Heading
আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২২, ১২:২৩
প্রায় দশ একর জায়গা জুড়ে পাচিল ঘেরা বন বনানীতে ভরা বিশাল সবুজ চত্তরের মাঝখানে উত্তরমুখী করে পাশাপাশি তৈরি দুটো পুরনো দোতলা বাড়ী।
দেখলেই বোঝা যায় একসময় একই পরিবারের দুই শরিকের বাড়ী ছিল। কিন্তু কালে কালে হাত বদল হয়ে পুরো সম্পত্তি দু ভাগ হয়ে বাড়ী দুটোর মাঝখান দিয়ে সীমানা প্রাচির উঠেছে। বর্তমানে সেখানে দুটো পরিবার বসবাস করে যারা ক্রয় সূত্রে মালিক।
বাউন্ডারি পাঁচিলের গাঁ ঘেসে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিবেশীর পুরনো আম গাছের বড় একটা ডাল পাঁচিল টপকিয়ে রোকেয়া বেগমের বাড়ীর আঙিনার একাংশ ঢেকে ফেলেছে। ভাল জাতের আম গাছ, একেবারে গোড়া থেকেই ডাল গজিয়েছে চারদিকে, কাণ্ড নেই বললেই চলে। প্রতি বছর অনেক আম ধরে সে সব ডালে। গাছের ডালটা তার আঙিনায় বিকেলের রোদের আলো পড়াতে বাধা দেয়, তাই দেয়ালের ধার ঘেসে সেখানটা কিছুটা স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকে। তাছাড়া গাছের ডালের ভারে সেখানকার বাউন্ডারি পাচিলটাও ফেটে গিয়েছে খানিকটা জায়গা জুড়ে।
সেটা নিয়ে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে কিছুটা মনমালিন্যেরও সৃষ্টি হলেও ডালটা কেটে ফেলার জন্য রোকেয়া বেগম জোরেশোরে কখনো কোন তাগাদা দেয়নি।
প্রতি বছর গাছের ডালে ঝুলে থাকা আমের থোকার কথা মনে পড়লে ডালটা কাটতে বলতে একদম মন চায়না রোকেয়া বেগমের। তাছাড়া এ পাশের ডালে যত আম ধরে তা সহ প্রতিবছর ওদের প্রতিবেশী পুরো গাছের আমের অর্ধেকটা পেড়ে এ বাড়ীতে দিয়ে যায়। বলা চলে গাছের ওই ডালটাই প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্কের একটা অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে দিনে দিনে।
রোকেয়া বেগমের ছয় বছরের ছেলে অর্ণবের বয়সী একটা ছেলেও আছে প্রতিবেশীর, নাম দুলাল। ধীরে ধীরে ওরাও ভাল বন্ধু হয়ে উঠেছে। সারাদিনই একই বয়সী দুজন দু বাড়ীর প্রশস্থ আঙ্গিনায় খেলাধুলা করে কাটায়। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে অর্ণব আর দুলালকে হয় এ বাড়ী না হয় ও বাড়ী থেকে ঘুম ঘুম চোখে কোলে করে এনে বিছানায় শোয়াতে হয়।
বাচ্চাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে দু প্রতিবেশী মিলে আম গাছটার ডালটার ভারে যেখানে পাচিলটা ফেটে গিয়েছে সে জায়গাটা ভেঙ্গে বাউন্ডারি দেয়ালে একটা দরজা তৈরি করেছে।
দু’বাড়ীরই মেইন গেটে পাহারা থাকে তাতে করে ছেলে দুটো বাইরে বেরুতে পারে না। আর গাছের ডালের নিচে বাউন্ডারি পাঁচিলে তৈরী গেটের কল্যাণে দুবাড়ীর আঙ্গিনা মিলে খেলাধুলার জন্য বড় একটা জায়গা পেয়ে ছেলে দুটো প্রাণ খুলে খেলাধুলা করতে পারে। অর্ণব আর দুলাল বাউন্ডারি পাচিলের গেট দিয়ে এ বাড়ী ও বাড়ীর আঙ্গিনায় ছুটোছুটি করে আর গাছের ছায়াতে বা ডালে চড়ে খেলাধুলা করে দিন কাটায়।
এভাবেই পাচিল ডিঙ্গানো গাছের ডালের কল্যাণে দুই প্রতিবেশীদের মধ্যে ফল ভাগাভাগি করা, তারপর বাউন্ডারি পাঁচিল ভেঙ্গে গেট তৈরি করা আর সর্বোপরি একই বয়সী দুটো ছেলের মধ্যে গড়ে ওঠা বন্ধুত্বের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে দুই পরিবারের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে সেটা রীতিমত মহল্লার সবার আলোচনার একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কি যে হল! বৈশাখ মাস শুরু হতে তখনও সপ্তাহ খানেক বাকি। বায়ু কোণে কাল মেঘের আনাগোনা থাকলেও চোখে পড়ার মত না তেমন কিছু না। হটাৎ ঝড়ের একটা ঝাপটায় মড়মড় শব্দে ওই ডালটাই ভেঙ্গে সেটার নিচে খেলায়রত দু’ছেলের ঘাড়ের উপর পড়ল।
সবাই দৌড়ে আসলো। দুটো ছেলেকেই আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়া হল। পাচ দিনের মাথায় দুলাল চোখ মেলে তাকালেও অর্ণব কোন চিকিৎসাই সাড়া না দিয়ে সকলকে কাঁদিয়ে চির বিদায় নিল।
ঘটনার আকস্মিকতায় দুটো পরিবারই একেবারে হতভম্ব হয়ে রইল।
শোকে মুহ্যমান অর্ণবের মা রোকেয়া বেগম অর্ণবের সম বয়সী মা হারা তার বড় মৃত বোনের ছেলে অবনীকে কোলে তুলে নিয়ে সব মেনে নেয়ার জোর খুজে পেল।
ওদিকে দুলালের বাবা মা এ দুঃসহ স্মৃতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঘটনার পর বছর না গড়াতেই তাদের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে স্থায়ী ভাবে বিদেশে বসবাসের জন্য পাড়ি জমাল।
মুল ডালটা হারিয়ে যেন বোঝা মুক্ত হয়ে আম গাছটা পড়ন্ত বয়সেও আকাশের দিকে তাকিয়ে সোজা হয়ে দাড়াল। আর আম গাছের ঝুলে পড়া ডালের জায়গায় সীমানা পাচিল ভেঙ্গে বানানো গেটটা স্থায়ী ভাবে বন্দ করে আরো শক্ত করে পাচিল তোলা হল।
অর্ণব মারা যাওয়ার পর তার জায়গা নেয়া অবনীর দৌড়াদৌড়িতে এপারটা আগের মতনই প্রাণবন্ত হয়ে উঠলেও ওপারটা একেবারে স্তব্দ হয়েই থাকল।
অর্ণবের মা ধীরে ধীরে সব মেনে নিয়ে মাতৃহারা অবনীর মা হয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠল।
রক্তের টানে ভালবাসা আর নিচক ভালবাসার টান এ দুটোর মধ্যে পার্থক্যটা রোকেয়া বেগম অনুধাবন করতে শুরু করল।
এমনি বোধহয় হয়। নিজ সন্তানের ভালবাসার মধ্যে কোথায় যেন একটা সামাজিক বাধ্যবাধকতার অনুশাসন থাকে। নিজ সন্তানকে সঠিক ভাবে লালন পালন করে বড় করার মধ্যে একটা সামাজিক চাহিদা পূরণের ব্যাপার থাকে। একটা চাওয়া পাওয়ার হিসেব আর তুলনার ক্ষেত্র থাকে। সে ভাবনাতেই দুলালের মা বাবা তাদের ছেলেকে তার জীবনের তিক্ত বাস্তবতার স্মৃতি থেকে দূরে রেখে ভাল ভাবে মানুষ করার জন্য ছেলেকে নিয়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে।
সুতোই গাঁথা মালার ফুলগুলোকে দৃশ্যমান সুতো একে অপরের সাথে বেধে রাখে। কিন্তু বিনিসুতোই গাঁথা মালার ফুলগুলো এক অদেখা টানে একে অপরের সাথে লেপটে থাকে। টানটা সমান ভাবে দুদিকের। ফুলগুলো শুঁখিয়ে মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে যেন হারিয়ে যাওয়ার আশংকাযুক্ত থেকে তারা একে অপরের সাথে যেভাবে লেপটে থাকে অবনীর সাথে রোকেয়া বেগম বাধনটা সেরকম।
সারাদিন মা ছেলে হাসি আনন্দের মধ্য দিয়েই সময় কাটায়। কেউ কাউকে একটুও যেন চোখের আড়াল হতে দেয় না।
বিকেলে অবনী বাইরে বেরোলে রোকেয়া বেগম ছাঁদে যেয়ে একাকী বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে সময় পার করে দেয়।
জীবনের সব অনুশাসন সব বিধানকে মেনে নিয়ে নিজের কাঁধ থেকে সব পার্থিব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে পারলে একজন মানুষ হালকা পালকের মত হয়ে যায়। সব নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নেয়া মানুষের একটা অপার্থিব রুপ আছে। পার্থিবতাকে পুরোপুরি পরিহার করে অপার্থিবতার কাছে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পণকৃত মানুষের চেহারাকে বর্ণনা করতে চিত্রকারেরা সে সকল চেহারা ঘিরে স্বর্গীয় আলোকের বলয় ব্যবহার করে। বাস্তবে যেটা সাধারণ চোখে ধরা না পড়লেও তা দিব্য চোখে দেখা যায়।
বিকেলের পড়ন্ত বেলার আলোকচ্ছটার মধ্যে আত্মবিসৃত রোকেয়া বেগমের শরীর থেকে তেমনি আলোকচ্ছটার বিচ্ছরন অবনীর চোখ এড়িয়ে যেতে পারেনা।
অবনী স্নাতক পাশ করে ভাল কোন চাকরিতে জয়েন করার জন্য ব্যস্ত। সন্ধ্যার একটু আগে ফিরে মাকে না দেখে সে সন্তর্পণে ছাঁদে যেয়ে আনমনে বসে থাকা মায়ের সে রুপ প্রত্যক্ষ করে ও যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। মা, বলে ডেকে রোকেয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে অবনী।
সন্ধ্যা হলে রোকেয়া বেগম নিচে নেমে আসে। ততোক্ষণে দারোয়ান গেট সহ বাড়ীর সব আলো জ্বালিয়ে দেয়। কিন্তু পাচিলের ওপাশটা বলতে গেলে অন্ধকার থাকে। অনেকবার ভেবেছে ওবাড়ীর দারোয়ানকে ডেকে লাইটগুলো জ্বালতে বলবে। কিন্তু বলবে বলবে করে আর বলা হয়নি।
কিন্তু সেদিন ওবাড়ীতে সন্ধ্যার পর পরই বেশ কয়েকটা লাইট জ্বলে উঠলো।
ভালই লাগলো রোকেয়া বেগমের। সেদিন থেকে প্রতি সন্ধ্যাই লাইট জ্বলতে দেখা গেল।
একদিন দারোয়ানের কাছ থেকে শুনল ওবাড়ীর ম্যাডাম বিদেশ থেকে ফিরেছে বেশ কয়েকদিন হল।
কথাটা শুনে প্রকৃতই ভাল লাগলো রোকেয়া বেগমের। মনে পড়ল দুলালের কথা। নিশ্চয় দুলাল অনেক বড় হয়েছে এতদিনে। বিদেশে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়ে তাকে মানুষের মত মানুষ করেছে রেবেকা চৌধুরী।
ভেবে ভাল লাগলো রোকেয়া বেগমের।
আসবার পর দিনই রেবেকা চৌধুরী তার বাড়ীর জানালার ফাঁক দিয়ে বিকেলে ছাদে নির্লিপ্তে বসে থাকা এক সময়ের অতি পরিচিত রোকেয়া বেগমকে লক্ষ্য করেছে।
এমনিতেই সে দুর্ঘটনায় অর্ণবের মৃত্যুতে রেবেকা চৌধুরী সন্তান হারা মাকে শান্তনা দেয়ার সব ভাষা হারিয়ে ফেলেছিল। তার উপর নিজের ছেলেটা বেচে যাওয়া আর তাদেরই গাছের ডাল চাপা পড়ে অর্ণবের মৃত্যু ইত্যাদির জন্য সে নিজের কাছে অপরাধী হয়ে আছে।
ঘটনার পর ছেলেকে নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার সময় রেবেকা চৌধুরী গিয়েছিল রোকেয়া বেগমের সাথে দেখা করতে। স্বাভাবিক হয়ে উঠা রোকেয়া বেগম সেদিন দুলালের মাথায় স্নেহের হাত রেখেছিল।
এত বছর বাদে ফেরার পর থেকে প্রতিদিন বিকেলে রেবেকা চৌধুরী তার জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে আত্মনিমগ্ন অবস্থায় ছাদে বসে থাকা রোকেয়া বেগমকে।
সন্ধ্যার আগেই বাইরে থেকে ফিরে অবনী ছাঁদে যায় তারপর মাদুরের উপর পা ছড়িয়ে বসা মায়ের কোলে মাথা রেখে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকে। দুজনে মিলে গল্প করে হাসি তামাসা করে।
ছেলেটা খুব প্রাণবন্ত। খুব জোরে জোরে মন খুলে হাসে। রেবেকা চৌধুরী তার ঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে সব দেখে আর অবনীর হাসির শব্দও শুনতে পায়।
-মা, আপনি দুলালকে এখনো ছোট ছেলের মত আগলে রাখতে চান কেন? ওর প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপ করা আপনার উচিত না। আপনার ছেলে কথাটা আপনাকে সরাসরি বলতে না পেরে আমাকে বলতে বলেছে।
ছেলের বউ এদেশের হলেও ওদেশেই জন্ম গ্রহন করে ওখানকার পরিবেশেই বড় হয়েছে। এক সাথে পড়ত ওরা, পড়া শেষ হতেই বিয়ে করেছে। দুজনেই সপ্তাহের পাচ দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজে ব্যস্ত থাকে। কাজ থেকে ফিরে যে যার মত ঘুমিয়ে পড়ে। মায়ের সাথে দেখা হয় না বললেই চলে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়ীতে থাকলেও ওরা নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে বা বাইরে ঘুরতে যায়। একটু সুযোগ পেলেই ছেলেকে কাছে পেতে চায় রেবেকা বেগম। তাতে ছেলে বিরক্ত হয়।
ছেলের বউয়ের কথাটা রেবেকা চৌধুরীর কাছে খুব ভারী লেগেছিল সেদিন। তবুও কোথায় যেন একটা ভরসার জায়গা ছিল। কিন্তু যেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ওদের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে রেবেকা চৌধুরী শুনতে পেল ছেলে বলছে –তুমি কি কথাটা মাকে বলেছিলে? বয়স হলে মানুষের বোধহয় সাধারণ বিষয়গুলো বোঝার শক্তি কমে যায়। কি যে করে মা? এখন দিব্যি দেশে ফিরে নিজ বাড়ীতে থাকতে পারে। সেখানে সব কিছুই আছে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। এখানে কেন যে খামাকা পড়ে আছে!
রেবেকা চৌধুরীর স্বামী মারা গিয়েছে বছর খানেক হল। ছেলের বিয়ে হওয়ার পর বছর না গড়াতেই তিনি চোখ বুজেছেন। ছেলের কথা চিন্তা করে স্বামী হারানো শোক মেনে নিয়ে রেবেকা চৌধুরী ছেলের সাথে জীবন কাটানোর মনস্থ করেছিলেন।
কিন্তু সেদিন খোকার সে কথার ভার তার কাছে অসহনীয় মনে হওয়াই সব মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে ফিরে এসেছে।
সেদিন বাড়ীর উঁচু বারান্দায় আনমনে বসে ছিল রেবেকা চৌধুরী। জংলা হয়ে যাওয়া বাড়ীর আঙ্গিনায় একটা মুরগি গোটা পাচ সাতটা বাচ্চা নিয়ে লনটা আঁচড়ে আঁচড়ে পোকা মাকড় খাচ্ছে আর বাচ্চাদের খাওয়ানোর সে দৃশ্য আনমনে দেখছিল রেবেকা চৌধুরী। হটাৎ করে একটা বেজি কোথা থেকে এসে ওর একটা বাচ্চার ঘাড় মটকিয়ে দিতেই মা মুরগিটা বীর দর্পে কক কক শব্দে ওর সব শক্তি দিয়ে বেজিটার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। বেজিটাকে তাড়িয়ে মা মুরগি ফিরে আসতেই বাচ্চাগুলো ওদের লুকানো জায়গা থেকে বেরিয়ে মায়ের ডানার নিচে আশ্রয় নিল।
বেজিটা কোন বাচ্চাকে না নিতে পারলেও একটা বাচ্চাকে মেরে রেখে গেল। বাচ্চাটার পড়ে থাকা প্রাণহীন দেহটাতে দুএকটা ঠোকর মেরে কিছু একটা শব্দ করে সেটাকে ফেলে রেখে অন্যান্য বাচ্চাদের নিয়ে আবার আগের মত আঁচড়ে আঁচড়ে খাবার সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ল মা মুরগি।
রেবেকা চৌধুরী বুঝল মুরগীদের স্মৃতি মানুষের মত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বাচ্চাকে বাচাতে মা মুরগি নিজের জীবনের বিনিময়ে বেজিটার সাথে লড়াই করল কিন্তু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নিজ বাচ্চার প্রাণহীন দেহটা সে যেন আর চিনতেই পারল না। জীবিত বাচ্চাদের নিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবন শুরু করল।
-আহ মানুষের স্মৃতিটাও যদি মুরগির মত হত! কথাটা ভাবতেই তার বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।
-রোকেয়া বেগম নিজ সন্তানকে হারিয়ে সব মেনে নিয়ে অন্যের সন্তানকে আপন করে কেমন শুখে আছে। মা ছেলে দুজনেই যে যা হারিয়েছে তার থেকে যেন অনেক বেশী কিছু পেয়ে কি আনন্দে আছে তারা!
নিজের ছেলেটা অলৌকিক ভাবে বেচে যাওয়াতে রেবেকা চৌধুরী নিজেকে খুব ভাগ্যবান ভেবে ছেলেকে সব অনিষ্ঠ থেকে মুক্ত রাখার জন্য উন্নত বিশ্বে পাড়ি জমিয়েছিল।
কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার সব থেকেও যেন কিছুই নেই!
-নিজের স্ত্রীকে নিয়ে ছেলে শুখেই আছে। আর সে চলে আসার পর এখন ওদের প্রাইভেসিতে কোন বিঘ্ন সৃষ্টি হবে না। ওরা সব কিছু নিজেদের মত করে গুছিয়ে নিতে পারবে।
কথাটা ভাবতেই বেবেকা চৌধুরীর বুক খালি একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল।
বাচ্চাগুলো বড় হয়ে গেলে একাকী মা মুরগির কি হবে, কি ভাবে তার জীবন কাটবে? তা অনুমেয়। যে ভাবেই হোক মৃত্যু একদিন তার সব ভবলীলার ইতি টানবে। আর তার আগ পর্যন্ত আপন জনদের স্মৃতি তাকে একদমই কষ্ট দেবে না।
মৃত্যু একদিন সব মানুষকেও মুক্তি দেবে ঠিকই, কিন্তু তার আগ পর্যন্ত স্মৃতি তাদের সকলকে তিলে তিলে নিষ্পেষিত করতেই থাকবে। কারণ মানুষতো আর মুরগি না।