জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'বাবা'।।

আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩৪

বাবা


-বাবা, আমাকে তুমি পাচ হাজার টাকা দিতে পারবে?
বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাই হটাৎ করেই পিছন থেকে একজন মানুষের কণ্ঠস্বর শুনে ঘুরে তাকালাম সেদিকে।
মাঝ বয়স পার করা পাঞ্জাবি পাজামা পরিহিত হালকা শরীরের একজন ভদ্রলোক।
সে দিকে ঘুরতেই তিনি আমার চোখের দিকে তাকালেন। স্মিত হাসিতে ভরা মুখ।
অবাক হলাম যখন বুঝলাম যে, আমাকে উদ্দেশ্য করেই তিনি কথাটা বললেন।
চট করে স্মৃতিটা ঘাটলাম। কিন্তু কিছুতেই লোকটি আমার চেনা বলে মনে হল না।
লোকটি কিছুতেই ভিক্ষুক হতে পারে না। কোন ভিক্ষুক এভাবে পাচ হাজার টাকার ভিক্ষা চাইবে না। আর লোকটাকে কোন ক্রমেই ঠকবাজ বলেও মনে হচ্ছে না যে কোন রোগ বা দুর্ঘটনার কথা বলে এভাবে তার প্রয়োজন উল্লেখ করে এতগুলো টাকা চাইবে!
বেশ কিছুক্ষণ ধরে আমরা চোখে চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

সেদিন সকালে অফিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে একটু রাস্তা পেরতেই গাড়ীর একটা টায়ার লিক হয়ে বসে গেল। কপাল কি খারাপ, ঠিক আগের দিন একটা টায়ার লিক হলে ড্রাইভার সেটা মেরামতের জন্য অফিসের পাশেই একটা দোকানে দিয়েছে, আজ অফিসে আমাকে নামিয়ে টায়ারটা সংগ্রহ করবে। এমারজেন্সি টায়ারে গাড়ীটা চলছে।
যাহোক, কি আর করা। গাড়ীটা রাস্তার ধারে পার্ক করল ড্রাইভার।
তাকে অপেক্ষা করতে হবে অফিস থেকে অন্য একটা গাড়ীকে বলা হয়েছে টায়ারটা আনতে। টায়ার নিয়ে আসলে সেটা লাগানোর পর গাড়ী চলবে।
ভাবলাম, রাস্তার মধ্যে এভাবে অপেক্ষা না করে পাশেই বাস স্টান্ড সেখান থেকে একটা বাস ধরে অফিসের সামনে নামবো। কথাটা ড্রাইভারকে বলে অল্প একটু পথ হেটে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াতেই এ ঘটনা।

পকেটে অত টাকা রাখা আমার কখনো অভ্যাস না। ক্রেডিট কার্ড সাথে থাকে, সেটা দিয়েই প্রয়োজনে কেনা কাটা করে নিই। কিন্তু সেদিন সকালে অফিসে বেরনোর সময় একটা খামে করে আমার স্ত্রী পাচ হাজার টাকা আমাকে দিল, আমার অফিসের পিয়নকে দেয়ার কথা বলে। ওর স্ত্রীর নাকি চিকিৎসার জন্য টাকার খুব প্রয়োজন।

-বাবা, টাকাটা দিলে আমার খুব উপকার হত।
আমি আমার থেকে কম করেও প্রায় পনেরো বিশ বছরের বড় অচেনা লোকটির দিকে তেমনি ভাবে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলাম। তার কথাতে আমার চিন্তার ছেঁদ পড়লো।
-আমার ছেলে ইউনিভারসিটিতে মেকানিক্যাল ইঙ্গিনিয়ারিং পড়ে, আমাকে খরচ দিতে হয় না, ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়ছে। মেস করে থাকে, টিউশানি করে ও নিজের হাত খরচ চালিয়ে নেয়। গত কাল ওর ফাইনাল রেজাল্ট বেরিয়েছে। ছেলেটা আমার খুব মেধাবী, না হলে আমার মত গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের টিচারের পক্ষে ছেলেকে রাজধানী শহরে ইউনিভারসিটিতে পড়ান সেত স্বপ্নের ব্যাপার। ছেলে গ্রেড ফোর পেয়েছে। আমি কথা দিয়েছিলাম গ্রেড ফোর পেলে ওকে ভাল একটা সার্ট আর প্যান্ট কিনে দেব। আজ সকালেই গ্রাম থেকে এসেছি। কিন্তু কিছুতেই টাকাটা জোগাড় করে আনতে পারিনি।
-ছেলেকে দেয়া কথা রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় না করেই শহরে এসেছে, কিন্তু তার জন্য লোকটির চোখে মুখে চিন্তার তেমন কোন লেশ মাত্র নেই!
লোকটি তেমনি স্মিত হাসিতে ভরা মুখ নিয়ে আমার সাথে কথা বলছিল।
-একবার ভেবেছিলাম শরীর খারাপের কথা বলে আমার পক্ষে আসা সম্ভব না সেটা ছেলেকে জানিয়ে দিই। কিন্তু কি জান বাবা, ছেলেকে মিথ্যা বলতে কিছুতেই মন থেকে সাই পেলাম না। আমার স্ত্রী বলল যাও দেখবা একটা উপায় বের হয়েই যাবে। আর আমি ভাবলাম এতদিনে ছেলের সে কথা হয়তো মনে নেই?
কথা বলার শেষের দিকে তার মুখের উপর অসহায়ত্বের একটা ভাব প্রতিভাত হয়ে উঠলো। নিজেকে বোকা বানানোর খোড়া যুক্তি বোধহয় তার নিজেরই মনপুত হয়নি।

-আজকে সকালেই আমার গাড়ীর টায়ার লিক হল, না হলে এ ভাবে এই বাস স্ট্যান্ডে আসার কথা না, আমার পকেটে পাচ হাজার টাকা আছে যেটা থাকার কথা না, আর এত মানুষ থাকতে আমার কাছেই এই অচেনা একজন অসহায় বাবা এমন ভাবে টাকা চাওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক!
-এত গুলো ‘না’ এই অসহায় বাবার জন্য ‘হ্যে’ হয়ে আজ আমি এই মুহূর্তে এক বাবার সামনে দাড়ান।
একটা বাস এসে থামল। আমার গন্তব্যের বাস না, তবে বোধ হল বাসটি ওই মানুষটির গন্তব্যে যাবে। আমার দিকে একটু তাকিয়ে নিয়ে লোকটি ওই একই রকম স্মিত হাসিতে মুখটা ভরে বাসের দিকে পা বাড়াতেই আমি তাকে থামতে বললাম।
-শুনুন, বাস তো অনেক আছে, না হয় পরের বাসে যান।
কিছু না বলে অচেনা লোকটা বাসটা ছেড়ে দিল।
-না, আমার তেমন তাড়া নেই, কিন্তু তোমার তো দেরী হয়ে যাবে, বাবা।
-না না, আমারও তেমন তাড়া নেই। আমার অফিস বেশী দূর নয় বলে আমার অফিসের স্থান আর আমার পদবীর কথা বলে তাকে নিশ্চিন্ত করলাম।
-বুজেছি, আমাদের গন্তব্য ভিন্ন দিকে।
সেই মায়া মাখা হাসি দিয়ে কথাটা বলল লোকটি।

-আমিও তার মত একজন বাবা, আর সব বাবারাই ছেলে মেয়েদের কাছে যাদুকরী হিরো। বাবারা ছেলে মেয়েদের সব চাহিদা দিয়ে বা না দিয়ে মিটিয়ে থাকে সে যে ভাবেই হোক। প্রয়োজনে কিছুটা হলেও খোড়া যুক্তি খাড়া করে। ছেলেমেয়েদেরকে কোন কিছু দেয়ার যে কি আনন্দ সেটা সব বাবাদের মত আমিও বুঝি।

-আজকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে এই অচেনা বাবার মত আমার বাবাও ঠিক এমনি ভাবে একদিন আমাকেও কথা দিয়েছিলেন -খোকা তুই যদি মাস্টার্স এ ফার্স্ট ক্লাস পাস তাহলে তোকে আমি একটা দামি সুট গিফট করব।
-বরাবরের মত ফার্স্ট ক্লাস যে আমি পাব সেটা আমিও জানতাম আর বাবাও জানত। পাচ ভাই বোনের সংসার আমাদের, বাবা সরকারী নিন্ম বেতনভুক কর্মচারী কোন রকমে আমাদের ভাই বোনদেরকে সরকারী স্কুল কলেজে পড়িয়ে মানুষ করতেন। তা সত্ত্বেও বাবা সেদিন কেন যে ওই অঙ্গীকারটা করেছিলেন সেটা আমি আজও চিন্তা করে সঠিক ভাবে বের করতে পারিনি।
-বাবা কি ভেবেছিলেন আমি ফার্স্ট ক্লাস পাব না! না, তা কি করে হয়? সে পর্যন্ত ফার্স্ট ক্লাসের নিচে আমার কোন রেজাল্ট ছিল না। আমার মত বাবাও নিশ্চিত জানতেন আমি ফার্স্ট ক্লাস পাব।
রেজাল্ট নিয়ে বাড়ী ফিরে সবাইকে জানালে বাড়ীতে আনন্দের বন্যা বইতে শুরু করেছিল সেদিন। বুঝলাম মায়ের আগেই প্রস্তুতি ছিল, মা ভাল ভাল রান্না করে আমাদের সব ভাই বোনদের একত্রে বসিয়ে তৃপ্তি করে খাওয়ালেন।
সবার সাথে একই টেবিলে বসে খাওয়ার জন্য মা বাবার রুমে যেয়ে ডাকাডাকি করলেও বাবা আমাদের সাথে খেতে আসলেন না।
শরীর খারাপের কথা বলে সে রাতে না খেয়ে সন্ধ্যার পর পরই শুয়ে পড়লেন বাবা।
-তোরা বেশী হট্টগোল করিসনে আজ রাতে, তোর বাবার শরীরটা বোধহয় খারাপ।
আমাদের খাবার শেষ হলে মা সবাইকে সাবধান করলেন।

আমি বাবার পাচ সন্তানের বড়, তাই বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা অন্য ভাই বোনের তুলনাই একটু বেশী ঘনিষ্ঠ। বড় সন্তানের উপর বাবারা বোধহয় বেশী ভরসা করে। সেভাবেই অন্যান্যদের থেকে বাবাকে আমি একটু বেশীই চিনতাম।
খাওয়া দাওয়া শেষে সব ভাই বোনেরা নিজ নিজ ঘরে চলে গেলে মাকে বললাম বাবার খাবারটা দিতে আমি সেটা বাবার রুমে নিয়ে যাব বলে বললাম।
-তোর অত ব্যাস্ত হওয়ার দরকার নেই, তুই তোর ঘরে যা, একটু বাদে আমি খাওয়ার সময় তোর বাবাকে ডাকব।
-না মা, তুমি ডাকলেও বাবা আজ রাতে খাবে না।
আমার কথাই মা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন।
বাবা কেন আজকে আমার রেজাল্ট বেরনোর দিন সবার সাথে এসে আনন্দে সামিল হলেন না, আর কেনই বা সবার সাথে বসে মায়ের স্পেশাল রান্না খেলেন না, সেটা আমি ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে না।
আমি ফার্স্ট ক্লাস পেলে বাবা তার গিফটের প্রমিসটা সবার সামনে না, আমাকে একা ডেকে আলাদা করে বলেছিলেন।
সন্তান যতই বড় হোক না কেন সব বাবারাই তাদেরকে সব বয়েসেই ছোট ভাবে। বাবা মায়ের কাছে সন্তান কখনো বড় হয় না।
-আমার এটা শেষ পরীক্ষা তাই এ রেজাল্টটা আমার জীবনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা যেন আমি অনুধাবন করতে ভুল না করি সে জন্যই বাবা আমাকে একাকী ডেকে ওই প্রমিসটা করে তার চোখে ছোট্ট ছেলেকে তার জীবনের শেষ গুরুত্বপূর্ণ ধাপটা পার হওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাতে ওই প্রমিসটা করেছিলেন। যদিও তিনি জানতেন যে ওই প্রমিসটা রাখার জন্য আর্থিক সঙ্গতি তার নেই।
-ছেলেকে তার জীবনের শেষ ধাপটা পার করে দেয়াই বাবার প্রধান লক্ষ্য, তার পর তার নিজের কি হবে সেটা কোন গুরুত্ব তার কাছে ছিল না।
আমি খাবার ট্রেটা হাতে নিয়ে বাবার ঘরে ঢুকে সেটা টেবিলের উপর নামিয়ে রাখলাম। পরিষ্কার বুঝলাম বাবা জেগে আছেন। আর তিনি যেন জানতেন আমি যাব তার ঘরে।
বাবা, বলে আস্তে করে ডাকতেই তিনি বিছানা থেকে উঠে বসলেন। খাট থেকে নেমে আমাকে তার বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। তার দু চোখ বয়ে আনন্দাশ্রু বাধ ভাঙ্গল। বাবা আমাকে খাটে তার পাশে বসিয়ে একদম ছোট্ট বাচ্চা ছেলের মত আমার মুখে গালে মাথায় হাতে পিঠে পাগলের মত হাত বুলিয়ে আদর করেছিলেন সেদিন।
এর মধ্যে মা কখন দরজায় নীরবে এসে দাড়িয়েছিলেন সেটা কারো চোখে পড়েনি। সেদিকে নজর পড়তেই বাবা যেন লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি আমাকে তার আলিঙ্গন মুক্ত করে দিয়েছিলেন।

পাচ হাজার টাকা ভরা খামটা অসহায় বাবাকে দেয়ার মনস্ত করলাম। ভাবলাম স্ত্রীকে এত সব না বলে পিয়নকে আমার থেকে সে টাকা দিয়ে দেব।

আমরা দুজন দুজনের চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অতি যত্ন সহকারে একান্ত আপনজনের মত করে টাকা ভরা খামটা বিনা দ্বিধায় ওই অচেনা বাবার দিকে এগিয়ে ধরলাম।
সেভাবেই আমার চোখে চোখ রেখেই তিনি কৃতজ্ঞতা ভরা চিত্তে খামটা গ্রহণ করলেন।
খামটা দেয়া নেয়ার সময় আমরা কেউই খামের দিকে নয় একজন আরেকজনের চোখে চোখে তাকিয়ে রইলাম।
-আমি তোমার অফিসে আসবো, বাবা।
খামটা গ্রহন করে কথাটা বলে প্রসন্ন চিত্তে তিনি তার গন্তব্যের বাসে উঠে চলে গেলেন।
বাসটা যতক্ষণ দেখা যায় ততোক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
-স্যার টায়ার পাল্টিয়েছি, বাসে না যেয়ে গাড়ীতে আসুন।
বাকি পথ গাড়ীতে করে অফিসে আসলাম। আমার সারা শরীর মন এক অজানা তৃপ্তির স্বাদে ভরপুর হয়ে রইল।
সেদিন গাড়ীটা সারতে কতক্ষণ লেগেছিল বা আমি কতক্ষণ বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করেছিলাম তার কিছুই বলতে পারব না।
-ওই অচেনা বাবাকে টাকার খামটা দিতে পেরে আমার খুব হালকা বোধ হয়েছিল সেদিন। আর ওই অচেনা বাবার দেহ ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল খামটা যেন তিনি কোন আপন জনের কাছ থেকে গ্রহন করছে।
-খামটা নিয়ে তিনি চলে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল –বহু বছর আগে আমার বাবা আমাকে তার প্রমিস করা গিফট না দিতে পেরে তাঁর মনে যে অতৃপ্ততা ভর করেছিল সেটা পুরোপুরি দূর হয়ে গেল।

-ওই অচেনা বাবা আমার অফিসে আসবে বলে বলল। তিনি কি সত্যিই আসবেন কোন দিন! আর কেনই বা আসবেন তিনি!
ভাবনাটা আমাকে ঘিরে রাখল।