জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'মৃত্যু পথযাত্রীর কথা'।

আপডেট: ১৩ Jun ২০২৩, ১২:৪৩

মৃত্যু পথ যাত্রীর কথা

 

মেহের কুঞ্জে আসলে বৃষ্টির জন্য মনটা সারাক্ষণ আনচান করে। বৃষ্টি মানুষকে ঘর মুখী করে নিজের দিকে তাকানোর পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়। প্রকৃতি ঘেরা এ বাড়ীতে বসে নিজের ভিতর ডুব দেয়ার স্বাদ অনন্য।
এটা আমার চার পুরুষের পৈত্রিক নিবাস। এখানে আমার জীবনের সবচেয়ে মধুর স্মৃতি ছেলেবেলা লুকিয়ে আছে। প্রায় দশ একর জমির উপর বাগান ঘেরা মেহের কুঞ্জ। আমার পর দাদার আমলের বাড়ীটা পরবর্তী প্রজন্মের সকলে মেরামত করে বাইরের চেহারাটা ঠিকঠাক রেখে ভিতরের বিভিন্ন ফিটিংস গুলো যুগোপযোগী করে রেখেছে। আর বাড়ীটা ঘিরে রাখা বিশাল বাগানে নতুন নতুন গাছগাছালি লাগিয়ে এর সৌন্দর্য বর্ধন করে সমৃদ্ধ করেছে।

এ বংশের অন্যান্যদের মত আমিও সারা জীবন সাফল্যের পিছনে ছুটে আর তা হাতের মুঠোয় ভরে জীবনটাকে খুব মধুময় আর অর্থপূর্ণ করে তোলার কাজে ব্যস্ত থেকে যৌবনের সব টুকু সময় কাটিয়ে দিয়েছি।
সে বয়সে শরীরটাও যেমন হালকা ফুরফুরে ছিল মনটাও তেমন। একখানে সাফল্য না পেলে অন্যটার পিছনে ছুটেছি। অনেকটা মধুকরের ফুল থেকে ফুলে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহের মত।
জীবন আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। জীবন কখনো থেমে যাওয়া তো দুরের কথা, পাওয়ার আনন্দে একটুও গতি কখনো কমাতে হয়নি। সামনে এগিয়ে যাওয়ার নাম ছিল জীবন।

ইদানিং মনটা অতৃপ্ততায় ভরে থাকে। জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় নিজেকে বড় অসহায় আর কেন জানি অসম্পূর্ণ লাগে।
সব আছে সবাই আছে, সব কিছু ভাল কিন্তু তবুও কেন যে এমন হয় বুঝি না।
জীবনের এ বেলা শেষে শরীরের চাহিদার প্রকার প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে আমি যখন নিজেকে গুটিয়ে নিতে চেয়েছি, মনও তখন তাতে সাই দিয়ে আমাকে বিশ্রাম নিতে বাধ্য করেছে।
নিজেকে নিজের মধ্যে টেনে এনে জীবনের এই শেষ বেলায় নিজেকে খুব একাকী লাগে আমার। মনে হয় আমি যেন আটকে আছি কোন জেলখানায়। বের হওয়ার জন্য সারাক্ষণ মনটা আনচান করে।

ছেলে মেয়ে দুটো নিজেদের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। তারা নিজ নিজ ভুবনে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। সে সব দেখে বছর দুই আগে শান্তিতেই চোখ বুজেছে আমার স্ত্রী। ব্যস্ততার জন্য ছেলে মেয়ে দুটো তখন কেউ আসতে পারিনি। আমিও তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করে ওদের আশ্বস্ত করে বলেছিলাম –আমি তো আছি, সব সামলে নেব। পরে অবশ্য দুজনই আলাদা ভাবে এসে মায়ের জন্য কান্নাকাটি করে গেছে।
ছেলে মেয়ে দুজনেই আমার জন্য ওদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এতকাল তো দুজন ছিলাম এখন আমি একদম একা, কি করে আমার দিন কাটবে আর একটা কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে!
আমি হেসে ওদের আশঙ্কাকে হালকা করে দিয়েছি।

আমার শহরের বাড়ীতে বসবাসের জন্য সব ধরনের আরাম আয়াসের ব্যবস্থা আছে। পাহারাদার, কাজের লোক, গাড়ী, ড্রাইভার আর দীর্ঘ দিন অবস্থান করার সুবাদে অনেক বন্ধু বান্ধব আপন জনও আছে। তাছাড়া অসুখ বিসুখের জন্য কাছাকাছি হাসপাতাল ইত্যাদিও আছে।
বন্ধু বান্ধবের সাথে সাধারণত সারাক্ষণই টেলিফোনে কথাবার্তা হয় আর মাঝে মাঝে বিকেলে কাজের মানুষটাকে সাথে নিয়ে ওয়াকওয়েতে হাটতে যায়। শরীরে কুলোই না বলে আজকাল কোন সামাজিক অনুষ্ঠান বা দাওয়াতে যাওয়া ছেড়েই দিয়েছি।
ছেলে মেয়ে দুটো নিয়মিত টেলিফোন করে খবর নেয়। আমি করি না, ওরা নানা কাজে ব্যস্ত থাকে তাই বিরক্তির কারণ যেন হতে না হয় সে সংশয়ে। ওরা ওদের সময় বুঝেই টেলিফোন করে খবর নেয়।

মেয়েরটার বাচ্চা হবে, সংবাদটা পেয়ে মনটা এক অভূতপূর্ব খুশীতে আন্দোলিত হল। ভাবছি ওদের প্রথম সন্তান, সে খুশীর ভাগ নেয়ার জন্য ওখানে যাওয়া খুবই প্রয়োজন। ও আমাদের বড় সন্তান ওর জন্মের খুশীটা নতুন করে আমার মন দেহকে আন্দোলিত করল।
শরীরটা সাঁই দিচ্ছিল না তবুও ঠিক করলাম এ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমি যাব। আবার ভাবলাম এটা যদি শেষ যাওয়া হয় তাহলে আমার জন্য ওদের খুশীটা আবার মাটি না হয়ে যায়? যেটা আমি কিছুতেই চায় না।
ওই একই সময় ছেলেটার সমাবর্তনের খবর আসলো। দীর্ঘ চার বছর কঠোর পরিশ্রমের পর সে পি এইচ ডি ডিগ্রী পেতে যাচ্ছে। দুটো ঘটনাই খুব আনন্দের, কিন্তু ঘটনা দুটো ঘটছে আমার অবস্থান থেকে যোজন দূরে দুটো আলাদা জায়গায়। দু’জায়গাতেই যাওয়ার জন্য মনটা আনচান করছে কিন্তু শারীরিক সীমাবদ্ধতা কঠিন ভাবে পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
তাইতো অসহায়ত্বের যন্ত্রণা মিটাতে শহর ছেড়ে এই পিতৃপুরুষের ভিটেই ফিরে আসা।

খোদাবক্স নামে অশীতিপর এক বৃদ্ধ যে বাবার আমল থেকেই এ বাড়ী দেখাশোনা করে রাখে সেই আমাকে অভ্যর্থনা জানালো। ওকে আগেই টেলিফোনে আমার আসার কথা জানিয়েছিলাম।
খোদাবক্স আমার থেকে বছর দশেকের বড়। লেখাপড়া জানা তবে কতদূর অব্দি পড়েছে বলতে পারব না। সে খুব গভীর কথা বলে, অনেকটা দার্শনিকের মত। বুঝি সেটা আমার বাবার কাছ থেকে পাওয়া।
খোদাবক্স পরিবার সহ এ ভিটেতেই আলাদা করে বানানো একটা ঘরে থাকে। তার দুটো ছেলে বড় হয়ে নিজেদের মত দূর শহরে থাকে। ওর বউটাও মারা গিয়েছে অনেক বছর। খোদাবক্সও আমার মত একা। ওর বউটা মারা যাওয়ার পর আমি নিজে এসে ওকে আমাদের বাড়ীর একটা ঘরে থাকার বন্দোবস্ত করেছি।
ছ ফুটের মত লম্বা, একদম পাতলা শরীরের গঠন। চোয়ালের হাড্ডিদুটো বেরিয়ে চোখদুটো লম্বা নাকের দুধারে দুটো গর্তের ভিতর জ্বলজ্বল করে। বাবার খুব প্রিয় পাত্র ছিল খোদাবক্স। মা মারা যাওয়ার পর বাবা শহরের বাসায় একাকী থাকতেন। শেষের দিকে বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লে খোদাবক্স শহরের বাসায় বাবার সাথে থাকতো। তিনি খোদাবক্সের হাতের উপর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমি পরিবার নিয়ে তখন বিদেশে। খোদাবক্স বাবার লাশ বাড়ীতে নিয়ে আসে। কবর দেয়ার সময় আমি কোনরকমে এসে হাজির হয়েছিলাম।
খোদাবক্সের কাছ থেকেই বাবার শেষের দিনগুলোর কথা শুনেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে খোদাবক্স বাবার মত আমাকে খোকা বলে ডাকে।

-খোকা, তোমার শরীর দেখছি খুব শুখিয়ে গেছে!
খোদাবক্সের এই সামান্য কথাটা আজ অনেক ভারী লাগলো। কোন তৃষিত মানুষকে ছোট এক গ্লাস পানি দিলে সে দিকে তাকিয়ে যেমন তৃষ্ণাটা অধিক বেড়ে যায় ঠিক তেমনি খোদাবক্সের কন্ঠটা আমার আপন জনদের ডাক বঞ্চিতের তৃষ্ণাটা বাড়িয়ে দিল।
কত দিন পর কেউ আমাকে খোকা বলে ডাকা শুনে আমার থেকে কয়েক বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও খোদাবক্সকে বাবার মত মনে হতে লাগলো।
বাবার মৃত্যুর সময় কেবল খোদাবক্সই তার পাশে ছিল। মৃত্যুর সময় বাবা কি বলেছিল কি কি করেছিল সেটা খোদাবক্স বাদে আর কেউ জানে না। সেসব ভেবে আমার চোখদুটো অশ্রুসজল হয়ে উঠা দেখে খোদাবক্স তাড়াতাড়ি আমাকে ঘরে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে নেয়ার জন্য তাড়া দিল।
আমি নিজেকে সংবরণ করে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেলাম।

মেহের কুঞ্জ মানে আমার পৈত্রিক বসত বাড়ী। দোতলা বাড়ীটার চারদিক ঘিরে ছ’ফুটের মত উচু ছাদওয়ালা বারান্দার উপর তৈরি। হাত মুখ ধুয়ে দোতলা থেকে নেমে দেখি খোদাবক্স পশ্চিম পাশের বারান্দায় পাতা টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখছে।
-আজ বৃষ্টি হবে খোকা, মনে হচ্ছে অনেক বড় বৃষ্টি হবে যেমনটি তুমি পছন্দ কর।
কথা বলতে বলতে খোদাবক্স পাশের একটা চেয়ারে বসলো।
ঘড়িতে দেখি দুপুর সবে গড়িয়েছে কিন্তু চারদিক অন্ধকার আর একটা গুমটে ভাব।
-তোমার বাবার মৃত্যুর আগে নয় দিন আমি তার সাথে ছিলাম। তিনি কিছুতেই হাসপাতালে যেতে চাইলেন না। অগত্যা তার বন্ধুরা মিলে ডাক্তারকে বাড়িতে ডাকানোর ব্যবস্থা করল। তারা সার্বক্ষণিক একজন নার্সের ব্যবস্থা করলেও তোমার বাবা নার্সকে পাশের রুমে থাকতে বলে আমাকে তার পাশে সব সময় থাকতে বলতেন।
খোদাবক্স একটু থেমে কি যেন একটা ভেবে নিল।
-জান খোকা, ওখানে তোমার বাবার অনেক ভাল ভাল শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু ছিল, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তারা কেউ তোমার বাবার মনের গন্ডি পেরিয়ে হৃদয়ে পৌছাতে পারিনি। মানুষের শরীর আর মনের চাহিদা কমে গেলে হৃদয়ের খোরাকটা অনুভূত হয়। যেমন ধর এই বৃষ্টি মানুষকে বাহিরমুখি থেকে অন্তর্মুখী করে দেয়। নিজের ভিতরের মানুষটাকে দেখার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয় অনেকটা সেরকম।
-মৃত্যুর আগে তোমার বাবা যদিও আমাকে সব সময় তার পাশে থাকতে বলত। কিন্তু অবাক করা কান্ড যে তিনি আমার সাথে তেমন কোন কথা বলত না। তার মানে বলার মত কোন কথা ছিল না তেমনটি না, বলার অনেক কিছু ছিল কিন্তু শোনার মত বোধকরি কেউ ছিল না।
বাইরে বৃষ্টি নামলো, সে দিকে তাকিয়েই খোদাবক্সের কথা শুনছিলাম।
-মানুষ যেমন কিছুদিনের জন্য বাড়ী থেকে বাইরে যাওয়ার আগে একান্ত নিজের মানুষকে ডেকে অনেক কিছু বলে যায় অনেকটা তেমনি। কিন্তু তোমার বাবাতো ভাল করেই জানতেন তার এ যাওয়া অল্প দিনের জন্য নয়, চিরদিনের তাইতো অনেক কথা ছিল বলার।
আমি তাকালাম খোদাবক্সের দিকে, দেখলাম সেও বৃষ্টির ধারার দিকে তাকিয়ে কথা বলছে।
-খোদাবক্স, আমি হাসপাতালের ওই মেডিক্যাল বন্দিখানায় মরতে চায় না। ওখানে সবাই সার্বক্ষণিক সেবা করে ঔষধ দিয়ে, পথ্য দিয়ে মানুষকে বাচিয়ে রাখতে চায়। তাদের অতসব কর্মকাণ্ড, আপনজনদের সাথে দেখা করার উপর নানা নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি মৃত্যুর মত একটা অমোঘ পরিণতিকেও ভীষণ ভয়াবহ করে তোলে। আমাদের সমাজ মৃত্যুকে ডাক্তারের পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করে, তাইতো মৃতকে বডি ব্যাগে ভরে সবার দৃষ্টির আড়ালে মর্গে পাঠিয়ে দেয়। মৃত্যুর সময় আমি আমার আপনজনদের মাঝে থেকে তাদের কাছ থেকে এ অন্তিম যাত্রার জন্য বিদায় নিতে চায়।
অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে খোদাবক্স মনে হল তার চোখ দুটো মুছে নিল।
-কথাগুলো বলতে বলতে তোমার বাবার চোখের দুধার বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। একটু ঘুমিয়ে পড়লে, ঘুম ভাংলেই তিনি যেন নতুন কাউকে দেখার জন্য মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিক দেখতেন।
খোদাবক্সের কথাগুলো শুনে আমার দুচোখ অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল।

-বাবু, আমি কি খোকাকে খবর দেব?
আমি জিজ্ঞেস করলে তিনি মৃদু হাসতেন।
-খোদাবক্স, তুই কি মনে করছিস আমি মারা যাব? তুই জানিসনে, খোকা কত ব্যস্ত থাকে?
-আমি বুঝেছিলাম খোকা, তিনি তোমাকে তার পাশে চাচ্ছিলেন। হয়তো তোমার হাতটা একটু ধরার জন্য, তোমার অশ্রুসজল চোখদুটো দেখার জন্য।
কথা বলতে বলতে এবার খোদাবক্স ডুকরে কেদে উঠলো।

বাইরে সাঁ সাঁ শব্দে বৃষ্টির ধারা ঝরেই চলেছে, তার ছিটে ফোটা আমাদের দুজনেরই চোখে মুখে এসে লেগে অশ্রুর সাথে মিশে যেতে লাগলো।
বৃষ্টির সাঁ সাঁ শব্দ যেন কন্ঠ পেল, খোদাবক্সের কান্নার স্বরটা বৃষ্টির একটানা শব্দের সাথে মিশে একাকার হয়ে চারদিকে ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
মনে হল খোদাবক্সের কথাগুলো শুধু মৃত্যু পথযাত্রী আমার বাবার না, সব অসহায় একাকী মৃত্যু পথযাত্রীর কথা।