জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -৯।

আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২২, ১২:৪৭

অম্বরাবনী- ৯ 

 

অফিস শেষে অবনী সোজা বাসায় ফিরে আসে। তারপর নিজেকে আটকে রাখে ওর নিজের ভূবনে। সামাজিক কোন মেলামেশা ওর নেই বললেই চলে। কাজের মাধ্যমেই ওর মেলা মেশা সীমাবন্ধ।
তাই অফিসের পর বা সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে তেমন কোন টেলিফোনও আসে না বা কেউ ওর বাসায়ও আসে না তেমন। টেলিফোনটা কোন কারণে বাজলে ও প্রায় লাফ দিয়ে উঠে যেয়ে ধরে। ফলস কল হলেও দুএকটা কথা না বলে ও ছাড়ে না।
অবনী ভাবে -কি হলো! একি পেল ও জীবনের কাছ থেকে। আন্তর্জাতিক এতবড় অফিসের বড় এক কর্মকর্তা সে, কিন্তু জীবন ওকে এই পর্যায়ে এনে ফেলেছে! একটু বন্ধুভাবাপন্ন কণ্ঠ শোনার জন্য বা ওকে যে বুঝতে পারে এমন একটা মানুষের সঙ্গ লাভের জন্য কাংগাল অবনী।
একদিন বিকালে হটাৎ করে দরজায় কে যেন নক করলো। অবনী ভীষণ অবাকই হলো। কিন্তু ভাল লাগলো এই ভেবে যে, রং নাম্বার কলের মত হয়তো একটু সময় কাটানো যাবে।
দরজা খুলতেই দেখলো ওর বাড়ীর মালিকের ষোল সতেরো বছর বয়সী ছেলে, নাম মিগেল।
বাড়ীর মালিক একজন মধ্যবয়স পার করা কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা নাম ম্যরিয়েট। তার হাজবেন্ড একজন পর্তুগীজ শেতাঙ্গ। মোজামবিক পর্তুগীজ কলোনী ছিল আর সে সুবাদেই শেতাঙ্গ পর্তুগীজরা এখানে বসবাস করতো। তাদেরই একজন বিয়ে করেছিল এই বাড়ীর মালিককে।
ছেলে মেয়েগুলোর গায়ের রং ফর্সা তবে চুলগুলোতে কিছুটা কোকড়ানো ভাব ওদেরকে এদেশের সাথে নাড়ীর সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখানকার রাস্তা ঘাটে এ ধরনের চেহারার ছেলেমেয়েদের বেশ দেখা যায়। এরা সবাই ওরকম মিকসড বাবা মায়ের ঔরসে জন্মানো। এ ধরনের পরিবারগুলো অন্যান্যদের তুলনায় স্বচ্ছল।
এরাও তেমনি একটি পরিবার। এই বাড়ীটা ওদের পৈত্রিক সুত্রে পাওয়া।
মহিলা ছাড়া তার দুই ছেলে দুই মেয়ে। মূল বাড়ীটা ভাড়া দিয়ে পিছন দিকের অংশে আলাদা ভাবে তৈরী সারভেন্টস কোয়াটারসে ওরা থাকে। বর্তমান দুর্মুলের বাজারে সংসার চালানোর জন্যই এই ব্যবস্থা।
মোটামুটি এই বাড়ী ভাড়া দিয়েই সংসারটা চলে ওদের।
মহিলাটি মাঝ বয়স পার হওয়া নির্ভেজাল কৃষ্ণাংগ কিন্তু চারটে ছেলেমেয়ের কেউ দেখতে ওর মত নয়। সবাই ফর্সা, মেয়ে দুটোর চুলের রং বাদামি তবে কোকড়ানো ভাব আছে। ছেলে দুটোও ফর্সা তবে চুলওলো কাল আর কোঁকড়ানো।
ম্যারিয়েটকে নিজ সংসারে নিজের ছেলেমেয়েদের ভিতরই চাক্ষুস ভীনদেশী মনে হয়। মিগেলের সাথে ওর বাকি ভাই বোনগুলোও আসলো।
বড় মেয়েটার নাম ইভা। ভারী সুন্দর চেহারা। এ লেভেল পাশ করেছে। ও নিজেকে কোন ভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ বলে ভাবে না। ভাববেই বা কেন? ওতো দেখতে প্রায় ইউরোপিয়ানদের মত।
ওদের আসার উপলক্ষ আমাকে হ্যাপি ক্রিসমাস বলা।
শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বেশ কিছু কথাবার্তাও হলো।
-আপনিতো অনেক দেশ দেখেছেন, তা পর্তুগাল কেমন, ভারী সুন্দর তায়না? প্রশ্নটা ইভার।
-আমি ইউরোপের অনেকগুলো দেশ দেখেছি তবে পর্তুগালে যাওয়া হয়নি।
কথাটা জানিয়ে অবনী ওদেরকেএই বলে আশ্বস্থ করলো যে গোটা ইউরোপটা সুন্দর তাই নিঃসন্দেহে পর্তুগালও একটা সুন্দর দেশ।
সবাই ওরা খুশী হলো। কারণ ওরা চারজনেরই ভবিষ্যতে পর্তুগালে চলে যাবার পরিকল্পনা আছে, কেননা বাবার পরিচয় ধরে ওটাই ওদের দেশ।
-মাকে নিয়ে একটু সমস্যা। কথাটা বললো মিগেল।
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অবনী তাকাল ওর দিকে।
-সমস্যা মানে, মা যেতে চায় না। আর আমাদেরকেও বলে এখানে থেকে যেতে।
কথাটা একটু আমতা আমতা করে ইভা বলল।
অবনী কিছু বলার আগেই ওদের ফুটফুটে ইউরোপিয়ান পুতুলের মত দেখতে পাচ বছরের ছোট্ট বোনটি বলে উঠলো -মাতো নিগ্রো।
রীতিমত চমকে উঠল অবনী। ভাবল বোধহয় বাচ্চা মেয়েটি ও না বুঝে কথাটা বলছে। কিন্তু ও হতবাক হল যখন দেখল অন্য ভাইবোনেরা মুখ টিপে হাসছে।
কালো চামড়ার কোকড়া চুলের ম্যারিয়েটকে অবনী দেখেছে। মাঝে মধ্যে কখনো কখনো বাসার সামনে দেখা হয়। মাথা নুয়িয়ে ভদ্রতা বিনিময়ও করে। একটা মলিনতার ছাপ ওর মুখে উপর সব সময়ই প্রতিভাত থাকে।
-ওর অবয়বটাই বোধহয় ওরকম। ভাবে অবনী।
-কিন্তু ম্যারিয়েট যে ওর গড়া স্বপ্নের পরিবারে এ রকম একা তা কখনো ভাবিনি। ভাবল অবনী।
ঐ মুহুর্তে অবনীর চোখের সামনে ম্যারিয়েটের ভাবলেশহীন মুখটা ভেষে উঠলো। কি ভেবে পীতবর্ণের ম্যারিয়েট শেতাঙ্গকে বিয়ে করেছিলো সেটা বলা মুশকিল। কিন্তু এখন যেখানে ও বাস করছে সেটা যে ওর স্বপ্নের ঘর না তা ঠিকই বোঝা যায় এই মুহুর্তে।
কাজের ছেলেটাকে ডাক দিয়ে ওদেরকে চা দিতে বলল অবনী।
এখানকার বাড়ী ভাড়া দেয়ার সিষ্টেম অনুযায়ী বাড়ীর সাথে আসবাব পত্র, থালা বাসন, ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি সব কিছুই বাড়ীর মালিক সরবরাহ করে। সে ভাবেই বাড়ীতে ওদের দেয়া একটা ভিসিআর আছে। আর ওটার জন্যই এসেছে ওরা।
ওদের মা বাবার বিবাহ বার্ষিকী আজ, আর তায় ওরা পরিবারের সবাই মিলে ওদের বিয়ের ক্যসেটটা দেখবে।
অবনী বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে বলল -ঠিক আছে যখন খুশী সেটটা নিয়ে যেও।
কিন্তু ওদের প্রয়োজনটা আরেকটু বেশী। ওরা এখানে বসেই ক্যাসেটটা দেখতে চায়।
-বেশতো কোন অসুবিধা নেই।
খুশী হলো ওরা।
ধন্যবাদ জানিয়ে ইভা বললো -মা আপনাকেও থাকতে বলেছেন। কারণ ক্যাসেটটা দেখার আগে ছোট্ট একটা ফ্যামিলি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। পার্টিতে আপনিও আমত্রিত।
ওরা বেরিয়ে যেতেই অবনী চট করে তৈরী হয়ে বেরলো কিছু ফুল আনার জন্য। বাসার মালিক ম্যারিয়েটের বিবাহ বার্ষিকী বলে কথা।

সন্ধ্যের পরপরই ম্যারিয়েট তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসলো। অবনী তাকে বিবাহ বার্ষিকীর অভিনন্দন জানিয়ে ছোট্ট ফুলের তোড়াটা দিতেই সে আর তার ছেলেমেয়েরা খুশী হয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করলো। বড় ড্রইং রূমটার এক পাশে টেবিল পেতে মোটামুটি মাঝারী আকারের একটা কেক সাজালো ওরা।
কত দিন পর একটু ভালো লাগলো অবনীর।
ওদের পরিবারের একে অপরের সাথে খোলামেলা সম্পর্ক অবনীকে মুগ্ধ করলো। মা আর সন্তানের চিরন্তন স্বর্গীয় সম্পর্ক দেখে ওর মন ছুঁয়ে গেল। শুধু প্রকৃতির খেয়ালের প্রকাশ ওদের ব্যহ্যিক বৈসাদৃশ্য চেহারা, পার্থিব কিছু হিসাব নিকাস ওদের মধ্যে চাক্ষুস পার্থক্য তৈরি করেছে।
কেক আর চা খাওয়ার পর সবাই বসলো ক্যাসেটা উপভোগ করার জন্য। ওরা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অবনীকে স্বচ্ছন্দ করার জন্য তাকে থ্রি সিটের সোফায় মাঝখানে বসিয়ে মিগেল আর ওর মা অবনীর দুপাশে বসলো।
ভিডিওতে রেকর্ড করা তারিখ দেখে বোঝা গেল তখন থেকে ঠিক দুই বছর আগে ভিডিওটা করা। বেশ সাজানো গোছানো কোন হোটেল বা কমিউনিটি সেণ্টারে বিয়েটা হচ্ছে। লোক সমাগমও বেশ। সাদা কালো দুশ্রেণীর মানুষই আছে, তবে সাদার সংখ্যাই বেশী।
সংগত কারণেই অবনীর একটু খটকা লাগলো। কারণ বর্তমানে ওদের বড় বোনটার বয়সই কম করে সতেরো আঠারো তো হবেই! তাহলে এখন থেকে দু বছর আগে ওদের বাবা মায়ের বিয়ে হচ্ছে! তা কি করে সম্ভব!
যাহোক, পশ্চিমা ধাচের পোশাকে বরের কাপড়ে আধা বয়স পার করা মাথার মাঝখানে টাক পড়া একজন সাদা চামড়ার মানুষকে দেখা গেল। অবনী বুঝল ওটাই ওদের বাবা। পাশে পশ্চিমা পোশাকে কনের বেশে বাড়ীর মালিক ম্যারিয়েট। তার এখন যা চেহারা বিয়ের সময়ও ওই একই চেহারা ছিল বলে বোধ হলো। চেহারায় বার্ধক্যের ছাপ তখনও বেশ পরিষ্কার।
-এ কি করে সম্ভব! নিজের কাছে জিজ্ঞাসা করল অবনী।

বিয়ের আনন্দে ওরা সব ভাই বোন মিলে অন্যন্যদের সাথে নাচা নাচি করছে। মা বাবার বিয়েতে আনন্দ করছে! অবাক হওয়ার মতোই কাণ্ড বটে।
-নিশ্চয় এটা ওদের কোন বিবাহ বাষিকী, একটু ঘটা করে উদযাপন করছে। ভাবল অবনী।
বেশ ভালো লাগছে দেখতে। এই ভীন দেশে এত অন্তরঙ্গ পরিবেশে এদের সাথে এমন একটি পরিবারিক ব্যপার উপভোগ করার সুযোগ পেয়ে ভারী ভালো লাগছিলো অবনীর। একাকীত্বের যন্ত্রনা থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়ে দেহ মন ভরে যাচ্ছিলো ওর।
-কিন্তু একি ওরা চার্চে আসলো কেন! এবং চার্চের ফাদার ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ওদেকে স্বামী স্ত্রী হিসাবে ঘোষনা দিল।
কোন কিছুই আর মিলাতে না পেরে অবাক হয়ে বসে রইল অবনী।
অবনীর পাশে বসে ছেলে মেয়েরা মিলে বিভিন্ন ভাবে হইহুল্লা করে উপভোগ করছে। অবনী এত সবের কিছুতেই একটুও ভাগ নিতে পারল না। ওদের এত কথাবার্ত্তা উচ্ছাস আর হাসাহাসির মধ্যেও নিজেকে একদম একা মনে হতে লাগলো অবনীর।
উচ্ছাসে উদ্বেলিত ওরা ভাইবোনদের সব মন্তব্যগুলো ওদের বাবাকে নিয়েই করছে। যেমন, বাবা হ্যান্ডসাম, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, ও বাবার নামীদামী সব ব্যবসায়ের পার্টনার ইত্যাদি। ওদের মাকে নিয়ে কোন মন্তব্যই যেন নে!
আড় চোখে দুএকবার ম্যরিয়েটকে দেখার চেষ্টা করল অবনী।
প্রায় বছর খানেক হলো এ বাড়ীতে আছে কিন্তু এত কাছ থেকে ম্যরিয়েটকে দেখিনি কখনো। শুনেছে মহিলা সরকারী হাসপাতালে নার্সের কাজ করে। সকালে উঠেই হেটে হেটে যায় ওর কাজে, হাতে ছোট একটা প্লাষ্টিকের কনটেনার। বোধহয় দুপুরের খাবার, কারণ ডিউটি শেষে ফিরতে রাত হয়ে যায় ওর।

ম্যারিয়েট নির্লিপ্ত হয়ে পলকহীন নেত্রে তাকিয়ে আছে। না আছে তাতে কোন উচ্ছাস বা কোন আবেগ। ছেলে মেয়েগুলো আনন্দে মেতে আছে। কেউ খেয়ালই করছে না মায়ের দিকে। ম্যারিয়েট তার নিজের জগতেই ডুবে আছে।
-কি ভাবছে ওর ইউরোপিয়ান স্বামীর ঔরসে ওর পীত বর্ণ শরীর থেকে ভীনদেশী সন্তানদের জন্মদাত্রী এই মধ্য বয়স পার করা ম্যারিয়েট?
ওর ভাবলেশহীন মুখটার দিকে তাকিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো অবনীর।
-নিজের সৃষ্টি পৃথিবীতে কত একা ম্যারিয়েট!
কথাটা ভেবে নিজের অজান্তেই একটা চাপা নিশ্বাস ছাড়লো অবনী।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর ক্যাসেটটা শেষ হলো।
খুশীতে ছেলে মেয়েরা সবাই গদগদ। কেবল ম্যারিয়েট আবেগহীন। ক্যাসেটের কোন কিছুই সে উপভোগ করলো কিনা বোঝা গেল না। কারণ তার কোন লক্ষন ওর অভিব্যক্তিতে বোঝা গেল না। যাওয়ার সময় অবনীকে ভীষণভাবে ধন্যবাদ জানালো ওরা সবাই।
ঘটনার কিছুই না বুঝে বিহব্বল হয়ে রইল অবনী।