জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -৪।

আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০২২, ১৭:২৬

অম্বরাবনী- ৪ 

 

‘পোড়া কপালে’ বলে করা কটাক্ষটাতে আহত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিল অবনী তারপর ধীর পদক্ষেপে সেখান থেকে সরে সে নির্জন স্থানে গিয়ে দাঁড়ালো। সবার অলক্ষে সন্তর্পনে সে নিজের কপালের দাগটা হাত দিয়ে অনুভব করলো।
কপালের পোড়া স্থানটা খুব পরিস্কার ভাবে ওর হাতে বাধছে। দাগটা ওর নিজের চোখে না
পড়লেও অন্য কারো চোখ এড়ানোর মত নয়। যে কেউ ওর দিকে তাকালেই সব কিছু বাদ দিয়ে প্রথমেই পোড়া কপালটা চোখে পড়বে। ভাবল অবনী।
অর্থাৎ সবাই ওকে পোড়া কপাল বলে, কেউ মনে মনে আর কেউ জোরে জোরে। কথাটা ভেবে যন্ত্রনায় ওর বুকটাা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো।
সেদিন চুপি সারে অনেকটা পালিয়ে স্কুল থেকে বাড়ী ফিরলো অবনী।
ততোক্ষনে বাড়ীর সবাই ওর ক্লাসে ফার্ষ্ট হওয়ার কথাটা জানে। সবাই হাসে মুখে ওর প্রশংসা করতে লাগলো। কিন্তু অবনীর কানে যেন কিছুই ঢুকছিলো না। ও জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করলো। তারপর সবাইকে এড়িয়ে সোজা নিজ রূমে প্রবেশ করলো।
বালিশে মুখ গুজে বিছানায় অনেকক্ষন ধরে শুয়ে থাকলো অবনী। কি করবে, কাকে কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না।
ওর এ কষ্টের কথা কাকে বলবে কি করে বোঝাবে সে সব! ওর এই অযাযিত কষ্টটা বুঝে সমাধান দিতে পারে এমন কাউকে চিন্তা করতে লাগলো অবনী।
মায়ের কথা ভাবলো। মা ওকে তার বুকের সব উষ্ণতায় ভরিয়ে ওর জ্বালাটা উপশম করবে ঠিকই। কিন্তু তারপর! ওর ঐ দাগটাতো আর মুছে দিতে পারবে না।
ভাবলো ক্লাসে ফার্ট না হলে হয়তো এমনটি হতো না। দাগটা অত কদর্য ভাবে অন্ততঃ অরপার চোখে হয়তো পড়তো না।
মনে হলো ওর এই পোড়া মুখটা আর দেখাবেনা কাউকে। লেখাপড়া মেলামেশা সব কিছুই ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।
-তা কি করে হয়! কোথায় যাবে, কে আছে ওর!
কোন কুল কিনারা না পেয়ে নিজের রেজাল্টের কথা চিন্তা করে কপালের পোড়া দাগটার কথাটা ভুলতে চেষ্টা করলো অবনী।

অকেক্ষন পর উঠে বেসিনে চোখ মুখটা ধুয়ে নিল। অনেক সময় ধরে নিজেকে আয়নায় দেখলো। আজকের মত পূর্বে কোন দিনই কপালের দাগটা অত খেয়াল করে দেখেনি অবনী। কিন্তু এখন দাগটা অনেক স্পষ্ট হয়ে কদর্য ভাবে ওর চেখে ধরা পড়তে লাগলো।
পোড়া জায়গাটা হাত দিয়ে স্পর্শ করে একান্ত ভাবে অনুভব করতে মন চায়লো আজ।
এই প্রথম দাগটা ঢেকে ফেলার প্রয়াস পেল অবনী। তোয়ালের এক কোনা দিয়ে দাগটা ঢেকে নিজেকে দেখলো কিছুক্ষন। এই প্রথম ওর মনে হলো কপালের দাগটা ঢাকতে পারলে ওকে অনেক সন্দুর দেখাতো।
-আহ দাগটা বাদে কি সন্দুর ওর মুখটা। দাগটা বাদ দিলে ও সবার সেরা হতে পারতো। বুক ফুলিয়ে মাথা উচু করে চলতে পারতো। বিধাতা প্রদত্ত কোন কিছুকে নিয়ে যারা কটাক্ষ করে তাদেরকে বিরত রাখার জন্য কটাক্ষের স্বীকার অসহায় মানুষদের চাপা কষ্টের কথা ওদেরকে বলতে পারতো।
বলতো -বিধাতা প্রদত্ত চেহারার জন্য আমার কি দোষ? কি করব এখন আমি। ঐ চেহারা থেকে বেরিয়ে আসার কোন উপায় তো নেই। বিধাতার ঐ দানকে নীরবে মেনে নিয়ে আমি যে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে চায় তার জন্য বরং আমাকে উৎসাহ দেয়া দরকার।
আরো বলতো- তোমাদের উপহাস আমাকে খুব কষ্ট দেয়।
এ বিষয়ে কিছু যে করার নেই ওর। দাগটা যে ওর কপালে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে।
বুক খালি করে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
আফসোচে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রইলো।
ওর মা বাবা সবাই খুশী ওর রেজাল্টে। বাবা গর্ব করে অন্য ছেলে মেয়েদেরকে বললেনও সে কথা।
অবনীর মা খুশীতে আপ্লুত হয়ে খোদার কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। অবনীকে জড়ীয়ে ধরে অভ্যাসবসতঃ ওর কপালের পোড়া দাগটার উপর চুমুই চুমুই ভরে দিতে লাগলেন।
হায়রে নিয়তি যে দাগটা সবার চোখে ওকে কদর্য করে রেখেছে, যে দাগটা প্রতি মুহুর্তে ওকে কষ্টে কষ্টে নিষ্পেষিত করছে, সেই দাগটাকেই ওর মমতাময়ী মা এত আদর করছে! করবে না কেন অবনী যে তার শরীরের একটা অংশ। নিজের শরীর যতই কদর্য হোক তাকে কি ঘৃনা করা যায়!
মা ওকে আড়ালে ডেকে সবার অলক্ষে কবিরাজ দাদুর কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন। বললেন -বাবা তুই অনেক বড় হবি, কোন বাধাই তোকে আটকাতে পারবে না।
কবিরাজ দাদুর কথাগুলো স্মরণ করে কিছুটা হলেও সব ঝেড়ে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস হল মনে। মায়ের অকৃতিম ভালবাসা বিশেষ করে ওর কপালের দাগটা যা এ মুহুর্তে ওর কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছে সেটাকে ওভাবে আদর করাটা অবনীর মনে কিছুটা আশার সঞ্চার করলো।
অবনীর সাফল্যের আড়ালে লুকানো যে ব্যথাটা তার বর্ণ বিষর্গও কেউ জানলো না। ওর সুখের জগতে ও অনেক আপন জনদের পেল, কিন্তু ওর কষ্টের জগতে অবনী একদম একা হয়ে রইলো। ওর মনের এত বড় একটা কষ্টের অংশীদার ও কাউকেই করতে পারলো না।
জীবন নিজ গতিতে এগিয়ে যেতে লাগলো।

এমনিতে কোন সমস্যা হয় না, সবার মধ্যে মিশে থাকলে অনেকের একজন হয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখা যায়। কিন্তু কোন কারণে সবার নজরটা যখন ওর দিকে পড়ে তখনই সব কিছুর আগে ওর কপালের দাগটা সবার নজরে পড়ে।
কপালের দাগটা সম্পর্কে সচেতন হওয়াই অবনী ধীরে ধীরে নিজের অজান্তেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো।
আজকাল ক্লাসে শিক্ষক কোন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তার উত্তর জানা থাকলেও অবনী হাত তোলেনা। আবার কোন বিষয় সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকলেও হাত তুলে বা দাড়িয়ে কোন প্রশ্ন করে না।
ব্যপারটা অন্য কারো নজরে না পড়লেও অরপার নজর এড়ালো না। আগে অবনী কোন প্রশ্নের জবাব দিলে যেখানে ওর রাগ হতো, হিংসা হতো, এখন অবনীর অযাচিত নির্লিপ্ততা ওর মনকে অস্বস্তিতে ভরে তুলতে লাগলো।
অন্য কেউ না বুঝলেও অরপা বুঝলো অবনী ইচ্ছা করে ক্লাসে চুপচাপ থাকে।
-কি হয়েছে অবনীর! ভাবলো অরপা। এভাবে দিনের পর দিন অবনী নিজেকে কেবল গুটাতে লাগলো।
অরপা ওর বাবার কোলের উপর মুখ লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেদিন অননীর প্রতি রাগে আর হিংসায় ওকে পোড়া কপাল বলে কটাক্ষ করেছিলো, আর কাছে দাড়িয়ে অবনী সে কথা শুনে ধীর পায়ে চলে যাওয়ার সময় পিছন থেকে খেয়াল করেছিল অরপা। কিন্তু তখন রাগটা এত তীব্র ছিল যে কোন অনুশোচনা বোধ ওর মধ্যে আসেনি। কিন্তু এখন দিনে দিনে অবনীর এ অবস্থা দেখে অরপার মধ্যে ধীরে ধীরে একটা অপরাধ বোধ জন্ম নিতে লাগলো।
অরপা আগে লক্ষ্য করতো লুকিয়ে লুকিয়ে অবনী ওর দিকে তাকায় বা ওর কাছাকাছি বসতে বা আসতে চেষ্টা করে। অমন চেষ্টা অবশ্য ক্লাসের সকল ছেলেরাই কমবেশী করে। কিন্তু আজকাল অবনী যখন ক্লাসে মন মরা হয়ে বসে থাকে, অন্য কারো দিকে খেয়াল করেনা, অরপা এখন ওর দিকে অন্য সবার তাকানো আর অবনীর তাকানোর মধ্যে যে একটা পার্থক্য ছিল সেটা বুঝতে পারে।
ক্লাসে অবনীর কোন তৎপরতা না থাকায় এখন সব বিষয়েই অরপারই জয়জয়াকার। অনেক মেধা আর শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত রাজমুকুটটা ও যেন এমনিতেই অরপার মাথায় পরিয়ে দিল। কোন কিছুই চায়লো না বিনিময়ে।
অস্বস্তিতে ভরে উঠলো অরপার মনটা।

-অবনী তোমার সাথে আমার একটু কথা বলা দরকার, সময় হবে।
বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা করার পর একদিন স্কুল ছুটির সময় অনেকে বেরিয়ে গেলে একটু সুযোগ বুঝে অরপা কথাটা বললো অবনীকে।
এভাবে অবনীর সাথে সরাসরি কথা বলা অরপার এই প্রথম।
পূর্বে এমন ঘটনা ঘটলে অবনীর মনের অবস্থা কি হতো তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। কিন্তু এ পর্যায়ে ওর মনটা যখন পোড়া মাটির মত শুখনো ঠনঠনে হয়ে গিয়েছে তখন আর একটি ফোটা পানিরও কোন চাহিদা তাতে ছিল না।
অবনী কি ভাবলো তা ও নিজেও জানে না। তবে এমন একটা আকাঙ্ক্ষিত ডাক ওর মনে একটুও আবেগ সৃষ্টি করতে পারলো না।
অরপার চোখের দিকে সরাসরি তাকালো অবনী। এভাবে এত কাছ থেকে ওর চোখে চোখ রেখে কখনো দেখিনি ওকে। ভারী সুন্দর দেখতে অরপা। ভাবলো অবনী।
-তুমি ঠিকমত পড়াশোনা করো, ম্যট্রিকে ভাল রেজাল্ট করবে।
কথাটা বলে অবনী আর দাড়ালো না। অরপাকে কোন কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হন হন করে হেটে চলে গেল।

অবনী ধীরে ধীরে একদম গুটিয়ে সবার একজন হয়ে নিজেকে লুকালো। ওর পড়াশোনার গ্রাফটা নামতে নামতে ওর অন্যান্য ভাইদের সমপর্যায়ে চলে আসলো।
বিষয়টা ওর বাবার নজর এড়িয়ে গেল। কারণ তিনি বোধহয় অবনীর মধ্যে উঁকি দেয়া সুপ্ত সম্ভাবনার দিকে কোন দিনই নজর দেননি। অবনীকে তার অন্যান্য ছেলেদের মত ভবিষ্যৎ জীবনে মধ্যবিত্ত সমাজের অন্য দশজনের একজন হিসাবেই গন্য করতেন তিনি।
কিন্তু এতে খেয়ালী বিশ্বনিয়ন্তার কি এসে যায়।
অবনীকে নিয়ে বিধাতার অভিনব পরিকল্পনা নিজ গতিতেই এগিয়ে চললো।
নিচে নামতে নামতে যখন বোধহয় একদম তলায় গিয়ে ঠেকলো তখন অবনীর ভিতর অলৌকিক ভাবে সব ঝেড়ে ফেলার এক অদম্য স্পৃহার জন্ম নিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ও সবাইকে তাক লাগিয়ে বোর্ডে প্রথম স্থান অধিকার করলো। ওর অগ্রযাত্রার পালে নতুন করে বৈশাখী ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা লাগলো।
এরপর মেধার বলে অবনী ওর ভাই বোন, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে ডিঙ্গিয়ে অনেক উচুতে নিজের আসন করে নিল। নিজের স্কলারশিপের টাকায় ও দেশের সবচেয়ে নামি দামি কলেজ ইউনিভারসিসিটিতে পড়াশোনা করে একেবারে অন্য জগতের মানুষে পরিণত হলো।
এমনি সময় ওর মা মারা গেলেন। নিজের অর্জিত সাফল্যের আড়ালে ওর আজন্ম লালিত কষ্টগুলো সাময়িক ভাবে ঢাকতে পারলেও মায়ের মৃত্যুতে অবনীর বুকটা ব্যথায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। মাকে ছাড়া জীবনটা অনর্থক মনে হলো। জীবনে এই প্রথম মনে হলো ওর যেন কোথাও কেউ নেই। মায়ের সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকলেও মায়ের উষ্ণতা ওর সব কষ্টকে দূরে ঠেলে রাখতো। মাকে হারানোর পর থেকে একটা উষ্ণ সান্নিধ্যের আশায় মনটা সবসময় আনচান করতে থাকে।
মা মারা যাওয়ার পর বাড়ীর সাথে ওর সম্পর্কেরও একটা ছেদ পড়লো। নিজের বলতে যা কিছু আছে তার থেকে দূরে কোথাও যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করে উঠলো।
বহুজাতিক কোম্পানীতে একটা চাকরী পেল অবনী। ভালোই হলো ওর জন্য। জীবন কাটানোর জন্য চেনা জানা পৃথিবী থেকে দূরে এমন একটা কিছু ওর খুব প্রয়োজন ছিল সে সময়।