জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'ওপারে গমন'। ।

আপডেট: ০৩ অগাস্ট ২০২৩, ১৫:২৩

ওপারে গমন

 

যা কিছু শরীর, সময়ের টানে তার সব কিছুই কমজোর হয়ে যায়। সময়ের কাছে সবাইকে নতি স্বীকার করতে হয়। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম।
শরীরের বয়স হয়ে গেলে কোন অঙ্গই আর ঠিকমত কাজ করে না, আর তখন সেগুলো মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
এ বয়সে এসে মানুষের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোও কমে যায়। কমে যায় অর্থ নতুন চ্যালেঞ্জ আসে না তেমনটি নয়, এ পর্যায়ে মানুষ কিছুটা অন্তর্মুখী হয়ে ওঠে তাই নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহন করতে চায় না, বরং নিজের অর্জনকে গুছিয়ে নিতে চায়।
জীবনের চ্যালেঞ্জ নেয়া না নেয়া অনেকটা নিজের উপর নির্ভর করে। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ না নিতে চায়লে সেগুলো এড়িয়ে চলা বা সেগুলোর চাহিদা সীমিত রাখা যায়। সে সব মনের ব্যপার, আর মনের বাস শরীরের কাঠামোতে তাই শরীর সাই না দিলে মনের জোর কমে যেয়ে তার গন্ডিও দিনে দিনে সঙ্কুচিত হয়ে আসে।
এ সময়ে মানুষ নির্জনতার কোলে আশ্রয় খোঁজে।

এ রকম পড়ন্ত বয়েসে এসে কবির চৌধুরী শহরের সব কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির কোলে দাঁড়িয়ে থাকা তার পৈতৃক বাড়ী, চৌধুরী কুঞ্জে আশ্রয় নিয়েছে।
পিতৃ পুরুষের ভিটে এটা। তার পরদাদার আমলের বাড়ী, তিনি জমিদার ছিলেন। ত্রিশ একর জমির উপর প্রায় এক মাইল নদীর ধার ঘেঁসে তৈরি জমিদার এস্টেট।
নদীর অংশের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় নদীর পাড়ের উপর বিশাল কাচারী ঘর। চারদিকে উঁচু মেঝের উপর উত্তর দক্ষিণ লম্বা পশ্চিম অর্থাৎ নদীর দিকে মুখ করে আয়তকার এই ঘরখানা। এই কাচারীঘরের বারান্দায় হাটাহাটি করে বা ইজি চেয়ারে নদী মুখ করে বসে তার দিন কাটে।
চৌধুরী এস্টেটের পিছন দিকে এ জায়গাটা, একদম নির্জন। সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটা বেশ প্রশস্ত। ওপারটা এপারের মতই উঁচু নিচু পাহাড় জঙ্গলে ভরা।
কবির চৌধুরীর দাদার আমলেই জমিদারী প্রথা রহিত হয়। দেশ ভাগের পর ওদের জমিদারীর মুল অংশ নদীর ওপারে পড়ে। মুল চৌধুরী এস্টেটও নদীর ওপারে আর ওপারেই জমিদারীর মূল তালুক।
শৈশবে কবির চৌধুরী যখন তার বাবার হাত ধরে এখানে এসে বসত বাবা তখন নদীর ওপার দেখিয়ে সেসব কথা বলতেন, যা সে তার বাবার কাছ থেকে শুনেছে।

-আমাদের আদি বসতি ওপারে, আমাদের পূর্ব পুরুষ ওপার থেকে এসে এপারে বসতি গড়েছেন। এপারে শরীরে বসবাস করলেও মনে প্রাণে ওপারে যাওয়ার জন্য ব্যকুল থাকে সবাই।
কবির চৌধুরীর বাবা কথাগুলো বলতে বলতে উদাস হয়ে যেতেন।
বাবা আরো বলতেন- ওপারের বাসিন্দারা সব সময় আমাদের কথা স্মরণ করে। ওপারে গেলে তারা আমাদের সবাইকে চিনবে।
মৃত্যুর আগে কবির চৌধুরীর বাবা এভাবেই বার বার ওপারের কথা বলতেন।

পড়ন্ত বেলায় কবির চৌধুরী এই কাচারি ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে ওপারের দিকে তাকিয়ে সে সব ভাবে।
ছোট কালে নদীটা আরো অনেক চওড়া মনে হত। মনে হত নদী পাড়ি দিয়ে ওপারে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু এখন এ বয়সে এসে ওপারটা পরিষ্কার দেখা না গেলেও অনুমানে বোঝা যায়। মনে হয় –নাহ, ওপারটা ততোটা দূরে না। আবছা দেখা যায় আর তাইতো মায়াবী লাগে।
ওপারের দিকে তাকিয়ে এত কথা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। মনে হয় সব শান্তি যেন ওপারে লুকিয়ে আছে। আরো মনে হয় তার সব পূর্ব পরুষ ওপারেই কোথাও আছে।
ওপারের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সেসব কথা ভেবে ভেবে দিন শেষে কখন সন্ধ্যে হয়ে আসে তা খেয়ালই করে না কবির চৌধুরী।

বৃদ্ধ বয়েসে আসলেই মানুষ বুঝতে পারে যে সে কত একা, কত নিঃসঙ্গ।
প্রকৃতপক্ষে মানুষ সব সময়ই একা। তবে যৌবন কালে যখন পরিবার আর সমাজের কাছে তার উপযোগিতা থাকে, তাদের প্রয়োজন মিটাতে পারে, তখন তাদের কাছে সে প্রিয়জন হয়। সে সময়ে সন্তান সন্ততি বন্ধু বান্ধব সবাই তার কাছে আসে তাদের নিজ নিজ প্রয়োজনে তাই সে বয়সটাতে একাকীত্ব অনুভূত হয় না।
কিন্তু জীবনের এ পড়ন্ত বেলা আসলে সাধারণত ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে নিজ নিজ সংসার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের কাছে বৃদ্ধ বাবা মায়ের তেমন কোন পার্থিব প্রয়োজন থাকে না। বন্ধু বান্ধবরাও বয়সের ভারে সবাই ধীরে ধীরে নিজেদেরকে গুটিয়ে নেয়।
টেলিফোনে খবর নিতে গেলে ছেলেমেয়েরা ব্যস্ততা দেখায়, বিরক্তও হয় অনেক সময়। আর বন্ধুদের অনেকেই বিভিন্ন বার্ধক্যজনিত রোগে শোকে শারীরিক মানসিক যন্ত্রণায় কথা বলার পর্যায়ে থাকে না।

কবির চৌধুরী তার ছেলেমেয়েদেরকে অন্য সব বাবার মত নিজ সাধ্য অনুযায়ী মানুষ করেছে, এখন তারা নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে জীবিকার টানে তাদেরকে ছেড়ে ভিন দেশে ভিন শহরে বসবাস করছে। এটাই চিরন্তন, এটাই স্বাভাবিক।
সময় সব কিছুকে কেমন যেন পাল্টে দেয়!
যখন সে পরিবারের কর্তা ছিল, তখন তার অনেক নির্দেশ বা সিদ্ধান্ত কারো পছন্দ না হলেও সবাই তা মেনে নিত। ছেলে মেয়েদের ভালোর কথা চিন্তা করে জীবনে অনেক সিদ্ধান্তই তাকে নিতে হয়েছে, এতদিন পরে এসে তার অনেকগুলোই মনে হচ্ছে ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। সে জন্য তার নিজের মনেও আফসোসের অন্ত নেই।
কিন্তু জীবনের এ পর্যায়ে সে সব প্রসঙ্গ উল্লেখ করে যখন ছেলেমেয়েরা বা তার স্ত্রী তাকে দোষারোপ করে, তখন মনে হয় তার ভুল করারও কোন অধিকার কোন দিন তার ছিল না। তাদের মন্তব্যে মনে হয় সেগুলো যেন ভুল না, অপরাধ ছিল।
ভুল করার অধিকার মানুষের জন্মগত, আর আপন জনদের ব্যাপারেই মানুষ ভুল করে ফেলে, অর্থাৎ ভুল হয়ে যায়। কিন্তু সেই আপনজনেরা যখন ভুল করার অধিকার হরণ করে নেয়, তখন সারা জীবন ধরে অতি যতনে গড়া সৌধ তাসের ঘরের মত মুখ থুবড়ে পড়ে। সারা জীবনের সব অর্জন যেন শূন্যে এসে শেষ হয়।
এ পরিস্থিতিতে সত্যিই তখন মরে যেতে ইচ্ছে হয়।
যাহোক, সে সব কিছু চুকিয়ে তার স্ত্রীও কি সুন্দর ভাবে বিদায় নিয়ে ওপারে চলে গেছে। তেমনি ভাবে তার অনেক বন্ধুরাও চির বিদায় নিয়ে চলে গেছে। তারা এখন এ সব ভাবনার অনেক ঊর্ধ্বে সব কিছু থেকে মুক্ত।

-তার এই বেচে থাকাটা কি তার সৌভাগ্য? না অন্য কিছু! তার মুক্তি কবে হবে!
এ সব চিন্তা করে কোন কুল কিনারা করতে পারে না কবির চৌধুরী।

শীতের দিন, দুপুর না গড়াতেই যেন সন্ধ্যে নেমে আসে। বেশ শীতও পড়েছে আর খোলা প্রান্তরে ফির ফির করে বাতাসে শীত যেন বেশী অনুভূত হচ্ছে। এই পড়া দুপুরেও কবির চৌধুরী চাদরে গা মাথা ঢেকে কাচারি ঘরের বারান্দায় ইজি চেয়ারে গাটা এলিয়ে দিয়ে ওপারে তাকিয়ে বসে আছে।
ওপারের গাছ আর পাহাড়ের ছায়া গুলো সব ধীরে ধীরে লম্বা হয়ে নদীতে পড়ছে। তারপর একটু একটু করে সে ছায়া আরো লম্বা হয়ে নদী পার হয়ে যেন এপারটা ছুতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
কেন জানি মনে হচ্ছে এপারের মানুষের মত ওপারের গাছগুলোও জানে যে স্বশরীরে এ নদী পার হওয়া নিষেধ। আর তাই তারা তাদের শরীর পিছে ফেলে ছায়া হয়ে নদী পার হওয়ার জন্য ব্যকুল হয়েছে সবাই।
মাঝে মাঝে মৃদু মন্দ বাতাস ডাল পালা সরিয়ে অস্তাচল থেকে উঁকি ঝুঁকি মারতে থাকা ক্লান্ত দিন মনিকে ডুব দেয়ার আগে শেষ বারের মত সব দেখে নিতে সাহায্য করছে। আর ছায়া গুলো তখন এপারে আসার ধ্যান ভেঙ্গে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে।
ধীরে ধীরে সূর্যের এ লুকোচুরি খেলা বন্দ হয়ে সব যেন নিস্তেজ হয়ে আসতে লাগলো। তারপর ধীরে ধীরে গাছ গুলোর ছায়া মিলিয়ে গেল।
অন্ধকার চারদিক ঘিরে ফেললো। নিস্তব্দতার চাদরে ঢেকে গেল সব কিছু।
অন্ধকারে সাথে তাল মিলিয়ে সব যেন নিজেকে গিলে ফেলল।
নিজের নিঃশ্বাসের শব্দটাও মিলিয়ে যেতে শুরু করল। বুকের ভিতর ধুকধুকনি ছাড়া আর সব শব্দই বন্দ হয়ে যেতে লাগল। আহ কি মাদকীয় সে সুরধ্বনি!
কবির চৌধুরী তার নিজের অস্তিত্ব বিলীন করে বাস্তব থেকে অনুভবের আবেশে প্রবেশ করল। একটা অভূতপূর্ব প্রশান্তিতে তার দেহ মন ভরে যেতে লাগলো।
বাবার কাছ থেকে শোনা ওপারের সব কিছু এক এক করে জীবন্ত হয়ে তার সামনে বিরাট পর্দায় ভেসে উঠতে লাগল।
সেখানে তার পরদাদা, দাদা, বাবা সহ যারা এপার ছেড়ে চলে গিয়েছে তাদের সবাই তার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। প্রশান্তি ভরা অবয়ে ঘরে ফেরার আনন্দে উদ্বেলিত সবাই। সব আপন মানুষেরা তাকে আহবান করল। ভালবাসায় ভরপুর সে আহবানের টান।
কবির চৌধুরীর দেহ মন জুড়িয়ে যেতে লাগলো।
তার হার্ট অপারেসান হওয়ার সময় যেমনি ভাবে ধীরে ধীরে অসাড়করণ প্রক্রিয়া তাকে বাস্তব জগৎ থেকে দূরে সরিয়ে অন্য এক চেতনার জগতে নিয়ে তার সব জ্বালা যন্ত্রণা শেষ করে দিয়েছিল, অনেকটা সেরকম অনুভুত হতে লাগল।
শরীরের ব্যথা বেদনা কষ্ট সব শেষ হয়ে স্বর্গীয় আবেশে সে ভাসতে লাগলো।

পাশে রাখা সেল ফোনটা বেজে উঠলো।
এ সময় নিশ্চয় তার ছেলেটা সুখ নিদ্রা ভেঙ্গে নতুন একটা দিন শুরু করার আগে বাবার একটু খোজ নিতে টেলিফোন করছে। ছেলেটা যখন নতুন সূর্যের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন দিন শুরু করছে কবির চৌধুরীর তখন সময় শেষ হয়ে এসেছে।

খোকার মুখটা ভেসে উঠল। একটা মায়া তাকে পিছু টানতে লাগল। মনে হল ছেলেটা বাবাকে ছাড়া খুব কষ্ট পাবে।
কিন্তু ততোক্ষণে অসাড়করণ প্রক্রিয়া পুরোদমে কাজ করতে শুরু করেছে। জীবিনের সব পিছু টানের শক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যেতে লাগল। সারা শরীর যেন অবস হয়ে সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অসাড় হয়ে আসল।
মনে হল শরীর মনের সব সুখ দুঃখ শেষ হয়ে গেল।
এখন যাওয়াতেই যত সুখ যাওয়াতেই যত আনন্দ।