জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -২২।

আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৪৬

জীবনের অন্যপিঠ- ২২ 

 

অমর লন্ডন যাবে বিশেষ প্রয়োজন। ওর অনুস্পস্থিতিতে যেন কাজের কোন ব্যঘাত না হয় সেজন্য চলতি সব প্রজেক্টগুলোর ব্যপারে ডাঃ অনিরুদ্ধ, লাবনী আর রামদয়ালকে যাবতীয় সব বুঝিয়ে বলার জন্য ওদেরকে নিয়ে বসেছে অমর। যাতে তার অনুপস্থিতিতে চলতি কাজের কোন ব্যঘাত না ঘটে।
অমর ঠিক করে বলতে পারছে না কতদিন লাগতে পারে ফিরতে। কিন্তু নিয়মিত টেলিফোনে যোগাযোগ থাকবে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে অমর।
বেশ কয়েকদিন ধরে অনিরূদ্ধও বলছে ওকেও ব্যক্তিগত জরূরী কাজে বাইরে যেতে হবে। অমর তার অনুস্পস্থিতিতে কিছুদিন পরে যাওয়ার জন্য অনিরূদ্ধকে বিভিন্ন ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলো কিন্তু অনিরূদ্ধ ওর সিদ্ধান্তে অনড়। ওর নাকি খুবই প্রয়োজন, দেরী হলে ওর জীবনে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, তাই ওকে যেতেই হবে, আর এখনই।
গত প্রায় দুবছর ধরে কখনো এক দুদিনের বেশী সময়ের জন্য চৌধুরী এষ্টেটের বাইরে যায়নি অনিরুদ্ধ। এখন হটাৎ করে কি এমন হলো যে ওকে এসময়টাতে যেতে হবে!
সেটা শুনে অবাক হয়ে আছে অমর। অনিরুদ্ধ এখনই না গেলে ওর বড় কি ক্ষতি হতে পারে সে বিষয়ে বারংবার জিজ্ঞাসা করলেও সে বলতে নারাজ।
অমর লক্ষ্য করেছে বেশ কিছুদিন ধরে অনিরুদ্ধকে চিন্তিত দেখায়। নিজেকে একটু গুটিয়ে রাখে, অমরের মনে হয়েছে কোন কারণে বিশেষ করে ডাঃ লাবনীর থেকে অনিরুদ্ধ যেন নিজেকে দূরে রাখতে চায়। সেটা নিয়ে ভেবেছে অমর, কিন্তু মনে হয়েছে কাজের কোন ব্যাপার নিয়ে হয়তো কোন অমিল হওয়ায় এমনটা, সময় গেলেই ঠিক হয়ে যাবে।
আজকাল মন খুলে তেমন কথাও বলে না অনিরুদ্ধ। কিন্তু অমর বাইরে যাবে এটা শোনার পর থেকে কেন জানি মনে হচ্ছে অনিরুদ্ধর যাওয়ার তাড়াটাও বেড়েছে।
কি হয়েছে অনিরুদ্ধর, সে ভাবনায় কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অমর।

-খোকাবাবু কি অত ভাবছো তুমি?
রামদয়ালের কথায় সম্বিৎ ফিরে পেল অমর।
পাশে নির্লিপ্তে বসা ডাঃ অনিরুদ্ধ আর লাবনী।
-কি এত ভাবো বলতো খোকাবাবু? ডাঃ অনিরূদ্ধ আর লাবনী আপামনির মত নিজেকে নিয়ে ভাবলে ঠিক আছে। কিন্তু চৌধুরী এষ্টেট নিয়ে যদি তোমার এ ভাবনা হয় তবে আমি বলবো সেটা অমুলক। চৌধুরী এষ্টেট নিয়ে তোমাকে একদম দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সব কিছু নিজ গতীতেই চলবে।
রামদয়েলের আত্মবিশ্বাসে ভরা মন্তব্যে মুখ উঠিয়ে জমিদার অমর চৌধুরী তাকাল রামদয়ালের দিকে।
অমরের বিহব্বল ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু থামলো রামদয়াল।
-চৌধুরী এষ্টেট সবাইকে দুশ্চিন্তা থেকে, মনের ব্যথা থেকে নিষ্কিৃতির জন্য তার বুকে স্থান দেয়। সেকি কাউকে দুঃশ্চিন্তায় ফেলতে পারে?
অমর তেমনি বসে রামদয়েলের কথা শুনতে লাগলো।
-আর চৌধুরীমা’তো আছেন। তিনি থাকবেন এই চৌধুরী এষ্টেটেই আর কোথাও তিনি যাবেন না। জীবনের আগের পাতাগুলো তিনি একদম বন্দ করে দিয়েছেন। ওটা নতুন করে খোলার মন তার আর নেই।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো রামদয়ালের বুক খালি করে।
ডাঃ লাবনী তাকিয়ে আছে নির্লিপ্তে উপবিষ্ট ডাঃ অনিরূদ্ধর দিকে। ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ভাবছে লাবনী।
-ঠিক আছে, প্রজেক্টের সব কাজকর্ম যাতে ঠিক মত চলে তা নিয়ে কোন সমস্যা হবে না। আর আমার অনুপস্থিতিতে রোগী দেখার জন্য আমার এক বন্ধুকে বলে রেখেছি। ও এখন কোথাও কিছু করছে না, বসেই আছে বলা যায়, আপনার কোন আপত্তি না থাকলে ও আসবে প্রতিদিন।
অমরকে নিশ্চিন্ত করতে চায়লো ডাঃ অনিরূদ্ধ।
এসময় অনিরূদ্ধ না থাকলে! রোগীদের জন্য না হয় অন্য ডাক্তার চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু এতগুলো প্রজেক্টের কাজ। অমর ছাড়া একমাত্র অনিরূন্ধই রাখে ওগুলোর যাবতীয় হিসাব।
সে সব কথা ভাবছে অমর।
অনিরূদ্ধর মত একজন নিবেদিত প্রাণকে অমর না চায়তেই পেয়েছে। অমরের অজান্তেই অনিরুদ্ধ নিজ উদ্যোগে একান্ত আপনজনের মত প্রতিটি কাজে কর্মে ও অমরের পাশে দাড়িয়েছে পরম বন্ধুর মত।
কিন্তু এখন এ পরিস্থিতিতে কি করবে অমর!

অমর আর অনিরুদ্ধ দুজনেই যাওয়ার আগে হাতের কাজকর্ম গুলো শেষ করতে ব্যস্ত। ওরা যাওয়ার আগে হাতের কাজগুলো গুছিয়ে নিতে চায়। যাওয়ার জন্য মরিয়া কিন্তু হাতের কাজগুলোর একটুও ফেলে রেখে যেতে চায় না কেউই।
কিন্তু কেন জানি শেষ করেই উঠতে পারছে না।

নীলিমা চৌধুরীর মধ্যেও কয়েকদিন ধরে একটা নির্লিপ্ততা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অমর আর অনিরূদ্ধর অনুস্পস্থিতিতে এত সব কাজের তদারকির অনিশ্চয়তা তাকেও ভাবিয়ে তুলেছে। তার উপর অমরের বিয়ের প্রতি অনীহার জন্য জমিদারীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এবং ছেলের জীবনের অজানা অধ্যায় সম্পর্কে তার পুরোপুরি অজ্ঞতা এবং তা তাকে জানাতে অমরের অনীহা, এ সব ভাবনা নীলিমা চৌধুরীকে যেন দিশেহারা করে দিয়েছে।
রামদয়ালও আজকাল না ডাকলে আসে না। লাবনীও কেমন যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।

অমর আর অনিরূদ্ধ দুজনেই চলে যাবে। কাল সকালেই রওয়ানা হবে ওরা।
অমর লন্ডনে যাবে কোন জরূরী দরকারে, পড়াশোনা শেষ করার পর কিছু কাজকর্ম থাকে সেগুলো করতে হবে বলে মাকে জানিয়েছে। তবে কবে ফিরবে সঠিক জানে না।
আর অনিরূদ্ধ কোথায় যাবে, কেন যাবে তা কিছুই বলেনি। তবে রামদয়াল জানিয়েছে কোথায় যাচ্ছে তা অনিরূদ্ধ নিজেই জানে না।
নীলিমা চৌধুরী কাউকে কিছু জিজ্ঞেসও করলেন না, বাধাও দিলেন না। একটা অজানা অভিমান তার পথ রোধ করে থাকল। ছেলেটার কিছু একটা সমস্যা হয়েছে তা তিনি আঁচ করতে পারেন, কিন্তু সেটা মা’কে জানাতে এত অনীহা কেন! আর অনিরুদ্ধকেও তিনি ছেলের মত দেখেন, সে ভাবেই ওর জীবনটাও তিনি গুছিয়ে দিতে চান। কিন্তু অনিরুদ্ধরই বা এ সময়ে কি হল, যাওয়ার জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন তার বিন্দু বিসর্গও তাকে কেউ বলল না।
একই সময় অমর আর অনিরুদ্ধ অনেকটা অজানা কারণে চৌধুরী এস্টেট ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবং অনেকটা তাড়াহুড়ো করে, যেন আগত কোন ঝড়ের ঝাপটা নিজেদেরকে বাচানোর তাগিদে। রামদয়ালের কাছে এটা যেন তেমন কোন ঘটনা না, কারণ তার কোন আচরনে তেমন কিছুই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
এত সব কিছুর মধ্যে কেন জানি রামদয়াল কিছুটা নিসাড় এবং নিষ্ক্রিয়। তার কারণটাও সবার অজানা।
বর্তমানে চৌধুরী এস্টেটে যারা অবস্থান করছে তারা সবাই সদ্য আগত। চলার পথে হটাৎ করে আসা ঝড় ঝাপটা থেকে বাচার জন্য অতিথি পাখীরা যেমন ক্ষণেকের জন্য আশ্রয় নেয় অনেকটা সেরকম। কিন্তু চৌধুরী এস্টেট রামদয়ালের শরীরের মত, ওর এখানেই শুরু এখানেই শেষ, কিন্তু কেন ওর কোন অনুভব অনুভূতিতে তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না! শরীরের ব্যথা সহ্য করে কেবল সেই’ই চুপ থাকতে পারে যে নিশ্চিত জানে যে, যা ঘটছে তা সাময়িক।
তবে রামদয়াল আজকাল চৌধুরী কুঞ্জের ভিতরে খুব একটা আসে না। বাগানে ঘোরা ফেরা করে, দীঘির ঘাটে বা কাচারি ঘরের বারান্দায় বসে ওর দিন কাটে।