কল্পিত কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'ভূতনাথ আর হবুনাথ'।

আপডেট: ২৬ Jul ২০২২, ১৪:৫৪

ভূতনাথ আর হবুনাথ


ভূতনাথ আর একজন হবুনাথ, রাজার দুই পন্ডিত।
ভূতনাথ পন্ডিত সমাপিত বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ গবেষণা করে, যেমন কোন দুর্ঘটনা কেন ঘটেছিল আর কি কি করলে এ ধরণের ঘটনা ভবিষ্যতে ঘটবে না সে সমস্ত বিষয়ে রাজাকে সারাক্ষণ পরামর্শ দেয়।
আর হবুনাথ পন্ডিত ভবিষ্যতে কি কি ঘটতে পারে সেটা সম্পর্কে রাজাকে আগাম তথ্য দিয়ে কি সব করলে বিপদ এড়ানো যায় সে সমস্ত বিষয়ে ব্যাবস্থাপনা দেয়।
তাদের দুজনের কাজ পরিপূরক তাই তারা দুজনে সব সময় সলা পরামর্শ করে কাজ করে।
ভূতনাথ সবসময় রাজার কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অতীতের কথা শুনতে চায় এবং বারবার তাকে অতীতের ঘটনাগুলো ঠিকঠাক মত স্মরণ করে বর্ণনা করতে বলে।
অন্যদিকে হবুনাথ রাজাকে সম্ভাব্য বিপদের কথা সব সময় স্মরণে রাখার তাগিদ দিতে থাকে।
প্রকারন্তে দুই পন্ডিতের পান্ডিত্বের বারংবারতায় রাজা মশাই সব সময় অতীত আর ভবিষ্যতেই বিচরণ করেন। বর্তমানে থাকার সুযোগ তিনি পান না বললে চলে।

জংগলে শিকার করা রাজ পরিবারের ঐতিহ্য বলা যায়। এ বংশের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে শিকারের ব্যাপারে অনেক গল্প কাহিনী প্রচলিত আছে। সে সব কিছু পন্ডিতদের জানা। তাই বর্তমান রাজা যখন তার শিকারে যাওয়ার বাসনার কথা প্রকাশ করলেন তখন থেকেই দুই পন্ডিত ভূত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষ জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিল।
সব আয়োজন শেষ করে কুষ্ঠি পঞ্জিকা সব গুনে দেখে যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করা হল। ভূত আর হবুনাথকে সাথে নিয়ে রাজা বেরিয়ে পড়লেন।

গভীর জঙ্গলের ভিতর উঁচু করে মাচা তৈরি করা হল। যাতে করে বাঘ মাচা বেয়ে উঠে এসে মাচার উপর উপবিষ্ট রাজা আর তার পারিষদদেরকে কামড়াতে না পারে। কারণ তাদের পরিবারে একবার একজন রাজা শিকার করতে এসে বাঘের পেটে একটা হাত আর একটা চোখ হারিয়ে প্রাণে বেচে ফিরেছিল।
সেবার মাচাটা বেশ নিচু করে বানানো হয়েছিল, উপরন্ত মাচার উঠার সিড়ি মাচার সাথে সংযুক্ত করে বানানো হয়েছিল। মাচার উপর রাখা মাংসের গন্ধে বাঘ সে সিড়ি বেয়ে লাফিয়ে মাচায় উঠে লঙ্কা কান্ড ঘটিয়েছিল। সে গল্প সবার মুখে।
এসব কথা স্মরণে রেখে দুই পন্ডিতের পরামর্শ মত এবার অনেক উঁচুতে মাচা তৈরি করা হল। সাথে আর যে একটা কাজ করা হল সেটা হল লম্বা মই বানিয়ে তাতে করেই রাজা আর তার পারিষদ মাচাতে উঠে ধাক্কা দিয়ে মইটা নিচে ফেলে দেয়া হল।
সবাই নিশ্চিন্ত, আর যাই করুক বাঘ কোন মতেই মাটিতে পড়ে থাকা মইটা সোজা করে সেটা মাচার গায়ে লাগিয়ে মাচাই উঠতে পারবে না।
মাচার উপর তৈরি গদি পাতা বাশের চেয়ারে উপবিষ্ট রাজা মহাশয়ের দিকে তাকিয়ে দুই পন্ডিতের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।
-আগে যখন বাঘ এসেছিল তখন নিশ্চয় বুদ্ধি দেয়ার জন্য রাজা মহাশয়ের সাথে কোন পন্ডিত ছিল না, সে কথা বাঘ মামা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিল কি বল?
ভূতনাথের গলা পরিষ্কার করতে করতে উন্নাসিক মুচকি হাসিতে ভরা কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্যে হবুনাথ যে বেশ প্রীত হল তা তার অঙ্গ ভঙ্গিমায় পরিষ্কার প্রতিভাত হয়ে উঠলো।
-যথার্থই বলেছ ভূত। কথাটা বলার সময় হবুনাথ মুচকি হাসির সাথে তার গোঁফের সরু ডগাটা আঙ্গুলের ডান হাতের তর্জনীর আগা দিয়ে একটু চুলকিয়ে নিল।
-তুমি কি খেয়াল করেছো ভূত, প্রাসাদের বিশাল কাচারি ঘরের দেয়ালে হরিনের চামড়া শিং ইত্যাদি শোভা পায় কিন্তু বাঘ মামার কোন চিহ্ন সেখানে নেই।
কথাটা বলে হবু একটু থামল রাজার অভিব্যক্তিটা আঁচ করার জন্য। কয়েক ধরনের বন্দুক আর কার্তুজ গুলো সাজিয়ে রাখাতে ব্যস্ত রাজা মহাশয়ের মুখটা ঠিক দেখা গেল না তবে তিনি দুই পন্ডিতের কথোপকথন শুনছেন সেটা নিশ্চিত হল পন্ডিতেরা।
-আমি রাজ পাচককে সুগন্ধি মসলা দিয়ে মাংস পাকাতে পরামর্শ দিয়েছিলাম।
-হ্যা সে তো আমি গন্ধেই টের পাচ্ছি।
-বাঘ মামার নাক যতই সর্দিতে আটকা থাক না কেন এ গন্ধে সে পাগল হয়ে মাচার উপর উঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে।
হবুনাথের মন্তব্যে দুই পন্ডিত মিলে তাদের নাদাপেটা থলথলে ভুড়ি দুলিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লো।
-তাহলে রাজা মহাশয়ের এবার বাঘ শিকার নিশ্চিত কি বল হবু?
-তা আর বলতে, আমি নায়েবকে বলে কাচারি ঘরের দেয়ালে পেরেক ঠুকারও ব্যবস্থা করেছি। শিকারের পর একদম দেরী করা যাবে না, রাজ পরিবারের জন্য এক ইতিহাস রচিত হতে যাচ্ছে, এ কি যেমন তেমন কথা।
আত্মতৃপ্তির হাসি ভরা বদনে দুই পন্ডিত একে অপরের দিকে তাকাল।
-আজ আমি আগে ভাগেই পেট ভর্তি করে খেয়ে নিয়েছি, যাতে রাতে ক্ষিদে না লাগে। রাত জাগতে হবে তো, কি বল?
-আরে দাদা তুমি আবারও প্রমান করলে পন্ডিতেরা সব একই জাতের, সে কথা ভেবে আমিও পেট পুরো করে খেয়েছি।
ভূতনাথের কথার জবাব দিয়ে দুই পণ্ডিতই মুখ চেপে আত্মতৃপ্তির হাসিতে রত হল।

সন্ধ্যা নেমে চারদিক অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
রাতে কেবল পেঁচার ডাক আর মাঝে মাঝে তক্ক সাপের তক তকানিতে বনের নিস্তব্দতাকে খান খান করে বিদীর্ণ করতে লাগলো। মাঝে মধ্যে কিছু বুনো শূকর আর শেয়ালের জ্বল জ্বল করা চোখের আনাগোনা দেখা যেতে লাগলো।
ইতিমধ্যে কখন মেঘে আকাশ ছেয়ে ফেলেছে কেউই খেয়াল করেনি।
-অতীতে শিকারের সময় বৃষ্টি হয়েছে এমনটি তো কেউ বলেনি!
-আমি বাঘ শিকারের বিষয়ে এত মগ্ন ছিলাম যে, বৃষ্টির প্রসঙ্গটা মাথায়ই আসেনি।
বৃষ্টির ভাব দেখে ভূতনাথের কথাই হবুনাথ মন্তব্য করলো।
ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হল যাকে বলে একদম মুষলধারে।
রাজা মহাশয় তার ব্যাগ থেকে রেইনকোর্ট বের করে গা মাথা মুড়ে নিলেন। কিন্তু বেচারা পন্ডিত দুজন নিরুপায় হয়ে শেয়াল ভেজা ভিজল।
ভাগ্য ভাল বৃষ্টি বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। তবে চর্বিদার পন্ডিতদ্বয় ভিজে আরো অধিকতর ভারী হয়ে গেল।
মেঘ সরে আকাশ পরিষ্কার হল বটে কিন্তু তাতে পন্ডিতদ্বয়ের ভেজা কাপড় শুখাল না বরং মল মুত্র ত্যাগের জন্য প্রকৃতি তাদেরকে খুব জোরে জোরে ডাকা ডাকি করতে লাগলো।
কিন্তু কিছু করার নেই। নিরুপায় ওরা।
একদিকে বাঘের ভয়ে দুজনের কেউ নিচে নামার সাহস পেল না। অধিকন্ত নিচে নামার মইটা বাঘের কথা চিন্তা করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে সেটা মাটি থেকে কেউ উঠিয়ে মাচার গায়ে হেলান না দিলে নামার কোন উপায়ও নেই।
পন্ডিত দুজন পেট ধরে আড়ামোড়া করে করে সময় কাটাতে লাগলো আর আগে ভাগে প্লান করে অতিভোজনের জন্য আফসোসও করতে লাগলো।
কষ্টের রজনীও শেষ হয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। ভূতনাথ আর হবুনাথ নিচে পড়ে থাকা মইটার দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
সূর্যের আলো উঁকি দিতেই একজন কাঠ কুড়ানী মাঝ বয়সি মহিলাকে দেখে রাজা মহাশয় তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইশারায় মাচার দিকে আসতে বললেন।
-দয়া করে মইটা মাচাই একটু লাগিয়ে দিন না।
কাঠ কুড়ানী মহিলা মাচার নিচে আসতেই পন্ডিতেরা পেট চেপে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলাই সমস্বরে বলে উঠলো।
মহিলাটি মইটা মাচার গায়ে লাগাতেই পণ্ডিতেরা ঠেলাঠেলি করে কোন রকমে নেমে জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা দৌড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ইতিমধ্যে কাঠ কূড়ানীর আরো দুজন সঙ্গী মাচার নিচে এসে দাঁড়ালো।
রাজা মশাই ওদের সকলকে ইশারা করে মাচার উপর উঠে আসতে বললেন।
-তবে হ্যে বাবু, আপনাদের মাংসের গন্ধ আমরা বেশ অনেক দূর থেকেই পেয়েছি আর কাঠ কুড়াতে কুড়াতে সে গন্ধেই এ দিকে এসেছি।
ততোক্ষণে দুই পন্ডিত তাদের প্রাত কর্ম শেষ করে মাচার নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।
-তাহলে বল ভূতনাথ মাংসে আমার সুগন্ধি মসলা দেয়ার ফলটা একশো তে একশো, না হলে কাঠ কুড়ানীরা কি এদিকে আসতো?
-এ জঙ্গল তো আর সেই আগের মত নেই। আমারদের দাদা পর দাদার আমলে এখানে বাঘ ছিল সেটা আমরা জানি। বাঘ অনেক মানুষ খেয়েছে কামড়েছে সে সব গল্প এখানকার সবার মুখে মুখে ঘোরে। কিন্তু এখন আর এ জঙ্গলে বাঘ নেই, মানুষ তাদের কবে মেরে সাফ করে দিয়েছে। আর হরিন গুলোকেও মানুষ সব মেরে খেয়ে ফেলেছে। জঙ্গলের মধ্যে বন বিভাগের একটা চিড়িয়াখানা আছে কেবলমাত্র সেখানেই বাঘ আর হরিন দেখা যায়। জঙ্গলে কেবল কিছু বানর, শেয়াল আর শূকর আছে।
রাজার দেয়া সুগন্ধি মসলা দিয়ে রান্না করা মাংস খেতে খেতে কাট কুড়ানীরা কথা গুলো বলতে লাগলো।
মাচার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনে ভূতনাথ আর হবুনাথ পন্ডিত একে অপরের দিকে তাকাল।
-আমার দিকে এভাবে তাকিও না, আমার কাজ অতীত নিয়ে খোজ খবর রাখা, আর শোন ওরা পরিষ্কার করে বলল যে বাঘ ছিল এবং বাঘে অনেককে কামড়িয়েছে, মেরেও ফেলেছে।
-আরে না, আমি তোমার দোষ ধরতে যাব কেন, আমার মত তুমিও তো একজন বিজ্ঞ পন্ডিত, তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে আমরা কথা বলি। সাধারণ মানুষের সাথে আমাদের পার্থক্যটা সেখানেই। আর সে জন্যই তো রাজা আমাদের রাজ দরবারে স্থান দিয়েছেন।
হবুর কথাই এবার ভূত তার দিকে তাকাল।
-না ভায়া তুমি ওভাবে আমার দিকে তাকিও না। তোমার দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই তো আমি ভবিষ্যৎ বানী করি। তোমার দেয়া তথ্যতো আর মিথ্যা নয়, তাই আমার ভবিষ্যৎ বানীও অযথা নয়। বাঘ থাকলে সবাই বুঝতো আমদের এত সব আয়োজন বৃথা নয়।
ওরা দু পন্ডিত যুক্তি দিয়ে নিজেদেরকে তুষ্ট করে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-তুমি কি কিছু বলতে চাও?
-না, তোমার কিছু থাকলে তুমিই বল।
হবুর প্রশ্নের জবাবে ভূত বলল।
-তাহলে বর্তমানে যে এ বনে বাঘ নেই সেটা নিয়ে কে ভাববে?
দুজনেই চুপচাপ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাবনাই ডুবে গেল।

জমিদার মহাশয় বর্তমানকে নিয়ে কিছুটা ভেবেছেন তাইতো তিনি ঋতুর কথা বিবেচনায় তার রেইন কোটটা সাথে এনেছেন। আর রাতে মাচা থেকে যাতে নামার প্রয়োজন না হয় সে জন্য খাবারও খুব কম খেয়েছেন।
কিন্তু পন্ডিতদের পান্ডিত্বের কাছে পরাভূত হয়ে এত উঁচুতে মাচা নির্মাণ করা আর বাঘের ভয়ে মইটা ফেলে দেয়ার ব্যাপারে তিনি পণ্ডিতদের উপর নির্ভর করে কোন হস্তক্ষেপ করেননি।
এ ঘটনার পর হয়তো ভূতনাথ আর হবুনাথ পন্ডিতের চাকরী থেকে রাজা ছাড়িয়ে দেবেন। কারণ প্রকৃত অর্থে অতীতকে যেমন বাচিয়ে না রাখলে তা কখনো কারো জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে না, তেমনি অনাগত ভবিষ্যতে কি ঘটবে সেটা সম্পূর্ণই বর্তমানের উপর নির্ভর করে।
আর বর্তমানকে নিয়ে ভাবার জন্য যে কোন মানুষ নিজেই যথেষ্ট। শুধু যা দরকার তা হল বিষয়টি অনুধাবন করা। তাহলে, ভূতনাথ বা হবুনাথের মত পন্ডিতের কোন দরকার হয় না। তারা প্রকৃতই অপ্রাসঙ্গিক। কারণ তাদের কাজ মনটাকে বর্তমান থেকে সরিয়ে সারাক্ষণ অতীত আর ভবিষ্যতে বিচরণ করানো।
বনের বাঘে খাওয়ার আগে মনের বাঘে মানুষকে বার বার করে খায়!