জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২৫।

আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৩, ১২:৫২

অম্বরাবনী-২৫ 

 

প্রবহমান প্রশস্ত জীবন নদীর অনেক কুলের মধ্যে একুলটা বেছে না নিয়ে অন্য কোন কুল কি বেছে নিতে পারতো অবনী! কিন্তু সে কুল যে একুলের মত হত না সেটা সম্পর্কে সে নিশ্চিত না।
সবই কি স্রোতের টান, তাঁরই ইচ্ছা!

অবনী এখন এমন একটা জায়গায় এসে হাজির হয়েছে যেখান থেকে নতুন করে অন্য কোন কুলের সন্ধান করা আর সম্ভব নয়। একটা জীবনে শুধু একটা কুলই দেখা যায় তার বেশী নয়।
এটায় বোধহয় মনুষ্য জীবনের একটা সীমাবদ্ধতা।
ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে অবনী এখন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সারা জীবনের উপার্জনের হিসাব মিলাতে বসেছে। থরে থরে সাজিয়ে রেখেছে ওর কষ্টের সব অর্জন। প্রতিটি অর্জনের পিছনেই এক একটা ত্যাগের ইতিহাস। এগুলো করতে করতেই ওর সময় ফুরিয়ে এসেছে।
এত অর্জন এত কিছু তার কিছুই ওর নিজের জন্য নয়। এর সব কিছু ও এই স্বর্গীয় অতিথির পায়ে সপে দিয়ে ভারমুক্ত হতে চায় সে।
অম্বরের দৃষ্টি সামনে দিগন্তের দিকে। যা কিছু কুলের তার কোন কিছুর প্রতি যেন ওর একটুও আকর্ষন নেই। অবনীর সারা জীবনের অর্জনের প্রতি ওর যেন একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই।
অবনীর অর্জনের এতটুকুও ওর নিজের জন্য নয়। এর সবটুকুইতো অম্বরের সুখের জন্যই।
কিন্তু অম্বরের দৃষ্টি অন্য দিকে কেন! তবে কি এত সব অম্বরের চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু এর বেশী যে তার সাধ্যাতীত।
অনেক ভাবে অম্বরের দৃষ্টি ওর নিজের দিকে, ওর অর্জনের দিকে আকর্ষন করার চেষ্টা করলো অবনী। কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হলো না।
তবে কি অভিমান!
পাড়ের টানে আর পাড়ের নানা ব্যস্ততায় অবনী কখনো অম্বরকে এমনি নীবিড় ভাবে সঙ্গ দিতে পারেনি। তবে এখনতো সব পরিত্যাগ করে, সব নির্ভর ছেড়ে অম্বরের কাছে ফিরে এসেছে। জীবন নদীর যে কুলকে অবনী জীবন জীবিকা নির্ভর করেছিল জীবনের এই প্রান্তে এসে সেখানকার সবাই ওকে পরিত্যাগ করেছে।
ভারী ক্লান্ত লাগছে অবনীর। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙ্গে আসছে। মন চাচ্ছে অম্বরের একটু উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে অবসন্ন চোখদুটো বন্দ করূক।
কিন্তু অম্বর অবনীর সমস্ত চাওয়া, আকাঙ্খার প্রতি একদম উদাসীন।
হটাৎ করে মনে হলো -তবে কি ওর যা কিছু অর্জন তার সবটায় অম্বরের চাওয়ার বাইরে?
তা কি করে হয়!
তাহলে ওর সারা জীবনের এত শ্রম এত সাধনা এর সবটুই কি বৃথা!
অম্বরকে অন্ধের মত ভালবেসে, স্বর্গ থেকে আগত অতিথিকে কাদা মাটির তৈরী অবনী সারা জীবন ধরে খুশী করার জন্যই ব্যস্ত থেকেছে। স্বর্গীয় অতিথি পাছে তাঁর প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করাকে অক্ষমতা মনে করে সে আশঙ্কায় কোনদিনই অম্বরের প্রয়োজনটা জিজ্ঞেস করেনি, কেবল ভেবে নিয়েছে নিজের জ্ঞান দিয়ে।
অবনীর সব কিছু, সব ন্যায় অন্যায় শুধু অম্বরের সুখের জন্যই। তার কোন কিছুই যদি অম্বরের পছন্দের না হয় তাহলে অবনীর অন্ধ ভালবাসার খাতিরে হলেও ওর সারা জীবনের অর্জনকে গ্রহন করে ওকে একটু ভার মুক্ত করূক।

বেলা প্রায় গড়িয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত দিনমনিও কর্তব্য শেষে ডুবে যাওয়ার আগে পশ্চিম আকাশে একটু থমকে দাড়িয়ে ঘরে ফেরার আগে সমস্ত দিবসের হিসাব মিলাচ্ছে।
নতুন করে কুল খুজে তা অন্বেষণ করার মত সময় অবনীর হাতে নেই। এখন অম্বর যদি মুখ ফিরিয়ে অবনীর সমস্ত অর্জনকে বৃথা করে দিয়ে নতুন অর্জনের কথা বলে তাহলে অবনী একেবারে অসহায়। এখন নতুন করে আর কিছু করার ক্ষমতা বা সময় কোনটাই অবনীর নেই।
তবুও ওর স্বর্গীয় মুখটা শেষবারের মত একটিবার দেখার বাসনা কিছুতেই দমাতে পারছে না অবনী। সারাটা জীবন যাকে সন্তোষ্ট করার জন্য, যার চিন্তায় বিভোর হয়ে কাটিয়ে দিল, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যদিও মনে হচ্ছে ওর সকল প্রচেষ্টায় বৃথা, তবু ঐ স্বর্গীয় অতিথির মুখটা প্রাণভরে অবনী দেখবে একবার।
দেখবে কি আছে তাতে!
ওর সবটুকু ভালবাসা নিংড়িয়ে মিনতি জানালো অম্বর যেন একটি বারের জন্য ওর দিকে একটু ফিরে তাকায়।
অম্বরের দৃষ্টি নিবদ্ধ সূদুর দিগন্তের দিকে, যেখানে আকাশ আর পৃথিবী এক হয়ে মিশে গেছে। তাকিয়ে আছে একই ভাবে কি এক অজানা টানে।
কি আছে সেখানে! কিসের টান যা অবনী ওর সারা জীবন ঢেলে দিয়েও তার সমকক্ষ হতে পারছে না। অবনীর ভূলটা যদি অম্বরকে না জিজ্ঞেস করে ওর জন্য এতকিছু করাটা হয়, তাহলে সেটা ওর বোকামি, নির্বুদ্ধিতা।
ভুল বা নির্বুদ্ধিতা কি অপরাধ? আর অপরাধই যদি হয় তবে তার জন্য সে কি দায়ী!
এই দিবা সায়াহ্নে সীমাহীন অথৈই জলের দিগন্তে অস্তগামী সুর্য্যর কম্পমান প্রতিচ্ছায়া যেন সমস্ত প্রথিবী জুড়ে একটা চাপা কান্নার সুর ছড়িয়ে দিচ্ছে। কান্নার সুরটা আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হচ্ছে।
কে কাঁদছে, কেন কাঁদছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
অবনীর হটাৎ করে খেয়াল হলো কান্নার সুরটা ওর আশপাশ থেকে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অবাক হলো অবনী, অম্বর কাঁদছে!
অম্বর কাঁদছে ঐ একই ভাবে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে!
নিস্তব্দ এই পরিবেশে বাইরের পৃথিবী কর্তৃক প্রত্যাখ্যত অবনী এই প্রথম বুঝলো এতসব কান্না এত চিৎকার গর্জন এতো প্রকৃতির নয়, এতো অম্বরের নীরব কান্না।
ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে অম্বর।
অবনীর বুকের ভিতরটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠলো। অম্বরের অবস্থান যে ওর বুকের গভীরে। তায় ওর কান্নার বেদনা যে ওর বুকের ভিতরেই গুমরে মরছে।
কতক্ষন ধরে কত দিন ধরে কাঁদছে অম্বর!
মনে হয় শুরু থেকেই। কিন্তু ব্যস্ত পৃথিবীর কোলাহলে আর ওর নিজের অন্ধ ভালবাসার মাতলামিতে অবনীর কানে অম্বরের কান্নার সে স্বর পৌছায়নি।
সারাক্ষন ধরে এমনি ভাবে ওর বুকের মধ্যে অম্বর কেঁদে চলেছে ঢুকরে ঢুকরে, অভিমান করে কাঁদছে অম্বর। অজন্ম কাঁদছে অম্বর অবনীর বুকের গভীরে। কিন্তু অবনীর কুলের রূপ রস গন্ধে নেষাগ্রস্ত চোখ কান বা কোন ঈন্দ্রিয়ই তা বুঝতে পারিনি। অম্বর বাতাসের শো শো শব্দে কেঁদেছে, নদীর স্রোতের কুল কুল ধ্বনিতে, সমুদ্রের অবিরাম গর্জনে, পশু পাখির ডাকে সারাক্ষন কেঁদে চলেছে।
ওহ! ওর সাথে বসবাস করে সারাটা জীবন অম্বর শুধু কেঁদেছেই!
অম্বর যেন কোন বড় পাপের মেয়াদী আসামি, শক্ত প্রাচির ঘেরা জেল খানার বাসিন্দা। এত যন্ত্রণা সহ্য করেও মুখ বন্দ করে মেয়াদ শেষ হওয়ার অপেক্ষা করেছে। জেলখানার প্রতিটি ক্ষন প্রতিটি মুহুর্ত গুনে গুনে ও শেষ করতে চেয়েছে।
এতকাল যে ঘরে বাস করেছে তাকে একটি মুহুর্তের জন্যও আপন ভাবতে পারেনি অম্বর। তায়তো ওর দৃষ্টি অসীমতার দিকে নিবদ্ধ।
যেখান থেকে আসা সেখানে ফিরে যাওয়ার আকুলতা!
জেলখানাকে কি কখনো আপন ঘর ভাবা যায়!

একটা অসহনীয় যনত্রনায় অবনীর বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো।
অবুঝ ছোট্ট শিশু সারাদিন বাইরে খেলাধুলো শেষে শরীর মনে আঘাত পেয়ে বুকভরা অভিযোগ নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মাতৃকোলে ছুটে এসে যদি দেখে কোন যাদুকর তার যাদুকাঠির ছোয়াই রক্তমাংসের উষ্ণ মায়ের কোলটা পাথরে পরিণত করেছে। তখন সে শিশু কি করবে কোথায় যাবে!
অবনী এখন যাবে কোথায়? কার কাছে জানাবে ওর অনুযোগ। ওর সবকিছু যে একটা শুন্যতায় ভরা।
পৃথিবী ওকে ঠেলে পর করে দিল দিন শেষে। আর অম্বরতো কোনদিনও ওর ছিল না! তবে এতদিন কাকে নিয়ে কি নিয়ে বাস করলো অবনী!
এক দিকে ওর মাটির গড়া শরীর দিয়ে অনেক দিনের জমে থাকা ঘামের দুর্গন্ধ ওকে অতিষ্ঠ করে তুললো। অন্য দিকে অম্বরের স্বর্গীয় সুবাস ওকে মাতাল করে রাখলো।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে লাগলো। মৃদু মন্দ শীতল বাতাস ওর চোখে মুখে লেগে ওকে ঘুমের নেশা ধরিয়ে দিল।