জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'সরকারী ডাক্তার'।

আপডেট: 2023-09-02 11:31:02

সরকারী ডাক্তার

পাহাড় আর গভীর জঙ্গলের ভিতর অবস্থিত ছোট্ট একটা সরকারি ডাক্তার খানায় পোস্টিং হল সদ্য পাশ করে চাকুরি পাওয়া তরুন ডাক্তার নীরব চৌধুরীর।
নীরব নামটা ওর বাবা মা কেন রেখেছিল তা সে জানে না। তবে নামের জন্যই হোক বা ওর জন্মগত স্বভাবের কারণেই হোক, নীরবতা তার খুব পছন্দ। কথা কম বলা অনেকটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ নীরব চৌধুরী।

চারদিকে কাটা তারের বেড়া ঘেরা এক চিলতে সমান যায়গার উপর নির্মিত নিচেই তিনটে রুম সহ দোতলা ডাক্তার খানার বিল্ডিং। নিচের একটা রুমে ডাক্তার খানার একমাত্র কর্মচারী মাঝ বয়সী কম্পাউন্ডার করম বড়ুয়া বসে আর ঔষধ পত্র রাখে। পাশের রুমটা রোগীদের বসার জন্য আর কোনার বড় রুমটা ডাক্তার বসার জন্য। ডাক্তারের রুমের ভিতর কয়েকটা কাঠের চেয়ার আর রোগীদের পরীক্ষা করার জন্য একটা কাঠের তৈরি খাট পাতা।
দোতলা পুরোটা ডাক্তারের থাকার ব্যবস্থা। বাথরুম সহ শোয়ার বড় একটা ঘর সাথে বসার ঘর। তারপর একটু খোলা ছাদ।
বিল্ডিঙ্গের পিছন দিকে, বাউন্ডারি ঘেঁসে টিনের ছাউনি দেয়া পাকা মেঝে আর দেয়ালের দুই কামরার রান্নাঘর। একটাতে রান্নার চুলা আর অন্যটা থাকার জন্য। অদুরে দুটো বাথরুম, একটা রোগীদের জন্য আর একটা কম্পাউন্ডার আর বেতনভুক উপজাতি রাধুনী নয়নসোনার ব্যবহার করে।
সাপ্তাহিক একদিন ছুটি বাদে অন্যান্য দিন সকাল আটটা থেকে বিকেল পাচটা পর্যন্ত রোগী দেখা হয়। বলতে গেলে ডাক্তার সারাদিন নিচেই থাকে শুধু দুপুরে আধ ঘন্টার জন্য খেতে উপরে যায়।
এখানকার মানুষদের মৌখিক এক্সপ্রেসান নেই বললেই চলে। এদের বয়স আঁচ করতে গেলেও বড় ধরনের ভুল হতে পারে। দশ বারো বছরের মেয়েটার বয়সের সাথে যোগ বিয়োগ করে নয়নসোনার বয়স বের করে করম বড়ুয়া বলেছিল নয়নসোনার বয়স পচিশ ত্রিশ হবে। নয়ন সোনা খাবার দাবার নিচে রান্না করে উপরে খাবার ঘরে দিয়ে যায়।
ডাক্তার সকালে নাস্তা করে নিচে নামে। নয়নসোনা সন্ধ্যার পর পরই রাতের খাবার উপরে দিয়ে ঢেকে রেখে বাড়ী চলে যায়। পরদিন সকালে ডাক্তারের নাস্তা খাওয়ার পর টেবিল পরিষ্কার করে থালা বাটি নিয়ে যায়, আর সে সময় ঘর দোর গুলো ঝেড়ে মুছে দেয় নয়নসোনা।
সরকারী একজন বৃদ্ধ বয়সী চৌকিদার আছে। সে সন্ধ্যা লাগতেই নিচে সব রুমে তালা লাগিয়ে কাটা তার দিয়ে ঘেরা কমপ্লেক্সটার লোহার গেটে তালা মেরে দেয়। তারপর লাঠি হাতে ডিউটি করে। ডিউটি করার ফাকে ফাকে নিচে রোগীদের বসার রুমে ঘুমিয়ে নেয়। চৌকিদারি সকালে উঠে সব তালা খুলে অফিস গুলো পরিষ্কার করে। তারপর অফিস শুরু হলে সে পাশেই নিজ বাড়ীতে চলে যায়।

গভীর জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাড়ী ঘরে উপজাতিদের বসবাস এখানে। এদের ভাষা ডাক্তার নীরব সঠিক ভাবে বোঝে না। তাতে অবশ্য তেমন অসুবিধা হয় না। রোগাক্রান্ত শরীরের আলাদা আলাদা ভাষা আছে সেটা ডাক্তারের চোখ ঠিকই বুঝে নেয়। না হলে তার কম্পাউন্ডার করম বড়ুয়া দোভাষীর কাজটা করে দেয়।
ব্যাপারটা বেশ মজার আর সেটা মাঝে মাঝেই হাস্যরসের পরিবেশ তৈরি করে। নীরব কম কথা বললেও সে সমস্ত পরিবেশে হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ে, করমও প্রাণ খুলে সে হাসিতে যোগ দেয়। কিন্তু পাহাড়ী রোগিদের মুখাবয়বে হাসি বোঝা গেলেও তারা কেউ কেন জানি শব্দ করে হাসে না।

নীরিব চৌধুরী এখানে যোগদান করার কয়েকদিন পর এখানকার মানুষ তার অভ্যর্থনার জন্য ছুটির দিন বিকেলে একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে প্রধান অতিথি হয়ে এদের অশীতিপর উপজাতি প্রধান যোগ দিয়েছিল। অনুষ্ঠানটা করম বড়ুয়াই বাংলা আর উপজাতি ভাষা মিশিয়ে পরিচালনা করল।
কিছু নাচ গান হয়ার পর চা বিস্কুট খাওয়া দাওয়া শেষে উপজাতি প্রধান বক্তৃতা দিতে দাড়ালেন।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তার অবশিষ্ট কয়েকটা দাত বের করে নীরবে হাসলেন কিছুক্ষণ। তা দেখে নীরবের অনেক আগে পড়া কবিতার একটা লাইন মনে পড়ল ‘অরদ অধরে মধুর হাসি’।
প্রায় দন্তহীন মুখে অকৃত্রিম হাসিটা তার মনের কথা বলে দেয়। তিনি হাসি ভরা মুখে হাত পা দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গি করে পাহাড়ী ভাষায় এক মিনিটের মত বক্তৃতা দিলেন।
নীরব তার কথার একটা বাক্যও না বুঝলেও তার অভিব্যক্তিতে পুরোপুরি বুঝল যে ডাক্তার এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে আসাতে তিনি খুব খুশী হয়েছেন এবং তার জন্য দোয়া করছেন।
পরে করম বড়ুয়া উপজাতি প্রধানের কথার তরজমা করলে নীরব তার কথা না বুঝেই যা বুঝেছিল সে সেটাই বলল।
তিনি বক্তৃতার ফাকে নয়ন সোনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন –বাবুর খাওয়া দাওয়া যেন ঠিক থাকে সোনা, নাহলে বাবু কিন্তু পালিয়ে যাবে।
কথাটা বলে তিনি ফোকলা দাতের হাসি যেন বন্দ করতে পারছিলেন না।
সে আনন্দ ঘন সন্ধাটা নীরবের মানস পটে গেঁথে রইল আর এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে সব আধুনিক সুবিধা বঞ্চিত এই মানুষ গুলোর পাশে দাড়ানোর একটা তাগিদ অনুভব করল।
এখানে নয়নসোনার রান্নাবান্না ইত্যাদি সব কিছু ঠিক ছিল কিন্তু এখানকার চাপ কলের পানি ডাক্তারের একদম সহ্য হচ্ছিল না।
সেটা বুঝতে পেরে নয়নসোনা নিজ উদ্যোগে প্রতিদিন তার বাড়ীর পাশের পাহাড়ের ঝরনা থেকে সকাল বিকাল মাটির কলসে করে পানি আনতে শুরু করল। সে পানি খেয়ে প্রথম দিনই পরিবর্তনটা টের পেল নীরব। কিন্তু নয়নসোনা তার কথা বুঝতে পারবে না বিধায় কোথা থেকে পানি এনেছে সেটা জিজ্ঞেস করতে পারল না। তবে তাকে বুঝাতে সামর্থ্য হল যে পানিটা তার খুব ভাল লাগছে।
পরদিন ডাঃ নীরব গোসল করার সময় টের পেল যে বাথরুমে বালতিতে তোলা পানিও খুব হালকা একদম আয়রন মুক্ত। গোসল করার পর চুলগুলো ঝরঝরে লাগতে লাগলো।

এর কয়েকদিন পর খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে ডাঃ নীরব পিছনে খোলা জানালার ধারে দাড়াতেই লক্ষ্য করল যে খারাপ অবস্থার রোগীদের আনা নেয়ার জন্য যে রিকশা ভ্যানটা আছে সেটা থেকে পানি ভর্তি ঘড়া নামিয়ে সেগুলো বয়ে দোতলার বাথরুমে উঠাচ্ছে নয়নসোনা। সাথে ওর দশ বারো বছরের মেয়েটা সাহায্য করছে।
নীরব বুঝল প্রতিদিন সকালে সে ঘুম থেকে উঠার আগে নয়নসোনা এভাবেই পানি এনে উপরে উঠায় তার স্নান আর খাওয়ার জন্য।
ভাবল আজ নয়ন সোনাকে ডেকে বলবে যে, অত কষ্ট করে তার জন্য পানি না আনার জন্য।

পাহাড় জঙ্গলে বৃষ্টি হয় প্রচুর। আর বৃষ্টি জিনিসটা নীরব চিরকাল পছন্দ করে। সমতল ভুমিতে আজকাল তেমন বৃষ্টি হয় না সকলে বৃষ্টির জন্য তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতে থাকে। কিন্তু এখানে এখন বৃষ্টি যেন তার সব কটি জানালা দরজা খুলে দিয়ে ঝরতে শুরু করেছে।
গত কয়েকদিন ধরে একটানা বৃষ্টি ঝরছে। সব কটি জানালা দরজা খুলেই নয় যেন আকাশ ফুটো হয়ে ঝরছে সে বৃষ্টি। থামার কোন লক্ষণই নেই। তাতে এ অঞ্চলের মানুষের যেমন সমস্যা নেই, তেমন কোন সমস্যা নীরবেরও নেই।
সমস্যা কেবল এ কয়দিন রোগীর সংখ্যা একদম কম।
নীরব অভ্যাস মত ঘড়ি ধরে নিচে এসে বসে, কিন্তু কোন রোগী না আসায় বসে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টির ফোটা গুনে গুনে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যায়।
এ বৃষ্টিতে ভিজে বা ছাতা মাথায় দিয়ে নয়নসোনা ঠিকই রান্নাবান্না করে খাবার টেবিলে সাজিয়ে রাখে।
একদিন সকালে নয়নসোনা নাস্তা টেবিলে লাগিয়ে যখন নিচে নেমে যাচ্ছিল নীরব তখন তার গলা পরিষ্কার করার ছলে নয়নসোনার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।
উদ্দেশ্য ছিল ওকে বলবে –তুমি এত ভিজ না, শরীর খারাপ করবে, আর বিশেষ করে তোমার মেয়েটা যেন না ভেজে। ছোট মেয়ে জ্বরে পড়লে কষ্ট পাবে।
নয়নসোনা কিছুটা ঘাবড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে নীরবের চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। ওর পরনের কাপড় আধা ভেজা, খোলা চুল চুইয়ে পানি পড়ছে।
এ রমম ভাবে বাবু কখনো তাকে ডাকিনি, কোন ত্রুটি হল কিনা সে রকম একটা আশঙ্কা ওর চোখ মুখে ফুটে উঠল।
নীরব একটু অপ্রস্তুত হল। ভাবতে লাগল কি করে বুঝাবে সে কি বলতে চায়?
নীরব হতবিহবল হয়ে বারান্দায় টাঙ্গানো তোয়ালেটা টান দিয়ে ওর হাতে দিল।
নয়নসোনা তেমনি ভাবে হতবুদ্ধি হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সিড়ি ভেঙ্গে করম বড়ুয়ার উপরে উঠার শব্দে ওরা সম্বিত ফিরে পেল।
ততোক্ষণে নীরব নয়নসোনার দিকে তোয়ালে এগিয়ে ধরা হাতটা গুটিয়ে নিল।
এই বৃষ্টির মধ্যে করম বড়ুয়া আজ একটু সকালেই এসেছে। সে নয়নসোনাকে নাস্তা নিয়ে উপরে উঠতেও দেখেছে কিন্তু দেরী হচ্ছে দেখে কোন অসুবিধা হয়েছে কিনা ভেবে উপরে উঠে দেখার জন্য দোতলায় উঠে এসেছে। সচরচর দরকার না থাকলে সে উপরে ওঠে না।
করম বড়ুয়া ডাক্তার বাবু আর নয়নসোনাকে ওভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও সিড়ির শেষ ধাপটা পেরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
-করম, তুমি এসেছ খুব ভাল হয়েছে। নয়নসোনাকে বল এভাবে প্রতিদিন ভিজলে ওর অসুখ করবে, তাই বৃষ্টির মধ্যে ঝর্নার পানি না এনে বাইরে বালতি বা অন্য কোন পাত্র পেতে রাখলেই হয়। আর বিশেষ করে ওর মেয়েটাকে যেন প্রতিদিন সকালে কষ্ট না দেয়। ছোট মেয়েটা এভাবে ভিজলে তারও অসুখ করবে।
বাংলা না বলতে পারলেও ডাক্তার বাবুর সব কথা নয়ন সোনা পুরোপুরি বুঝল।
-ওর নিজের কিছু হবে না, এসব তার শরীরে সহে গেছে। চিন্তা মেয়েটাকে নিয়ে। গত দুদিন ধরে ওর জ্বর কিছুতেই কমছে না।
নয়নসোনার কথা তরজমা করে করম বড়ুয়া কথা গুলো বলল।
-বল কি? তা আগে বলেনি কেন আমাকে?
-ও ভেবেছিল এমনিতেই জ্বর চলে যাবে।
করম বড়ুয়ার কাছ থেকে শুনে নয়নসোনাকে একটা ধমক দিল ডাক্তার নীরব।
-তোমরা নিচে যাও, আমি এখনি নামছি।
কথাটা বলে নীরব তার রুমে ঢুকল।
রেডি হয়ে নিচে নেমে করমকে কিছু ঔষধ পত্র নিতে বলে সে একটা ছাতা মাথায় করম আর নয়নসোনাকে নিয়ে তার বাড়ীর দিকে রওয়ানা হল।
মেয়েটার নাম আঁখি, ওর গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। মেপে দেখল প্রায় এক শো চার ডিগ্রী।
মেয়েটাকে ভাল করে পরীক্ষা করল নীরব। খুব সকালে তার বাসার নিচে মায়ের সাথে পানি ভর্তি ঘড়া নামানোর সে দৃশ্য ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটা অপরাধ বোধ ওকে তাড়া করতে লাগলো।
ওকে একটা ট্যাবলেট খায়িয়ে ওর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে ওর কপালে হাত বুলাতে লাগলো নীরব। নয়নসোনাকে বলল মেয়ের হাত পা তল পেট সব ঠান্ডা পানিতে কাপড় চুবিয়ে মুছে দিতে।
আঁখি খালি পেটে ট্যাবলেট খেয়ে ডাক্তার নীরবের গায়ে বমি করে দিল।
করম বড়ুয়া আর নয়নসোনা কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে উঠলেও নীরবের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা গেল না। সে ভেজা কাপড় দিয়ে স্বস্নেহে আঁখির মুখ গলা সব মুছে বমি পরিষ্কার করে দিল। তারপর ওর জামাটা পরিবর্তন করে দিতে বলে একটু পাশে গিয়ে নিজের কাপড় জামা থেকে বমি ধুয়ে নিল।
মাচার উপর তৈরি এক কামরার দোচালা ঘরে সারা দিন কেটে সন্ধ্যে হয়ে এল।
সারা রাত ধরে বৃষ্টির মধ্যেই তিনটি মানুষ আঁখিকে সেবা শ্রুশা করেও বাচাতে পারল না। রাত ফুরনোর আগেই ওর আঁখি চিরতরে বন্দ হয়ে গেল।
সকাল হতেই খবর পেয়ে সবাই আসতে লাগলো। উপজাতি প্রধানও আসলো।
-সরকারী ডাক্তারের দোষে আঁখি মারা গিয়েছে, চিকিৎসা করতে পারবে না তাহলে তাদের কবিরাজি ডাক্তারকে খবর কেন দিল না?
জড় হওয়া একজন উপজাতি যুবকের মন্তব্যে উপস্থিত সবাই এমন কি উপজাতি প্রধানও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। শুরু হল হট্টগোল।

করম বড়ুয়ার অনুনয় বিনয়ে তারা কর্ণপাত করল না। মাচার উপর দাঁড়িয়ে তরুন ডাক্তার নীরব নীরবে খেয়াল করতে লাগলো, যে লোকগুলো তাকে সংবর্ধনার দিন অবতার বলে সন্মধন করে ভক্তিতে তার পায়ে মাথা নত করে তাকে অপ্রস্তুত করেছিল বা এদের মধ্যে অধিকাংশ তার কাছ থেকে ঔষধ খেয়ে ভাল হয়েছে তাদের এ মূর্তি দেখে সে অবাক হল।
উপজাতি কয়েকজন অল্প বয়সী অতি উত্তেজিত যুবক মিলে ডাক্তারকে শাস্তি দেয়ার জন্য তাকে মাচার উপর থেকে টেনে হেচড়ে নিচে নামানোর কথা বলে নানা অঙ্গ ভঙ্গি করতে লাগল।
সদ্য কন্যা বিয়োগের শোকে মুহ্যমান নয়নসোনা ঘরের ভিতর তার মেয়ের নিশ্চল দেহটা রেখে একটা দা হাতে বেরিয়ে মাচার উপর দাঁড়ালো। তার সে রুদ্র মূর্তি দেখে সবাই থমকে গেল। তরুন ডাক্তার নীরবও সে মুহূর্তে তার চেনা শান্ত শিষ্ট কর্তব্যপরায়ণ পাহাড়ী নয়নসোনাকে খুঁজে পেল না।
বৃদ্ধ উপজাতি প্রধান বাদে বাকি সবাই এক এক করে বিভিন্ন মন্তব্য করতে করতে চলে গেল।
করম বড়ুয়ার সাথে কথা বলে ওরা আঁখির মৃত দেহের সৎকারের ব্যবস্থা করল।

মেয়েটা মারা যাওয়ার পর অকালে বিধবা নয়নসোনা একা হয়ে যাওয়াই ওকে রাধুনীর থাকার ঘরটাতে এসে থাকার জন্য বলল ডাঃ নীরব। ওর উপজাতি প্রতিবেশীদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে নয়নসোনা হেলথ কমপ্লেক্সের রাঁধুনির ঘরে এসে উঠল।
বর্ষার মৌসুম পার হতে এবার একটু বেশী সময় নিল। টানা বৃষ্টির তোড়ে মাস খানেকের মধ্যে নয়নসোনার বাড়ীর আঙ্গিনা নানা লতা পাতায় ছেয়ে ফেলল। তারপর একদিন তার বাশ কাঠের মাচার উপর বানানো ঘরটার চাল ধ্বসে পড়ে নয়নসোনার ঘরটা মাটির সাথে মিশে জঙ্গলে হারিয়ে গেল।

বছর গড়াতেই ডাক্তারের পোস্টিং হয়ে তার যাওয়ার সময় হয়ে আসলো। এই জঙ্গলে নতুন কেউ আসতে চায় না তাই নতুন ডাক্তার কবে আসবে তা সঠিক করে কেউ বলতে পারল না।
নিজের বসবাসের ঘর হারানো এবং নিজের গোষ্ঠী থেকে অনেকটা বিছিন্ন নয়নসোনার মধ্যে কোন ভাবাবেগ পরিলক্ষিত হল না।
-আমি তোমার খোঁজ রাখবো, আর করম বড়ুয়া তো থাকল।
যাওয়ার দিন সকালে গাড়ীতে উঠে বসার আগে ডাক্তার নীরব হালকা ভাবে কথাটা বলল নয়নসোনাকে।
নয়নসোনা কোন জবাব দিল না বা কোন আবেগও প্রকাশ করল না। পাশে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে করম বড়ুয়া।
কি ভেবে পাহাড়ে চলাচল করা পুরনো উয়িলি জীপের পা দানি থেকে পা’টা নামিয়ে ডাঃ নীরব ঘুরে তাকাল নয়নসোনার দিকে।
-তুমি কি যাবে আমার সাথে?
খুব একান্তে কথাটা বলল তরুন সরকারী ডাক্তার নীরব পাহাড়ের উপজাতি অশিক্ষিত অসহায় মেয়ে নয়নসোনাকে।
নয়নসোনা আর করম বুড়ুয়ার ভাবলেশহীন নীরবতা দেখে বোঝার উপায় নেই যে তরুন ডাঃ নীরবের কথার কি অর্থ তারা বুঝল।
নয়নসোনাকে কথাটা বলে তরুন ডাক্তার তেমনি ভাবে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। মনে হল সে নিজের অবস্থান বিস্মৃত হয়ে তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই দেখছে না।
নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ঝরা বৃষ্টির মধ্যে সকালে একটু রোদ বেরলেও এরই মধ্যে সবার অলক্ষ্যে আকাশ মেঘে ঢেকে বৃষ্টি পড়তে শুরু করল।
বৃষ্টির ফোটায় সম্বিত ফিরে পেয়ে তরুন ডাক্তার নীরব নীরবেই গাড়ীতে উঠে বসতেই গাড়ী চলতে শুরু করল।
মানুষের মন বিধাতার এক বিচিত্র সৃষ্টি, বোঝা বড় দায়। কেউ যখন কোন কিছু ভেবে চিন্তে বলে তখন হয়তো সে নিজে তার কারণটা বুঝলেও বুঝতে পারে, কেননা চিন্তা যুক্তিগ্রাহ্য।
চিন্তা করতে হয় কিন্তু আবেগ নিজ থেকেই উত্থিত হয়। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আবেগ যদি মনের গন্ডি পেরিয়ে সামনের কাতারে এসে দাঁড়ায় তখন প্রকৃতই ভূত ভবিষ্যতের সব চিন্তা লোপ পায়। আবেগ যুক্তি অন্ধ।