জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১২।

আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৪২

অম্বরাবনী- ১২ 

 

হটাৎ করে টিলার উপর নির্মিত বাসার নিচে একটা বড় পুরোনো গাছ মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়লো। সেই শব্দে অবনী সম্বিৎ ফিরে পেল।
এমন বৃষ্টি আর ঝড় এখানে সাধারণত হয় না। তায় এখানকার গাছগুলোও সে ভাবে শেকড় গজিয়ে প্রস্তুত না। হটাৎ করে এত ঝড় বৃষ্টি যেন ওদেরকেও অপ্রস্তুত করে দিয়েছে।
টেলিফোনটা কড় কড় শব্দ করে বেজে উঠলো। কেন যেন একটু অবাক হল অবনী। শব্দটা যেন আশংকা ধ্বনি।
ষ্টোর অফিসার ফ্রান্সের বাসিন্দা পিয়েঘের কন্ঠ।
কিছুটা উত্তেজিত কণ্ঠে ও যা বললো তাতে বোঝা গেল যে বুলডোজার দিয়ে ডেট ওভার হওয়া খাবার গুলো মাড়িয়ে নষ্ট করার সময় ডোজারের নিচে পড়ে একজন মহিলা তার পিঠে বহন করা বাচ্চাসহ পিষ্ট হয়ে গেছে।
একটু রাগ প্রকাশ করে পিয়েঘ আরো বললো যে ঐ মানুষগুলো যাতে বুলডোজার চালানোর সময় তার সামনে এসে খাবার সংগ্রহ না করে তার জন্য অনেকবার বলা হয়েছে ওদেরকে। এমনকি ওদেরকে সাবধান করে একটা সাইনবোর্ডও টাঙিয়ে দিয়েছে বলে বললো সে।
ঝড় বৃষ্টির একটু রেশ কমলেও তখনো পুরোপুরি থামেনি। ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়ছেই।
গাড়ী করে রওয়ানা দিল অবনী। একটু দ্রুত যাওয়ার জন্য সর্টকাট রাস্তা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে ফল হলো না। রাস্তায় অনেক গাছ উপড়ে বা ভেঙে পড়ে রাস্তা বন্দ হয়ে আছে। কোন মানুষ জন রাস্তায় দেখা যাচ্ছে না।
সবই স্তম্ভিত, জীবন যেন থেমে গেছে। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে মূক প্রকৃতি অবিরাম চোখের জল ফেলছে।
কিন্তু কেন! এ সবতো তাঁরই কর্ম।
অবশেষে অনেক রাস্তা ঘুরে অবনী যখন ষ্টোরের ওখানে পৌছালো ততোক্ষনে বৃষ্টির ফোটা ছোট হয়ে আসলেও অন্ধকারটা জমাট বেধেছে।
পুলিশ এসে মৃতদেহের অবশিষ্টাংশ নিয়ে গিয়েছে, পিষ্ঠ খাবার দাবারের অবশিষ্ঠাংশও নিত্যদিনের মত বুলডোজারের ব্লেড দিয়ে ঠেলে মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।
পিয়েঘ বললো যে ব্যপারটা দুঃখজনক তবে ও দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা হয়েছে। স্থানীয় একজন গন্যমান্য জননেতা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি মন্তব্য করলেন যে এরপর থেকে ভীড় কমবে। তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে আরো বললেন -স্যার আপনি উত্তম ব্যবস্থাই গ্রহন করেছেন, আর যে মহিলা মারা গিয়েছে, ওর কেউ নেই ঐ বাচ্চাটা বাদে, তায় এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে।
নিয়ম মাফিক পুলিশ কেস হয়েছে। কিছু তদন্ত হবে কিন্তু কিছুই হবে না। কর্তৃপক্ষ তাদের করণীয় সব ব্যবস্থাই গ্রহন করেছে। উপস্থিত সবাই এ ধরণের মন্তব্য করে ঘটনাটাকে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করলো।
কিন্তু অবনী সেটা পারল না। প্রচন্ড একটা অপরাধ বোধ তার মধ্যে জন্ম নিল। মনে হতে লাগলো এ মৃত্যুর দায় দায়ীত্ব কাউকে না কাউকে নিতে হবে।

বাসায় ফিরল অবনী। বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকার বারান্দায় বসে নিজের মধ্যে হারিয়ে নিজেকে নিজের সামনে দাড় করাল।
অম্বর খুবই ব্যথিত চিত্তে সামনে এসে দাড়াল। এত করে বললাম এতে আমার কি করার আছে। চিৎকার করে বললাম আমি নির্দোষ। কিন্তু একটি বারের জন্যও ও আমার দিকে ফিরে তাকালো না। পরিস্কার ভাবে শুনতে পেলাম ও কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
কত দিন অম্বর কাঁদে না এভাবে।
কান্নার ব্যপারটা প্রকৃতির এক মহান দান। কাঁদতে পারলে অন্তরটা হালকা হয়ে যায়। আগুনের তাপে মোমবাতির শক্ত মোম যেমন গলে পড়ে বুকের পাথর ভারী ব্যথ্যাটাও তেমনি কান্নার ফোটা হয়ে বেরিয়ে বুকটাকে হালকা করে দেয়।
শেষবার ও কেদেছিলো যখন মা মারা গেল। তার পর থেকে ব্যাথাগুলো কেবল মনের মধ্যেই গুমরে মরেছে চোখের জল হয়ে বেরূতে পারেনি।
নিজর কৃত ধ্বংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতিও কেঁদে চলেছে। বর্ষার জল কুল কুল শব্দ করে সব ধুয়ে মুছে নিয়ে বয়ে যাচ্ছে। অবনী কান পেতে শুনছে সে শব্দ। অম্বরের কান্নার শব্দটাও প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার হয়ে মনটা একটু হালকা লাগছে।
অভিনব এ প্রকৃতি! প্রবল আক্রোষে নির্মম ভাবে সব ভেঙ্গে চুরে দিয়ে এখন আবার শোকে মুহ্যমান। একি অনুশোচনা না অপারগতার কষ্টের বহিঃপ্রকাশ! অদ্ভুত প্রকৃতির এ খেলা! এর জবাব সে ছাড়া বোধহয় অন্য কেউ দিতে পারে না।

অফিসের কাজ, ক্লাব পার্টি ইত্যাদিতে আরো বেশী করে জড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না, যখনই সব কিছুর বাইরে যখনই অম্বর আর আমি একাকী তখনই অম্বরের কান্নার শব্দে আমার বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়।
বুঝতে পারি এখানে একদম একা আমি। কেউ কোথাও নেই। কি করবো এখন। কাকে বলবো আমার এ যন্ত্রনার কথা। কি করলে কোথায় গেলে অম্বরের কান্না আমি থামাতে পারবো। কুল কুল করে বয়ে যাওয়া জলের শব্দের সাথে ওর কান্নাটা মিশে বুকটা হালকা যেন হালকা হল।

আইন অবনী বা অন্য কাউকেই দোষী সাব্যস্ত করতে পারলো না। আর করবেই বা কেন। বৃহৎ স্বার্থে যে সব ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে তার সবই যুক্তিসিদ্ধ। অংকের নিয়মের মত সবই পরিস্কার।
অংকের নিয়ম যে কোন পর্থিব আইনেই সিদ্ধ, অংকের নিয়মেই পৃথিবী চলে।
কিন্তু অংকের নিয়ম অম্বরের চিরকালই খুব অপছন্দ। মানুষের মন আবেগ ভালবাসা এগুলো কি অংকের নিয়মে চলে!

লম্বা ছুটি নিলাম। ভাবলাম জায়গা পরিবর্তন করলে নতুন নতুন জায়গা দেখলে, প্রকৃতির ছোয়াই গেলে ভালো লাগবে আর নিঃশ্চয় অম্বর খুশী হবে। কারণ ওর চাপা কান্না আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
ওকে নিয়ে কোথায় না কোথায় ঘুরলাম। পাগলের মত কত জাইগায় ছুটলাম। কত কি দেখলাম, কত কি করলাম কিন্তু সব প্রচেষ্টার ফল ঐ এক। কিছু সময় পরই সেই একই একঘেয়েমি আর ক্লান্তি।
ক্লান্তি আর একঘেয়েমি দুর করবার জন্য ভাবলাম প্রকৃতির আরো কাছাকাছি যাওয়ার। যেখানে প্রকৃতিকে ছোয়া যায়, প্রকৃতি যেখানে কথা বলে বিলাপ করে করে মনের ব্যথা ব্যক্ত করে।
জলপ্রবাত অম্বরের চিরকালই খুব ভাল লাগে। শক্ত পাথরের উপর সশব্দে আছড়ে পড়ে খান খান হয়ে যাওয়ার সাথে অম্বরের যেন একটা মিল আছে। নদীর পানি আছড়ে পড়ে গো গো শব্দে মনের সব অব্যক্ত ব্যথা চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে নিজেকে হালকা করতে চায়। অবনীরও প্রয়োজন জলপ্রবাতের গর্জনের সাথে কণ্ট মিলিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে মনটাকে একদম হালকা করতে।
রাঈন জলপ্রবাত ইউরোপের সর্ববৃহৎ। ভাবলাম ওখানে গেলে হয়তো মনটা একটু জুড়াবে। ছুটলাম সেখানে।

ইউরোপের রানী সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ওটা। জুরিখ থেকে ট্রেনে ঘণ্টা খানেকের রাস্তা। ট্রেন থেকে স্যাফাইজেনে নেমে স্টেশানের বাইরে এসে দাড়ালাম। ওখান থেকে অলি গলি সরূ রাস্তা ধরে আরো আধা ঘন্টার হাটা পথ।
জনমানব শূন্য সুনসান নিরবতা। চিনি না যাব কিভাবে?
তাকিয়ে দেখছি নিল আকাশটা। ধুলো বালি শুন্য নীল আকাশ কোন দূষণ নেই তায় এখানে প্রকৃতি নির্মল। খুব ভাল লাগছিল আকাশ দেখতে। পথ খোজার কথা ভুলে পুরোপুরি আকাশের প্রেমে পড়েছিলাম।
ফুতপাথ ধরে হেটে যাওয়া এক বৃদ্ধার লাঠির ঠুক ঠুক শব্দে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালাম। বৃদ্ধা আমার মত ভিন দেশী একজনকে ও ভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বোধহয় একটু অবাক হয়ে থামলেন।
-তোমাকে কোন সাহায্য করতে পারি। হাসি মাখা মুখটা, খুব ভাল লাগলো, ঠিক যেন আকাশের মত নির্মল।
বৃদ্ধা আমাকে সযত্নে কাছে ডেকে রাস্তার অপর পাশে নিয়ে গেল। তারপর খুব অল্প কথায় পিচ ঢালা ফুটপাথের পাশ দিয়ে পেইণ্ট করে মেরূন রং দিয়ে আঁকা পায়ের চিহ্ন্য দেখিয়ে সেটা অনুসরন করতে বলে বললো- ঘোরানো পেঁচানো অলি গলি ধরে যেতে হবে, চিহ্নটা অনুসরন করে চলতে থাকবে। রাস্তা শেষ বা ভুল বলে মনে হলে, ওটা ভ্রম বলে মন থেকে ঝেড়ে ফেলবে, তাহলে নিশ্চিত ভাবে গন্তব্যে পৌঁছাবে।
মুচকি হেসে কথাটা বলেছিলেন সেদিন জীবনের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ওই অজানা বৃদ্ধা।
পদচিহ্ন অনুসরন করে চলেছি নিশ্চিত গন্তব্যে। জটিল সমস্যার কি সরল সমাধান! অজানা অচেনা জায়গা, রাস্তা ঘুরানো পেচানো কিন্তু হারানোর কোন ভয় নেই।
আহ বুকে কত আশা, অমৃতের গন্ধ পাচ্ছি মনে মনে। ঘুরিয়ে পেচিয়ে পায়ের ছাপগুলো অনুসরন করে চলেছি। অজানা অচেনা ঘোরানো পেচানো সরু পথ প্রতি বাকেই মনে হয় রাস্তা শেষ কিন্তু না জীবন সম্পর্কে কবিতার দুটি লাইন মনে পড়লো:

Does it really end or simply it’s a bend!
All talk though, no one know,
what is at the bend and beyond!

নিশ্চিত গন্তব্যে যাওয়ার আনন্দ সুখসপ্নের মত।
সময়টা শীতের আগে আগে। টুরিষ্টদের ভীড় নেই বললেই চলে। বলতে গেলে শুধু আমি আর অম্বর। ওর কান্নাটা এখন আর শোনা যাচ্ছে না একটুও।
আকাঙ্ক্ষা পুরনের নিশ্চয়তার মুহুর্তটুকু যেন অমৃত সুধা। কিন্তু অবনী ভালো করেই জানে যে আকাঙ্খা পূরণ হওয়ার শুরূটা আনন্দদায়ক কিন্তু পর মুহূর্তেই অম্বরের কান্নার শুরূ। শুরূ হতে আরম্ভ করলেই যেন শেষ হওয়ার বাঁশিটা বেজে ওঠে- এইতো জীবন।
আগে এমনটা হতো না। ভোগের ভিতর, উপভোগের ভিতর নিজেকে ডুবিয়ে রাখা যেত। কিন্তু ইদানিং একটুতেই দেহ মন ক্লান্তিতে ভরে যায়, সব সময় মনে হয় -এখানটা নয় অন্য কোন খানে গেলে হয়তো অম্বর একটু শান্তি পাবে। কিন্তু কোথায় সে অন্য খান!

শত মাইল পথ অতিক্রম করে আসা রাঈনের আছড়ে পড়ার ক্ষীণ শব্দ কানে আসছে। আহ জীবনটাকে যদি এখানেই থামিয়ে রাখা যেত। নিশ্চিত আশাপুরনের মুহূর্তের সপ্নটাকে যদি ধরে রাখা যেত মনের গভীরে! আশাপূরণ শুরূ হওয়ার আগ পর্যন্ত সেটার পরিমান সীমাহীন, তায় অনুভবটাও স্বর্গীয় -যার কোন শেষ নেই। কিন্তু আশাপুরনটা পার্থিব -শুরূ হলেই তা একটা পরিমাপের অংকে বাধা হয়ে যায়। যার পরিমাপ আছে তাতো শেষ হয়ে যাবেই।
ছোট্ট শিশুটির খেলনা ঘোড়া কেনার বায়না পুরনের জন্য বাবা যখন ছেলেকে দোকানে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গিকার করে তখন থেকেই স্বর্গীয় তৃপ্তিটা শুরূ হয়। কিন্তু যে মুহুর্তে ওর স্বপ্নের ঘোড়াটা মর্তের তৈরী খেলনার আকৃতিতে আবদ্ধ হয়ে যায় তখনই তৃপ্তিটা শেষ হতে থাকে। কি বিচিত্র প্রকৃতি আর বিচিত্র তাঁর খেয়াল!

চারিদিকের রাঈনের গর্জনে অন্য সব শব্দ ম্লান হয়ে আসলো। আশা পূরণের আসন্ন মুহূর্ত! পায়ের চিহ্নগুলোর দরকার ফুরিয়ে গেল। দৃষ্টি তখন শুধু সামনের দিকে, নিচের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেন সময় নষ্ট। সেই মায়াবী মুখের বৃদ্ধার দেখান পায়ের চিহ্ন গুলো যে ঠিক কোথায় শেষ হয়েছিল তা আর খেয়ালি করিনি।