Heading
আপডেট: ২৫ Jun ২০২৩, ১১:৪২
দেশে ফিরে এলো অমর লন্ডনের জীবনটাকে পিছনে ফেলে।
বাবার দেহে প্রাণটা তখনও ধুক ধুক করছিলো। কিন্তু তার কথা বন্দ হয়ে গিয়েছিল কয়েকদিন আগে থেকে। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে তিনি দেখেছিলেন ছেলেকে। কিছুই বলতে পারেননি। দুচোখের কোনা বয়ে নীরবে কেবল অশ্রু ঝরছিল অবিরাম।
মৃত্যু সজ্জায় বাবাকে খুব অসহায় মনে হয়েছিলো অমরের। তার মুখের উপর ভেসে উঠা রেখাগুলো দেখে বোঝা যাচ্ছিলো অনেক অব্যক্ত ব্যথা নিয়ে তিনি বিদায় নিচ্ছেন। কিন্তু তার কিছুই বলে যেতে পারলেন না।
সাধ্যমত সব কিছু করলো বাবাকে বাচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না।
অমর আসার পাচ দিনের মাথায় কাউকে কিছু না বলেই, ছেলেকে কেবল চেয়ে চেয়ে দেখেই বিদায় নিলেন আমির চৌধুরী।
মৃত্যু যেন অতি দরদীর মত তার জীবনের শত কঠিন অব্যক্ত ব্যথাগুলো পাশ কাটিয়ে বিদায় নিতে সহায়ক হলো।
জীবনের সব অর্জন ব্যর্থতা সব কিছু আর সবাইকে ফেলে অপূর্ণতায় ভরা হৃদয়ে বিদায় নিলেন তিনি। তার ইচ্ছে অনিচ্ছের কথা তিনি বলে যেতে পারলেন না। এখন তার একমাত্র পুত্র অমরকে বাবার রেখে যাওয়া যাবতীয় কর্মকাণ্ড দেখে আর তার ঘনিষ্ঠ জনদের কাছ থেকে শুনে সব বুঝতে হবে।
বিধাতার বেলাও বোধহয় অনেকটা এরকমই; তাঁর চাওয়া বা ইচ্ছার কোন কিছুই পরিস্কার করে বলেন না। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে রেখে যাওয়া বিভিন্ন কার্যক্রম দেখে আর বিভিন্ন দৈবজ্ঞ জনের কথা শুনে বুঝে নিতে হয়।
প্রকৃত অর্থে বাবার অকাল মৃত্যু অমরকেও ওর জীবনের কিছু কঠিন বাস্তবতাকে পিছনে ফেলে আসতে সহায়ক হলো।
বাবার মৃত্যুতে বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু বাস্তবতার সব অনুশাসন মেনে বাবাকে যথাযত মর্যাদার সাথে সমাধিস্ত করলো অমর।
জমিদারীর হাল ধরলো। কাজের মধ্যে ডুবে কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলতে চায়লো নিজেকে। সব জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনা দিয়ে বাবার অবলা ইচ্ছানুযায়ী জমিদারীর উন্নয়নে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করলো।
দিনে দিনে সবই স্বাবাভিক হয়ে আসলো। থমকে থাকা সব কিছুতেই আবার নতুন করে গতি সঞ্চারিত হলো।
জমিদারী সংক্রান্ত শত সহস্র কথা বলে যখন ফুরাতে পারছিল না তখন অমর ওর নিজের কথাগুলো কাউকেই বলতে পারলো না। ওর নিজের কোন কিছুকেই ভুলতেও পারলো না, কারণ সেসব ভুলা যায় না। সবকিছু ওর বুকের মধ্যে কেবল গুমরে মরতে লাগলো।
কাকে বলবে কথাগুলো! বাবাকে হয়তো বলা যেত সবকিছু। কিন্তু তাতো আর হলো না।
এখানে সবাই সবই নিজ নিজ গতিতেই চলছে। ওর অবলা বেদনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তার জন্য কোন কিছুই থামবে না এখানে। অমর চায়ও না যে কিছুর জন্য কিছু থেমে থাকুক।
প্রায় ছ মাস হয়ে গেল। চেরী কি অবস্থায় আছে কে জানে!
-খোকা, নতুন ডাক্তার আপামনি এসেছে।
খোদাবকস, ওদের পুরনো চাকর, অমরকে কেলে পিঠে নিয়েছে ছোট কালে। ওর ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল।
উঠে দাড়ালো অমর। খোলা জানালা দিয়ে তাকালো বাইরে। সুর্য্যরে আলো ফুটতে শুরূ করেছে ততোক্ষনে।
একজন মহিলা ডাক্তারের দরকার হাসপাতালটার জন্য। প্রথম থেকেই ব্যপারটা অমরের দৃষ্টিতে পড়েছিল। কিন্তু কোন মহিলা এখানে চাকরীর জন্য আসবে বলে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল ওর মনে।
অনিরূদ্ধ বিষয়টা আলোচনা করাতেই অমর ওকেই বলেছিল কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে। একটাই এপ্লিকেশান পড়লো। অনিরূদ্ধ ট্রাংকলে যোগাযোগ করে, কথা বলে অমরের মত নিয়ে তাকে যোগদান করতে বলছে।
সেই ডাক্তারই বোধহয় হবে। ভাবলো অমর।
-খোকা, এ ভাবে রাত জেগে জেগে ছাই পাস ভেবে কিছু কি হবে? তোমার শরীরের কি অবস্থা হচ্ছে সেদিকে খেয়াল আছে। ওদিকে তোমার মা’রও একই অবস্থা গত ছয় মাস ধরে।
অমরের ইজি চেয়ারটা জানালার ধার থেকে সরিয়ে রাখতে রাখতে খোদাবকস কথাগুলো বললো।
-তুমি ডাক্তার ম্যাডামকে বসিয়ে নাস্তা দাও, আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি করে একটা তোয়ালে নিয়ে বাথরূমে ঢুকলো অমর।
কিছুক্ষন বাদেই তৈরী হয়ে ঢুকলো কাচারি ঘরে।
জমিদার বাড়ীর সামনে দিকে অবস্থিত প্রশস্ত জমিদার আমলের কাচারিঘর। মোটা দামী কার্পেট বিছানো, জানালা দরজায় ভারী পর্দা ঝুলছে। আয়তকার কক্ষটির সামনের দিক দিয়ে ঢোকার দুটো দরজা দুপাশে। পিছনেও দুটো দরজা তবে সামনের দুটোর ঠিক মুখোমুখি নয়। এই কক্ষ থেকে বাড়ীর মধ্যে যাতায়াতের জন্য সুবিধামত পিছনের দিকের দরজা দুটো বসানো। আর সব দিকেই পর্যাপ্ত সংখ্যক জানালা।
পূব পশ্চিম লম্বা দক্ষিনমূখি কাচারি ঘরের সামনে পুরোটা জুড়ে দশ ফুটের মত চওড়া আও পাচ ফুটের মত উঁচু বারান্দা। বারান্দা থেকে নিচে নামার জন্য পুরো বারান্দা ঘিরে লম্বা লম্বা শেত পাথরে মোড়া সিড়ি। সামনে বেশ অনেক খানি খোলা জায়গা।
কাচারি ঘরের পূর্ব পাশটাতে লাইব্রেরী। দেয়ালের সাথে লাগানো অনেকগুলো আলমারী, থরে থরে বই সাজানো। বসে পড়ার জন্য একটা বড় টেবিল ও বেশ কয়েকটা চেয়ার।
লাইব্রেরীর সাথেই পিছনের দেয়াল ঘেসে লম্বা ডাইনিং টেবিল আর চেয়ার।
পূর্ব পশ্চিম দিক লম্বা রূমটার মোটামুটি এক তৃতাংশ জুড়ে লাইব্রেরী আর ডাইনিং স্পেস। একটা পর্দা টাঙিয়ে জায়গাটুকু আলাদা করা।
অবশিষ্ট অংশ জুড়ে বসার জায়গা। বিশ্বের নানা দেশের নিদর্শন গুলো নিপুনভাবে দেয়ালে এবং ছোট ছোট সাইড টেবিলে সাজানো। বসার সোফা আর সাইড টেবিলগুলোও বিশ্ব কারূকার্য্যরে সাক্ষ্য বহনকারী।
পশ্চিম পাশের দেয়ালে সব চৌধুরীদের ছবি টাঙানো। ওই দিকটায় ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে বসে নতুন মহিলা ডাক্তার।
হালকা কচি কলা পাতা রংয়ের শাড়ী পরা। শ্যম্পু করা ঝিরঝিরে মাজা অব্দি লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দেয়া। গায়ের রংটা ফরসা।
-ডক্টর লাবনী?
কথাটা বলতে বলতে অমর চৌধুরী একটু ব্যস্ত ভাবে প্রবেশ করল।
ভদ্রমহিলা উঠে দাড়ালেন।
-আমি অমর চৌধুরী। বসুন দয়া করে।
পাচ ফুট পাচ ইঞ্চির মত লম্বা। অমর চৌধুরী থেকে চার পাচ ইঞ্চি খাট হবেন ভদ্রমহিলা। বয়সটা অমরের মত বা একটু বেশীই হবে। চেহারায় আভিজাত্যের ছাপের সাথে একটা ভারিক্কি ভাব আছে।
-অনিরূদ্ধ এখনি এসে পড়বে।
ডাঃ লাবনীর পাশের সোফায় বসলো অমর।
-আসার আগেও টেলিফোনে ওর সাথে কথা হয়েছে। ওর সাথে দেখা না হলেও কথা হয়েছে কয়েকবার। অনিরূদ্ধ আমার জুনিয়র, আমার দু বছর পর ডাক্তারী পাশ করেছে ও।
লাবনীকে ভালো লাগলো অমরের। বিশেষ করে ওর স্বতঃস্ফুর্ততা আর গাম্ভীর্য্য। লাবনী ব্যক্তিত্ব সচেতন আর পোশাক পরিচ্ছদেও পরিপাটি।
রাজধানী শহরে একটা হাসপাতালে কাজে যোগ দিয়েছিল। সেখানে কাজ করেছে কয়েক মাস। কিন্তু এখানকার কাজটা ওর কাছে চ্যালেঞ্জিং মনে হয়েছে। একটা হাসপাতালকে শুণ্য থেকে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় অংশ গ্রহন করার মানষিক টানটা উপেক্ষা করতে পারিনি।
তাছাড়া শহর আর পরিচিত মুখগুলো ছাড়ার জন্য কিছুদিন ধরেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো লাবনী।
ওর ইচ্ছা পরিবেশ ভালো হলে চাকরীটা এখানেই করবে আর ওর পাচ বছরের ছেলেকে নিয়ে এখানেই থাকবে।
অমরের ব্যবহার লাবনীর ভালো লাগলো।
-আপনার পরিকল্পনার কথা আমি অনিরূদ্ধর কাছ থেকে শুনেছি। আমার পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগীতার আশ্বাস আমি দিতে পারি।
মৃদু হাসলো অমর চৌধুরী।
অনিরূদ্ধ প্রবেশ করলো।
-অনিরূদ্ধ আসুন। আপনার কথাই আলোচনা হচ্ছিলো। এই কিছুক্ষন হলো ডাঃ লাবনী এসেছেন।
টেলিফোনে কয়েকবার যোগাযোগের ভিত্তিতে লবিনী সম্পর্কে একটা ছবি একেছিল মনে মনে অনিরূদ্ধ। কিন্তু ওকে সামনা সামনি দেখে ওর আকা ছবির সাথে এই লাবনীর কোন মিল নেই দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো ওর দিকে।
একহারা গড়নের পরিপাটি সুশ্রী লাবনী।
-তুমি অনিরূদ্ধ। তোমার সাথে কথা বলে যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে তুমি অনেক বেশী স্মার্ট।
কথাগুলো বলে লাবনী তাকালো অমর চৌধুরীর দিকে। স্মীত হেসে বললো -মিঃ চৌধুরী আপনার হাসপাতালের প্রতি অনিরূদ্ধর উৎসাহ দেখে আমি অভিভূত।
এ ধরণের প্রশংসায় অনিরূদ্ধ কৃতজ্ঞতায় আরো জড়ষঢ় হয়ে সোফার এক পাশে বসে মৃদু হাসতে লাগলো।
লাবনীর মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন আধিপত্য বিস্তারকারী আকর্ষনীয় ব্যক্তিত্ব বিরাজ করে।
-খোকা, তোমাদের নাস্তা টেবিলে দিয়েছি।
ঘাড়ের উপর রাখা কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে খোদাবকস বললো।