ালবাবু, আপনার সাথে আমার পার্থক্যটা ওই জায়গাই। আমি চিকিৎসা করি শরীরের, ঔষধ দিয়ে। ঔষধগুলো শরীর ভেদ করে মন পর্যন্ত পৌছাতে পারে না।
একটু যেন অন্যমনষ্ক হলো অনিরূদ্ধ। তাকালো খোলা জানালা দিয়ে আকাশটা একটু দেখার জন্য।
-কি বিচিত্র বিধাতার তৈরী মানুষের শরীর!
একটু থামলো অনিরূদ্ধ।
-শারীরিক যন্ত্রণার উপশম হলে মনটা ভালো লাগে ঠিকই কিন্তু তা মনের ক্ষত কোন ক্রমেই সারতে পারে না।
রামদয়াল কিছুটা অবাক হয়ে তাকালো অনিরূর দিকে।
-ওদের রোগের বহিঃপ্রকাশ গুলো শরীরে প্রতিভাত হলেও তার উৎপত্তি ওদের মনের গভীরে। সেখানে আমি পৌছাবো কি করে!