জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'নিজের অশ্রু নিজেই মুছে নেয়া শ্রেয়'।

আপডেট: ০২ অগাস্ট ২০২২, ১৪:৪৬

নিজের অশ্রু নিজেই মুছে নেয়া শ্রেয়


যমজ দুই ভাই, কয়েক মিনিটের ব্যবধানে একই মায়ের উদর থেকে ওদের জন্ম। বাবা মা ওদের দু’ভায়ের নাম মিলিয়ে রেখেছে রবি ও সূর্য। দেখতে অবিকল একই, সত্যি বলতে ছোট বয়সে ওদের মা বাবা ছাড়া অন্যরা রবি ও সূর্যকে আলাদা করতে পারত না।
দু’ভাই একসঙ্গে খেলাধুলা, মারামারি, কাড়াকাড়ি করে বড় হয়েছে।
দশ বছরে পড়েছে ওরা। সেবার বাবা মা ওদেরকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেল।
সমুদ্রের ধার ঘেঁসে একটা হোটেলে উঠেছে ওরা। ওই হোটেলেরই এক্সক্লুসিভ বিচে ছাতার নিচে স্বামী স্ত্রী পাশা পাশি দুটো চেয়ারে বসে আর রবি ও সূর্য ওদের দৃষ্টি সীমার মধ্যেই বিচে খেলছে।
মা বাবা নিজেরা কথা বলতে বলতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল।
এরই মধ্যে রবি কাঁদতে কাঁদতে ওদের ছাতার নিচে আসাতে ওরা সম্বিত ফিরে পেল।
রবির সারা গায়ে বালু ভর্তি। বেশ কান্না কাটি ছেলেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তখনও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ওর দু চোয়াল গড়িয়ে।
কি হয়েছে তা জানার জন্য ওর মা চঞ্চল হয়ে উঠলেন। রবি কাঁদতে কাঁদতে যা বলল তাতে বোঝা গেল দুভায়ের মারামারি, যেটা নিত্যনৈমিত্তিক।
সূর্যের কথা জিজ্ঞেস করাতে ও যা বলল তাতে মনে হল দু’ভায়ের ঝগড়ার পর সূর্য হোটেলের দিকে চলে গেছে।
মা ব্যস্ত হয়ে একবার নিজের হাত দিয়ে, একবার ওড়না দিয়ে এবং শেষে পানির বোতল থেকে পানি ছিটিয়ে দিয়ে আদর করে করে ওর অশ্রু ধুয়ে মুছে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সে ভাবেই ওর কান্না থামল।
বাবা দেরী না করে সূর্যর খোজে হোটেলের দিকে পা বাড়ালেন।

হোটেলের পিছন দিকটা ঘেঁসে বিচ। পিছন দিকে বেশ কিছুটা খোলা যায়গা বুক অব্দি উঁচু কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা। হোটেল থেকে বিচে বেরুনোর জন্য একটা পকেট গেট আছে। সে গেটটা দিয়ে বিচ থেকে হোটেল কমপ্লেক্সে ঢুকলে খোলা জায়গাটা পার হয়ে হোটেল বিল্ডিঙয়ের বারান্দায় উঠার লম্বা লম্বা তিন ধাপ সিড়ি। হোটেল বিল্ডিঙয়ের মেঝেতে উঠার আগে বাঁ দিকে কয়েকটা পানির টিউব। সবগুলোর নিচে সান বাধানো যাতে করে বিচ থেকে আসা বোর্ডাররা তাদের হাত পা ধুয়ে নিতে পারে।
সেখানেই সূর্যকে পাওয়া গেল।
সূর্য নিজে নিজেই ততোক্ষণে হাত পা মুখ সব ধুয়ে নিজেকে ফ্রেস করে নিয়েছে।
-বাবা, কাউন্টারে আংকেলদের বললে আমাকে চাবি দিয়ে দিত, ওরা আমাকে চেনে।
বাবাকে দেখে মুচকি হেসে সূর্য কথাটা বলল।
ভায়ের সাথে কি নিয়ে মারামারি হয়েছে বা ভায়ের মত ও কেদেছিল কিনা, ওর চেহারা বা আচরনে সে সব বোঝার একটুও উপায় নেই।

বর্তমানে দু’ভাই স্বাভাবিক নিয়মে বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত। দু’জনই বিদেশে ভাল ইউনিভারসিটি থেকে আন্ডার গ্রাড শেষ করেছে। রবি লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরে বাবার কোম্পানিতে যোগদান করে বেশ সুখে শান্তিতেই জীবন অতিবাহিত করছে। আর সূর্য লেখাপড়া শেষে ওদেশেই থেকে একটা ভাল কোম্পানিতে কাজ করছে।

সবই বলা যায় স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয় রবি তার ভালবাসার পাত্রীকে বিয়ে করে স্ত্রী আর তার শশুরের পরিবারের অনুরোধে আলাদা বাসা নিয়ে একই শহরে বসবাস করছে।
বিয়ের বছর খানেক আগে রবি আর ওর হবু স্ত্রী, অধরাকে নিয়ে গাড়ী করে যাওয়ার সময় অধরাদের বাড়ীর কাছাকাছি এক জায়গায় ওদের গাড়ীটা এক্সিডেন্ট করে। রবিই গাড়ী চালাচ্ছিল, ওর মাথায় বেশ চোট লাগে, কিন্তু ভাগ্যের জোরে অধরা অক্ষত থাকে। অধরাই এ্যাম্বুলেন্স ডেকে রবিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর অধরা ওর নিজের মা বাবাকে খবর দেয়।
সারাদিন চিকিৎসার পর অধরা আর ওর মা বাবা মিলে রবিকে ওদের বাড়ীতে নিয়ে যায়।
সন্ধার পর অধরা টেলিফোনে রবির মা বাবাকে এক্সিডেন্টের সব ঘটনা জানালে রবির মা বাবা ছুটে যায় অধরাদের বাড়ীতে ছেলেকে দেখতে।
ওরা ছেলেকে সে রাতেই বাড়ী আনার কথা জানালে সে অবস্থাই ওকে বেশী নড়াচড়া করা ঠিক হবে না তাছাড়া হাসপাতালও ধারে কাছে উল্লেখ করে রবিকে সেখানেই রাখার জন্য অধরার বাবা মা বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে।
এ বিষয়ে রবির নিরব ভুমিকা দেখে ওর মা বাবা ছেলের মনোভাব বুঝতে পেরে তারা আর কোন জোরাজোরি করা থেকে নিরাস্ত্র হয়।
রবি প্রায় দু সপ্তাহ অধরাদের বাসাই থেকে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠে। সে সময় রবির মা বাবা প্রতিদিন একবার যেয়ে ছেলেকে দেখে আসতো।
রবি সুস্থ হওয়ার পর বাড়ী ফিরে নিজের কাজে যোগদান করলেও নিজের বাড়ীতে যেন সেই আগের মত স্বস্তি বোধ না করার ব্যাপারটা বাবা মা বুঝতে পারতেন। অধরা যেদিন আসতো সেদিন রবি বেশ প্রাণবন্ত থাকতো। তারপর অধরাকে ওদের বাড়ীতে নামিয়ে অদের বাসায় অনেকক্ষণ অবস্থান করে বাড়ী ফিরে নিজ কক্ষে ঢুকে দরজা বন্দ করে দিত।
অধরা এ বাড়ীতে আসলে রবির মা বাবার সাথে নুন্যতম সৌজন্য শেষে রবির কক্ষে ঢুকে সারা সময় কাটিয়ে চলে যেত।
প্রথম থেকেই বোঝা যেত, অধরা রবির মা বাবাকে তেমন পছন্দ করত না, আর দিনে দিনে রবিও অধরার মত হয়ে গেল।
ছেলে বাড়ীতে সব সময় মন মরা হয়ে থাকে দেখে রবির বাবা মা অধরার বাবা মাকে প্রস্তাব দিয়ে তাড়তাড়ি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু বিয়ের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে অধরার বাবা মায়ের অদ্ভুত এক প্রস্তাবে খুব ওরা অবাক হলেন। বিয়ের পর রবি আর অধরা আলাদা থাকার শর্ত আরোপ করেন তারা। এ বিষয়ে অধরা আর রবি দুজনেরই মত আছে বলেও জানালেন তারা।
ওদের সুখের কথা ভেবে রবির বাবা মা তাতে সায় দিলেন।
সেভাবেই বিয়ের পর থেকে ওরা অধরাদের বাসার কাছাকাছি আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকে।
বিয়ের পর অধরাদের বাসায় থাকার ব্যাপারে ওদের প্রস্তাবটা রবির খুব একটা অপছন্দের না হলেও লোকে কি বলবে তা ভেবেই বাসা ভাড়া নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রবি। আলাদা বাসায় থাকলেও প্রকৃত পক্ষে ওরা অধরাদের বাসাই অবস্থান করে।

বেশ কিছু দিন পর এ সব কিছু জেনে সূর্য কারো সাথে কোন আলোচনা ছাড়াই বাবা মায়ের সাথে থাকবে বলে বিদেশের চাকরী ছেড়ে দেশে চলে আসে।
-তোর এত সুন্দর একটা চাকরী আর অত সুন্দর দেশ ছেড়ে চলে আসলি বাবা! সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে একবারও আমাদের সাথে আলোচনাও করলি না?
ফিরে আসার পর বাবার কথাই মৃদু হাসল সূর্য। ভায়ের কথা এক বারের জন্যও জিজ্ঞেস করলো না, যেন কিছুই হয়নি।
ওদেশের একটা মেয়ের সাথে ভাব ভালবাসা হয়েছে সূর্যের। একই ইউনিভার্সিটিতে পড়তো ওরা।
-মা আমি লিজকে বলেছি ও যদি তোমাদের সাথে মানিয়ে চলতে পারে আর এখানে এসে থাকতে পারে তাহলেই আমাদের সম্পর্ক হতে পারে। আমি আসার আগে লিজের মা বাবাকেও একই কথা বলেছি। ওর একটা ছোট ভাই আছে, ওর থেকে পাচ বছরের ছোট। ওর মা কমুউনিটি কলেজে পড়ান আর বাবা ফেডারেল গভারমেন্টের আওতাভুক্ত কর বিভাগে চাকরী করেন।
লিজ আর ওর বাবা মায়ের সাথে সূর্য ওর নিজের বাবা মায়ের ভিডিও কলের মাধ্যমে নিয়মিত যোগাযোগের ব্যাবস্থা করল যাতে দুটো পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে একে অপরকে নীবিড় ভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বাবার অনুরোধে সূর্য ওদের পারিবারিক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে।
অফিসে সূর্যের সাথে রবির প্রায় প্রতিদিন দেখা হয়, কথাও হয় কিন্তু কেন জানি দিনে দিনে দুজনের মধ্যে একটা অদেখা অভেদ্য প্রাচিরের সৃষ্টি হয়ে উঠলো।

প্রায় বছর খানেকের মধ্যে সূর্য আর লিজের পরিবারের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠলো আর দুপরিবারের সম্মতিতে এদেশে ওদের বিয়ে হবে সে পরিকল্পনায় লিজের বাবা মা তাদের দু’সন্তানকে নিয়ে এদেশে আসলেন।
নির্ধারিত তারিখে ধুমধাম করে সূর্য আর লিজের বিয়ে হল।
বিয়ের পর দুটো পরিবার সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেয়ে ওই একই হোটেলে উঠলো।
লিজ ওর বাবা মা আর ছোট ভাই সবারই সূর্য আর ওর পরিবারের সবাইকে খুব পছন্দ। সমুদ্র সৈকতে ভিন দেশী চাক্ষস বৈসাদৃশ্য দুটো পরিবার একে অপরের সাথে মিশে সৈকতে আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
সূর্য আর ওর বাবা পাশাপাশি ছাতার নিচে দুটো চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে গল্পে মত্ত আর বাকিরা সৈকতে নানা আনন্দে ব্যস্ত।
-জান বাবা, সেদিন আমার আর রবির মধ্যে কি ঘটনা ঘটেছিল?
বাবা অবাক হলেন এতদিন পর সূর্য সেই ছোটবেলার ঘটনার অবতারনা করাই।
কিছু না বলে তিনি ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
-সেদিন আমরা দু’ভাই যখন খেলছিলাম তখন আমাদের সাথে আমাদের থেকে একটু কম বয়সী একটা ছেলেও খেলছিল। হটাৎ করে বড় একটা ঢেউ এসে আমাদের তিন জনকেই পানিতে ফেলে দেয়। আমরা সবাই হাবুডুবু খেলাম, আমার থেকে রবি একটু বেশী ব্যথা পেয়েছিল। আমরা দু’ভাই উপরে উঠে আসলেও সেই অন্য ছেলেটি তখনও নিজেকে পুরোপুরি সামলাতে পারেনি। আর তাই আমি রবিকে ছেড়ে তাড়াতাড়ি ওই ছেলেটাকে টেনে উঠালাম।
-এর মধ্যেই সে ছেলেটির বাবা মা দৌড়ে আসলো, ছেলেকে কোলে তূলে নিয়ে আমাকে অনেক করে আদর করে দোয়া করল।
-ওরা ছেলেকে নিয়ে চলে গেলে আমি ররির কাছে গিয়ে ওর কোথায় লেগেছে জিজ্ঞেস করতেই ও কাঁদতে কাঁদতে ঠাস করে আমার গালে একটা চড় মেরে তোমাদের কাছে চলে গেল।
একটু থামল সূর্য।
-সেদিন রবির চড়ে আমি যতটুকু না ব্যাথা পেয়েছিলাম তার থেকে কষ্ট পেয়েছিলাম বিনা অপরাধে ও আমাকে মেরেছিল বলে।
বাবা হতবাক হয়ে সূর্যের কথা শুনতে শুনতে তার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো।

-বাবা, আপনার ছেলে খুব ভাল একজন মানুষ, আর সে জন্যই আমি ওকে এত ভালবাসি।
লিজ কখন এসে পাশে দাড়িয়েছে কেউ খেয়াল করেনি। ওর কথাই লিজের মুখের দিকে তাকালেন বাবা। বুঝলেন ঘটনাটা সূর্য আগেই লিজের সাথে শেয়ার করেছে।
বাবা তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিজেকে প্রকৃতিস্থ করে নিলেন।
-নিজের চোখের অশ্রু নিজেই মুছে নেয়া শ্রেয় বাবা। অন্যরা সেটা মুছতে গেলে, অশ্রু ঠিকই মুছবে কিন্তু নিজেদের পছন্দ মত কাপড় দিয়ে মুছবে।
সূর্যর মন্তব্যে লিজ আর সূর্যের বাবা সূর্যর দুপাশে বসে ওকে জড়িয়ে ধরল।