Heading
আপডেট: ১৫ Jun ২০২২, ১৩:২০
তার আসল নামটা যে কি তা সঠিক করে বলতে পারবো না। বাবা তাকে মোম বলে ডাকতো আর সে ভাবেই অন্যান্যরা সবাই কেউ মোমভাই কেউ মোমচাচা, ইত্যদি বলে ডাকতো। আমরা তাকে মোমদা বলে সম্বোধন করতাম।
ছোট খাট পাতলা শরীর। উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশ নিচে। একটু লম্বাটে মুখোমন্ডল, চোয়াল দুটো ভিতরের দিকে বসানো। ছোট ছোট মার্বেলের মত দুটো চোখ, তার মধ্যখানে সরু একটা নাক। ছোট্ট চিবুক তার উপর একগুচ্ছো ছাগলে দাড়ি।
ছোট বেলা থেকেই দেখেছি তাকে আমাদের বাড়ীতে। প্রকৃত অর্থে কাজের লোক বলতে যা বুঝায় তেমন নয়, বলা যাই পরিবারের একজন সদস্য।
প্রায় দশ একর জমি নিয়ে আমাদের ভিটা বাড়ি। বসত বাড়িটা বাদে বাকি জাইগা জুড়ে বিরাট বাগান আর সেখানে মোটামুটি নাম জানা সব ধরনের ফলের গাছ। মোমদার অন্যতম একটা দায়িত্ব ছিল সঠিক সময়ে বিভিন্ন ফল যেমন আম, কলা, কাঠাল, নারিকেল, তাল ইত্যাদি গাছ থেকে পেড়ে ঘরে রেখে দেয়া। তারপর সময় হলে সেগুলো বাড়ীর সবাইকে সহ আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা।
সে বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত, যেমন কখন কি ফল পাড়তে হবে, কত দিন সেগুলি ঘরে রাখতে হবে, কাকে কাকে কতটা দিতে হবে ইত্যাদি ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণভাবে মোমদার আওতাধীন ছিল।
ফলফলাদি গাছ থেকে পাড়ার পর সেগুলো সে জানালাবিহীন টিনের দোচালা একটা বেড়ার ঘরে রাখতো। ঐ ঘরটাতেই সে রাতে ঘুমাতো। বাইরে কোথাও গেলে ঘরের দরজাটা একটা মোটা তার দিয়ে বেধে তালা লাগিয়ে রাখতো। তার অনুপস্থিতিতে কেউ কখনো ঐ ঘরটাতে ঢুকতো না।
অনেক রুপকথার গল্প জানতো মোমদা। এ ধরনের কাল্পনিক রাজরাজার বা রাক্ষস খোক্ষকের গল্প তার খুব প্রিয় ছিল। আমাদেরকে এসব গল্প বলার সময় নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গি করে, অনেক সময় যাত্রা গানের অভিনেতাদের মত পোশাক পরে আমাদেরকে গল্প শোনাতো। এ ধরনের গল্পের আসর বসতো গোপনে অর্থাৎ বড়দের অনুপস্থিতিতে।
কেন জানি বড়দের সান্নিধ্য বরাবরই অপছন্দনীয় ছিল মোমদার। সে বলতো -বড়রা তার গল্প বুঝবে না। ওরা সব হিসেবী, আর হিসেব কখনো কেউ মিলাতে পেরেছে? বলতো- ওরা বেশী হিসেবি, যাদু বুঝবে না। জংগলের গাছপালা, ফল, ফুল,পাখী, বানর, খরগোস আর আমাদের নিয়েই ছিল তার আলাদা এক রূপকথার জগত।
বড় বলতে যাদেরকে বুঝাই তাদের মধ্যে কেবল বাবার সাথেই তার কথা হত। কথা বলতো মেপে মেপে মাথা নিচু করে।
কারো পারিবারিক সুখ দুঃখের কথা, শরীর খারাপের কথা বা দেশ বা সমাজের কোন ভালো খারাপ কথায় সে কখনো মনোযোগ দিত না। এ ধরনের আলোচনা অসহ্য লাগে মোমদার কাছে। সে বলত – এগুলো সব অযথা ঝামেলা, চোখ বুঝলেই সব শান্তি এ সব ঝামেলা থেকে মুক্তি।
বাবার উপস্থিতিতে ও সবসময়ই আমাদের সাথে গাম্ভীর্য বজায় রেখে কথা বলে মোমদা। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে সে হয়ে উঠত এক অন্য এক মানুষ, যেন অন্য এক মোমদা। আমরা কেউ বা তার কোলে আর কেউ বা কাঁধে। মাঝ বয়স পার করা গড়নে ছোট খাটো এই মানূষটার কাধে খুব সহজেই লাফ দিয়ে উঠা যায়।
তার দোচালা ঘরটার পিছনে অর্থাৎ জংগলের দিকে পাটি বিছিয়ে পড়ন্ত বেলায় মোমদা তার বিভিন্ন ফলের সম্ভার দিয়ে আমাদের আপ্যায়নে মেতে উঠতো।
কেউ বা আব্দার করলো পাকা কাঁঠাল খাবে। মোমদা খোজ নিয়ে দেখলো ঘরের কাঁঠাল একটাও পাকেনি। এখন কি করা যায়। আমাদের চাওয়া কোন কিছু মোমদা দিতে পারবে না এটা তার বা আমাদের কারো অভিধানেই যেন ছিল না।
মোমদা কিছুক্ষনের জন্য কি একটা ভাবলো, মনে মনে কিছু একটা হিসাব করে দা’টা হাতে তাকে অনুসরন করার জন্য ইশারা করে পা বাড়ালো। জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে এক জায়গায় থামলো। তার পর হাতের দা’টা দিয়ে মাটি খুড়ে আস্ত এক পাকা কাঁঠাল বের করে আনলো। আমাদের কি আনন্দ তখন। এক যাদুকরী কাজ করার গৌরবে মোমদার চোখেও সাফল্যের জ্যোতি ঝলমল করে উঠতো।
একবারের ঘটনা। আমরা বায়না ধরলাম গাছ থেকে পাকা তাল পেড়ে আমাদের খাওয়ানোর জন্য। মোমদা একটু মুশকিলেই পড়লো বলে মনে হলো। কারণ সে তাল গাছে উঠতে পারতো না। কিন্তু ব্যাপারটা যেমনি সেও মানতে পারলো না তেমনি আমরাও না। কারণ আমাদের ঐ ছোট্ট পৃথিবীতে মোমদা ছিল এক রুপকথার যাদুকর। আর সেও তার বিভিন্ন করিতকর্ম দেখাতে দেখাতে নিজের কাছেও হয়ে উঠেছিল এক অপ্রতিদ্বন্দী যাদুকর।
বেশ কিছুক্ষন কি যেন একটা চিন্তা ভাবনা করে বললো -ঠিক আছে তবে দু তিন দিন পর ও আমাদেরকে বলবে।
কয়েক দিন পর সে বললো- তোরা সব চুপি চুপি ঠিক দুপুরের সময় সবাই যখন ঘরে বিশ্রাম নেয় তখন জংগলের মধ্যে তাল গাছটার কাছে চলে আসবি।
যেমনি বলা তেমনি কাজ। আমরা সবাই সময় মত হাজির। মোমদা বিজয়ের হাসি ভরা কণ্ঠে বললো- চল আমি তোদেরকে যাদু দিয়ে তাল পেড়ে খাওয়াবো।
আমরা সবাই অবাক হয়ে পলকহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মোমদা আমাদের কাছে রূপকথার এক বিশ্বজয়ী নায়ক হয়ে উঠলো।
-তোরা চুপ করে বস।
কথাটা বলে সে তার থলের ভিতর থেকে বের করে একটা তালি লাগানো হাটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা জামা পরলো। তারপর থলের ভিতর থেকে একটা লাঠি বের করে সেটা তাল গাছটির দিকে লক্ষ করে বিড়বিড় করে চোখ মুখ ঘুরিয়ে মন্ত্রের মত করে কি যেন পড়তে লাগলো।
সে যেন সাক্ষাৎ রূপকথার নায়ক হয়ে উঠলো আমাদের চোখে। লাঠিটা তালগাছের দিকে নির্দেশ করে তিনটা শিষ দিল আর অমনি ধপ ধপ করে তিনটে তাল পড়লো। আমরা বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
মোমদার নিজের বলতে ওর বউ আর দশ এগার বছরের একটা মেয়ে। পাশের অন্য এক গ্রামে থাকতো ওরা। ওদেরকে কখনো দেখিনি তবে মাঝে মধ্যেই বাবাকে বকাবকি করতে শুনতাম- মোম তোর মেয়ে বউকে দেখতে যাসনে কেন, ওদের খোজ খবর কি রাখিস?
মোমদা হাতের কাজ করতে করতেই অনেকটা স্বগত স্বরে জবাব দিত- ঐ এক ঝামেলা। বাবা রাগ করে বলতেন- তোর বউ মেয়ে তোর কাছে ঝামেলা?
চাপা স্বরে গজ গজ করতে করতে মোমদা জবাব দিত -ঝামেলা ছাড়া কি, আর আমিতো প্রতি মাসেই দরকারি সব পাঠিয়ে দিই।
তার নিজের পরিবার তার কাছে ঝামেলা। আর অন্য যে জিনিসটাকে সে ঝামেলা বলতো সেটা তার শরীর। মোমদা আমাদের সাথে দৌড়ে পারতো না একটুতেই হাপিয়ে যেত, বুকের বা পাশটাতে ব্যাথা করতো। তখন সে খুব বিরক্তির সাথে বলতো- এই শরীরটায় আমার বড় ঝামেলা।
সারাক্ষণ সে প্রায় আমাদের সাথেই থাকতো। স্কুল থেকে কোন কারণে ফিরতে একটু দেরী হলে মোমদা খুব অস্থির হয়ে উঠতো। তার অস্থিরতা চরমে উঠতো স্কুল ছুটি থাকলে যদি আমরা কোথাও বেড়াতে যেতাম তখন।
মোমদার বুকের ব্যাথাটা একবার খুব বেড়ে গেল। বাবা তার বাইরে বেরুনো একদম নিষেধ করে দিলেন। মোমদা আমাদেরকে ডেকে চুপে চুপে বললো- ও কিছু না, তোদের বাবা খামাকা বেশী করে বলছে।
বাবা বাইরে বেরুলেই মোমদা আমাদেরকে নিয়ে বাগানে বেরিয়ে পড়তো। কিন্তু সে আগের মত আর অত হাটতে পারতো না, বুকে হাত দিয়ে বসে পড়তো একটুতেই। সারা কপালে ঘাম জমে যেত। একটু জিড়িয়ে নিয়েই জোর করে হেসে বলতো- আরে ভয় নেই আমি যাদু দিয়ে সব ঠিক করে দেব।
যখন আমরা জিজ্ঞেস করতাম- যাদু কোথা থেকে শিখেছে সে। মিচ মিচ করে হসতো মোমদা। আর বলতো- আমার যদি ঝামেলাটুকু না থাকতো তবে অনেক বড় যাদুকর হতে পারতাম।
মোমদার বুকের ব্যথাটা বাড়তেই থাকলো। আমরা আবদার করলাম- মোমদা যাদু করে তোমার এই ঝামেলাটা তাড়াওনা, না হলে তোমার সাথে আজকাল ঠিক মত খেলাই যায় না।
তাকে একটু চিন্তাগ্রস্ত দেখালো।
বুকের ব্যথাটা ক্রমেই বেড়ে চললো। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেল আর বাইরে বেরুনো একেবারে নিষেধ করে দিল। সব কিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। মোমদার শরীরটা সত্যিই একটা ঝামেলা হয়ে দাড়ালো আমাদের কাছেও।
বাবা সবাইকে ডেকে মোমদাকে কোন রকম বিরক্ত করতে নিষেধ করলেন।
কয়েকদিন পর কাঁদতে কাঁদতে তার বউ আর মেয়েটা আসলো। আমরা সবাই তার ঘরে গেলাম। মোমদার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তার বউটা কাঁদছে আর মোমদা অসহায়ের মত শুয়ে আছে।
এ অবস্থায় মোমদাকে একদম অপরিচিত লাগলো। মোমদা তার মেয়েটাকে কাছে ডেকে একটু আদর করতেই তার চোখের ধার গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। আমার চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো সে একটু লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছার চেষ্টা করলো মোমদা।
মোমদা কাদছে! দৃশ্যটা আমার একদম ভাল লাগলো না। আমি নিশব্দে বেরিয়ে এলাম।
হাটতে হাটতে বাড়ীর সাথে লাগোয়া জংগলটার মধ্যে ঢুকলাম। এখানে সাধারণত বাড়ীর অন্য কেউ আসে না। এই জংগলটার ভিতর একটা জায়গা পরিস্কার করা, এখানেই মোমদা আমাদেরকে নিয়ে বসে সব রূপকথার গল্প শোনাতো আর চোখ ধাঁধানো যাদু দেখাতো। এখানে মাটি জড় করে উঁচু একটা জায়গা বানানো, যেখানে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মোমদা বসতো। এখানে বসলে মোমদাকে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ মনে হতো। মনে মনে ভাবতাম একদিন মোমদার মত যাদুকর হতেই হবে।
তাকে একদিন বলেছিলাম – বউ আর মেয়েও যখন তোমার ঝামেলা তখন যাদু করে সেটা ঠিক করো না কেন। সে কি যেন একটা চিন্তা করলো তারপর বললো- নাহ সেটা সম্ভব না কারণ ওদের উপর যাদু দিলে তা তার নিজের বুকে এসে আঘাত করবে।
জাইগাটাতে বসে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হটাৎ করে মোমদার বসার জায়গাটাতে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলাম, দেখলাম একটা ছোট সাপ ওখনে শুয়ে আছে।
মোমদা একদিন বলেছিলো- ও যেদিন পুরোপুরি যাদুকর হবে সেদিন ওর মাথার উপর সাপ এসে বসবে। মনে খুব জোর ফিরে পেলাম যে মোমদা নিশ্চয় পুরোপুরি যাদুকর হয়ে গেছে, সে নিশ্চয় তার বর্তমান ঝামেলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষ্যা করতে পারবে।
কতক্ষন এভাবে বসে ছিলাম জানি না। তবে বুঝতে পারলাম বেলা গড়িয়ে অন্ধকার নেমেছে। ধীর পায়ে বাড়ীর ভিতর গেলাম।
কেউ কোথাও নেই। মোমদার ঘরটাও চুপচাপ। এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বেড়ার দরজাটা ঠেলে মোমদার ঘরে ঢুকলাম। সে জেগেই ছিল। আমাকে দেখে বললো- এতক্ষন কোথায় ছিলি, কি ঘাবড়ে গিয়েছিস?
আমি কোন জবাব না দিয়ে অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই মনে হচ্ছিলো যেন একজন পাকা যাদুকরকে দেখছি, যে তার যাদুর পরোশে সব ঝামেলা মিটিয়ে দেবে।
– তুমিতো পুরোপুরি যাদুকর হয়ে গিয়েছো।
কথা শুনে একটু অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি তার বসার স্থানে সাপ বসে থাকার কথাটা বললাম। ও কেমন যেন একটু উদাস হয়ে গেল। জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
ততোক্ষনে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। মোমদা আমার সাথে কথা বলতে বলতে ওর যাদুর ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিল। তারপর ওর হাতটা আমার কাধে রেখে বললো- যাদু করে সব ঝামেলা শেষ করতেই হবে, কি বলিস?
তার কথা ঠিক বুঝলাম না, তবে নীরবে ঘাড় নাড়লাম। সে আমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো। পিছন ফিরে অন্ধকারে নিমজ্জিত বাড়ীটার দিকে তাকালো কিছুক্ষণ। টুকটাক আওয়াজ, কথার শব্দ, হাসির রোল শোনা গেল বাড়ীর ভিতর থেকে। সে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে নিয়ে ঐ জংগলটার ভিতর ঢুকলো। আমাদের বসার জায়গাটায় দাড়ালো। তার দুটো হাত আমার ঘাড়ের উপর রেখে অন্ধকারের মধ্যে খুব ভালো করে আমার মুখের রেখাগুলো দেখার চেষ্টা করলো।
মোমদা তার মুখটা আমার মুখের একদম কাছে নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বললো- আমি যাচ্ছি, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
তারপর বিড় বিড় করে বললো- আমার এসব কিছু ভাল লাগেনা, ঝামেলা শেষ করা দরকার। তার গলাটা ধরে আসলো, তবে অন্ধকার থাকায় মুখটা ঠিকমত দেখতে পেলাম না।
জংগলটা ঠেলতে ঠেলতে অন্ধকারের মধ্যেই সে চলে গেল।
জংগলটা পার হলেই রেল লাইন, দুর থেকে আসা একটা রেলের শব্দ ভেষে এলো।
আর ফিরলো না মোমদাদা।
তার আসল নামটা যে কি তা সঠিক করে বলতে পারবো না। বাবা তাকে মোম বলে ডাকতো আর সে ভাবেই অন্যান্যরা সবাই কেউ মোমভাই কেউ মোমচাচা, ইত্যদি বলে ডাকতো। আমরা তাকে মোমদা বলে সম্বোধন করতাম।
ছোট খাট পাতলা শরীর। উচ্চতা পাঁচ ফুটের বেশ নিচে। একটু লম্বাটে মুখোমন্ডল, চোয়াল দুটো ভিতরের দিকে বসানো। ছোট ছোট মার্বেলের মত দুটো চোখ, তার মধ্যখানে সরু একটা নাক। ছোট্ট চিবুক তার উপর একগুচ্ছো ছাগলে দাড়ি।
ছোট বেলা থেকেই দেখেছি তাকে আমাদের বাড়ীতে। প্রকৃত অর্থে কাজের লোক বলতে যা বুঝায় তেমন নয়, বলা যাই পরিবারের একজন সদস্য।
প্রায় দশ একর জমি নিয়ে আমাদের ভিটা বাড়ি। বসত বাড়িটা বাদে বাকি জাইগা জুড়ে বিরাট বাগান আর সেখানে মোটামুটি নাম জানা সব ধরনের ফলের গাছ। মোমদার অন্যতম একটা দায়িত্ব ছিল সঠিক সময়ে বিভিন্ন ফল যেমন আম, কলা, কাঠাল, নারিকেল, তাল ইত্যাদি গাছ থেকে পেড়ে ঘরে রেখে দেয়া। তারপর সময় হলে সেগুলো বাড়ীর সবাইকে সহ আত্মীয় স্বজন আর প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা।
সে বিষয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত, যেমন কখন কি ফল পাড়তে হবে, কত দিন সেগুলি ঘরে রাখতে হবে, কাকে কাকে কতটা দিতে হবে ইত্যাদি ব্যাপারগুলো সম্পূর্ণভাবে মোমদার আওতাধীন ছিল।
ফলফলাদি গাছ থেকে পাড়ার পর সেগুলো সে জানালাবিহীন টিনের দোচালা একটা বেড়ার ঘরে রাখতো। ঐ ঘরটাতেই সে রাতে ঘুমাতো। বাইরে কোথাও গেলে ঘরের দরজাটা একটা মোটা তার দিয়ে বেধে তালা লাগিয়ে রাখতো। তার অনুপস্থিতিতে কেউ কখনো ঐ ঘরটাতে ঢুকতো না।
অনেক রুপকথার গল্প জানতো মোমদা। এ ধরনের কাল্পনিক রাজরাজার বা রাক্ষস খোক্ষকের গল্প তার খুব প্রিয় ছিল। আমাদেরকে এসব গল্প বলার সময় নানা রকম অঙ্গ ভঙ্গি করে, অনেক সময় যাত্রা গানের অভিনেতাদের মত পোশাক পরে আমাদেরকে গল্প শোনাতো। এ ধরনের গল্পের আসর বসতো গোপনে অর্থাৎ বড়দের অনুপস্থিতিতে।
কেন জানি বড়দের সান্নিধ্য বরাবরই অপছন্দনীয় ছিল মোমদার। সে বলতো -বড়রা তার গল্প বুঝবে না। ওরা সব হিসেবী, আর হিসেব কখনো কেউ মিলাতে পেরেছে? বলতো- ওরা বেশী হিসেবি, যাদু বুঝবে না। জংগলের গাছপালা, ফল, ফুল,পাখী, বানর, খরগোস আর আমাদের নিয়েই ছিল তার আলাদা এক রূপকথার জগত।
বড় বলতে যাদেরকে বুঝাই তাদের মধ্যে কেবল বাবার সাথেই তার কথা হত। কথা বলতো মেপে মেপে মাথা নিচু করে।
কারো পারিবারিক সুখ দুঃখের কথা, শরীর খারাপের কথা বা দেশ বা সমাজের কোন ভালো খারাপ কথায় সে কখনো মনোযোগ দিত না। এ ধরনের আলোচনা অসহ্য লাগে মোমদার কাছে। সে বলত – এগুলো সব অযথা ঝামেলা, চোখ বুঝলেই সব শান্তি এ সব ঝামেলা থেকে মুক্তি।
বাবার উপস্থিতিতে ও সবসময়ই আমাদের সাথে গাম্ভীর্য বজায় রেখে কথা বলে মোমদা। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে সে হয়ে উঠত এক অন্য এক মানুষ, যেন অন্য এক মোমদা। আমরা কেউ বা তার কোলে আর কেউ বা কাঁধে। মাঝ বয়স পার করা গড়নে ছোট খাটো এই মানূষটার কাধে খুব সহজেই লাফ দিয়ে উঠা যায়।
তার দোচালা ঘরটার পিছনে অর্থাৎ জংগলের দিকে পাটি বিছিয়ে পড়ন্ত বেলায় মোমদা তার বিভিন্ন ফলের সম্ভার দিয়ে আমাদের আপ্যায়নে মেতে উঠতো।
কেউ বা আব্দার করলো পাকা কাঁঠাল খাবে। মোমদা খোজ নিয়ে দেখলো ঘরের কাঁঠাল একটাও পাকেনি। এখন কি করা যায়। আমাদের চাওয়া কোন কিছু মোমদা দিতে পারবে না এটা তার বা আমাদের কারো অভিধানেই যেন ছিল না।
মোমদা কিছুক্ষনের জন্য কি একটা ভাবলো, মনে মনে কিছু একটা হিসাব করে দা’টা হাতে তাকে অনুসরন করার জন্য ইশারা করে পা বাড়ালো। জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে এক জায়গায় থামলো। তার পর হাতের দা’টা দিয়ে মাটি খুড়ে আস্ত এক পাকা কাঁঠাল বের করে আনলো। আমাদের কি আনন্দ তখন। এক যাদুকরী কাজ করার গৌরবে মোমদার চোখেও সাফল্যের জ্যোতি ঝলমল করে উঠতো।
একবারের ঘটনা। আমরা বায়না ধরলাম গাছ থেকে পাকা তাল পেড়ে আমাদের খাওয়ানোর জন্য। মোমদা একটু মুশকিলেই পড়লো বলে মনে হলো। কারণ সে তাল গাছে উঠতে পারতো না। কিন্তু ব্যাপারটা যেমনি সেও মানতে পারলো না তেমনি আমরাও না। কারণ আমাদের ঐ ছোট্ট পৃথিবীতে মোমদা ছিল এক রুপকথার যাদুকর। আর সেও তার বিভিন্ন করিতকর্ম দেখাতে দেখাতে নিজের কাছেও হয়ে উঠেছিল এক অপ্রতিদ্বন্দী যাদুকর।
বেশ কিছুক্ষন কি যেন একটা চিন্তা ভাবনা করে বললো -ঠিক আছে তবে দু তিন দিন পর ও আমাদেরকে বলবে।
কয়েক দিন পর সে বললো- তোরা সব চুপি চুপি ঠিক দুপুরের সময় সবাই যখন ঘরে বিশ্রাম নেয় তখন জংগলের মধ্যে তাল গাছটার কাছে চলে আসবি।
যেমনি বলা তেমনি কাজ। আমরা সবাই সময় মত হাজির। মোমদা বিজয়ের হাসি ভরা কণ্ঠে বললো- চল আমি তোদেরকে যাদু দিয়ে তাল পেড়ে খাওয়াবো।
আমরা সবাই অবাক হয়ে পলকহীন চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মোমদা আমাদের কাছে রূপকথার এক বিশ্বজয়ী নায়ক হয়ে উঠলো।
-তোরা চুপ করে বস।
কথাটা বলে সে তার থলের ভিতর থেকে বের করে একটা তালি লাগানো হাটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা জামা পরলো। তারপর থলের ভিতর থেকে একটা লাঠি বের করে সেটা তাল গাছটির দিকে লক্ষ করে বিড়বিড় করে চোখ মুখ ঘুরিয়ে মন্ত্রের মত করে কি যেন পড়তে লাগলো।
সে যেন সাক্ষাৎ রূপকথার নায়ক হয়ে উঠলো আমাদের চোখে। লাঠিটা তালগাছের দিকে নির্দেশ করে তিনটা শিষ দিল আর অমনি ধপ ধপ করে তিনটে তাল পড়লো। আমরা বাকরূদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
মোমদার নিজের বলতে ওর বউ আর দশ এগার বছরের একটা মেয়ে। পাশের অন্য এক গ্রামে থাকতো ওরা। ওদেরকে কখনো দেখিনি তবে মাঝে মধ্যেই বাবাকে বকাবকি করতে শুনতাম- মোম তোর মেয়ে বউকে দেখতে যাসনে কেন, ওদের খোজ খবর কি রাখিস?
মোমদা হাতের কাজ করতে করতেই অনেকটা স্বগত স্বরে জবাব দিত- ঐ এক ঝামেলা। বাবা রাগ করে বলতেন- তোর বউ মেয়ে তোর কাছে ঝামেলা?
চাপা স্বরে গজ গজ করতে করতে মোমদা জবাব দিত -ঝামেলা ছাড়া কি, আর আমিতো প্রতি মাসেই দরকারি সব পাঠিয়ে দিই।
তার নিজের পরিবার তার কাছে ঝামেলা। আর অন্য যে জিনিসটাকে সে ঝামেলা বলতো সেটা তার শরীর। মোমদা আমাদের সাথে দৌড়ে পারতো না একটুতেই হাপিয়ে যেত, বুকের বা পাশটাতে ব্যাথা করতো। তখন সে খুব বিরক্তির সাথে বলতো- এই শরীরটায় আমার বড় ঝামেলা।
সারাক্ষণ সে প্রায় আমাদের সাথেই থাকতো। স্কুল থেকে কোন কারণে ফিরতে একটু দেরী হলে মোমদা খুব অস্থির হয়ে উঠতো। তার অস্থিরতা চরমে উঠতো স্কুল ছুটি থাকলে যদি আমরা কোথাও বেড়াতে যেতাম তখন।
মোমদার বুকের ব্যাথাটা একবার খুব বেড়ে গেল। বাবা তার বাইরে বেরুনো একদম নিষেধ করে দিলেন। মোমদা আমাদেরকে ডেকে চুপে চুপে বললো- ও কিছু না, তোদের বাবা খামাকা বেশী করে বলছে।
বাবা বাইরে বেরুলেই মোমদা আমাদেরকে নিয়ে বাগানে বেরিয়ে পড়তো। কিন্তু সে আগের মত আর অত হাটতে পারতো না, বুকে হাত দিয়ে বসে পড়তো একটুতেই। সারা কপালে ঘাম জমে যেত। একটু জিড়িয়ে নিয়েই জোর করে হেসে বলতো- আরে ভয় নেই আমি যাদু দিয়ে সব ঠিক করে দেব।
যখন আমরা জিজ্ঞেস করতাম- যাদু কোথা থেকে শিখেছে সে। মিচ মিচ করে হসতো মোমদা। আর বলতো- আমার যদি ঝামেলাটুকু না থাকতো তবে অনেক বড় যাদুকর হতে পারতাম।
মোমদার বুকের ব্যথাটা বাড়তেই থাকলো। আমরা আবদার করলাম- মোমদা যাদু করে তোমার এই ঝামেলাটা তাড়াওনা, না হলে তোমার সাথে আজকাল ঠিক মত খেলাই যায় না।
তাকে একটু চিন্তাগ্রস্ত দেখালো।
বুকের ব্যথাটা ক্রমেই বেড়ে চললো। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেল আর বাইরে বেরুনো একেবারে নিষেধ করে দিল। সব কিছুই কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। মোমদার শরীরটা সত্যিই একটা ঝামেলা হয়ে দাড়ালো আমাদের কাছেও।
বাবা সবাইকে ডেকে মোমদাকে কোন রকম বিরক্ত করতে নিষেধ করলেন।
কয়েকদিন পর কাঁদতে কাঁদতে তার বউ আর মেয়েটা আসলো। আমরা সবাই তার ঘরে গেলাম। মোমদার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে তার বউটা কাঁদছে আর মোমদা অসহায়ের মত শুয়ে আছে।
এ অবস্থায় মোমদাকে একদম অপরিচিত লাগলো। মোমদা তার মেয়েটাকে কাছে ডেকে একটু আদর করতেই তার চোখের ধার গড়িয়ে পানি পড়তে লাগলো। আমার চোখে চোখ পড়তেই মনে হলো সে একটু লজ্জা পেল। তাড়াতাড়ি চোখ মুছার চেষ্টা করলো মোমদা।
মোমদা কাদছে! দৃশ্যটা আমার একদম ভাল লাগলো না। আমি নিশব্দে বেরিয়ে এলাম।
হাটতে হাটতে বাড়ীর সাথে লাগোয়া জংগলটার মধ্যে ঢুকলাম। এখানে সাধারণত বাড়ীর অন্য কেউ আসে না। এই জংগলটার ভিতর একটা জায়গা পরিস্কার করা, এখানেই মোমদা আমাদেরকে নিয়ে বসে সব রূপকথার গল্প শোনাতো আর চোখ ধাঁধানো যাদু দেখাতো। এখানে মাটি জড় করে উঁচু একটা জায়গা বানানো, যেখানে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় মোমদা বসতো। এখানে বসলে মোমদাকে সম্পূর্ণ অন্য এক মানুষ মনে হতো। মনে মনে ভাবতাম একদিন মোমদার মত যাদুকর হতেই হবে।
তাকে একদিন বলেছিলাম – বউ আর মেয়েও যখন তোমার ঝামেলা তখন যাদু করে সেটা ঠিক করো না কেন। সে কি যেন একটা চিন্তা করলো তারপর বললো- নাহ সেটা সম্ভব না কারণ ওদের উপর যাদু দিলে তা তার নিজের বুকে এসে আঘাত করবে।
জাইগাটাতে বসে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম। হটাৎ করে মোমদার বসার জায়গাটাতে নজর পড়তেই আঁতকে উঠলাম, দেখলাম একটা ছোট সাপ ওখনে শুয়ে আছে।
মোমদা একদিন বলেছিলো- ও যেদিন পুরোপুরি যাদুকর হবে সেদিন ওর মাথার উপর সাপ এসে বসবে। মনে খুব জোর ফিরে পেলাম যে মোমদা নিশ্চয় পুরোপুরি যাদুকর হয়ে গেছে, সে নিশ্চয় তার বর্তমান ঝামেলার হাত থেকে নিজেকে রক্ষ্যা করতে পারবে।
কতক্ষন এভাবে বসে ছিলাম জানি না। তবে বুঝতে পারলাম বেলা গড়িয়ে অন্ধকার নেমেছে। ধীর পায়ে বাড়ীর ভিতর গেলাম।
কেউ কোথাও নেই। মোমদার ঘরটাও চুপচাপ। এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বেড়ার দরজাটা ঠেলে মোমদার ঘরে ঢুকলাম। সে জেগেই ছিল। আমাকে দেখে বললো- এতক্ষন কোথায় ছিলি, কি ঘাবড়ে গিয়েছিস?
আমি কোন জবাব না দিয়ে অপলক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই মনে হচ্ছিলো যেন একজন পাকা যাদুকরকে দেখছি, যে তার যাদুর পরোশে সব ঝামেলা মিটিয়ে দেবে।
– তুমিতো পুরোপুরি যাদুকর হয়ে গিয়েছো।
কথা শুনে একটু অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। আমি তার বসার স্থানে সাপ বসে থাকার কথাটা বললাম। ও কেমন যেন একটু উদাস হয়ে গেল। জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করলো।
ততোক্ষনে চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। মোমদা আমার সাথে কথা বলতে বলতে ওর যাদুর ব্যাগটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে নিল। তারপর ওর হাতটা আমার কাধে রেখে বললো- যাদু করে সব ঝামেলা শেষ করতেই হবে, কি বলিস?
তার কথা ঠিক বুঝলাম না, তবে নীরবে ঘাড় নাড়লাম। সে আমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো। পিছন ফিরে অন্ধকারে নিমজ্জিত বাড়ীটার দিকে তাকালো কিছুক্ষণ। টুকটাক আওয়াজ, কথার শব্দ, হাসির রোল শোনা গেল বাড়ীর ভিতর থেকে। সে একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে আমাকে নিয়ে ঐ জংগলটার ভিতর ঢুকলো। আমাদের বসার জায়গাটায় দাড়ালো। তার দুটো হাত আমার ঘাড়ের উপর রেখে অন্ধকারের মধ্যে খুব ভালো করে আমার মুখের রেখাগুলো দেখার চেষ্টা করলো।
মোমদা তার মুখটা আমার মুখের একদম কাছে নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বললো- আমি যাচ্ছি, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
তারপর বিড় বিড় করে বললো- আমার এসব কিছু ভাল লাগেনা, ঝামেলা শেষ করা দরকার। তার গলাটা ধরে আসলো, তবে অন্ধকার থাকায় মুখটা ঠিকমত দেখতে পেলাম না।
জংগলটা ঠেলতে ঠেলতে অন্ধকারের মধ্যেই সে চলে গেল।
জংগলটা পার হলেই রেল লাইন, দুর থেকে আসা একটা রেলের শব্দ ভেষে এলো।
আর ফিরলো না মোমদাদা।