জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১৩।

আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:২৯

 অম্বরাবনী- ১৩ 

 

সামনেই জলপ্রপাতটা। পাহাড়ের বুক চিরে বড় বড় পাথর ভেঙ্গে আর ঠেলে আসতে ওর একটুও ক্লান্তি নেই। চলার পথের সব বাধা সরিয়ে সামনে চলার মধ্যে যে অমৃত লুকিয়ে আছে সে সুধা পান করেই ও যেন মোহিত। কি অপরূপ সাজে সেজে ও আছড়ে পড়ছে।
এপাড়টা চমৎকার! অশান্ত হৃদয় জুড়িয়ে গেল অবনীর।
কিন্তু দূরে চোখ পড়তেই অবনীর মনে হলো জলপ্রপাতের ওপাড়টা আরো সুন্দর আরো প্রাণবন্ত। ওপারটাতে আরো ভাল লাগবে ভেবে অবনী রাঈনের উপর নির্মিত রেলের ব্রিজ পার হয়ে পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে গেল।
এখান থেকে জলপ্রপাতকে একদম কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখা যায়। এ এক অন্য রূপ, এখানে না আসলে ওর এই রূপটার সন্ধানই পাওয়া যেত না।
অবনী ওর পঞ্চ ইন্দ্রিয় ভরে উপভোগ করতে লাগলো স্বর্গীয় সে দৃশ্য।
দু’চারজন বাদে পর্যটকদের ভীড় নেই বললেই চলে। শুধু প্রকৃতির পদচারনা বাদে আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব এখানে নেই।
অবনী জলপ্রপাতের পাড় ঘেসে দাড়িয়ে থাকা কালো পাথরের উপর বসলো। ওর ডানদিকে পাহাড় থেকে নেমে আসা রাঈন গর্জন করে আছড়ে পড়ে বিভিন্ন সুর মুর্ছনার সৃষ্টি করছে। রাঈনের গর্জনে অন্য আর কোন শব্দই কানে আসছে না। হারমোনিয়ামের সাথে গলা মিলে গেলে শিল্পি যেমন নিজের অস্তিত্বকে ভুলে হারমোনিয়ামের সুরের সাথে একাকার হয়ে যায়। এই মুহুর্তে অবনীর বুকের ভিতর জমে থাকা শত বেদনা রাঈনের আছড়ে পড়া গর্জনের সাথে একাকার হয়ে গেছে।
কত পাহাড় জঙ্গল পাড়ি দিয়ে নিঃশেষ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে মহামিলনের আনন্দে উচু পাহাড় থেকে থেকে ঝাপ দিয়ে নিচে পাথরের উপর আছড়ে পড়ে খান খান হয়ে রাঈন নিজের আলাদা অস্তিত্বকে বিলীন করে ধোয়া, কুয়াসা হয়ে যাচ্ছে। আর তারই ফাঁকে ফাঁকে রংধনু আটকে এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারনা করছে। আর নিচে ক্লান্ত শ্রান্ত রাঈনকে মাতৃসম জলরাশি সাদরে অভ্যর্থনা করছে।
এ যেন বেদনা উপশোমের মহৌষধ। এ মুহুর্তে অবনীও নিজেকে পুরোপুরি সপে দিয়ে ও হয়ে উঠেছে একচ্ছত্র প্রকৃতির সন্তান।
আর একটু বাদিকে ভাটিতে রাঈনের অন্য এক রূপ। উচু নিচু এবড়ো থেবড়ো পথ পাড়ি দেয়া ক্ষীপ্র অশান্ত রাঈন এখানে শান্ত কিন্তু আশ্বস্ত গতীতে মহামিলনের স্বপ্নে সমুদ্রের সন্ধানে এগিয়ে চলেছে। একটু আগ পর্যন্ত ও দুপাড়ের সমস্ত রূপ রস গন্ধ আস্বাদন করে সবাইকে মোহিত করতে ব্যস্ত ছিল।
কিন্তু এখানে যেন ওর মোহভঙ্গ হয়েছে। এত ছুটোছুটি কাড়াকাড়ি আহাজাহির করার প্রবনতা সবই যেন ওর কাছে নিরর্থক এখন। এখন ওর প্রয়াস শুধু সাগরের সাথে মিলন। পথের এতদিনের সব সঞ্চয় যেন ওর কাছে মূল্যহীন, অপেক্ষা যেন কেবল মহামিলনের।
দুটো সম্পূর্ণ আলাদা রূপ রাঈনের। ডানে অর্থাৎ উজানে যা ঘটছে তা উন্মত্ততা আর অনিশ্চিওতায় ভরা, ধৈর্য্যর বাধন ভেঙ্গে যাওয়ার সামীল। একটা অতিশয্য আর ভেঙ্গে চুরমার করার উন্মাদনা। আর একটু দুরে ভাটির রাঈন আশা পুরনের আশ্বস্ততায় শান্ত সৌম্য আত্মভোলা।
রাঈনের এ আলাদা দুটো রূপ কারো চোখে পড়ে কিনা বলা মুস্কিল। কিন্তু এই জায়গা থেকে জীবন প্রবাহের এ দুটো ভিন্ন রূপ অবনীর এতদিনের আঁকা জীবনের ছবিটার রূপ এলোমেলো করে দিতে লাগলো।
পর্যটকের দৃষ্টিতে উচু পাহাড় থেকে আছড়ে পড়া বর্ণচ্ছটা আর গর্জনের মধ্যেই রাঈনের সৌন্দর্য্য আর সার্থকতা। জীবনের সংগ্রাম আর পাওয়ার তৃপ্তিতে ভরা। পর্যটকেরা আসে আর যায়, আর তাদের চোখ কান মন জুড়াতে রাঈনের আত্মভোলা এ উন্মাদনা।
আর অন্য দিকটা ক্লান্তি আর নিশ্চিত মৃত্যু, উৎপত্তির সাথে মিশে যাওয়ার স্বপ্ন। মরণেই যেন শান্তি। এত গর্জন এত আর্তনাদ যেন পথ শেষ না হওয়ার বিরক্তি প্রকাশ। তায়তো পথের শেষ বাধাটুকু পেরিয়ে অবশেষে ও সৌম্য শান্ত।
এখানে আসা পর্যটক আর রাঈনের দৃষ্টি ভঙ্গির মধ্যে কি বিশাল ব্যবধান!

অবনী প্রাণভরে দেখছে রাঈনের আছড়ে পড়া। আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ছিটকে পড়া জলের ফোটা রংধনুর রঙে রক্তিম হয়ে ওর শরীর মন দুই জুড়িয়ে দিচ্ছে।
এটা যদি রাঈনের রক্তাত্ব অশ্রু হয় তাতেই বা কার কি এসে যায়!
অম্বরের দৃষ্টি নিবদ্ধ ভাটির দিকে। যেখানে চাওয়া পাওয়ার কোন হিসাব নেই, আছে কেবল মাতৃকোলে ফেরার আকুল আকাঙ্ক্ষা। একটু আগের সবকিছু সব অর্জন পাওয়া বা দেয়ার তৃপ্তি, না পাওয়া বা হারানোর বেদনা সবই অপ্রাসঙ্গিক মুল্যহীন সেখানে।
রাঈনের আছড়ে পড়া আর রংধনুতে আটকে থাকা হাসিরচ্ছটা দুরদুরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের আকর্ষন করে পৃথিবীর সৌন্দর্যে মোহিত করে সবাইকে মোহাচ্ছন্ন করতে চায়ছে। আর সে জন্যই সকলে ছুটে আসে।

কিন্তু অম্বরের একি অপার্থিব চাওয়া, একি আস্বাদন!
এত পথ পাড়ি দেয়া, চলার পথে যা কিছু তার থেকে স্বাদ গন্ধ রূপ রস আস্বাদন করে তৃপ্ত হওয়ার প্রচেষ্টা, এত পরিচিতি এত অর্জন এর সব কিছুই কি মূল্যহীন! একমাত্র আশা শুধু গন্তব্যে পৌছানো, উৎপত্তির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া! নদীর সব ফোটা জলের যত কুলকুল স্যাঁ স্যাঁ যত গর্জন সবই ঐ একই কথা বলছে-

ছুটো না শুধু বৃথা, শোন মোর কথা,
ক্ষ্যন্ত দাও ক্ষনেকের জন্য।
বল কোথায় সে দেশ, কবে হবে এ চলার শেষ
পেরিয়ে উচু নীচু পর্বত জনারন্য?

তোমার এত চলা, এত বলা,
এত বল, এত কান্ড অতল।
জানি শুধু হেসে সব ফেলে শেষে
চাও তুমি যেতে, জানি শুধু পেতে,
সে মায়ের কোল হোক তা উষ্ণ বা শীতল!

যা তুমি কর, যা তুমি ধর, সবি শুধু পেতে মোর মন
তাইতো এত আয়োজন শত, এত সব মাতন।

তবে নিজ বুকে রাখ কান,
বন্দ হোক বাহিরের যত ধ্যান জ্ঞান
যদি জানতে চাও আমার যাতন।

মহাকাশ ছেদী, মহাকাল ভেদী,
একই আকাঙ্খা একই আকুতী।
কবে যাব ফিরে, আপনার ঘরে,
যেখানে আমার উৎপত্তি।

দাও যেতে মোরে, রূখিওনা ওরে,
তুমি যা দিলে সেত বাধে শক্ত শেকলে।
কেন যে বোঝনা, আমার এ যাতনা,
আমি তো এসেছি চলে যাব বলে।

প্রতিক্ষন তব প্রতি করেছি আকুতী
ভেদিয়া আকাশ মর্ত্য।
আমি যা পায়, সবি তার ছেড়ে যেতে চায়
এ খাচায় নই আমি আসক্ত।

অবনীর মন চাইলো এই তো সময় অম্বরের সাথে তার চাওয়া পাওয়ার কিছুটা হিসাব মিলিয়ে নেয়ার। ওর দৃঢ় বিশ্বাসের ভিত্তিতে একতরফা ভাবে ওর সমস্ত শক্তি সামর্থ দিয়ে শুধু ওর তৃপ্তির জন্য কৃত কর্তব্যের ফলটা জানার খুব ইচ্ছা হলো অনবীর। কিন্তু রাঈনের একটানা গর্জনের মাঝে ওর কোন কথায় অম্বরের কানে পৌছালো না। ওর দৃষ্টি শুধু রাঈনের ভাটির দিকেই নিবদ্ধ।

ফিরে এলো অনবী এক বুক ক্লান্তি নিয়ে। রাঈনের ভিন্ন রূপের মধ্যে অবনী অম্বরকে নতুন করে আবিষ্কার করলো।
এ ওর পরিচিত অম্বর নয়। কি চায় সে ওর কাছে!
জলপ্রপাতের গর্জন অবনীর সমস্ত জীবনের হিসেবটায় গরমিল করে দিল। সব কেমন এলোমেলো হয়ে যেতে লাগলো।
কোন কিছুতেই যেন মন বসাতে পারছিল না। জল্প্রপাতের গজর্নে এলোমেলো হয়ে যাওয়া হিসাবটা মেলানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো অবনী।
এমনি বোধহয় নিয়ম প্রতিটি অবুঝ প্রাণের জন্য। প্রদিপের আলোতে ডানা ঝলসে যাওয়া পতঙ্গ সব ভূলে ঐ প্রদিপের টানেই যেন আমৃত্যু মোহিত থাকে।
নদীর আছড়ে পড়া গর্জন আর ভাটিতে শান্ত সৌম্য মহামিলনের আকাঙ্ক্ষার স্বরূপ উদঘাটনের মধ্যেই ওর জবাব নিহীত বলে মনে হলো অবনীর।
এমনি দুটো পৃথক সত্তার সম্মিলনীই ওদের সহাবস্থানের জন্য প্রয়োজন। অবনী আর অম্বরের সহাবস্থান।