Heading
আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২২, ১১:২৪
- তুমি হচ্ছো ইশ্বরের সৃষ্টির বিশেষ একজন, অবনী। তুমি সবার থেকে আলাদা। সবার যা আছে তা হয়তো তোমার নেই কিন্তু তোমার যা আছে তা অন্য সবার নেই। বিধাতা তোমাকে ওভবেই দেখতে চান।
একটু থামলেন প্রিন্সিপাল, অশীতিপর সিষ্টার রবিনসন বারোই।
-সোনা মানিক আমার, দেখুক না সে তাঁর নিজের সৃষ্টিকে যেভাবে সে চায়। সবইতো তাঁর খেয়াল। এতে তো কারো কোন হাত নেই। তাঁর খুশীই আমাদের খুশী।
একটু থেমে তিনি আবার বললেন - ইশ্বরের সৃষ্টি প্রতিটি জীব জড় তাঁর কাছে বিশেষ মুল্যবান। সবার সাথেই সৃষ্টিকর্তার বিশেষ সম্পর্ক আছে। সবার জন্যই তাঁর আলাদা আলাদা পরিকল্পনা আছে। এ বিশ্বের কোন সৃষ্টিই তুচ্ছ নয়। কোন ঘটনায় অকারণে ঘটে না।
সিষ্টার রবিনসন ওর মাথায় পিঠে স্বস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। অবনী নির্লিপ্তে ওর আদরমাখানো কণ্ঠস্বর আর কথায় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রইলো।
-সে দিতেও পারে আবার নিতেও পারে। তায় যেটা দেয়নি তা নিয়ে সব সময় চিন্তাগ্রস্থ না থেকে যেটা নেয়নি তা নিয়েও চিন্তা করা দরকার। চারিদিকে দেখো কত জনের কত কিছুই সে নিয়ে নিয়েছে। আমরা নিশ্চয় তার অতি ভালবাসার পাত্র তায়তো আমাদের কারোরি তেমন বড় কিছু নেয়নি ঈশ্বর।
স্মিত একটা হাসি তার মুখে লেগেই থাকে সব সময়। সে হাসি যেন মহান স্রষ্টার প্রতি তার সারাক্ষণ কৃতজ্ঞতার বহিপ্রকাশ। সংক্ষেপে বলা যায় স্রষ্টার সব বিধানকেই মেনে নিয়ে পথ চলার কথাই বলতো তার মুখটা।
-মানুষের ক্ষমতা কেবল ইচ্ছা পোষণ করার মধ্যেই সীমিত। ইচ্ছার শক্তি খুবই প্রবল। ইচ্ছেটা ধরে রেখে এগুলে গন্তব্যে তুমি পৌঁছাবেই।
একটু শ্বাস টেনে তিনি আবার বললেন- চলার পথে বিক্ষিপ্ত দুএকটা কাঁটা যদি পায়ে নাই বিঁধল তাহলে নিজের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিজেকে নিয়ে ভাববে কখন সোনা। বিধাতার সৃষ্টি নিয়ে যারা হাসে বা দুঃখ করে তারা প্রকৃতই অজ্ঞান, অতি সাধারণ অবুঝ তারা। দৃষ্টি সীমার ওপারে কি আছে তা কি নিশ্চিত কেউ জানে? ওদের কথায় বা মন্তব্যে সব সময় কান দিও না।
সব মানুষের জীবনেই কিছু মানুষ আসে বা কিছু ঘটনা ঘটে যা জীবনের দিক নির্দেশনার আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। সিষ্টার রবিনসনও অবনীর জীবনে এমনই একটা মানুষ।
ঐ দিন তিনি অবনীকে আরো বলেছিলেন -মনটা চঞ্চল হলে নিজের ভিতর ডুব দিও, অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে। যাদের ভেষে থাকার মত অবলম্বনের অভাব নেই ওদের জন্য অবশ্য ডুব দেয়া কষ্টকর।
একটু থেমে আবার বললেন -মন চায়লে আমার ছোট্ট আঙ্গিনায় একদিন এসো, ভালো লাগবে।
সিস্টারের বাসাটা স্কুলের পাশেই। স্কুলের পর তিনি এক অন্য মানুষ। নিজে খৃষ্টান নান হলেও এই বৃদ্ধার কাছে সব ধর্মের লোকেরই যাতায়াত।
প্রথমে ধর্মের কথাটা মনে হতেই সিস্টারের কাছে না যাওয়ার মনস্ত করেছিলো অবনী। কিন্তু সব ধর্মের আর বয়সের লোকজনের যাতায়াত দেখে একদিন বিকালে অতৃপ্ত মনের ক্ষুধা নিয়ে অবনী গেল তার ওখানে।
ভিতরটা বেশ প্রশস্ত, অনেক জায়গা। ব্যস্ত শহরের মধ্যে এমন একটা নিরিবিলি জায়গা আছে তা ভিতরে না আসলে বোঝা যায় না। এই পড়ন্ত বিকেলে অনেক শিশুরাই খেলছে, মনে হচ্ছে ছোটখাট একটা শিশু পার্ক। কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করলো না ওকে।
ছোট বড় অনেক গাছের ছায়া ঘেরা চত্তরটা। তারই ফাঁকে অনেক মানুষ বসে দাড়িয়ে গল্প করছে। খুবই অনানুষ্ঠানিক একটা পরিবেশ। কিন্তু কোন কোলাহল নেই। সবাই যেন আত্মসচেতন।
বেশ ভালো লাগলো অবনীর। বেশ কিছুক্ষন ঘুরতে ঘুরতে গোলাকৃতি একটা বড় হলঘরের কাছে পৌছালো সে। সেখানেই সিষ্টার রবিনসনের সাথে দেখা।
অবনীকে দেখে তিনি অবাক হলেন বলে মনে হলো না। ওর ঐ স্মিত হাসি ভরা মুখে স্বস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন - কতক্ষন এসেছো?
তিনি অবনীকে নিয়ে পাশেই গাছের নিচে পাতা একটা বেঞ্চে বসলেন।
-শহরের কোলাহল থেকে একটু স্বস্থির জন্য মানুষ এখানে আসে।
একটু থেমে পাশের গোলাকারাকৃতি ঘরটার দিকে নির্দেশ করে বললেন -ওটা মেডিটেশান সেণ্টার অর্থাৎ ধ্যান কেন্দ্র। না, চমকে যাওয়ার মত তেমন কিছুই না। নামটা যত বড় কিছু মনে হচ্ছে তার কিছুই নয়। ভিতরটাতে কিছুই নেই। সেদিন নিজের মধ্যে ডুব দেয়ার কথা বলেছিলাম না তোমাকে। যারা নিজের মধ্যে ডুব দিতে চায় তারাই ওখানে গিয়ে বসে। সবার কাছ থেকে পরামর্শের ভিত্তিতে সেরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি। মন চায়লে যেয়ে দেখতে পারো।
সিষ্টার রবিনসন চলে যাওয়ার পর মেডিটেশান সেণ্টারের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকল অবনী।
ভিতরে একই রকম গোলাকৃতি আরেকটি দেয়াল নজরে পড়লো। দুটো দেয়ালের মধ্যখানে তিন চার ফিট গ্যাপ বোধ হলো, দুটো মানুষ পাশাপাশি হাটার মত জায়গা। ক্ষীন আলোতে চোখে পড়ল ভিতরের দেয়ালটাতে লেখা ‘যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাহকে চিনেছে’।
লেখাটার ডানে বায়ে ইহুদী তারকা, ক্রস, ক্রিসেণ্ট, ত্রিশুল সহ সকল ধর্মের চিহ্ন অংকিত।
অবনী কিছুটা সাচ্ছন্দ বোধ করল মনে মনে।
লুমিনাস পেইণ্ট করা দুটি তীর চিহ্নের দ্বারা ডানে ও বায়ে পথ নির্দেশ করা। ডান নির্দেশক তীর চিহ্নের নিচে পুরূষ আর বায়ে নির্দেশক তীর চিহ্নের নিচে মহিলা লেখা।
ডান দিকে কিছুদুর যেতেই গোলাকৃতির কারণে প্রবেশ পথের আলোর রশ্মি ক্রমে ক্ষীন হয়ে নিশ্বেস হতেই মোমবাতির মত ক্ষীনপ্রভা নজরে পড়লো। বোঝা গেল সামনে কাঁচের দরজা। ভিতরে আলো আধারী পরিবেশ। একটু ধাক্কা দিতেই দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। ভিতরে ঢুকতেই স্প্রিং এর টানে দরজাটা ধীরে ধীরে বন্দ হয়ে গেল। পিছন ফিরতেই দেখল টিনটেড গ্লাস, ভেতর থেকে বাইরে কিছুই দেখা যায় না।
ভিতরটা একেবারেই নিঃশব্দ এবং দেয়ালে লুকিয়ে স্থাপন করা ক্ষীন লাইটের আলোছায়া। দেয়ালটা মনে হলো অফ হোয়াইট রং, একেবারে ফাঁকা। বেশ প্রশস্ত জায়গাটা।
একদম নিস্তব্দ নিথর। যেন অন্য এক জগত।
ছোট ছোট বেড সাইড কার্পেটের আয়তনে ম্যাট পাতা।
আলো ছায়ার মধ্যে মনে হলো দুএকজন মানুষ নিজ নিজ ভঙ্গিতে ম্যাট গুলোর উপর বসা। নিস্তব্দ এবং নিশ্চল।
-কি করছে ওরা সেটা ঠিক বোঝা গেল না। তবে মনে হলো ওরা ডুবে আছে নিজের গভীরে।
বেশ কিছুটা সময় বসে নিঃশব্দে লুমিনাস তীর চিহ্ন অনুসরন করে বেরিয়ে আসলো অবনী।
বিকালটা প্রায় গড়িয়ে গিয়েছে। গোলাকৃতি ঘরটার যে দিকটা দিয়ে সে ঢুকেছিল এটা তার বিপরিত দিক।
ভিতরটা অন্য কিছুই না, শব্দহীন করে তৈরী স্বপ্নীল একটা পরিবেশ।
বাইরে আসতেই নানা কোলাহল কানে আসতে লাগলো। মনে হলো ভিতরটায় ভাল ছিল।
ফিরে আসলো অবনী।
কিন্তু ঐ পৃথিবী বিচ্ছিন্ন পরিবেশটা যেন ওকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখল। ও রকম আলো আধারীই অবনীর দরকার। ওখানে নিজের দুর্বল সবকিছুকেই অন্যের চোখ থেকে আড়াল করা যায়। অন্যকে দেখা যায় না, শুধু নিজেকে ছাড়া।
জায়গাটা অবনীর মনের মধ্যে এক ধরণের স্থায়ী আসন করে নিল। নিজেকে দেখার আর নিজেকে একেবারে মুখোমুখি দাড় করিয়ে কথা বলার এক অভাবনীয় পরিবেশ ওখানে।
দৈনন্দিন কাজে চিন্তায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় কর্মচঞ্চল মানুষ কেবল অপরকে দেখতেই ব্যস্ত। আর গোলটা বাধে ওখানেই। সবাইকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে শুধু অন্যের ভাল মন্দ দোষ গুন চোখে পড়ে। আড়ালে থেকে যায় শুধু নিজেরটা।
জায়গাটা অবনীকে দারূন ভাবে আকর্ষন করতে লাগলো।
কয়েকদিন পর অবনী আবার গেল ওখানে। তারপর অনেকবার। নিজেকে দেহাবরন থেকে বের করে সামনে দাড় করিয়ে নিজের সাথে কথা বলত অবনী।
একদিন ধ্যান কেন্দ্রেই অবনীর দেখা মিললো অম্বরের সাথে।
আলো আধারিতে অম্বর একদম তার সামনে এসে বসলো। ওর নিঃশ্বাস যেন অবনীর চোখে মুখে অনুভূত হতে লাগলো। ওকে প্রথমে দেখে একটু চমকে উঠলো অবনী। নিজেকে সামলিয়ে নিতেই মনে হলো- না, ও অপরিচিত কেউ না, ও অবনীর আপনজন, ওর সাথে জন্ম জন্মান্তরের পরিচয়।
অম্বর অপার্থিব এক সত্তা। পৃথিবীর কোন ধুলো ময়লায় ওকে স্পর্শ করতে পারিনি। ও নির্মল নিষ্কলুস, যা কিছু পার্থিব তার সবকিছুই যেন ওর অপছন্দ। ওর শরীরের স্বর্গীয় গন্ধ অবনীকে মোহিত করলো।
কি এক অভাবনীয় আকর্ষন ওর মধ্যে। প্রথম দেখাতেই অবনী বুঝল ও তার অনেক পরিচিত। ওর সব কিছুই তার জানা। ওর চাওয়া পাওয়া আকাঙ্ক্ষা সবকিছু। ওর অবস্থান অবনীর বুকের গভীরে। অবনী অনুধাবন করল -এতকাল তার যত শ্রম যত প্রচেষ্টা তার সব ওকে খুশী করার জন্যই। ও স্বর্গীয় আর অবনী মর্তের বাসিন্দা। ওকে সুখী রাখায় অবনীর জীবনের একমাত্র ব্রত।
অবনীর মনে হলো ওর সাথে পরিচয় তার গোড়া থেকেই। কিন্তু যাবতীয় ব্যস্ততায় ওকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল।
-তায় কি ওর এত অভিমান! ও একবারের জন্যও অবনীর দিকে তাকায় না। একটা কথাও বলে না। ওকে বোঝা বড় দায়।
ধ্যান কেন্দ্রে গেলেই কেবল দেখা হতো ওর সাথে।
অবনী বুঝল সেই তার একমাত্র ভালবাসা। ওকে ঘিরেই তার সব চিন্তা চেতনা। ওর প্রতি অবনীর ভালবাসা এতই প্রবল যে ওর সব কিছুই অবনী এমনিতেই বুঝতে পারে। ও মুখ ফুটে কিছু না বললেও ওর মনের কথা অবনীর জানা। তায়তো অবনীর সমস্ত কাজকর্ম আশা আকাঙ্ক্ষা ওকে ঘিরেই আবর্তিত, কেবল ওকে সন্তষ্ট করার জন্যই। বিধাতার এক অদ্ভুত সৃষ্টি অম্বর।