Heading
আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২৫, ১৪:৩১
খাটো করে পাতলা চেহারার ছেলেটির নাম রতন। ওর উচ্চতা বড়জোর পাচ ফুটের সামান্য একটু উপরে হবে। বয়স পচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে।
কুচকুচে কালো গায়ের রঙের এই ছেলেটির চেহারার দিকে আকর্ষিত হওয়ার মত বলা যায় তেমন কিছুই নেই। শুধু মাত্র ওই কালো কুচকুচে চেহারায় ও যখন সরু সাদা গুলো বের করে হাসে, তখন সেটা যে কারোরই নজর কাড়ার কথা।
কিন্তু আজ এই মুহূর্তে সহায় সম্পত্তি সব হারিয়ে কোন ক্রমেই দাত বের করে কেন, সাধারন হাসি হাসার মত অবস্থা রতনের নেই। তায় এখন ওর পুরোটাই কুৎসিত কদাকার। ওর দলের সাঙ্গ পাঙ্গরাও সব হারিয়ে কান্না কাটি করে মনের জ্বালা কিছুটা জুড়াতে পারলেও রতনের তা হওয়ার না। কারণ সাঙ্গ পাঙ্গরা যখন সব হারিয়ে অবশিষ্ট কিছু তল্পি তল্পা নিয়ে শহর ছেড়ে নিজ নিজ উৎপত্তির কাছে ফিরে যেতে তৎপর, পু্লিশ তখন রতনকে মাজাই দড়ি বেধে টেনে হেঁচড়ে জেলে নিয়ে যাচ্ছে।
রতনকে সবাই কানাগলির গুন্ডা আর এলাকার ত্রাস বলে জানে। ওর কাছ থেকে অনুমতি না নিয়ে বড় কোন কাজ এ এলাকায় হতে পারে না, সে কাজ খারাপই হোক বা ভাল।
হতদরিদ্র পরিবারে জন্ম রতনের। মফঃস্বল শহরে পনেরো ফুটের মত চওড়া একটা গলি রাস্তা যার দুধারে গাঁ ঘেসে ঘেসে বাড়ীগুলো দাঁড়ানো, ওই রাস্তার শেষের দিকে রাস্তার গা ঘেসে একটা ফাকা জায়গার উপর নির্মিত টিনের চাউনি দেয়া তিন কামরার বাড়ি ওদের। নিজের রোজগারের টাকা দিয়ে ওর বাবা বাড়ীটা তৈরী করেছে, তবে জমিটা ওদের না।
বাবা রাজ মিস্ত্রির কাজ করে। রতনের পর আরো দুটো বোন আর ওর মা এই নিয়ে ওদের সংসার।
রাস্তাটা কানা গলি, মেইন রাস্তা থেকে এক মাইলের মত একে বেকে ভিতরে ঢুকে শেষ হয়েছে একটা নদীতে যেয়ে। সেখানে একটা খেয়াঘাট, ওপারের গ্রাম থেকে কিছু মানুষ প্রতিদিন পারাপার হয়। ছোট ভাঙ্গা-চুরো একটা নৌকা করে এক মাঝি খেয়া পারাপার করে। সারা দিনে গড়ে শ দুই মানুষ পারাপার হয় আর সে রোজগারেই কানা মাঝির সংসার চলে। মাঝির বংশে ষাটের উপর বয়স হলেই সবাই চোখের জ্যোতি হারাতে শুরু করে। দিনে দিনে তাই কানা কথাটা ওদের বংশের টাইটেলে পরিণত হয়েছে।
-বাবা, আরতো কেবল দু’চার বছর বাকি আছে, হাল ধরার মত কোন ছেলে সন্তানও আমার নেই, এর পরেতো কানা হয়ে ভিক্ষে করে খাওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকবে না। তাই, এ কটা দিনের জন্য আমাকে ঘাট থেকে উঠিয়ে দিও না। না হলে ভেবে দেখ আমার সংসার চলবে কি করে? এটুকু দয়া তুমি আমার জন্য কর বাবা, না হলে পরিবার নিয়ে যে মাঠে মারা যাব।
-দেখ মাঝি, ম্যালা ফ্যাচ ফ্যাচ করো না। এ কানা গলি আমার এলাকা। ওমাথা থেকে শুরু করে রাস্তাটা আমার দখলে শুধু এ ঘাটের মাথাটা কব্জায় নিতে পারলেই ষোল আনা পূর্ণ হয়।
এরই মধ্যে রতন ওই ঘাটেই নদী দখল করে কাঠ আর বাশের মাচার উপর বিনোদন কেন্দ্র বানিয়েছে, যেখানে বিশেষ করে অঞ্চলের উঠতি বয়েসের ছেলেমেয়েরা বিকেল বেলা আর ছুটির দিনে ভিড় করে। বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে রতনের ব্যবসা।
কানা মাঝির কাকুতি মিনতিতে কোন কর্ণপাত না করে রতন মাঝির ভাঙ্গা নৌকাটা উঠিয়ে দিয়ে খেয়া পারাপারের জন্য ইঞ্জিনের নৌকা চালু করে পুরো ব্যাবসাটা নিজ আয়ত্বে নিয়ে ষোল আনা পূর্ণ করে নিল।
ঘাটে পারাপারের ইনকামটা হারিয়ে শোকে দুঃখে কয়েক মাসের মধ্যে সময়ের অনেক আগেই কানা হয়ে গেল মাঝি। কানা হওয়ার পর এমনিতেই ভিক্ষে করে জীবন পার করার পরিকল্পনা ছিল ওর। সে কাজটা মাঝি আগে ভাগেই শুরু করলো। কানা হয়ে অন্য কোন উপায়ন্তর না দেখে ওই ঘাটেই ভিক্ষার বাটি নিয়ে বসলো খেয়া মাঝি। পারাপার হওয়া মানুষগুলো ওর সব চেনাজানা, আর তাই তারা যাতায়াতের পথে ওকে দয়া করে কিছু না কিছু ভিক্ষা দিয়ে যেতে লাগলো।
তাতে করে বলতে গেলে, কানা মাঝির আয় ইনকাম আগের মতই রয়ে গেল, শুধু কজের ধরণটা পাল্টালো।
এ ঘটনার বছর পনেরো আগে, রাস্তাটা যেখানে মেইন রোড থেকে বের হয়েছে, ওই তেমাথার চায়ের দোকানে খাওয়া পরার চুক্তিতে কাজ করার জন্য ওর বাবা কাকুতি মিনতি করে দশ বছরের রতনকে হাতে ধরে কবির মস্তানের কাছে তুলে দিয়েছিল। মধ্য বয়েস পার করা কবির মস্তানের চায়ের দোকান ছিল ওটা।
দোকানটা এখন নাকি রতনের। রতন সারাদিন ওই দোকানে বসে ওর সব সাঙ্গ পাঙ্গদের নিয়ে আড্ডা দেয় আর তাস, ক্যারাম খেলে ওরা দিন কাটায়।
দোকানটা সরকারী জায়গার উপর বানানো। এখনো কবির মস্তানের নামেই দোকানটা সবাই চেনে। কবির পাশেই এক বস্তিতে থাকতো। কোন এক খুনের কেসে কবির জেলে ছিল বেশ কয়েক বছর। জেল খানাতেই অনেকের সাথে পরিচয় হয় তার। সেখানেই পরিচয় এক বড় রাজনৈতিক নেতার সাথে। পরে সেই নেতাই প্রভাব খাটিয়ে ওকে সরকারি জায়গার উপর টিনের চালা উঠিয়ে দোকানটা তৈরী করতে সাহায্য করেছিল।
রতনের বয়স তখন বারো তের হবে। খুব ঝড় হল একদিন। আশে পাশের সব টিনের ছাউনি দেয়া ঘর বাড়ীর চাল সব উড়ে গেল, কবির মস্তানের দোকানটা বাদে। ঝড় যখন ঝাপটা দিয়ে দোকানের টিনের চালটা ধরে টানাটানি করছিল, দোকানে কর্মরত রতন তখন উপায়ন্তর না দেখে ছাপড়া চালের কাঠামোর একটা বাশ ধরে ঝুলে পড়েছিল। আর তাতেই নাকি দোকানটা বেচে গিয়েছিল।
কবির মস্তানের সামনেই ঘটনাটা ঘটেছিল। তা দেখে সে তাজ্জব বনে গেল। ঝড় থামার পর রতনকে বুকে জড়িয়ে ধরলো কবির। সে সময় থেকেই কবির মস্তান রতনকে অন্ধের মত ভালবাসতে শুরু করলো আর সব সময় সাথে সাথে নিয়েই ঘুরত।
তারপর অনেক বছর কেটে গিয়েছে, কবির মস্তান মারা যাওয়ার পর ওর পরিবার বস্তি ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছে। তখন থেকেই দোকানটা রতনের। দোকানটাকে সবাই কবির মস্তানের নামে চিনলেও রতনকে সবাই কানা গলির রতন বলে চেনে।
ঝড়ের ঘটনাটাকে উল্লেখ করে কবির মস্তান বিভিন্ন সময়ে সবার সামনে রতনের সাহসের প্রশংসা করত। ওর উপর কবির মস্তানের এই বিশ্বাস দিনে দিনে রতনকে তার নিজের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করল। তারপর ধীরে ধীরে ওর লুকিয়ে থাকা সাহসটা মনের গন্ডি পেরিয়ে শরীরের গণ্ডিতে প্রবেশ করল।
তখনও কবির মস্তান বেচে, একদিন মিউনিসিপ্যালিটির কিছু লোক ওদের দোকানের জায়গাটা মাপা মাপি করে ওটা বেআইনি বলে মন্তব্য করার সাথে সাথে রতন ক্ষিপ্ত হয়ে মিউনিসিপ্যালিটির একজনকে ধাক্কা দিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিল। পুলিশ রতনকে এরেস্ট করলে পরে কবিরই ওকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসলো।
ব্যাস, রতনের নাম ছড়িয়ে পড়লো আর রাতারাতিই ও গুন্ডা বনে গেল।
নিজের ওপর ওর অত্যধিক বিশ্বাস আর সাথে ওর বয়সের আর ওরই মত হারানোর কিছু না থাকা একটা বন্ধুদের দল ওকে নেতা বলে মেনে নিল। তারা সবাই ওর নির্দেশে সব কিছু অন্ধের মত করার অঙ্গীকারে ওর সাথে যোগ দিল। দিনে দিনে রতনই ওদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলো।
গলির রাস্তার দুধারে মোটামুটি দুএকজন বাদে সব নিন্ম মধ্যবিত্ত মানুষের বসবাস। এ ঘটনার বেশ কয়েক বছর পর গলির মাঝামাঝি বসবাসরত একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ি সে তার বাড়ীর ড্রেনটা বাউন্ডারি পাচিলের বাইরে রাস্তার উপর নির্মাণ করলো। ভয়ে কেউ বাধা দিতে পারল না। ওই জায়গাটাতে রিকসা ভ্যান সাইকেল ইত্যাদির জট লেগেই থাকতে লাগলো। কিন্তু ক্ষমতার কাছে সবাই যেন বোবা, অন্ধ। একদিন আসহ্য হয়ে রতন একাই একটা লোহার খোন্তা নিয়ে ড্রেনটা ভাংতে শুরু করলো। এ ঘটনা দেখে আশে পাশের মানুষ জড় হয়ে ছানাবড়া চোখে দেখতে লাগলো।
বড় লোক বাড়ীর মালিক তার কয়েকজন লোক নিয়ে তেড়ে আসলে হালকা পাতলা শরীরের রতন লোহার খোন্তাটা শক্ত করে ধরে ওদের দিকে রক্ত চক্ষু করে দাঁড়িয়ে রইলো। এরই মধ্যে খবর পেয়ে ওর দলের অন্যান্যরা হাজির হয়ে ওর পাশে দাড়াল। বড় লোক মালিকের লোকজন পিছিয়ে গেল। গলির মানুষ, ধনী গরীব সবাই রতনের সাহসের প্রশংসাই পঞ্চমুখ হয়ে উঠলো। সে ঘটনার পর থেকেই সবাই সামাজিক ভাবে রতনকে নেতা হিসেবে গ্রহন করে নিল।
ধীরে ধীরে রতন ওর গলির আর বলতে গেলে ওর অঞ্চলের সমস্ত রকম ঝামেলার সামাজিক বিচারক হয়ে উঠলো এবং ওর বিচার সকলে অন্ধ ভাবে মেনে নিতে লাগলো।
সরকারী জমির উপর দোকানটা বানানো তাই সরকারী লোকজনকে ম্যানেজ করে চলতে হয় বলে রতন তাদের সাথে সব সময় সম্পর্ক রক্ষা করে চলতো আর সে সম্পর্কের জেরেই ও আর ওর দলের অন্যান্য সদস্যদের বিপদের দিনে সরকারী আনুকূল্য পেতে তেমন বেগ পেতে হতো না ওর। এ ছাড়া ভালবেসে হোক বা ভয়ে হোক অঞ্চলের কেউ ওর আর ওর দলের বিরুদ্ধে কোন কথা বলার সাহস দেখানোর কথা ভুলেই গেল।
যে জমিটার উপর ওর বাবা টিনের চালা ঘর তৈরী করেছে সে জমির মালিক বিদেশে থাকে। মুলত জমিটা পাহারা দেয়ার জন্যই রতনের বাবাকে সেখানে ঘর বাধতে অনুমতি দিয়েছিল। এখন শোনা যায় জমিটা নাকি রতনের নামে কাগজপত্র করা। আর মালিক পক্ষের কাউকে এ অঞ্চলে অনেক বছর আসতেও দেখা যায় না।
রাস্তাটার শেষ প্রান্তে নদী দখল করে বিনোদন কেন্দ্র স্থাপন করার ফলে রতনই প্রকৃত পক্ষে পুরো কানাগলির একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠলো। প্রথমে নদীর ঘাটের উপর রেস্টুরেন্ট আর বেশ কয়েকটা কটেজ তৈরি করে ব্যবসা শুরু করলেও দিনে দিনে নদী দখল করে ভাসমান কটেজেরও ব্যবস্থা করলো রতন।
তারপর কানাগলির রতন কানা মাঝির কাছ থেকে নদীর ঘাটটা দখলের পর, রতন গরীব থেকে একদম আমির বনে গেল। আর ওর দলের লোকগুলোও খেয়ে পরে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।
ইতিমধ্যেই রতন ওদের টিনের চালের বাড়ীটা ভেঙ্গে সেখানে আট্টালিকা তৈরী করেছে।
মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে কবির মস্তান বৃদ্ধ বয়সে রতনের বয়সি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিল নাম অধরা। প্রথম দেখাতেই ওর কালো রঙের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা সাদা দাতের হাসি দিয়ে রতন অধরার নজরটা কেড়েছিল।
কবির মস্তান মারা যাওয়ার পর ওর দোকানটার সাথে রতন অধরাকেও বিয়ে করে নিল।
রতন এখন সবার কাছে ভয়ের পাত্র। ন্যায় অন্যায় যে কোন ধরনের কাজই রতনের দ্বারা সম্ভব। ওর দলের সবাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে রতনের অস্তিত্বের সাথে ওদের অস্তিত্ব সরাসরি জড়িত। আর তাই ওর সাঙ্গ পাঙ্গরা রতনকে বাচিয়ে রাখার জন্য যা দরকার তা করতে বদ্ধপরিকর।
মানুষের মন খুব বিচিত্র। মনকে বোকা বানানো খুবিই সোজা। সত্য মিথ্যা দুটো বলেই মনকে বুঝ মানানো যায়। বুঝ মেনে নিয়ে মন ভাল থাকলে শরীরও ভালো থাকে, তাতে করে গায়ে যেমন শক্তি পাওয়া যায় তেমনি ভাবে যে কোন কাজে একাগ্রতা বাড়িয়ে উন্নতিও করা যায়।
মনকে বিশ্বাস করাতে পারলে ঔষধের মত দেখতে নির্ভেজাল পানি পান করেও শরীরের রোগ সারানো যায় বলে ভরি ভরি প্রমান আছে। এখানে সত্য মিথ্যা কোন বিষয় না, বিষয়টা হচ্ছে বিশ্বাস। কোন বিশ্বাসে কোন মানুষের মনকে উজ্জীবিত করতে পারলে, সে বিশ্বাস রক্ষার খাতিরে অবলীলাই অনুসারীরা জীবনের বিনিময়ে হলেও অনেক অসাধ্য কাজ সাধন করতে পারে। অন্যের কাছে বা সাধারন জ্ঞানে তা যতই অযৌক্তিক বা অপরাধ মনে হোক না কেন, সে ব্যাপারগুলো বিশ্বাস স্থাপন করা ব্যক্তির বিবেককে কোন ভাবেই নাড়া দেয় না।
রোগা পাতলা খাটো শরীরের অধিকারী রতনের উপর এ ধরনের অন্ধ বিশ্বাস স্থাপনকারী সাঙ্গ পাঙ্গরাই ওকে ত্রাসের নেতা বানিয়ে ফেললো।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী একটা জীবনকে যদি হিমালয়ের চূড়াতে ওঠার প্রতিযোগিতার সাথে তুলনা করা যায়। অনেকটা চোখে ঠুলি লাগানো ঘোড়ার মত, চুড়াই উঠাটাই যখন মুখ্য, সেখানে যে কোন পন্থা বা রাস্তা সুবিধাজনক মনে হবে সেটা অবলম্বন করতে কোন বাধা থাকে না।
সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠার আগ পর্যন্ত পাহাড়, যেটা লক্ষ্য অর্জনের পথে প্রকৃত বাধা বা সমস্যা, যা অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়, সেই বাধাসম পর্বতটাই নিজের শরীর দিয়ে আরোহীকে সকল ঝড় ঝাপটার হাত থেকে বাচায়। কিন্তু সর্বোচ্চ চূড়াতে উঠার পর অর্থাৎ সকল বাধা অতিক্রম করার পর, পর্বতটা তার রক্ষা-বর্মটা সরিয়ে নেয়, আর তখন ঝড় ঝাপটা সহ সব রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সরাসরি আরোহীকে আঘাত করতে থাকে। প্রস্তুতি না থাকলে সফলতা লাভের পর পরই তাকে ওখানেই সমাহিত হতে হয়।
তেমনি ভাবে কোন মানুষ যখন কোন নিয়ম নীতির ধার না ধেরে তার সুবিধাজনক যে কোন পন্থা বা রাস্তা অবলম্বন করে তার সর্বোচ্চ লক্ষ্যে পৌঁছে যায়, তখন সে অনেকটা সীমালঙ্ঘন কারীর মত হয়ে পড়ে, সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে কোন আত্মরক্ষা মুলক ব্যবস্থার তোয়াক্কা করে না। তাই, এ অবস্থাই কারো পক্ষেই বেশীক্ষণ বা বেশীদিন ধরে টিকে থাকা সম্ভব হয় না।
কানা মাঝির ঘাট দখলের ঘটনাটা বোধহয় রতনের জন্য শেষ চূড়া আরোহন ছিল।
ওটাকে দখল বলা সমচিন হবে না, কারন দখল করতে হলে বিপরীত একটা শক্তি লাগে। কানা মাঝি কানাগলির রতনের ইচ্ছে চরিতার্থ করার পথে কোন প্রতিপক্ষ শক্তিই দাড় করাতে পারেনি।
এরকমই বোধহয় হয়! অন্যায় আর জুলুমের প্রতি পৃথিবীর সব ব্যবস্থা সমুহ যখন কানার মত আচরণ করে তখন প্রকৃতিই বোধহয় সে শুন্য স্থান পুরন করার জন্য আক্রোশে ফেটে পড়ে।
কানাগলির রতন কানা মাঝির কাছ থেকে বিনা বাধায় ঘাটটা দখল নেয়ার পর থেকেই আকাশ কালো হয়ে মুখ গোমরা করলো। তান্ডব শুরু করার পূর্বে প্রকৃতি পূর্ব সংকেত স্বরূপ ঝাপটা দিয়ে দিয়ে প্রস্তুতি মুলক কাজটা করলো কয়েকদিন ধরে।
প্রকৃতির সম্ভাব্য আক্রোশ আন্দাজ করে কানা মাঝি তড়িঘড়ি করে তার একমাত্র সম্বল ভিক্ষার থালা গুটিয়ে নিয়ে আগে ভাগেই নিজ ঘরে ফিরে গেল। আকাশের কালো কুচকুচে মেঘের দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির সম্ভাব্য আক্রোশ সম্পর্কে রতনও আন্দাজ করল, কিন্তু ওর অত সম্পদ গুটিয়ে কি ভাবে নিরাপদে নিয়ে যাবে তার কোন উপায় বের করতে না পেরে তান্ডবের অনেক আগে থেকেই ও সারাক্ষন মনে এক অজানা ভয় নিয়ে দিন কাটাতে লাগলো।
সে দিন মাঝ রাত থেকে শুরু হল ঝড়, একেবারে যাকে বলে তান্ডব, প্রকৃতি যেন রুদ্র রোষে ফেটে পড়ল সব ভেঙ্গে চুরে দেবে বলে। কিছুতেই তা যেন থামার না। সে রাতটা রতনের জীবনে সব চেয়ে দীর্ঘ আর ভয়ার্ত রাতে পরিনত হল।
সারা রাত রতন দূচোখের পাতা এক করতে পারলো না। ভোর রাতে ঝড় থামল।
একটু আলো ফুটতেই রতন বেরিয়ে পড়লো। আশঙ্কায় ভরা ওর মনটা।
-এ কি কাণ্ড, ঝড় রতনের চায়ের দোকান আর নদী দখল করে তৈরী করা সব স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। ফেরি পারাপারের নৌকাটা আর নদীর উপর তৈরি করা ভাসমান ঘরগুলো ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে ডাঙ্গায় তুলে দিয়েছে। ওর সারা জীবনের অর্জন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
চোখ দূটো অশ্রুতে ভরে গেল রতনের। ভারি ক্লান্ত লাগলো শরীরটা, পা দুটোতে সব জোর যেন হারিয়ে ফেললো রতন।
-প্রকৃতি এত নির্মম হতে পারে! ভাবল রতন।
নিরুপায় রতন ফিরে এসে ওর ঘরের বারান্দায় থপ করে বসে পড়লো।
-শোন বাবা রতন, এ পৃথিবীতে জোরজবরদস্তি করে অর্জন করা সব কিছুই জোরজবরদস্তির মাধ্যমেই চলে যাবে। যে ধন সম্পদ কাউকে ফাঁকি দিয়ে বা বঞ্চিত করে আসে, সেগুলো আবার ফাঁকির মাধ্যমে অন্য কেউ নিয়ে নেবে। অন্যায় ভাবে যা কিছু আসবে তা আবার সেভাবেই অন্যের কাছে চলে যাবে। আর এ গুলো ঘটবে যখন তুমি একদম প্রস্তুত না।
রতন যেদিন মাঝির খেয়াটা বন্ধ করলো, সেদিন দিনের শেষ খ্যেপটা মেরে কানা মাঝি নৌকাটা ঘাটে ভিড়াতেই দেখলো দল বল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রতন। ওদের দিকে তাকিয়ে ওর ফুটো নৌকাটা পানিতে ডুবাতে ডুবাতে চোখ দুটো মুছে নিয়ে কানা মাঝি কথাগুলো বলেছিল সেদিন।
কানা মাঝি দাড়টা হাতে করে উপরে উঠে এসে দাড়ালো। কোমরে বাধা গামছাটা খুলে তা দিয়ে চোখ মুখ মুছতে মুছতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল অসহায়ের মত।
সব হারানো দিশেহারা রতনের কানে কানা মাঝির সেদিনের কথাগুলো কেবলই বাজতে লাগলো।
ঘুণ পোকা সবার অলক্ষে খুব ধীরে ধীরে অনেক বড় কাজ করে ফেলে। ঘুণ নীরবে সকলের অলক্ষে প্রকাণ্ড একটা চকচকে বাড়ী ভিতর থেকে খেয়ে ওটাতে ধ্বস ধরাতে পারে। শক্ত আবরণের ভিতর কাঠের অপরিপক্ব ও পচনশীল অংশ ঘুণের খাদ্য। ভিতরটা খেয়ে ফেললে বাইরের আবরণ এমনিতেই ধ্বসে পড়ে।
কুপথে অর্জিত সম্পদও ঘুণের মত। গভীর থেকে খাওয়া শুরু হয়, বাইরে থেকে তার কিচ্ছু দেখা যায় না। সম্পদশালী মানুষেরা যারা অন্যায় ভাবে মানুষের হক নষ্ট করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, একটা অজানা ভয় ঘুণে খাওয়ার মত সারাক্ষন তাদের তাড়া করে ফেরে। একটু শান্তির জন্য কত কিছু না করে বেড়াই তারা। তারপর একদিন সব ঝর ঝর করে ভেঙ্গে পড়ে। তাসের ঘরের স্থায়িত্ব কেবলই সময়ের ব্যাপার মাত্র।
রতনের বাড়ীর প্রকৃত মালিকের করা মামলায় কোর্টের আদেশে রতনের বাড়ী পুলিশ সিল গালা করে দিল। ওর পুরো পরিবার প্রকৃতই রাস্তাই এসে দাড়ালো। সব সম্পদ সম্পত্তি হারানো রতনকে ঐ দিন বিকেল নাগাত জবর দখলের মামলাই ওয়ারেন্টের ভিত্তিতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল।
আশে পাশের অনেক মানুষ জড় হল। কানা মাঝিও ছিল তার ভিতর। কানা গলির ত্রাস রতন উদ্ভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে, কেবল শুন্যতা ছাড়া অন্য কিছু নেই সেখানে।
কানা মাঝি চোখে কিছুই দেখলো না সে সব কিছু। তবে ওর চোখের দুকোন বয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো।