জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে ছোট গল্প "দেয়ার তৃপ্তি অতল"।

আপডেট: ১৭ Jul ২০২৪, ১৬:০৮


দেয়ার তৃপ্তি অতল

এরই মধ্যে সেলিম সরকার একবার আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে গিয়েছিল।
পেভমেন্ট ধরে হাটার সময় তিনি হাউজিং এর ভিতর দিয়ে যাওয়া মেইন রোড ধরে একটা দ্রুতগামী গাড়ীর সামনে আচমকা দৌড় দিলে, তাকে বাচাতে গাড়ীর ড্রাইভার হার্ড ব্রেক করে রাস্তার পাশে খোলা ড্রেন টপকিয়ে একটা গাছে ধাক্কা খেয়ে থেমে যায়। গাছে ধাক্কা লেগে গাড়ীর ড্রাইভারের ক্যাবিন চ্যাপটা হয়ে ড্রাইভার ভিতরে আটকা পড়ে বুকের পাজরের হাড় ভেঙ্গে কোন ভাবে জানে বেচে যায়।
ড্রাইভারের জ্ঞান ফিরলে হাসপাতালের বেডে শুয়ে পুলিশের প্রশ্নের উত্তরে জানায়, সেলিম সরকার নাকি ইচ্ছে করে গাড়ীর সামনে দৌড় দিয়েছিল।
ঘটনাদৃষ্টে পুলিশ ধারণা করে যে, সেলিম সরকার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল।

সেলিম সরকার একজন সফল চাকুরে। দীর্ঘদিন চাকরি করার পর, চাকরীর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে চাকরীর নির্ধারিত বয়স শেষ করে অবসরে যান। দেশ বিদেশে প্রচুর সুনাম কুড়ানো এই মানুষটি মোটা পেনসান সুবিধা নিয়ে অবসর গ্রহন করে বেশ কয়েক বছর হল শহরের অভিজাত এলাকায় নিজ বাড়ীতে অবস্থান করছেন।

বলা চলে অবসরের পরও তিনি সবল সুস্থ দেহের একজন মানুষ। সারা জীবন তিনি সচেতন এবং হিসাবি মানুষ হিসেবে পরিচিত। তার সহকর্মীদের তুলনায় তার শারীরিক বয়স কম করে হলেও দশ বছরের কম মনে হয়। শুধু দেখাতেই না শারীরিক সামের্থ্যর ব্যাপারেও তিনি তা প্রমান করেন।
এখন হাতে অফুরন্ত সময়, এ বয়সেও তিনি সপ্তাহে সাত দিন, প্রথম দিকে সকালে তারপর সকাল বিকেল দু’বেলায় লম্বা রাস্তা হাটা হাটি করেন। সকাল বিকাল মিলিয়ে প্রতিদিন প্রায় সাত আট কিলোমিটারের মত পথ হাটেন করেন।

তার একমাত্র ছেলে, বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। ছেলে ছেলের বউ আর তাদের তিন বছরের একটা ছেলে সন্তানকে নিয়ে বাবার সাথে একই বাড়ীতে বসবাস করে সবাই মিলে।
সেলিম সরকারের মত একজন সুখী সামর্থ্য মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করবে! সেটা কারো কাছে বিশ্বাস যোগ্য না।

অবসর নেয়ার পর বছর সাতেক গত হল। প্রথম দু’তিন বছর জুনিয়র কলিগেরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাকতো। তার কাছ থেকে জীবনের গল্প শুনত, তাতে অনুপ্রাণিত হয়ে হাত তালিও দিত।
কিন্তু ক্রমে ক্রমে তারাও অবসরে চলে যাওয়ার পর বলতে গেলে তিনি তার চাকুরী জগত, যেখানে বলতে গেলে জীবনের সোনালী দিনগুলো কাটিয়েছেন, সেখানে তিনি অপরিচিত হয়ে গেলেন।
এখন যারা আছে তাদের সাথে বলা চলে জেনারেশান গ্যাপ হয়ে গিয়েছে।
সেলিম সরকারও তাই তার সারা জীবন ধরে অর্জিত ভুবন থেকে বলতে গেলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
বাড়িতে তার স্ত্রী তাদের পোতাকে নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। ছেলে বউমা দু’জনেই চাকুরে তাই, ছোট কাল থেকেই কোলে পিঠে করে পোতাকে মানুষ করেছে তাই ছেলেটিও ওর দাদির সঙ্গ খুব পছন্দ করে।
খোকা আর বউমা দুজনেই, সকালে কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে বাড়ী ফেরে। সন্ধ্যার পর বাবা মা ফিরলে ওদের সাথে একটু খেলা ধুলো করে পোতা রাতে ওর দাদির সাথে ঘুমায়।
সেলিম সরকার রোজ সকালে উঠে বেশ দূরে চলে যায় হাটতে, আর বিকেলে লেকের চারপাশ দিয়ে ঘুরানো ওয়াকওয়েতে হাটে।
বিকেলে কিছুক্ষণ হেটে, সন্ধ্যে নাগাত ওয়াকওয়ের সাথে তৈরি বসার বেঞ্চে বসে লেকে মাছের ডুবসাতার খেলা দেখে। তার মত দুএকজনের সাথে বেঞ্চে বসে কথাবার্তা বলে কোন কোন দিন সন্ধ্যার বেশ একটু পর বাড়ী ফেরে। কোন কোন দিন তেমন কাউকে পেলে টি স্টলে যেয়ে চা খেয়ে রাতে বাসায় ফেরে।
বাসায় রান্না বান্না করার জন্য একজন ফুল টাইম কুক আছে, নাম আবুল। সেলিম সরকারের স্ত্রী তাকে দিয়েই বাজার সদায় করায়, আর কার জন্য কি রান্না হবে সে গুলো নিয়ন্ত্রণ করে।
ছেলে আর বউ সন্ধ্যার একটু আগেই বাড়ী ফিরে ছেলেটাকে নিয়ে একটু আদর করে তারপর সন্ধ্যার পর পরই খাওয়া দাওয়া সেরে নিজ রুমে ঢুকে টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত দশটা নাগাত তার স্ত্রী পোতার সাথে খাওয়া দাওয়া সেরে নিজ রুমে চলে যায়।
সলিল সরকারের ফিরতে দেরী হলে বাড়ীর আধা বয়স পার করা কুক দরজা খুলে টেবিলে খাবার দেয়।
সকালে অফিস যেতে হবে তাই খোকা আর ওর স্ত্রী নয়টার মধ্যে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। পোতাকে সকাল সকাল ঘুম পাড়াতে হবে বলে তার স্ত্রীও মোটামুটি দশটার মধ্যে রুমে ঢুকে যায়। কুক বেচারা সারাদিন খাটা খাটনি করে, আবার পরদিন সকালে উঠে নাস্তা বানাতে হয় তাই সেলিম সরকারের খাবার শেষ হলে ঝটপট থালাবাটি ধুয়ে সেও ঘুমাতে চলে যায়।
তার ঘুমানোর সময়টা বলা যায়, সেলিম সরকারের রাতের খাবারের টাইমের উপর নির্ভর করে।
সেলিম সরকারের বিছানায় যাওয়ার কোন তাড়া নেই। ঘুম থেকে উঠারও কোন ওজর নেই। ঘুম আসলে শোয়া আবার ঘুম ভাঙ্গলে বিছানা ছেড়ে উঠা।

কিছু দিন হল সেলিম সরকারের স্ত্রীই বলেছে –রাতে তুমি একটু দেরী করে ফিরলেও অসুবিধে নেই, আমি আবুলকে বলেছি তোমার খাবার টেবিলে লাগিয়ে দিয়ে ও ঘুমাতে চলে যাবে। পরদিন সকালেই আবার সবার জন্য নাস্তা তৈরি করার সময় তোমার রাখা থালা বাটিগুলো ধুয়ে ফেললেই হল।
সেলিম সরকারের স্ত্রীর প্রস্তাবে আবুল খুশী হয়ে সেদিন থেকেই সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে সেলিম সরকারের জন্য টেবিলে খাবার লাগিয়ে শুতে চলে যায়। কারো যাতে কোন অসুবিধা না হয় তার জন্য সেলিম সরকারের স্ত্রী বাসার মেইন ডোরের অতিরিক্ত চাবিটা স্বামীকে দিয়ে রেখেছে।
এ ব্যবস্থা করার ফলে সেলিম সরকারের বাড়ীতে ফেরা নিয়ে কারও কোন কিছু এসে যায় না।

মাঝে মাঝে মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় সেলিম সরকারের। অবসরের পর থেকে সেল ফোন দেখার অভ্যাসটা গড়ে উঠেছে, আগে ছিল না। রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সেল ফোনটা ঘাটা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না। অত রাতে বন্ধুদের মধ্যে কাউকে অন লাইন দেখলে ফোন দেয় কখনো কখনো।
তাদের অধিকাংশ জেগে থাকে মোটামুটি কোন না কোন শারীরিক অসুবিধার কারণে। তারা অত রাতে কথা বলতে যেন একটু বিরক্ত হয়। কেউ হয়তো বলে, কিছুক্ষণ বাদেই ওষুধ খেতে হবে তাই জেগে আছে।

বয়সের ভারে, বলতে গেলে বন্ধুদের সবারই শরীর ভেঙ্গে গিয়েছে, তাই মোটামুটি শরীর নিয়ে আছে ওরা, শরীরের কথায় তারা চলে। তাই রাতে বিরাতে ওদেরকে সাহায্য করার জন্য কেউ না কেউ থাকে ওদের সাথে।

রাত প্রায় বারোটা কিছুতেই ঘুম আসছে না। সবাই ঘুমাচ্ছে যে যার রুমে।
সবারই ব্যস্ততা আছে শুধু তার কোন ব্যস্ততা নেই, সমস্যাও নেই।
কাউকে তার দরকার নেই, আর তাকেও কারো প্রয়োজন নেই।
দেয়া নেয়ার করেই মানুষ ব্যস্ত জীবন কাটায়। হিসেবি মানুষগুলো দেয়ার সাথে নেয়ার পার্থিব সমীকরণটা মিলিয়ে নিয়ে জীবন চালায়। মোটামুটি সবাই সতর্ক থাকে যেন নেয়াটা কোন ক্রমেই দেয়ার থেকে কম না হয়। বেশী পেলে কেউ সাধারণত আপত্তি করে না, তবে কম নেয়াটা মেনে নেয় না।
নেয়ার এই প্রবণতা মোটামুটি ভাবে প্রয়োজনের সাথে সমঞ্জস্য মনে হলেও, বেশী বেশী নেয়ার সাথে সাথে মানুষের প্রয়োজনটাও বেশী বেশী করে বাড়তে থাকে।
এমনি ভাবে জীবন কাটানো একজন মানুষ ছিলেন সেলিম সরকার। কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ে এসে মনে হচ্ছে নেয়ার স্থায়িত্ব ক্ষণস্থায়ী কিন্তু দেয়ারটা ঠিক তার উল্টো।
মানুষ যখন ধান বা গমের চাষ করে তখন সে তা নিজে ভোগ করার জন্য করে, কারণ তার ফসল কয়েক মাসের মধ্যে ঘরে তোলা যায়। কিন্তু মানুষ যখন একটা বৃক্ষ রোপন করে তখন সে গাছটা খুব ধীরে ধীরে বড় হয়, তা দেখে দেখে প্রতিদিন মনটা আনন্দে ভরিয়ে তোলে। তারপর গাছটা বড় হতে থাকে আর বপনকারী বুড়ো হতে থাকে।
সে যদি ভাগ্যবান হয় তাহলে মানুষ পশু ও পাখীর সাথে সেও ওই গাছের ফুল ফল আর সুশীতল ছায়া উপভোগ করতে পারে, না হলে সে সুখস্বপ্ন নিয়ে পরলোকে গমন করে।
জীবনটা অনেকটা এরকমই।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে সেলিম সরকারের রাত দিনের পার্থক্যটা যেন ঘুচে গেছে। কারণ, যেহেতু কোন কিছুর জন্য তাড়া নেই, তাই কখন ঘুমাবে আর কখন উঠবে তার কোন ঠিক নেই। আগে ইউকেন্ড গুলোর রং ছিল আলাদা। কত প্লান থাকতো কত কিছু করার থাকতো ছুটির দিনগুলোতে।
সেলিম সরকার জীবনের কোন অর্থ খুজে পাচ্ছেন না এ পর্যায়ে এসে।
তাইতো মাঝে মাঝে ভাবে, তার বেচে থাকা আর না থাকার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই।

রাতে ঘুম না আসলে এসব কথা মনের ভিতর পাক খায়।
-আমাকে বাচাতে গিয়েই বেচারা ড্রাইভার ছেলেটা পঙ্গুত্ব বরন করে না মরে বেচে আছে।
সেসব ভাবতে ভাবতে হাটাৎ করে সেল ফোনটা বেচে উঠল।
এত রাতে কে ফোন করল?
ভাবতে ভাবতে চশমা চোখে দিয়ে দেখল তার বন্ধু কাশেম। একই মহল্লায় বাস করে।
কি হল ওর আবার এত রাতে! ভুল করে নাত? কাশেম ওর ভাল বন্ধু, কিন্তু ওর সাথে রেগুলার যোগাযোগ নেই, নিশ্চয় ভুল ভাবে টিপ পড়েছে।
ভাবতে ভাবতে ফোনটা তিনি ধরলেন।
-বন্ধু, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে, গা থর থর করে কাপছে, ছেলে বউ কেউ বাসায় নেই। আমাকে যে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবে তেমন কেউ নেই।
ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে খুব কষ্ট করে কথা গুলো বলল, তার বন্ধুটি।
সেলিম সরকারের গলা শুনে ও তাড়াতাড়ি বলল –ভুল করে তোর কাছে চলে গেছে, আমি সালাম মনে করে তোকে ফোন করেছি।
বলেই ফোনটা কেটে দিল।
-বুঝলাম আমাদের বন্ধু সালামকে ফোন করতে ভুল করে আমাকে করেছে।
আমার সারা শরীর মনে এক অজানা বেদনা অনুভব করলাম। কাশেম খুব অসুস্থ, ওকে এত রাতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ও সালামকে খুঁজছে, আমাদের একই রোডে ওর বাসা কিন্তু আমাকে কেন সাহায্যের জন্য বলল না!

কথাটা ভাবতেই নিজের উপর খুব রাগ হল।
তাড়াতাড়ি তিন তলা থেকে নেমে, আমার গাড়ীটা চালিয়ে পাচ মিনিটেই ওর বাসার নিচে পৌছালাম। দারোয়ান গেট খুলে দিলে, গাড়ীটা পার্ক করে দেখলাম লিফট বন্দ। দারোয়ান বলল চার তলায় ওর বাসা। আমি সিড়ি বেয়ে উঠে গিয়ে বেল বাজালাম।
ওর স্ত্রী দরজা খুলে আমাকে দেখে অবাক। আমরা পারিবারিক ভেবে ঘনিষ্ঠ, কিন্তু কাজের চাপে মাঝে মাঝে কোন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়া দেখা হয় না।
সময় নষ্ট না করে আমি কাশেমের রুমে ঢুকলাম।
দেখলাম বেডে হেলান দিয়ে কাশেম টেলিফোন টিপছে।
আমাকে দেখে ও যে অবাক হল তা স্পষ্ট বোঝা গেল।
গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এসি চালানো থাকলেও কপালে ঘাম জমেছে।
আর কোন কথা না বলে ওর স্ত্রীর সাহায্য নিয়ে কাশেমকে আমার গাড়ীতে করে হাঁসপাতালে নিয়ে ভর্তি করালাম।
কাশেমের হার্ট এ্যাটাক হয়েছিল, বেশী দেরী হলে ওকে বাচানো যেত না বলে ডাক্তার জানাল।
পরদিন ভোরেই কাশেমের ছেলেমেয়েরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো। সব শুনে আমাকে জড়িয়ে ধরে ওদের অন্তরের সবটুকু নিংড়ে আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে লাগলো।

সেদিনই আমি অপরের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দেয়ার কি তৃপ্তি সেটা অনুভব করলাম।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে নতুন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পেলাম।

দেয়ার তৃপ্তি অতল, সে স্বাদ যে পেয়েছে সে জীবনের যে কোন পর্যায়ে হোক না কেন, সে দিতে কখনো একটুও কুন্ঠা বোধ করবে না।
আমি নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম। একাকীত্ব আর জীবনের অর্থহীনতার মনোভাব থেকে আমার আমার যেন চির মুক্তি হল।