জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে ছোট গল্প 'স্মৃতিভ্রংশ"।

আপডেট: 2023-01-25 10:46:37

স্মৃতিভ্রংশ

 

প্রতাপ চৌধুরী প্রচন্ড কর্তৃত্বব্যঞ্জক একজন রাজা। তার প্রকৃত নাম অমর চৌধুরী কিন্তু তার প্রতাপশালীতার জন্য তাকে প্রজারা ওই নামেই সম্বোধন করে। তাতে তিনি প্রকৃতই খুশী হন। নিজের উপর অঘাত বিশ্বাস তার।
মানুষ জীবনে যে যা, সেটাকে তার জন্মগত প্রাপ্যতা এবং সে ভাবেই তাকে জীবন কাটাতে হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তার এ বিশ্বাস, তার কাজে এবং আচার আচরণে প্রকাশ পায়।
রাজ পরিবারের গুটিকতক সদস্য বাদে রাজ্যের অন্যান্য সকলকে তিনি কেবল মাত্র এক একটা সংখ্যা হিসেবে গণ্য করেন। রাজা তার সভাসদ ও কর্মচারীদেরকে নামে নয়, নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করার ব্যবস্থা করেছেন। তার রাজসভার পনের জন সভাসদ ছয় থেকে বিশ বলে পরিচিত।
সভাসদরা প্রজাদের মধ্য থেকেই আসে তাই তারা আবার প্রথম সংখ্যা অর্থাৎ এক নম্বর হয় কি করে! সে ভাবনা থেকেই রাজা এক থেকে পাচ পর্যন্ত নম্বর বাদ রেখে ছয় থেকে তাদের সংখ্যা গননা শুরু করার ব্যবস্থা করেছেন।
রাজ কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত নম্বর ব্যাজ পরিধান করা বাধ্যতামূলক। প্রাসাদ এবং রাজকাজে নিয়জিত কয়েকশো কর্মচারীর মধ্যে কারো ব্যাপারে যে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাদের নাম নয় নম্বর উল্লেখ করেই তা করা হয়।
সভাসদরা সবাই রাজার পরিচিত। তাদের সবাই স্ব স্ব নম্বর অনুযায়ী পরিচিতি থাকলেও সাধারণ প্রজাদের সাথে পার্থক্য করার জন্য সভাসদদেরকে পোশাকে নম্বর ঝুলানোর বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দেয়া হয়েছে। আর তাদেরকে নম্বর ধরে ডাকার কাজটি সভা কক্ষে সোনার খাঁচার মধ্যে ঝুলানো রাজার পোষা অতি আদরের তোতা করে থাকে। রাজার মত তোতাও সভাসদের বরাদ্দ নম্বর জানে।
তা নিয়ে সভাসদদের মধ্যে একটা অহম বোধও কাজও করে। সাধারণের মত নম্বর ঝুলাতে হয় না বলে তারা নিজেদেরকে অসাধারণ বিবেচনা করে।
একই ভাবে রাজ্যের সব প্রজাদের বিষয়েও দায়িত্বপ্রাপ্ত আলাদা আলাদা সভাসদ কর্তৃক এলাকা অনুযায়ী প্রজাদের নামের পরিবর্তে বরাদ্দকৃত নম্বর অনুযায়ী যে কোন কার্য সমাধা করা হয়ে থাকে। মোটকথা, বলা যায় রাজ পরিবার ছাড়া রাজ্যের সকলকে নামে নয়, নম্বর অনুযায়ী চিহ্নিত করা হয়।
কারো নাম মনে রাখা বা নাম ধরে সম্বোধন করাকে রাজা নিজের জন্য অমর্যাদাকর মনে করেন। এ ব্যাপারটিতে রাজার মনে একটা বিজাতীয় অহম বোধ কাজ করে।

একবার রাজার জন্মদিন পালনের অনুষ্ঠানের সময় আয়োজিত বিশেষ দৌড় প্রতিযোগিতায় এক অতি সাধারণ প্রজার ছেলের দৌড়ের গতি দেখে রাজা বিশেষ উল্লাসিত হয়ে ছেলেটিকে পুরস্কৃত করার বাসনা প্রকাশ করলেন।
ছেলেটিকে পুরষ্কার গ্রহন করার জন্য রাজ আসনের কাছে আসার ঘোষণা দেয়ার সময় ঘোষণাকারী সভাসদ রাজার মহানুভতায় অতি পুলকিত হয়ে ছেলেটির বাবার নাম উল্লেখ করে তাকে ডাকার ঘোষণা জারী করায় রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ সে অনুষ্ঠান ত্যাগ করলেন।
পরে শাস্তিস্বরূপ সে সভাসদকে বহিষ্কার করে প্রজাদের অন্তর্ভুক্ত করে তার জন্য সাধারণ প্রজার নতুন নম্বর বরাদ্দ করা হল। আর প্রতিযোগিতায় জেতা ছেলেটির বাবার খাজনা তিন বছরের জন্য তিন গুণ হারে বৃদ্ধি করা হল।
সে দুঃখে নিরুপায় বাবা ছেলেকে নিয়ে একত্রে গলায় গরুর রশি পেচিয়ে বাড়ীর সামনে গাছে ঝুলে আত্মহত্যা করল।
প্রতিকার স্বরূপ রাজা প্রজাটির বিধবা স্ত্রীর সাধারণ প্রজাদের নম্বর বাতিল করে তার জন্য একটি রাজকর্মচারীর নম্বর বরদ্দ পূর্বক রাজ প্রাসাদে ঝাড়ুদারের এর কাজে নিয়োগ দিলেন।
রাজার এ মহানুভবতাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সেদিন রাজকবি কয়েক লাইনের একটি কবিতা লিখে রাজ সভায় পাঠ করে শুনাল।

 

গরুর দড়ি পেচিয়ে গলে, গোবেচারা গেল চলে
মৃত মানুষ হাটার চেয়ে মরে গিয়ে বাচল বটে।
আত্মহত্যা মহাপাপ, কথাটা বুঝল না বেটা না বাপ
কি পাপ যে হল তাতে! সে জ্ঞান কি আছে মূর্খের ঘটে!

নিজের হাতে এ কাল নিল, পরকালটাও শেষ করল
বাচলো নিয়ে মূর্খতা, আর যা করল সেটা কাপুরুষতা
এই হল মূর্খের জীবন কথা, এ কাল ওকাল দুটোই বৃথা।

বাপ বেটার প্রজা নম্বর দুটো কাটতে হল,
তাতে সভাসদের কাজ বাড়ালো।
রাজার কি মহানুভতা! এটা কি যে সে কথা!
সব হারানো বিধবাকে, রাজা চাকরী দিলেন নিজে ডেকে।

রাজা মহানুভব, বিচক্ষণ অতি,
কি অনুভব! আর কি তার অনুভূতি!

সব কিছু ঠিক হয়ে গেল।
কিন্তু কি যে হল!
রাজার তোতা কথা বলা ক্ষান্ত দিল!

 

রাজসভায় রাজকবি তার রচিত কবিতাটি আবৃতি করলে সভাসদেরা সবাই ‘বাহ’ ‘বাহ’ বলে রাজা সাহেবের গুণ কীর্তন করল।
তবে কবিতার শেষের লাইনটার অর্থ কেউ বুঝল না।
রাজা সভাসদদের উল্লাস ধ্বনিতে আশ্বস্ত হয়ে রাজা হাত নেড়ে তার জবাব দিতে ব্যস্ত থাকলেন।
একদিকে রাজা অসহায় প্রজার পাশে দাঁড়ানোর জন্য মহানুভবতার এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। অন্য দিকে তার রাজ্যে কারো নাম থাকবে না এ ভাবনা সভাসদ ও প্রজাদের মনে চিরস্থায়িত্ব আসন লাভ করল।
রাজ্যের সকলে রাজার নামের সাথে আরো একটি বিশেষণ যোগ করে তাকে রাজা মহানুভব প্রতাপশালী চৌধুরী বলে আখ্যায়িত করল।

রাজার এ অর্জন উদযাপন করার তাড়না সভাসদ সবাই বোধ করতে লাগলো। উদযাপন মানেই কাঙ্গালি ভোজ, তাতে গরীব প্রজাদের পেট পুরে পোলাও কোর্মা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা। সাথে ওই একই অনুষ্ঠানে রাজা তার পনেরো বছর বয়সী একমাত্র পুত্রকে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুবরাজ উপাধিতে ভূষিত করার অভিপ্রায় রাজসভায় ঘোষণা দিলেন।
রাজার নতুন উপাধি ধারণ, সাথে যুবরাজের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অনুষ্ঠান চিরস্মরণীয় করে রাখার লক্ষে রাজা সভাসদদের নিয়ে স্বপরিবারে পাহাড়ে শিকারের আয়োজন করার আদেশ দিলেন। সিদ্ধান্ত হল, যে করেই হোক এ অনুষ্ঠানের ভাবগাম্ভীর্যের কথা ভেবে এবারে যে কোন প্রকারে জঙ্গল থেকে একটা বাঘ শিকারের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু হবে।
সব ব্যবস্থা করা হল। যে কয়দিন লাগুক না কেন বাঘ শিকারের পরদিন প্রাসাদে বিরাট ভুরি ভোজের মাধ্যমে যুবরাজের অভিষেকের ঘোষণা দেয়ার এলান জারী করা হল।
দুটো আয়োজনই পাশাপাশি চলতে লাগলো। সারা রাজ্যে হই হই রই রই সাড়া পড়ে গেল।
গভীর জঙ্গলে লেকের গাঁ ঘেঁসে দাঁড়ানো পাহাড়ের ঢালে বিশাল মাচা তৈরী করা হল। ঠিক হল বাঘ পানি পান করতে আসলে কাছ থেকে নির্ভুল ভাবে গুলি ছুড়ে শিকার করা হবে। সে লক্ষে সময়ের কথা বিবেচনায় সেখানে নুন্যতম সাত দিনের রাত্রি যাপন ও ভোজের আয়োজন করা হল।
যুবরাজের অভিষেক অনুষ্ঠানে রাজার নামের সাথে ব্যাঘ্রব্যাধ উপাধি যোগ করারও একটা পরিকল্পনা সভাসদরা সবাই মিলে গ্রহন করল।

পাচ দিনের মাথায় বাঘ আসলো পানি পান করতে। বিশাল দেহধারী ডোরাকাটা বাঘটা সাক্ষাৎ সামনে আসাতে সব সভাসদ সহ রাজা নিজেও সবার অলক্ষে ঢোক গিললেন। নিশানা করে সময় মত গুলিও ছুঁড়লেন তিনি।
বাঘটা লাফ দিয়ে উঠে তার বিশাল দেহ নিয়ে পানিতে লাফিয়ে পড়ল।
মাচার উপর সবাই মিলে ভয়ে লাফ দিয়ে উঠতেই মাচাটা হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ে সকলে পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে নিচে পড়ল। তাতে সকলে কম বেশী আহত হলেও রাজপুত্র নিচে একটা পাথর খণ্ডের উপর সরাসরি পড়াতে মাথায় আঘাত লেগে জ্ঞান হারাল।

রাজ্যের নাম করা সব বৈদ্য কবিরাজ এমনকি ইংরেজ ডাক্তারকেও আনা হল।
কিন্তু কিছুতেই কিছু করা গেল না। মাস খানেক ভুগে ছেলেটা মারা গেল।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে রাজা রানীর বিলাপে প্রাসাদের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। কোন কিছুই তাদেরকে শান্ত করতে ব্যর্থ হল।
পুত্র শোকে কাতর হওয়া রানী বিলাপ করতে করতে পাচ দিনের দিন ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন। রাজবাড়ীর সামনেই ছেলের কবরের পাশেই তাকে সমাহিত করা হল।
রাজার শারীরিক ক্ষত নিবিড় চিকিৎসার মাধ্যমে ভাল হলেও মনের ক্ষত কিছুতেই ভাল করা গেল না। স্ত্রী পুত্রকে হারিয়ে তিনি দিনরাত প্রাসাদ ছেড়ে কবর দুটোর পাশে বিলাপ করতে লাগলেন।
অনুনয় বিনয় বা কিছুটা জোর করে যৎসামান্য কিছু খাওয়ানো গেলেও রাজা মশায়ের ঘুম যেন চিরতরে হারিয়ে গেল।
এ ভাবে কয়েক মাস চলার পর রাজা সাহেবের স্মৃতিভ্রংশ হল। এখন তিনি কাউকে আর চিনতে পারেন না। আর বিলাপ করাও একেবারে বন্ধ করে দিলেন।
কেউ আসলে কেবল ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়াও বন্ধ হয়ে গেল।

-রাজা সাহেবের স্থায়ী ভাবে স্মৃতিভ্রংশ ঘটিয়াছে।
ইংরেজ ডাক্তারের কথায় সভাসদ সবাই হতবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।
-এ রোগের আপাতত কোন চিকিৎসা এখানে নাই। তিনি যতদিন বাচিবেন তাহাকে এ ভাবেই বাচিতে হইবে।
ইংরেজ ডাক্তার কিছু অসুদপত্র লিখে দিয়ে নিজের সরঞ্জামাদি গুটিয়ে নিয়ে অবাক হওয়া সভাসদদের মুখের দিকে তাকালেন।
-শোক করিতে থাকিলে রাজা সাহেব বেশী দিন বাচিতেন না। তাহার এই স্মৃতিভ্রংশতাকে প্রাকৃতিক চিকিৎসা গণ্য করিয়া এ ভাবেই তাহাকে বাচাইয়া রাখিতে হইবে।
কথাটা বলে ইংরেজ ডাক্তার প্রাসাদের সামনে অপেক্ষামান ঘোড়া গাড়ীতে চেপে বসলেন।
-আমার ধারণা, স্মৃতি আর ফিরিয়া আসিবে না। তিনি এ ভাবেই চুপচাপ থাকিবেন। আর স্মৃতি ফিরিয়া আসিলে তিনি আবার যন্ত্রণায় কাতর হইয়া বিলাপ করিয়া মৃত্যুটাকে আগাইয়া আনিবেন।
রাজা সাহেবের পাকা উঠানের উপর ঘোড়ার খুরের শব্দে সভাসদ বৃন্দেরা সম্বিত ফিরে পেয়ে ইংরেজ ডাক্তারকে বহনকারী প্রস্তায়মান ঘোড়া গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে রইল।

স্বামী আর পুত্র হারানো শোকে পাথর হওয়া জমিদার বাড়ীর নতুন ঝাড়ুদার প্রাসাদের সন্মুখে রানী ও রাজ পুত্রের প্রায় একই আকারের দুটো পাশাপাশি কবর চিহ্নিত করার জন্য একজন রাজ সভাসদকে অনুরোধ করে এক ও দুই নম্বর লেখা দুটো কাঠের ফলক মা আর ছেলের কবরের শিয়রে লাগিয়ে দিল।
তাতে কেউ কোন আপত্তি করল না। কারণ তানা হলে কিছুদিন পর কার কবর কোনটা সেটা চিহ্নিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।
-তাছাড়া, রাজা নিজে এক থেকে পাচ পর্যন্ত নম্বর তো খালিই রেখেছেন।
রাজকবির মন্তব্যে রাজ সভাসদ সবাই সেদিকে তাকিয়ে রইল।