জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' এর শেষ পর্ব।

আপডেট: 2022-09-04 13:28:49

অমৃতের সন্ধানে- ২৩ 

 

কাল খুব ভোরেই বেরূতে হবে। তাহলেই হয়তো ফেরিটা পাওয়া যাবে। কথাটা ভাবতে ভাবতে মানিক একটু আড়ামোড়া ভেঙ্গে আবার চিন্তায় ডুব দিল।
দোকানী সব মায়া কাটিয়ে তারপর যেতে বলেছে। শিউলির চিন্তাটায় কি সেই মায়ার বাধন!
এটা একটা টান, মনের গভীরের অবচেতন মনের একটা টান। প্রতি নিয়তই টানে। কিন্তু এই টানতো কখনই ওকে বাধতে চায়নি। কখনোই ওর চলার গতিকে রূখতে চায়নি। এ টানতো ওর চলার গতি বৃদ্ধিতে সহায়ক। এ ভাবনাতো ওকে দিক নির্দেশনা দিয়েছে। শিউলিতো অমৃতের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওকে অমৃত আস্বাদের সন্ধান দিয়েছে। ওর জীবনের সাথে শিউলির অস্তিত্বটা প্রাণের সাথে বাতাসের সম্পর্কের মত। অতএব শিউলি কোন মায়া নয় বরং ওর নিজের অংশ।
রাত কত হলো কে জানে। কি যেন একটা ভেবে মানিক উঠে দাড়ালো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। জোৎস্নার আলোয় উদ্ভাসিত চারদিক।
অজানা এক আকর্ষণে ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসলো।
নিজেকে একদম হালকা লাগলো। মনে হলো ঈন্দ্রীয়ের খাচা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে ও। ধীর পদভারে নিচে নেমে এলো। গোলাকার চাঁদটা একদম মাথার উপর। চারধারের সব কিছুই ওর পরিচিত লাগতে লাগলো হটাৎ করেই।
ফুলের গন্ধটা সমস্ত চত্তরকে ঘিরে রেখেছে। বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল মানিক। চেনা গন্ধের ফুলের নামটা মানিকের স্মরণে আসলো।
শিউলির গন্ধটা বোধহয় জোৎস্নাতেই বেশী ছড়াই।
মাথার উপর চাঁদটা হাসছে আত্মতৃপ্তিতে। ঘাসের চত্তরটা ছায়াহীন সর্গীয় দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করছে। মাথার উপর চাঁদের আলতে সব ছায়াগুলো ছোট্ট শিশুর মত জড়ষড় হয়ে মায়ার বাঁধনে নিজ নিজ সত্তার কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
কি অপূর্ব বাধন! শুধু মানিক বাধনহীন মুক্ত স্বাধীন। এখন শুধুমাত্র সুর্য্য ওঠার অপেক্ষা। জীবনের সকল হিসাব চাওয়া পাওয়ার ব্যবধান সে সবকিছুরই উর্ধ্বে ও।
ওর ঘরটা যে পাশে তার উল্টো পাশটা দিয়ে বাড়ীর বাইরে বেরিয়ে এলো মানিক হাটতে হাটতে।
আহ একি অপরূপ দৃশ্য! সামনে প্রশস্ত নদী। লম্বা লম্বা সিড়িয়ালা সান বাধানো ঘাট, বিল্ডিং এর গাঁ ঘেঁষে থরে থরে ধাপগুলো নদীতে গিয়ে পড়েছে। উপরে মেঘ মুক্ত আকাশ আর নিচে জোৎস্নালোকিত নিস্তব্ধ ধরণী। স্বর্গ মর্ত্য সব যেন মিলেমিশে একাকার।
ঘাটের এক কোনায় একটা সাম্পান বাঁধা। ঢেউ এসে ওর উপর আছড়ে পড়ে ওকে যেন বাঁধন ছেঁড়ার আহবান করছে।
সব কিছু সুনিপূন ভাবে সাজানো। মানুষ আর প্রকৃতি মিলে একে অন্যের সহায়ক হয়ে স্বপ্ন আর বাস্তবতার দুরত্ব যেন একেবারে বিলীন করে দিয়েছে।
সিড়ি বেয়ে বেশ কিছুটা নেমে যে দিকটাতে সাম্পানটা বাধা ও দিকে সিড়ির এক কোনায় যেয়ে বসলো মানিক।
নদীর ওপাড়টা ঝাপসা। কি আছে ওখানে কে জানে। জানার তো কোন উপায়ও নেই। যারা জানে তেমন কাউকে ধারে কাছেও দেখা যাচ্ছে না।
বুক ভরে একটা নিশ্বাস টানলো মানিক।
জানা জগতটা মানিকের সুখকর নয়। পাওয়ার খাতাটা ওর বরাবরই শূণ্য, বরং যা আছে তা শুধু বেদনা বিধুর। পিছন ফিরে তাকিয়ে চোখ জুড়ানোর মত কিছুই নেই বললে চলে।
সামনেটা ঝাপসা অনিশ্চিত। পাওয়ার কিছু থাকলে ঐ ঝাপসার মধ্যেই থাকবে। তায় মনে খুব ইচ্ছা হয় ওপারটা যদি ও ছুতে পারতো!
ঘাটের দোকানীর মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কি হালকা লোকটা, শুধু ডাকের অপেক্ষা।
চেনা গন্ধটা আবার নাকে এসে লাগতে লাগলো।
মনে হলো কে যেন একজন পায়ে পায়ে এসে একটু দুরে দাড়ালো। মানিক বুঝলো সেই চেনা গন্ধ সেই শব্দ! কিন্তু তা কি হতে পারে, তা কি করে সম্ভব!
মানিক ফিরে দেখলো না। ওপারের দিকেই তাকিয়ে রইলো।
কেউ একদম কাছে এসে বসলো মানিকের। চেনা গন্ধে জায়গাটা ভরে গেল।
ওর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মানিকের মধ্যে কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হলো না।
কি বলবে তা ভেবে পেল না। ওর সব চিন্তা সব ভাবনা যেন গুলিয়ে যেতে লাগলো। ওতো নোঙরবিহীন দিক হারানো ভাসমান এক নৌকা। ওতো বাধনহীন কিন্তু ডানা ভাঙ্গা এক পাখী। ওতো ঘাটের দোকানীর মত হালকা শতছিন্ন মাকড়াসার জাল। শুধু ডাকের অপেক্ষা।
কিন্তু এই মুহূর্তে সব হিসাবপত্র যেন গরমিল হয়ে যাচ্ছে! পিছনের দিকে ফিরে তাকানোর প্রবল একটা ইচ্ছা জাগছে!
ওর নানীর আদরে ভরা কণ্ঠস্বর ওর কানে বাজছে।
আহ সেইতো ছিল মানিকের অমৃতের ভান্ডার।
মানুষের এমন অনেক কাজ, অনেক কথা থাকে তা সে নিজে বাদে কাউকে বলে না। কারণ বললে কেউ তা বোঝে না। বুঝলেও ভূল বোঝে। আর সে ভয়েই তা অবলাই রয়ে যায়।
এই মুহুর্তে ওর পরিষ্কার মনে পড়ছে যে নানীর মৃত্যুসজ্জার টেলিগ্রামটা ও বিদেশে বসে সঠিক সময় পেয়েও পরে সকলকে মিথ্যে বলেছিলো যে টেলিগ্রামটা ও পায়নি। কারণ নানীর মৃত্যু যন্ত্রনা নিজ চোখে দেখার সাহস ওর ছিলো না। তায়তো নানীর মৃত্যুর খবর পেয়েও ভয়ে তাকে দেখতে যায়নি মানিক।
-এ কি ওর অপরাধ না কাপুরূষতা!
যুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে ওর নানী মারা গেলেন বেশ কিছুদিন রোগ ভোগের পর।
ও জানে অসুস্থতার খবর পেয়ে সব কাজ ফেলে শিউলি ছুটে গিয়েছিল। শেষ দিন গুলোতে শিউলি তার পাশেই ছিল।
মৃত্যুর কয়েকদিন আগে রোকেয়া বেগম শিউলিকে ছাড়া অন্য কাউকে সহ্য করতে পারতেন না। শিউলি সারাক্ষনই পাশে থেকে তার যত প্রয়োজন তা মেটাতো।
নানী মৃত্যু যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে শুধু মানিককেই খুজেছিলেন। মৃত্যুর দুদিন আগে তার অন্যান্য ছেলে মেয়ে সবাই পাশে থাকার পরও তিনি শুধু মানিককে খুজতেন।
এক পর্যায়ে সবাই বিরক্ত হলে রোকেয়া বেগম হাত জোড় করে মানিককে এক পলক দেখার আকুতি জানিয়েছিলেন সবার কাছে।
মৃত্যুর দুদিন আগ থেকে রোকেয়া বেগম সবার সাথে কথা বলা বন্দ করে দিলেন। খাওয়া দাওয়াও প্রায় ছেড়ে দিলেন। শুধু চামচে করে একটু পানি শিউলি মুখে দিলে অতি কষ্টে তিনি তা গিলতেন।
মৃত্যুর আগে সব সময় শিউলির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন আর দুচোখের কোনা গড়িয়ে অশ্রু ঝরত।
মরার ঠিক আগের দিন বিকেল বেলা থেকে রোকেয়া বেগম বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন। একটু কিছু খেলেনও। সবার সাথে দুএকটা করে কথা বলে ওদেরকে চলে যেতে বললেন, শুধু শিউলি বাদে।
রাত বেশ গভীর। তিনি শিউলিকে আদর করে ওর পাশে বসালেন। ওর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। শিউলির দিকে তাঁকিয়ে একটু মৃদু হাসলেন। একদম সুস্থ মানুষের মত।
শিউলির চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠলো। ও ঠিকই বুঝলো এটা প্রকৃত সুস্থতা নয়।
ক্রন্ধনরত শিউলির মাথাটা সযত্নে বুকে টেনে নিয়ে ওর শরীর মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।
সে যেন যাদুর পরশ। আদরের অতিশয্যে ঘুমে শিউলির দুচোখ বন্ধ হয়ে আসলো।
ঘুমিয়ে পড়ার আগে একটা ক্ষীন কণ্ঠস্বর শিউলির কানে আসলো -আমি মানিককে সব বলেছি।
তিনি কখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন শিউলি তা জানে না।
ও তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। এত তৃপ্তির ঘুম কখনো ঘুমিয়েছে কিনা ওর জানা নেই। আহ ঘুমটা যদি না ভাঙতো!
কি ঘটলো তার কিছুই জানে না ও।
সুর্য্যের আলোর সাথে শিউলির যেন চির শত্রুতা। জানালা দিয়ে ঢোকা ভোরের সুর্য্যের কিরণ ওর ঘুম ভাঙালো। ধড়ফঢ় করে উঠতেই ও টের পেল রাঙাদাদির হীমশীতল হাত ওর হাতটা ধরে আছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তৃপ্তির হাসিতে ভরা মুখ। সেই যন্ত্রনার রেখাগুলো একদমই নেই।
ওর মুঠিবদ্ধ হাতটা খুলতেই দেখলো ওর হাতের মধ্যে রাঙাদাদির গলার সেই চিকন হারটা, যেটা রাঙাদাদা বিয়ের সময় তাকে দিয়েছিল।
ওটা ছিল তার খুব প্রিয় একটা বস্তু। রাঙাদাদি ঐ বয়সেও বিভিন্ন বিশেষ দিনে ওটা পরতো।
রাঙাদাদিই একদিন বলেছিলো যে মানিকের মারও ঐ হারটা খুবই পছন্দ ছিল। ইচ্ছে ছিল বিয়ের সময় হারটা মেয়েকে উপহার দিবে। কিন্তু কোন কিচু না নিয়েই ও চলে গেল!
বেশ কিছু সময় ধরে রাঙাদাদির অবস দেহের পাশে ঐ ভাবেই বসে রইলো শিউলি। হারটা নড়াচড়া করে অনেকক্ষন ধরে দেখলো। আর দেখলো তার মুখটাও, তাতে কোন অভিব্যক্তি আছে কিনা বুঝতে চাইল।
একটা মৃত দেহের সাথে একা থাকতে ওর একটুও ভয় করলো না। একটা স্বর্গীয় পরিবেশ। ওর অসাড় দেহটা স্বর্গের কোন বস্তু মনে হলো শিউলির। সারা ঘরটা একটা গন্ধে ভরপুর হয়ে রইলো। রাঙাদাদির এ স্বর্গীয় চেহারা আগে কখনো দেখেনি শিউলি।
সে দিকে তাকিয়ে তেমনিই বসে রইলো শিউলি। একটুও কাদলোও না, কাউকে কোন খবরও দিল না।
হটাৎ করে লোকজনের কান্নার শব্দে ও সম্বিৎ ফিরে পেল।
ধীর পায়ে শিউলি বেরিয়ে নিজ কক্ষে ঢুকে দরজাটা বন্দ করলো।
ওর খুব আফসোচ হলো নিজের উপর।
কি বলেছে রাঙাদাদি মানিককে শিউলি তা জানে না! শিউলির দুচোখ অশ্রুর বন্যায় ভেসে যেতে লাগলো।

মানিক কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে নিঃশব্দে। এ যেন বোবা কান্না। ব্যথায় বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। জমে থাকা সব ব্যথা বেদনা বাঁধ ভেঙ্গে যেন ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু হয়ে ওর দুচোখ বয়ে গড়িয়ে পড়ছে।
অনেকক্ষন ধরে কাঁদলো। বুক খালি করে কাঁদলো।
মেঘ ভেদ করে সূর্যটা উকি দেয়ার চেষ্টা করছে। এখনতো শিউলির আর থাকা চলে না। সূর্য উঠার আগেই যেতে হবে ওকে।
রাতের আধার অগ্রাহ্য করে, ভ্রমরের আগমনের জন্য সেজে গুজে সারা রাত জেগে অপেক্ষা করার পর, দিনের আলো একটু ফুটতেই ভ্রমর এল। কিন্তু হায়! সূর্যের আলো শিউলির অসহ্য, তাই আলো ফুটার আগেই সে টুপ করে ঝরে পড়ল আর ওর নিপ্রাণ দেহটা মাটিতে লুটিয়ে রইলো।
এটাই নিয়তি!
মানিককেও যেতে হবে। ফেরীটা পেতেই হবে ওকে। আর না, এপারের কোন কিছুরই হিসাব মেলানো যায় না। কোন কিছুই কারো ইচ্ছা বা পরিকল্পনা মত চলে না।
এপারে যা কিছু ঘটলো, যে যা পেলো বা হারালো, কি তার অর্থ, তা ও জানে না। এ সব খুজতে খুজতেই এক একটা জীবন কোথাও থেমে গেলেই হলো।
জীবনের শেষ কোথায় সেটা অজানা বিষয়, তাই জীবন মানে শেষ অব্দি যাওয়া নয়, শেষ হয়ে যাওয়া। ওরূটা হয়ে গিয়েছে যাদের, তাদের সামনে আর একটা মাত্র সত্য- শেষ হবে নিশ্চিত।
কবে কোথায় কিভাবে শেষ হবে তা সবারই অজানা।
মাঝের যা কিছু সব ভ্রম, মায়া।
পৃথিবী যেন ঘুমিয়ে কোন সাড়া শব্দ নেই। কোথাও কেউ নেই।
বাতাসে ঢেউ গুলো স্বশব্দে আঁছড়ে পড়ে কি যেন বলতে চাচ্ছে। ও যেন ডাকছে যাদুর ছোয়াই সব জ্বালা জুড়িয়ে দেবে বলে।
মূক বধির প্রকৃতি চাঞ্চল্যতায় মেতে উঠেছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে সমস্বরে বলে উঠবে সব না বলা কথা।
জীবনের গল্প কখনোই মেলে না। তবে তা থেমে যায়। থেমে যাওয়ার মধ্যেই বোধহয় অমৃত্যের সন্ধান পাওয়া যায়। গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই থেমে শেষ হয়ে যাওয়াটা বোধহয় বিধাতার আর্শিবাদ! অমৃত্যের সন্ধানে সময় পার করার নামই বোধহয় জীবন।