জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -২১।

আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১৩:১১

অম্বরাবনী-২১ 

 

-হায়, বিধাতা অবনী কি এমন অপরাধ করলো যা সে নিজেই জানে না!
এ সব ভেবে কিছুটা হতচেতনের মত হয়ে রইল অবনী।
ষষ্ঠ প্রশ্নকারী ফাইল থেকে মুখ না উঠিয়েই একটু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন - সনাক্তকরন চিহ্নতো একটা স্থায়ী জিনিস, এটাতো পরিবর্তন করা যায় না। তবে লুকানো যায়। আর ইচ্ছাকৃতভাবে লুকানোটা সততাহীনতারই সামিল, নয় কি?
এই ছোট্ট মন্তব্যে অবনী ওর সমস্ত দেহে অবস করা শীতলতা অনুভব করতে লাগলো। শরীরের সমস্ত জোর হারিয়ে ফেললো। মাথাটা ঘুরে উঠলো, ওর মনে হলো ও বোধহয় চেয়ার থেকে পড়ে যাবে।
মনে হলো আহ এই মুহুর্তে এই জায়গা এই পৃথিবী থেকে নীরবে বিদায় নেয়ার যদি কোন সুইচ থাকতো তবে কোন দ্বিধা না করেই ও সেটা টিপে সব জ্বালা সব যন্ত্রনা শেষ করে দিত।
-বিধাতার ইচ্ছাকে অবনী কি করে অস্বীকার করবে! অস্বীকারতো ও করতে চায়নি। বিধতার দান, তা সে যত তিক্ত হোক না কেন তা মেনে নিয়েই তাঁর সৃষ্ট পৃথিবীতে তা মানিয়ে নিয়ে জীবনটা কাটাতে চেয়েছিল অবনী। এটাই তার অপরাধ, এটাই তার অসততা!
-মানুষের কাছ থেকে, বিশেষ করে ছিদ্রান্বেষী মানুষের দৃষ্টি থেকে নিজের লজ্জা ঢাকা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যতো ওর ছিল না।
-গভীর জলে হাবুডুবু খাওয়া মানুষকি বাচার জন্য একটুও হাতপা ছোড়াছুড়ি করবে না। আর এ হাত পা ছোড়াছুড়িতে ঐ মুহুর্তে যদি আশেপাশের কারো গায়ে সে জলের ছিটে ফোটা লাগে, তবে তাতো উদ্দেশ্য প্রনোদিত নয়।
-কিন্তু হায় বিধাতা কারো গায়ে লাগাতো দুরের কথা তার শব্দও কেউ শুনতে পায়নি!
-বুকের গভীরের যন্ত্রনা একটু উপশোমের জন্য রক্ত মাংসের মানুষকি একটু হাহুতাস করবে না। হাহুতাসের নিঃশ্বাসের যদি একটু শব্দ হওয়া কি অপরাধ! বিধাতার দেয়া যন্ত্রনা লাঘবের জন্য হাহুতাস করাটাকি বিধাতার বিধানের অবমাননা।
-আসলে সব তারই দোষ। ডুবতে ডুবতে হাতের পাশে ভাসমান কিছু খড়কুটাকে বিধাতার নিজ হাতে পাঠানো আশ্রয় ভেবে নিজেকে সাধু সন্যাসীর আসনে স্থান দিয়েছিল অবনী। এমন একটা পরিস্থিতিতে ও সব ভুলে নতুন করে বাচার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বেমালুম ভুলেই গেল যে ও জলে হাবুডুবু খাওয়া একজন মানুষ!
বিধাতার সৃষ্টির বোধহয় এ এক অনন্যতা।
ঈন্দ্রিয়তাড়ীত রক্ত মাংসের মানুষ একদিকে যেমন কোন কারণে ভীষন একটা খারাপ কাজ করে ফেললে ওর সচেনত মন নিজেকে জানোয়ার ভেবে অমানুষে পরিণত হওয়ার কথা চিন্তা করে, অন্যদিকে ঠিক তেমনি যখন খুব একটা ভাল কাজ করে তখন নিজেকে দেবতার আসনে বসিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ডুবে যায়। কিন্তু বিধাতার সৃষ্টি মানুষ এ দুটোর কোনটায় নয়।
সৃষ্টা যে তাঁর সৃষ্টির সবায়কে এ দুয়ের মাঝে দেখতে পছন্দ করে।

অবনীর দীর্ঘ নিস্তব্দতা অন্য চারজন প্রশ্নকারীকে আরো বেশী করে অবাক করে দিল।
সবাই অবনীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে - কি সেই সনাক্তকরণ চিহ্ন যা অবনী গোপন করে অসাধুতার পরিচয় দিয়েছে?
কিছুক্ষন আগ পর্যন্ত ওর প্রশংসায়রত মানুষগুলো এখন জানতে চায় যে কি সে চিহৃ যা অবনী উদ্দেশ্যপ্রনোদিত হয়ে গোপন করেছে যা সততাহানীকর। যা তার নতুন নিয়োগের জন্য এক বড় অযোগ্যতা?

মানুষ তার বিধাতার সৃষ্টি শরীরের ভিতর কত জিনিস ধারণ করে আছে যা সে নিজেই ভীষন ঘৃনা করে। শরীরের ভিতর থাকলে কোন সমস্যা নেই কারণ সে নিজে বা অন্যেরা সেটা দেখতে পায় না। কিন্তু একবার যদি তা বাইরে চলে আসে তাহলে কি সেটা নিয়ে বসবাস করা যায়?
বিষয়টি অসহনীয় হয়ে ওঠে যদি কারো সাথে এমনটি হয় যে তার শরীরের মধ্যে বসবাসরত ঐ দ্রব্যগুলো সম্পর্কে তার মনের মধ্যে সেগুলোর অবস্থান সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সচেনতা সৃষ্টি হয় অথবা তার অবস্থান যদি প্রতিনিয়ত তাকে দেখতে হয় অনুভব করতে হয়। আর ঐ পচা নোংরা গন্ধ যদি অনবরত তার নাকে আসতে থাকে তাহলে তার বেচে থাকাটা যে দুর্বিসহ হয় তা বোঝার ক্ষমতা ক’জনার আছে। সেটা লুকিয়ে রেখে, ভুলে থাকাটায় তার বাচার একমাত্র উপায়।

অবনী ধীরে ধীরে ওর হাতের আঙ্গুল দিয়ে চুলে ঢাকা ডান কপালটা অনুভব করলো। পোড়া দাগটা পরিস্কার অনুভূত হলো।
আহ কতদিন এর অস্তিত্বকে এমনিভাবে ও অনুভব করেনি।
এ যেন নিজেকে অনুভব করা। এই দাগটাকে ভুলতে যেয়ে অবনী নিজেকেই ভুলতে বসেছিল। দাগটা যে ওর অস্তিত্বের সাথে জড়িত। এটাকে কি করে ভুলবে ও। এই দাগটার উপর ওর মা সব সময় আদর করে চুম্বন করতেন। যখনই মায়ের কোলে মুখ লুকাতো তখনই তিনি ক্ষতটার উপর তার মধুর পরশ বুলিয়ে ওর মনটাকে শান্ত করে দিতেন। এটাযে শুধু দাগমাত্রই না এতো ওর মায়ের স্মৃতি ভরা।

অবনী ধীরে ধীরে ডান কপালের উপর থেকে চুলগুলো উঠালো।
একযোগে চমকে উঠলো ওরা পাচ জনই! এ অবনী ওদের একদম অচেনা অপরিচিত।
এতদিনকার পরিচিত পৃথিবীতে অবনী হটাৎ করেই অপরিচিত হয়ে গেল। সবাই আতকে উঠলো। এ কোন অবনী।
ছেড়ে আসা পৃথিবীটা নিজের হাতে ঠেলতে ঠেলতে সেটা এখন অবনীর কাছেও যেন অপরিচিত। আর যাদের সাথে এতকাল বসবাস করে নিজের হাতে গড়া একটা পৃথিবী রচনা করতে চায়লো সেখানেও সে অপরিচিত হয়ে অপরাধীর কাঠগড়াই দাড়াল!
কি চেয়েছিল ও জীবনের কাছ থেক! আজ যা পেল তা কি ওর সত্যিকারের প্রাপ্য। নিজের কাছেই অবনী আজ যেন অপরিচিত হয়ে গেল।

জীবনের উপর ঘৃনা ধরে গেল অবনীর।
কাকে কি দিল আর কি দিল না তার জবাবদিহীতা কখনো বিধাতাকে করতে হবে না। তবে তার দেয়া জীবনটাকে কেউ যদি একটু স্বপ্ন দিয়ে ভরতে চায়, তার তিক্ত দানকে যেহেতু প্রত্যাক্ষান করার শক্তি কারো নেই তায় মনভোলানো গান গেয়ে যদি ওটাকে একটু কম তেতো ভেবে গলধকরন করতে চায় তবে বিধাতার তাতে কি এসে যায়!
জীবনভর ও যা করলো তার সবই কি ভূল! তার নিজ সাধনার বলে আপন বলতে যা বুঝাই তার সবকিছুকে ছেড়ে আসাটা কি পাপ!
আজ যদি অবনী ওর পরিবার ওর স্কুল কলেজের অন্যান্য সব বন্ধু বান্ধবদের এবং উপুর্যপরী দেশের অধিকাংশ মানুষের সাথে থাকতো তাহলে হয়তো তাকে এই শাস্তি পেতে হতো না। ওর পোড়া কপালটা ঢাকার জন্য এতকিছু করতেও হতো না। আর ছায় চাপা দেয়া আগুনটা খুচিয়ে বের করার প্রয়োজনও হতো না কারো।
কি করবে এখন অবনী! কাকে বলবে এসব কথা?
গুটি পোকার মত দিনে দিনে নিজের তৈরী গুটির মধ্যে নিজেকে শক্ত ভাবে বন্দি করেছে অবনী। যতদিন নিজের স্বপ্ন নিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল ততোদিন কিছুই বোঝেনি অবনী। সে স্বপ্ন ভাংতেওতো চায়নি ও। কিন্তু আজ যখন নিষ্ঠুর বাস্তবতা ধাক্কা দিয়ে ওকে স্বপ্নের পৃথিবী থেকে টেনে হেচড়ে বের করলো। তখনই ওর অনুভূত হলো যে ঘুমের ঘোরে কি এক অভেদ্য দেয়াল গড়েছে অবনী ওর নিজের চারপাশে।
কিন্তু না, ঘোরের মধ্যে তৈরী এই দেয়ালের মধ্যে জাগ্রত অবস্থায় আর বাস করা যাবে না। এটা ভেঙে গুড়িয়ে ওকে বের হয়ে আসতেই হবে।