Heading
আপডেট: ১৪ মে ২০২৩, ১৩:৩০
ভারতের দক্ষিনাঞ্চল থেকে আসার পর প্রথম ডিসুজা ওর দেশে আর ফেরত যায়নি। এঅঞ্চলেই বিয়ে করে এখানেই থেকে গিয়েছে ওরা বংশ পরস্পর। দ্বিতীয় ডিসুজা পর্যন্ত দেশের সাথে যোগাযোগ ছিলো। কিন্তু তার পর থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পুরোপুরি। বর্তমানে রামদয়াল ডিসুজা আর ওর পরিবার এখানকার মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে বলা যায়।
তখন অব্দি নতুন জমিদারের সাথে তেমন ভাবে আলাপ হয়নি রামদয়ালের। কারণটা বোধহয় গুরুত্বের অনগ্রগণ্যতা, নতুন জমিদারের আয়ুর্বেদের প্রতি অনাগ্রহ।
মাস খানেক পর বর্তমান চৌধুরী একদিন আয়ুর্বেদ চিকিৎসালয়ের ইন চার্জ রামদয়াল ডিসুজাকে ডেকে পাঠালেন ওর দপ্তরে।
লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে রামদয়াল হাজির হলো।
অমর চৌধুরী রামদয়ালের থেকে বছর আট দশেকের ছোট। অমর ছোট থাকতে চৌধুরী এষ্টেটের মধ্যে অনেক খেলাধুলো করেছে ওরা এক সাথে। কিন্তু তার পর অনেক বছর কেটে গিয়েছে। কত কিছু ঘটেছে ইতিমধ্যে।
রামদয়ালের কথা মনে আছে অমরের। চিকিৎসালয়ের সাথে ওদের বংশপরস্পরিক সম্পর্কের কথাটাও ওর জানা।
রামদয়ালের শরীরের এ হাল দেখে একটু অবাক হলো অমর। বিশেষ করে ওর কপালের উপর অনেক গুলো কুচকানো রেখার মানচিত্রের প্রতি ওর দৃষ্টি আকর্ষিত হলো। কিন্তু প্রকাশ করলো না কিছুই।
বাবার আমলের আয়ুর্বেদী রামদয়ালকে যথাযত সন্মান দেখালো বর্তমান চৌধুরী। প্রতিষ্ঠানটি আগলে রাখার জন্য ওকে আর ওর মাধ্যমে ওদের বংশের সবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করলো অমর।
চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কে আধুনিক চিন্তাভাবনা নিয়ে বলতে গেলে ছোটখাট একটা লেকচার দিল জমিদার। কিন্তু যে সমস্ত কথা ও বললো তার এক বর্ণও বলতে গেলে বুঝলো না রামদয়াল।
রামদয়াল নিজের কাছে ছোট হয়ে গেল যখন বর্তমান চৌধুরী আধুনিক সব চিকিৎসা আর ম্যানেজমেণ্টের কথা ওকে শোনাতে লাগলো।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসা রামদয়ালের বংশগত, ওর রক্তে তা মিশে আছে। বলতে গেলে ওর ছোট কালটা কেটেছে বাবার হাত ধরে চৌধুরীমাতা দাতব্য চিকিৎসালয়ের হারবাল গার্ডেনের মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
আযুর্বেদের উপর কোন পুথিগত বিদ্যা ওর নেই।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত অমর চৌধুরী ইংগিতটা সেদিকেই করছিল। বর্তমান চৌধুরী যখন এ ব্যপারে ও কোথায় কি ভাবে পড়াশোনা করেছে তা জিজ্ঞেস করলো তখন অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো রামদয়াল। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা সম্পর্কে ওর এত দিনের অভিজ্ঞতা নির্ভর মনের জোর যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো।
রামদয়াল অনেকটা অপরাধির মত নত মস্তকে বসে রইলো বর্তমান চৌধুরীর সামনে। ভাবল -চিকিৎসালয়টির বর্তমান হালের জন্য আসলে সেই দায়ী। এর জন্য কৌফিয়ত ওরইতো দেয়ার কথা।
-দরীদ্র প্রজাদের কল্যানই আমার একমাত্র লক্ষ্য। বাপ দাদার আমল থেকে আমাদের যে প্রজা তার সংখ্যা অনেকগুনে বেড়ে গিয়েছে। আর তাদের প্রয়োজনের পরিধিও বেড়েছে। এই বাস্তবতার নিরিখে সব বিষয়েই যদি আধুনিক পদ্ধতি সমুহ কাজে না লাগায় তাহলে দারীদ্রতা, অশিক্ষা, রোগ শোক ওদেরকে আকণ্ঠ ডুবিয়ে ফেলবে।
বর্তমান চৌধুরীর কথাবার্ত্তা রামদয়াল মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে লাগল। জমিদারী আর চৌধুরী এষ্টেটের বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা শুনে রামদয়াল মনে মনে আশান্বিত বোধ করে শরীর মন দুটোতেই একটু একটু করে বল ফিরে আসতে লাগল।
-আপনি আমাদের বংশের একজন সদস্যের মত। আপনিই বলুন কবিরাজ মশায়, প্রথম চৌধুরী ছিলেন ছয় ফুটের মত লম্বা, আমি তার চতুর্থ প্রজন্ম। কিন্তু আমার উচ্চতা ছয় ফুটের অনেক নিচে। এখন আমি যদি ঐতিহ্য বা তাঁর প্রতি ভক্তির কথা বলে তাঁর মাপের জামা পরে থাকি তাহলে সেটা কি যুগপোযোগী হবে?
একটু থামলো অমর। দেখলো তন্ময় হয়ে শুনছে রামদয়াল।
-দাদুর জামাটা পরে জমিদারী চালালে নিজের মনের ভিতর হয়তো শান্তি পাবো, তার প্রতি শ্রদ্ধা দেখাচ্ছি ভেবে। কিন্তু আমার মনে হয় তাতে তাঁর প্রতি সন্মান দেখানোর পরিবর্তে তাকে অপমান করা হবে। কারণ তাতে লোক হাসবে, প্রথমতঃ শত বছরের পুরনো জামার ডিজাইন দেখে -বলবে ‘প্রথম চৌধুরীর এই পছন্দ ছিল’। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে সে সময়ে ওটাই ছিল শ্রেষ্ট ডিজাইন। দ্বিতীয়তঃ জামার ফিটিংয়ের ব্যপারটা আমাকে রঙ্গমঞ্চের কৌতুকাভিনেতা বানিয়ে ছাড়বে।
নতুন জমিদারকে শ্রদ্ধাবনত বদনে তাকিয়ে দেখছিলো রামদয়াল। সুঠাম দেহের অধিকারী বুদ্ধিদৃপ্ত জমিদারকে দেখে ওর মনে হতে লাগলো এতদিনে বোধহয় সব ঠিক হবে আসবে। তার সদ্য প্রয়াত বাবা আমির চৌধুরীর অন্যমনষ্কতার জন্য ঝিমিয়ে পড়া জমিদারী আবার কর্মব্যস্ত হয়ে উঠবে, আর চৌধুরী এষ্টেট তার হারানো ঐতিহ্য আবার পুনরোদ্ধার করবে।
-ঐতিহ্যকে মৃত ভেবে ওটাকে ধরে পড়ে থাকলে চলবে না, তাকে সময়ের দাবীর সাথে সামঞ্জস্য রেখে এগিয়ে নিতে হবে।
কথগুলো বলে চিকিৎসালয়ের প্রসঙ্গ পাড়লো জমিদার। এ যাবত যে সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে বা কি কি ধরনের রোগের চিকিৎসা করা হয়েছে তদুপরী তাদের আরোগ্য লাভের হার কেমন ইত্যাদি সম্পর্কে জমিদার জানতে চায়লো।
এ সব ব্যপারে রামদয়াল কোন তথ্যই দিতে পারলো না।
প্রতিদিন যে সমস্ত রোগী আসে তাদের সকলকেই দরদ দিয়ে পরীক্ষা করে অসুদ দেয় রামদয়াল। যারা পুরনো রোগী তাদেরকে ও নামে চেনে আর অন্যদেরকে চিনে রাখার কোন পদ্ধতি ওর নেই।
রোগীদের বাড়ী, ওদের সংসার সন্তানাদি সব কিছুর হিসাব ওর মনের পাতায় আঁকা। মনের মাধুরী দিয়ে আঁকা ছবির সব মাপ কি শিল্পী না মেপে বলতে পারে!
ওর রোগীদের বাহির ভিতর দুটোই ওর জানা। কিন্তু জমিদার যেভাবে জানতে চাচ্ছেন সে সবের কিছুই ওর জানা নেই। ইতিপূর্বে এধরণের কোন নির্দেশনা ও পায়নি কারো কাছ থেকে।
সবাইকেই বিনা মূল্যে অসুদ পত্র দেয়, সাথে বিভিন্ন ঋতুতে নির্দেশ মত ফলফলাদিও কম বেশী দেয়া হয় সব রোগীদের। নিজে হাতেই ওগুলো বিতরন করে রামদয়াল, নিজের বুদ্ধি বিবেক মত। তায় ওগুলোর জন্য আলাদা কোন হিসাব রাখেনি কখনো।
যদিও সাধারণতঃ সকাল আটাটার মধ্যে রামদয়াল ডাক্তার খানায় চলে আসে কিন্তু সপ্তাহের অধিকাংশ দিনই দূরদুরান্ত থেকে আসা রোগীদের ডাকাডাকিতে অনেক সকালেই ঘুম ভাঙে ওর। রোগীরা একটা অধিকারের জোর নিয়েই ওকে ওর ঘর থেকে ডেকে তোলে। বিছানা ছেড়ে কোনরকমে কিছু একটা মুখে দিয়েই চলে আসে ডাক্তারখানায়।
শুরূ হয় নতুন একটা দিন।
প্রথম রোগীটি আসার পর ওর দিন শুরূ হয় আর শেষ রোগীটি যাওয়ার পর দিন শেষ হয়। শেষ বা শুরু কোনটাই ঘড়ি দেখে হয় না। আর অবসর সময় যেটুকু পায় তার সবটুকু আয়ুর্বেদ বাগানের মধ্যে কাটে।
রামদয়ালের ছোট্ট জগতের সবটুকু জুড়েই আয়ুর্বেদ।
কোন রোগীর অবস্থা খারাপ হলে রামদয়াল পায়ে হেটে বা ওর সাইকেলে প্যাডেল মারতে মারতে রোগীর বাড়ীতে যায়।
রামদয়ালের থাকার ঘরটা ডাক্তার খানার অদূরে অবস্থিত। জমিদারের বদান্যতায় ওর বেচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা হয় জমিদারীর বিশেষ ফান্ড থেকে।
আয়ুর্বেদ বাগানটার প্রতিটি গাছের খোজ ওর অন্তরে। তবে গাছের কোন পরিসংখ্যন, কোন বই খাতা দেখে ও দিতে পারবে না জমিদারকে।
রাতের আধারে আলো বাদে রাস্তা চলতে কষ্ট হয় কিন্তু আয়ুর্বেদ বাগানের যে কোন কোণ থেকে গভীর অন্ধকারে কোন গাছের পাতা বা শেকড় তুলে আনতে ওর কোন কিছুরই সাহায্যের প্রয়োজন হয় না।
জমিদারের জিজ্ঞাস্য বিভিন্ন পরিসংখ্যনের গুরূত্ব যে অপরিসীম সে ব্যপারে রামদয়াল পুরোপুরি একমতই শুধু নয় এ পরিসংখ্যনগুলো না রাখাটা তার নিজের দায়ীত্ববোধের অসারতা সেটাও সে অনুধাবন করলো সে।
যতটুকু তথ্য ওর নিজের মনে আছে এবং যাকিছু অন্যন্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব তার পরে নির্ভর করেই জমিদারের নির্দেশ অনুযায়ী একটা নুত্যতম পরিসংখ্যন তৈরীর প্রয়োজনীতা সম্পর্কে রামদয়াল পুরোপুরি একমত পোষন করল। এটা না করা হলে যে এই চিকিৎসার কোন উন্নতি হবে না সে বিষয়েও ওর দ্বিমত নেই।
জমিদারের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ভূল চিকিৎসার জন্য রোগী ভালো করার পরিবর্তে যে খারাপ হচ্ছে না বা মৃত্যুর কারণ হচ্ছে না তা নিশ্চিত হওয়ার উপায় কি? জমিদারের এ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে ওর বলার কিছুই ছিল না।
অনেক সময় ধরে রামদয়ালের সাথে এ বিষয়ে কথা বললেন জমিদার। ভূল চিকিৎসার জন্য পৃথিবীর অনেক জায়গায় জীবন নাশের কিছু ঘটনাও রামদয়ালকে শুনালেন জমিদার।
রামদয়াল মন্ত্রোমুগ্ধের মত ওর সব কথা শুনলো।
দাতব্য চিকিৎসালয়টি আরো বড় আকারে আরো বেশী চিকিৎসা সুবিধা দেয়ার ব্যপারে জমিদার তার ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করে এটা সম্পর্কে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা আলোচনা করলেন।
এখানে প্রাথমিক অবস্থায় ছোট কলেবরে একটা আধুনিক হাসপাতাল নির্মান করা হবে যা ভবিষ্যতে আরো বড় করা হবে। যেহেতু সেসব সময় সাপেক্ষ, তাই প্রাথমিক ভাবে একজন পাশ করা ডাক্তারের ব্যবস্থা তিনি করেছেন, যিনি দুএক দিনের মধ্যেই এসে পৌছাবে বলে জানালো জমিদার।
জমিদার আরো জানালো যে তার চিন্তাভাবনায় আধুনিক হাসপাতালের সাথে আয়ুর্বেদ শাখা রাখার পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। তবে তিনি আধুনিক আয়ুর্বেদের উপর পড়াশোনা করা ডাক্তারদের নিয়োগ দেবেন বলে জানালেন।
জমিদার রামদয়ালকে চিকিৎসার ব্যপারে বিভিন্ন পরিসংখ্যন যেমন গত ছয় মাসে কাদেরকে চিকিৎসা করা হয়েছে, তাদের আরোগ্য লাভের হার ইত্যাদি ব্যপারে যতটুকু পারা যায় তথ্য যোগাড় করে লিপিবদ্ধ করতে বললেন। আয়ুর্বেদ বাগানটাতে কি কি প্রজাতির গাছ গাছড়া আছে আর অন্যান্য কি প্রজাতির গাছ লাগানো যায় সে সম্পর্কেও একটা প্রতিবেদন তৈরী করতে বললেন। এাছাড়া আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার উপর বিভিন্ন বই পুস্তকের নাম লিপিবদ্ধ করতে বললেন যাতে করে পর্যায়ক্রমে সেগুলো যোগাড়ের ব্যবস্থা করা যায়।
-এটা প্রতিযোগীতার যুগ। টিকে থাকতে হলে সে ভাবেই যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে।
কি অকাঠ্য সব যুক্তি আর সময়োপযোগী চিন্তা চেতনা বর্তমান চৌধুরীর! সব বইএর ভাষার মত। কোনটার সাথেই মতোদ্বৈত্যতার একটুও অবকাস নেই।
কিন্তু কি করবে রামদয়াল এখন! কোথা থেকে কি ভাবে শুরূ করবে বর্তমান চৌধুরীর দেয়া কাজগুলো?
এতকাল লিখিত পরিসংখ্যনের কথা ভেবেতো ও কাজ করেনি। আর এ প্রক্রিয়া ওর পূর্ব পূরূষ থেকেই চলে আসছে।
ওর চিকিৎসায় কত রোগী সেরে উঠে তাদের হাসি মুখ দেখে রামদয়াল অন্তর জুড়িয়েছে। আবার কতজনের মৃত্যুর সংবাদে ওর হৃদয়টা ফুটো হয়ে যন্ত্রণার চিহৃগুলো ওর কপালের রেখায় ফুটে উঠেছে। কিন্তু তারতো কোন হিসেব সে লিখে রাখেনি।