Heading
আপডেট: 2023-04-16 17:54:35
নদীটা অবশেষে সাগরের মুখে এসে ঠেকলো। শীতল বাতাসের সাথে সাগরের গর্জন কানে এসে বাজতে লাগলো। সে শব্দ অম্বরের কান্নাটা যেন ছাপিয়ে দিল।
আধো বোজা চোখে অবনী বুঝল সাগরের সন্ধানে, অসীমতার সন্ধানে রত অম্বরের অবশেষে ঘুরে দেখার সময় এসেছে। মনে হলো বোধহয় ওর অপেক্ষার পালা সমাপ্ত প্রায়। অবনী মনে একটা ক্ষীন আশা নিয়ে চোখ দুটো খোলা রাখার চেষ্টা করতে লাগলো। একবার হলেও অম্বর ওর দিকে ফিরে তাকাবে, একটা কিছু হয়তো বলবে।
যে স্বর্গীয় অতিথিকে নিয়ে সারাটা জীবন অতিবাহিত করলো, যার জন্য ওর এতসব অর্জন, তার সবটুকু ভূল হলেও আকাশ থেকে আসা অতিথি কি ঐ আকাশের বিশালতা দেখিয়ে একটা কিছু বলবে না, একটু ফিরে কি তাকাবে না!
তা কি করে হয়!
মনে হলো অম্বর মুখটা ফেরাচ্ছে ওর দিকে। কত কাল কত সময় একত্রে কাটিয়েছে ওরা। পছন্দ না হলেওতো এ ঘরেই এতদিন বাস করেছে সে স্বর্গীয় অতিথি।
আহ কি প্রশান্তি কি তৃপ্তি! স্বর্গীয় স্বাদ!
ঐ তো অম্বর ফিরে তাকিয়েছে ওর দিকে। কিছু একটা যেন বললো!
কতবার কতভাবে সকল জানা ও শোনা সুরে
সুধালাম তারে কত আকুতি করে।
দিয়েছি শুণ্য করে, যা ছিল সম্বল মম
ক্লান্ত অবসন্ন আমি, একটু তাকাও একটু থামো।
সবশেষে জীবন সায়াহ্নে এসে হিসাব মিলায়
কি তাকে দিলাম কি সে চায়!
যত শ্রম যত চেষ্টা পাপ বা পূণ্য
সবইতো তোমারই জন্য।
জানো তুমি স্বর্গীয় আত্মা, জানে বিধাতা।
স্বর্গ থেকে এসেছিলে স্বর্গে যাবে চলে
মর্তের তাকে, মাটি নেবে বুকে
হায়! আমি যে কে তা
কেউ গেলনা বলে সেকথা।
বিধাতার বিচিত্র সৃষ্টি মানুষ। তার মধ্য থেকে কোন কোন জীবনকে বিধাতা যেন সৃষ্টি করে তাঁর রহস্যের গীনিপিগ বানিয়ে। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ সব জীবনের অর্থ কি? কিন্তু বিধাতার কোন কিছুই নিরর্থক নয়।
সব মানুষই প্রকৃতপক্ষে একা! এক একটা আলাদা আলাদা দ্বীপের বাসিন্দা এক একটা জীবন। আর জীবন হল আসা আর যাওয়া, এ দুটোই কেবল অমোঘ সত্য। এ দুয়ের মাঝে যা কিছু তার সবটুকুই অনিশ্চিত। জীবন একটা মোহ মায়া জাল, সব জীবনই দুঃখ দিয়ে শেষ হয়। জীবন কেবল যাওয়ার জন্যই আসা।
একবার যখন আসা হয়ে যায় তখন শুধু একমাত্র যাওয়াটাই সত্য এবং অবসম্ভাবী। আসা আর যাওয়ার ব্যপারটা সব জীবনের একই রকম অভিন্ন। যে ভাবে আসা ওভাবেই যাওয়া। মাঝপথের সময়টাতে যে যা উপার্জন করেছে তার কিছুই কেউ সাথে নিতে পারে না।
প্রতিটি জীবনের সবচেয়ে অদ্ভুত দিকটি হচ্ছে; সবাই এই অনিশ্চয়তায় ভরা সময়টুকুকেই নিশ্চিত করতেই সময় পার করে দেয়। এটাই মোহ, মরিচিকার পিছনে ছুটে চলে। এই সময়টুকুতে মানুষ সবাই একান্তে নিজের একা হয়ে যায়।
মানুষের জীবনে এমন এমন কথা, চিন্তা চেতনা, আকাঙ্খা থাকে যা সে নিজে ছাড়া অন্য কাউকে বলতে পারে না, বলা যায় না। এই কর্মচঞ্চল পৃথিবীতে যত ভীড়ের মধ্যে সময় কাটাক না কেন, দিনের শেষে প্রত্যেক মানুষ একান্তভাবে নিজের, একদম একা।
এখানেই অম্বরের অবস্থান প্রতিটি জীবনে। মাটির ঘরে স্বর্গীয় অতিথি।
প্রকৃত অর্থে স্বর্গীয় আত্মাকে খুশী করার জন্যই প্রতিটি মানুষের কর্মতৎপরতা। অনিশ্চয়তায় ভরা মধ্যবর্তী স্থানের মোহ এটা। আকাশ থেকে খসে পড়া অমরাত্মা অম্বর সব অবনীর মাটির খাচায় অতিথি।
মাটির ঘরে বিধাতার বাস! মাটিতো দিশেহারা হয়ে জ্ঞান শুন্য হয়ে স্বর্গাগত অতিথির মন যোগানোর জন্য আকুল থাকবেই। অসম অতিথির প্রয়োজন জিজ্ঞেস করাটা দৈন্যতা প্রকাশ ভেবে দৈন্যাক্লীষ্ট অবনী ওর সাধ্যের মধ্যে যা কিছু সম্ভব তার সব কিছু স্বর্গাগত অতিথির পদতলে সপে নিজেকে কৃতার্থ ভাবে। তাতে যদি অতিথির সন্তোষ্টি না ঘটে, তাতে কারো কি কিছু করার থাকে!
স্বর্গ থেকে দেবতার প্রসাদ কি করে আনবে অবনী। অতিথি সন্তোষ্ট হবে সে লক্ষেই অবনীর যত প্রচেষ্টা। প্রচেষ্টা পুরোটা বিফলে গেলেই বা কি করবে ও।
অবনীর সারা জীবনের অর্জন বৃথা গেল কিনা তা প্রভুই জানে। অবনী সারা জীবনভর যা কিছু করেছে তা শুধু অম্বরকে খুশী করার জন্যই। অম্বর ওর মাটির ঘরে বিধাতার বসবাস। অবনী কেবল অম্বরকে আবরন করেই আছে- ও’যে অম্বরাবনী। প্রকৃত অর্থে মানুষ মাত্রই মাটির ঘরে আকাশ থেকে আগত অমরাত্মাকে ধারনকারী এক সত্তা- অম্বরাবনী।
প্রতিটি জীবন একটি বৃহৎ বৃত্তের গণ্ডিতে ঘেরা অনেকগুলো ছোট ছোট বৃত্তের সমাহার। ছোট ছোট বৃত্তগুলি হচ্ছে মানুষের এক একটা স্বপ্ন বা পরিকল্পনা। বৃহৎ বৃত্তটা সম্পর্কে সব মানুষ জানে এবং তা মেনে নেয় প্রতিটি প্রাণ।
মানুষের নিজের পরিকল্পিত ছোট ছোট বৃত্তগুলির বিষয়ে তাদের মন সব সময় সন্দেহে ভরা থাকে। তায়তো ওই বৃত্তগুলির শুরুর বিন্দুটা সে বসালেও শেষের বিন্দুটা অধরা রয়ে যাই। ছোট বৃত্ত গুলোর কোন কোনটার দুটি বিন্দু মিললে মানুষ নিজেকে সার্থক মনে করে। আর বৃহৎ বৃত্তটার শেষ বিন্দু দুটো মিলে গেলে বিধাতার পরিকল্পনা পূর্ণতা লাভ করে।
কিন্তু একি আলো নিভে গেল কেন! নিকোষ কালো অন্ধকার আর সমুদ্রের গর্জন সব কিছুকেই ছাপিয়ে ফেললো।
কি ভেবে যে স্বর্গ ছেড়ে, এলে তুমি মাটির নীড়ে!
সকল জ্বরা জীর্ন ভূলে, সুখি তোমায় করব বলে
ভুলেই গেলাম কি চাও তুমি!
কেবল দেয়ার জন্য ব্যকুল আমি।
দিনে দিনে, আমি অধম মনে মনে
তোমার অবয় ভুলেই গেলাম
নিজ অবয়ে তোমায় আমি গড়ে নিলাম।
ভরার নামে পাত্র তোমার, ভরে নিলাম ভান্ড আমার
তোমার মত হওয়ার নামে, তোমার মত দেখতে হলাম।
ভিতরটা আমিই রলাম, বাইরেটা কেবল বদলে নিলাম।
তৃপ্ত হল ষড়রিপু, আনন্দেতে ভরল আমার লোভী বপু।
তোমার নামে তৈরি তীরে, শত্রু আমার ধীরে ধীরে
করি নিপাত একে একে জীবন ভরে।
যখন যাওয়ার সময় হল, বেলা আমার ডুবে গেল
এ কি দেখি! যা দিলাম তার কিছুই যে চায়না তোমার
এখন করবে কি এই অধম বলো!