জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'সোনার হরিণ'।

আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:২৫

সোনার হরিণ


জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই নিজের হাতে খেয়া নৌকার বৈঠা দেখে আসছে জীবন। বৈঠা ধরার আগের তেমন কোন স্মৃতি ওর নেই।
ওরা ভিন গাঁয়ের মানুষ। ওর বাবা খেয়া চালানোর জন্যই এ গাঁয়ে এসেছিল। সেই ছোট বেলাই বাবার হাত ধরেই শুরু করেছিল কাজটা, তারপর ধীরে ধীরে দায়িত্বটা ওর ঘাড়ে এসে চাপল। একে একে মা বাবা দুজনেই চলে গেল। প্রথমে মা তারপর এক বছরের ব্যবধানে নিজ গাঁয়ের মেয়ে কাজল আর ছেলের চার হাত এক করে দিয়ে বাবা আর দেরী না করে চোখ বুজল।
তারপর কত দিন মাস বছর চলে গেল।
জীবন একটা বিদ্যাই শিখেছে আর তা হল এই খেয়া চালান। এটা তার নেশা পেশা দুটোই। খুব ভক্তি করে খেয়া নৌকা বাওয়ার কাজটা করে ও। বৈঠা ধরলে ওর ঘুম নাওয়া খাওয়া কোন কিছুই মনে থাকে না। নৌকা বাওয়ার সময় ও মনের সুখে গান গায়। সব যাত্রীই ওর গানের খুব ভক্ত।
ওদের সন্তান হয়ে বাচে না। কয়েক বছরের ব্যবধানে তিন তিনটে মৃত সন্তান প্রসবের পর কাজল একটা জীবিত ছেলের জন্ম দিল। তখন সন্তানের ব্যাপারে কোন উচ্ছাস ছিল না কারো মনে। ভেবেছিল ছেলেটাকে ওরা বাচিয়ে রাখতে পারবে না।
কিন্তু বেচে রইল ছেলেটা। আর ধীরে ধীরে হাটি হাটি পা পা করে বড় হতে লাগলো। কিন্তু ছেলেটা জন্ম থেকেই রোগা, কিছু খেতে চায় না, সব সময় পেটে ব্যথা করে। ডাক্তার দেখিয়েছিল, তিনি বলেছেন একটু বড় হলে ওকে একটা অপারেশান করাতে হবে।
কত দিন ধরে ভাবছে কিছু টাকা জমলে শহরের কোন হাসপাতালে ছেলের অপারেশান করাবে। তখন একটা ঘরও ভাড়া নিতে হবে কিছু দিনের জন্য। তার জন্য অনেক খরচা আর তাই ওরা প্রতিদিন কিছু না কিছু টাকা জমায়।

ওদের ঘরটা নদীর পাড়েই বলা যায়। নদীরই অংশ ওটা, সবাই বলে এককালে নদীটা যখন পুরো যৌবনা ছিল তখন অনেক চওড়া ছিল। কালে কালে নদী শুখিয়ে দুপাড় জেগে উঠেছে।
মাঝি সকালে বেরিয়ে যায় আর ফিরতে সন্ধ্যে লাগে। দুপুরে কাজল ওর জন্য খাবার নিয়ে যায় ঘাটে।
ছেলেটাকে ঘিরেই ওদের সব স্বপ্ন। প্রতিদিন জমানো টাকা গুনে গুনে ওরা সুখ স্বপ্ন দেখে জীবন কাটায়।

কিন্তু সেবারে এক কান্ড ঘটে গেল।
ভরা বর্ষা, গাঙ তখন যেন পুরো যৌবনা। মাঝ দরিয়াই স্রোতে খেয়াটা সামলানো ভারী মুশকিল হয়ে পড়ে। একবার ভেবেছিল চেয়ারম্যানকে বলে বর্ষা না কমা পর্যন্ত খেয়া বন্দ রাখবে। কিন্তু মানুষের কথা চিন্তা করে খেয়া বন্দ করতে মন সাই দেয়নি জীবনের। তবে বৃষ্টির কথা চিন্তা করে খেয়া নৌকার উপর ছোট একটা ছই বসিয়েছে মাঝি।
সেদিন শেষ পারাপারটা করতে সন্ধ্যা প্রায় গড়িয়ে গেল। শেষ খ্যাপ নেয়ার জন্য ওপারে অপেক্ষা করছিল মাঝি। একবার ভাবল এই ফিস ফিসে বৃষ্টির মধ্যে কেউ বোধহয় পার হবে না। ফিরে আসার জন্য নাওটা রওয়ানা করে কিছু দূর চলেও এসেছিল। তখনি ছাতা মাথায় কয়েকজন মানুষের ডাকা ডাকিতে উল্টো ঘুরে নাওটা ভিড়াল ঘাটে।
যাত্রীরা সবাই ছইয়ের নিচে বসলো। মাঝ গাঙ পার হতে স্রোতে বেশ কষ্টই হল। যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে খেয়াটা টেনে গাছের সাথে বাধতে বাধতে অন্ধকার ঘনিয়ে আসলো।
ছইয়ের মধ্যে পাতা মাদুরটা ভিজে গিয়েছে, ভাবল ওটা বাড়ীতে নিয়ে শুখিয়ে কাল আবার পেতে দেবে। মাদুরটা উঠানোর সময় অন্ধকারে হাতে যেন শক্ত কি একটা ঠেকল। বাড়ি ফিরে আলোই দেখবে ভেবে মাঝি মাদুরটা গুটিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ী আসলো।
হারিকেনের আলোই যা দেখল তাতে ওর চোখ কপালে উঠলো। কারো গলা থেকে পড়ে যাওয়া সোনার এক গাছি ভারী হার! মাঝি কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না।
কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে তাই সে তাড়াতাড়ি হারটা একটা কাপড়ে জড়িয়ে ঘরে লুকিয়ে রাখল।
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে মাঝি ওর বউকে ব্যাপারটা খুলে বলল।
-এ বড় পাপের কাজ মাঝি! যার হার তাকে ফিরিয়ে দাও বাপু। ও রেখে আমাদের কাজ নেই। মাঝির বউ আৎকে উঠে কথাটা বলল।
-আস্তে কথা ক, আমি কি জানি এটা কার হার? কত মানুষ পারাপার হয়, কি করে বুঝব এর মালিক কে? আর কাউকে তো একথা বলাও যাবে না, তাতে বরং বিপদ বাড়বে বই কমবে না।
-তা তুমি এই ভাঙ্গা ঘরে অত দামী জিনিস রাখবা কোথাই? যদি চুরি হয়ে যায়!
বউয়ের কথাই মাঝি আতকে উঠল।
-চল এক কাজ করি বউ, এ রাতেই হারটা বাগানে মাটিতে পুঁতে রেখে আসি। কেউ জানবে না, চুরি হওয়ার ভয়ও থাকবে না, পরে এর মালিক পাওয়া গেলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া যাবে।
হার ছড়া একটা কাপড়ের টুকরাই ভাল ভাবে মুড়ে প্লাস্টিকের ব্যাগে পেঁচিয়ে মাঝি আর ওর বউ মিলে ফিস ফিসে বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে পাশের বাগানে একটা বড় গাছের নিচে পুঁতে রেখে আসলো।
সেদিন থেকে ওদের দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার থেকে শান্তি যেন উধাও হয়ে গেল। ছেলেটার চিকিৎসা করানোর চিন্তা বাদে আর কোন দুশ্চিন্তা ওদের ছিল না। আর সে জন্য মাঝি আরো বেশী বেশী কাজ করে বেশী রোজগার করে ছেলের চিকিৎসা করানোর সুখ স্বপ্ন দেখত। কিন্তু হারটা পাওয়ার পর থেকে ওদের জীবনটা যেন পালিয়ে বাচার মত হল।
পারাপারের সময় কেউ ওর দিকে তাকালে বা সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করলে মাঝি মনে মনে ভাবে সেই বুঝি হারটার মালিক।
গাছের নিচে পুতে রাখা হারটা আবার কেউ না জানি নিয়ে যায়! সে দুশ্চিন্তায় ওদের রাতের ঘুমও যেন বিদায় নিল। মাঝি নানা অছিলাই জঙ্গলে হারটা পুতে রাখা জায়গাটা দেখে আসে প্রতিদিন। এই অবিরাম বর্ষণে কয়েক দিনের মধ্যেই সে জায়গাটা লতা পাতা জন্মে ঢেকে ফেলল।
-কি দেখ রোজ রোজ মাঝি? ওটা সোনার হার, সোনার হরিণ না যে পায়ে হেটে চলে যাবে!
-আরে না বউ, তেমনটা না, অন্যের জিনিস কেউ আবার চুরী করে না নেয়?
-ও নিয়ে তুমি অত চিন্তা করোনা মাঝি। যারা ওটা হারিয়েছে সে সব ধনী মানুষেরা তোমার ভাঙ্গা খেয়া নৌকার আঁধারে ভরা ছইয়ের কথা যেমন চিন্তা করছে না, তেমনি চোর চোট্টারা অত দামী জিনিস চুরী করার জন্য ভুল করেও আমাদের কুড়ে ঘর বা গাছের তলায় আসবে না। মালিক আর চোর দুজনেই সেটা খুঁজবে আলোই ভরা অট্টালিকার ভিতরে, অন্ধকারে না।
দিন যেতে লাগলো। সপ্তাহ, মাস, কিন্তু কেউ একবারের জন্যও হারটার ব্যাপারে মাঝিকে জিজ্ঞেস করল না।
-আচ্ছা, হারটার কত দাম হবে গো মাঝি?
-ও কথা জিজ্ঞেস কর কেন! সেটা জেনে আমাদের কি?
একদিন রাতে শোয়ার পর কাজল জিজ্ঞেস করলে মাঝি কথাটা বলল।
-তবুও আন্দাজ করে বলনা।
কাজল কি চিন্তা করে কথাটা বলল, মাঝি তা বুঝল।
-তবে এটা ঠিক যে, আমাদের ছেলের চিকিৎসার যাবতীয় খরচ উঠে আরো বেচে থাকবে।
মাঝির কথাই কাজালের চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল।

হারের চিন্তাই মাঝির কন্ঠে গান থেমে গেল। সব সময় দুশ্চিন্তায় ওর মুখটাও মলিন থাকে। ছেলের চিকিৎসার জন্য বেশী বেশী কাজ করে টাকা জমানোর আগ্রহটা হারিয়ে ফেলল মাঝি। অনেকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে ওর –কিছু না বলে হাসতে চেষ্টা করে মাঝি।
ওরা জানে ওদের কাছে খুব মূল্যবান একটা দ্রব্য আছে, যার সঠিক মূল্য ওদের অজানা। আর অজানা আশংকায় সেটা জানার জন্য কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারে না কারণ সেটার মালিক ওরা না।
হারের মালিক শহরের বিত্তশালী একজন মানুষ। এদিকের কোন গায়ের মেয়েকে বিয়ে করেছে ভালবাসা করে। আর ভালবেসে বিয়ে করা নতুন বউকে অনেক গহনার সাথে ওই হারটাও দিয়েছে। সেটা যে তারা হারিয়েছে তা বুঝে উঠতেও প্রায় মাস খানেক সময় লেগে গেল। তাই তারাও পরিষ্কার ভাবে মনে করতে পারল না কোথায় হারিয়েছে হারটা।
ওরকম এক জোড়া হার হারিয়ে গেলেও তেমন কোন ক্ষতি ছিল না কিন্তু সেটা ছিল বংশের ঐতিহ্যবাহী হার, যেটা বংশপরম্পর বড় ছেলের বউয়ের প্রাপ্য। তাই হার জোড়ার কদরটা যতটা না মূল্যে, তার চেয়ে বেশি সেটার স্মৃতিতে।
পরিবারের চাপে আর নানা মন্তব্যে তা নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া হয়ে ভালবাসার বিয়ের মধ্যে কোনরকমে বিয়েটা টিকে থাকলেও ভালবাসাটা থাকল না। আর বিশেষ করে নতুন বধুর শশুর বাড়ী থেকে মেয়ে অলক্ষ্মী ইত্যাদি বলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল।
দু বাড়ীর সব জায়গা তন্ন তন্ন করে খোজাখুজি করা হল। প্রথমে সব কাজের লোক, তারপর আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হল না।
অতি মুল্যবান বস্তুটি যেখানে হারিয়েছে তার ধারে কাছেও কেউ খোঁজ না করে প্রচলিত বিশ্বাসের ভিত্তিতে কাছের মানুষ গুলোই হয়রানির শিকার হল।

মূল্যবান দ্রব্যটি যারা হারাল তারা ব্যাপারটিকে মেনে নিতে না পারায় তাদের মধ্যে অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌছালো। অন্যদিকে মুল্যবান দ্রব্যটি যারা পড়ে পেল তারাও বাস্তবটা অনুধাবন করতে না পারায় দ্রব্যটিকে না পারল নিজেদের কাজে লাগাতে, না পারলো প্রকৃত মালিককে খুঁজে বের করে যার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিতে। আর সে চিন্তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হয়ে তাদের সোজা সরল জীবন প্রবাহ থেমে যাওয়ার উপক্রম হল।
মহা মুল্যবান বস্তুটির মুল্য না বুঝতে পারা দরিদ্র মাঝি নিজের যে যৎসামান্য সম্বল নিয়ে স্বপ্ন দেখে জীবন কাটাত তার সব নিতান্ত মুল্যহীন প্রতীয়মান হয়ে তাদের স্বপ্নটাকে দুঃস্বপ্নে পরিনত করল।
সোনার হার গাছির ধনাড্য মালিক আর দরিদ্র মাঝির সুখ শান্তি হরণকারী সোনার হার বস্তুতই অলীক সোনার হরিণে পরিনত হল।


Read More