Heading
আপডেট: ০৭ Jul ২০২২, ১১:০৭
সারা জীবন ধরে কর্মক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি সন্তানদের লালন পালন আর তাদের জীবনে সফলতা আর বিফলতাকে নিজের সফলতা আর বিফলতার মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে অবনী।
কর্ম জীবন থেকে অবসর নিতে নিতে সন্তানেরা যে যার মত করে জীবন শুরু করে দিয়েছে। তাই এখন তার পূর্ণ অবসর।
বাবা মা অনেক আগেই গত হয়েছেন। ছেলেমেয়েদের সাথে স্থায়ী ভাবে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে তার স্ত্রী নাতি পোতা নিয়ে ব্যস্ততার ভিতর দিন কাটাচ্ছে।
অবনী শহর ছেড়ে নিজ পিতৃ পুরুষের ভিটেই চলে এসেছে। নগরায়নের ছোঁয়া লাগলেও প্রকৃতি সেখানে এখনো কথা বলে। নিজেকে নিয়ে ভাববার পরিবেশ পাওয়া যায়। মা বাবা আর স্ত্রী সন্তানদের ছাড়া আপন বলতে যাদেরকে বোঝাই কম বেশী তাদের সবাই এখানেই আছে।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে অবনীর আর কোন কিছুর জন্য কোন তাড়া নেই, নেই কোন সময়সূচীও। ঘুম ভাংলে সকাল হয় আর ঘুম আসলে রাত হয়।
জীবনের প্রতিযোগিতা বলতে যা বুঝাই তা এখন আর নেই।
কর্মব্যস্ত জীবনে সহকর্মী বা জানাশোনা কেউ মারা যাওয়ার ঘটনা তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াই অংশগ্রহন করা আর শোক বার্তা পাঠানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো। কিন্তু বর্তমানে আত্মীয় স্বজন বা চেনাজানা কারো মৃত্যু ভেতরটাকে কেন জানি নাড়া দেয়। মনে প্রশ্ন জাগে –কোথায় যাচ্ছে তারা! যারা গেছে তারা কেমন আছে কি ভাবে আছে!
পাচিল ঘেরা পুরনো বাড়ীর বিশাল আঙিনার সামনের দিকে লনে জন্মানো অসংখ্য ঘাসের পাতার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে ইচ্ছে হয় –যারা চলে গেছে তারা সবাই আছে কোথাও না কোথাও, ঘাসের পাতা হয়ে। শিশির জমে থাকা পাতার উপর ভোরের সূর্য কিরণ যখন বিচ্ছুরিত হয় তখন মনে হয় ওরা সব হাসছে, কথা বলছে, ভাল আছে সবাই।
নিজেকে নিয়ে ভাবতে এখন আর একদম ভাল লাগে না অবনীর। যা কিছু নিজের না- শারীরিক বা মানসিক সে গুলো নিয়ে ভাবনা অধিকতর অর্থবহ মনে হয়। নিজের জন্য নুন্যতম প্রয়োজনগুলো এমনিতেই মিটে যাই। যেমন নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য ভেবে ভেবে তা করা লাগে না বিষয়গুলো অনেকটা ওরকম।
প্রতিযোগিতা পূর্ণ কর্ম জীবনটা ছিল যেন নিরেট শক্ত পাথরের মত। যা কিছু নিজের, মান মর্যাদা, সম্পদ প্রতিপত্তি এমনকি চিন্তা চেতনা ইত্যাদি সবকিছু শক্ত ভাবে গার্ড দিয়ে রেখেছিল চিরকাল, যেন বাইরে থেকে কিছুই প্রবেশ করতে না পারে।
একখণ্ড কালো পাথরের ভিতর দিয়ে বাইরের আলোর যেমন কোন চলাচল থাকে না অনেকটা সেরকম। কিন্তু দীর্ঘদিন বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলায় এই ঘনতম আলোক দুর্ভেদ্য বস্তুটি রুপান্তরের মাধ্যমে এর আনবিক গঠনের পরিবর্তন ঘটিয়ে এর ভিতর দিয়ে আলোর প্রবেশ ঘটিয়ে স্ফটিকে পরিণত হয়। একই পাথর, কিন্তু তার ভিতর কেবল বাইরের আলো প্রবেশ করার ফলেই পৃথিবীর সবচেয়ে মুল্যবান বস্তুতে পরিনত হয়। ভাবতে গেলে গায়ে কাটা দেয়।
জীবনের এ পর্যায়ে এসে জীবিকার জন্য প্রতিযোগিতা করাটা নিতান্তই নিরর্থক মনে হওয়াই অবনী নিজেকে নিজের থেকে অবমুক্ত করে ধ্যানে জ্ঞানে যেন বহির্জগতে প্রবেশ করল।
একদিন প্রত্যুষে বেরিয়ে পড়লো অবনী। কেন যাবে, কোথায় যাবে তার কোন হিসেব বাদেই। কোন কিছু আকড়ে থাকা নয়, যাওয়াতেই যেন তার যত আনন্দ। গন্তব্যহীন পথচলা আর উদ্দেশ্যবিহীন কাজের মধ্যে একটা স্বর্গীয় স্বাদ আছে। অজানা রাস্তাতেই নতুন রাস্তার খোঁজ পাওয়া যায়। ঠিকানা খোঁজা মানুষের ঠিকানা দেখানোর জন্যই রাস্তাতেই ঈশ্বরের বাস করেন।
অচেনা জায়গা, রাস্তার ধার ঘেসে একটা মাঠে ছেলেরা দল বেধে ফুটবল খেলছে। ওদেরই বলটা এসে গড়িয়ে পড়ল অবনীর পায়ের কাছে। ছেলেগুলো কিছুটা দ্বিধা ভরে তাকিয়ে সেদিকে।
ফুটবল খেলা অবনীর খুব প্রিয়। ছোট বেলাই এমনি ভাবে ও যখন বন্ধুদের সাথে নিয়ে ফুটবল খেলত তখন একটা বিষয়ে সব সময় সমস্যা দেখা দিত, সেটা হল রেফারী কে হবে। সবাই খেলবে খেলাতেই যত আনন্দ, তাই রেফারী কেউ হতে চাইত না।
কিন্তু আজ সময়টা বদলেছে। খেলার ইচ্ছে থাকলেও শরীর কিছুতেই সেটা করতে দেবে না। মন আর শরীরের এ দ্বন্দ্বটা চিরদিনের।
ওদেরকে দেখে কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেও ওদের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে হাসি মুখে বলটাতে একটা কিক মেরে ওদের দিকে পাঠিয়ে দিল।
তা দেখে ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে কিছু একটা আলোচনা করল।
-দাদু, তুমি রেফারী করবে আমাদের জন্য?
সরলতার এ এক অপরূপ সৌন্দর্য, যেটা কেবল বাচ্চাদের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। বাচ্চারা যারা এখনো কোমল, তাই বস্তুবাদীতার শেকলে আবদ্ধ হয়নি, কর্মজীবনের জটিল সব হিসেবের মধ্যে যারা এখনও ঢোকেনি তাদের ভিতর দিয়ে ঐশ্বরিক সৌন্দর্য প্রতিফলিত হয়। যেটা মানুষ সহ এমনকি হিংস্র পশুর বাচ্চাদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। আর তাইতো যে কোন বাচ্চাদের সৌন্দর্য ক্ষনেকের জন্য হলেও কোন নিরেট অসংবেদী মানুষকেও দোলা দেয়।
এই অচেনা বৃদ্ধ মানুষটার কোন ব্যস্ততা আছে কিনা, সে কোথাই যাচ্ছে, সে সব কোন কিছুই বাদ বিচার না করে বাচ্চাদের ওই অনুরোধ অবনী কি ভাবে ফিরিয়ে দেবে!
ঘাড়ের ঝোলাটা নামিয়ে রেখে অবনী নেমে পড়লো ওদের রেফারীং করার জন্য।
পৃথিবীর প্রতিটি খেলাই প্রতিযোগিতামূলক, অর্থাৎ একজনের পরাজয় অন্যের জয়। খেলা শেষে একপক্ষ উল্লাসে ফেটে পড়ে আনন্দোৎসব করে আর অন্য পক্ষ পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে আহত হৃদয়ে ঘরে ফেরে। খেলা চলাকালে তো বটেই খেলার পরেও প্রতিযোগিতার রেশ চলতে থাকে। প্রতিযোগিতার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আবেগ জড়িয়ে পড়ে আর সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে নিচক খেলার হার জিত শত্রুতায় পরিনত হয়ে সকলকে মারামারি হানাহানিতেও জড়িয়ে ফেলে।
খেলাটা সেভাবেই চলতে লাগলো। তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াসে বৃদ্ধ অবনী বাঁশিতে ফু দিতে দিতে মাঠের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত অবধি ছুটতে লাগলো। এখানে যেন কারো কিছু করার নেই সবাই খেলার নিয়ম নীতির গোলকধাঁধার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে কেবল ছুটতে লাগলো, উদ্দেশ্য কি ভাবে অন্য দলের গোলের ভিতর বলটা ঢুকানো যায়।
খেলাই হার জিতের কাছে ওদের বন্ধুত্ব যেন হেরে গেল। ওরা একে অপরকে বুদ্ধি দিয়ে, কসরত করে এমনকি শারীরিক শক্তি প্রয়োগের দ্বারা ঘায়েল করতে লাগলো। ওরা প্রায়শই রেফারিকেও পক্ষপাতিত্বের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করতে লাগলো।
এ অবস্থাই অবনী লম্বা বাঁশি বাজিয়ে খেলার হাফ টাইম ঘোষণা করে জিভ বের করে হাফাতে হাফাতে মাঠের ভিতর চিত হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো।
ছেলেদের সবাই একে একে এসে ওকে ঘিরে দাড়াল। ওর শরীর খারাপ লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। অবনী হাত উচু করে ওদেরকে আশ্বস্ত করলো।
ইতিমধ্যেই সব ছেলেরা ওর চারদিক ঘিরে বসেছে। একটু জিড়িয়ে নিয়ে অবনী ধীরে ধীরে উঠে বসলো। তা দেখে সবাই একসাথে উল্লাসে ফেটে পড়লো।
-তোমরা সবাই একটা বিষয় খেয়াল করেছো? এতক্ষণ তোমরা যা করছিলে তাতে এক দল উল্লাসিত হলে অন্য দল দুঃখে ভারাক্রান্ত হচ্ছিলো। কিন্তু দেখ আমার ভাল হয়ে উঠা দেখে তোমরা সবাই একসাথে উল্লাসিত হয়ে উঠলে।
সবাই অবনীর কথা নিশ্চুপ হয়ে শুনতে লাগলো।
-আমরা প্রতিষ্ঠিত একটা নিয়মে সব কিছু করে থাকি। এই নিয়মের জন্য আমাদের প্রকৃতই ভাল না খারাপ হচ্ছে সেটা ভেবে দেখার জন্য একটুও চেষ্টা করিনা।
-আচ্ছা, ভেবে দেখ তোমারা সবাই সবার বন্ধু, প্রতিবেশী। তা স্বত্বেও এই খেলাটা শেষে তোমরা একদল আনন্দে ডগমগ করতে করতে আর একদল ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ী ফিরে যাও। তাই না?
সবাই তাতে সাই দিল।
-লক্ষ্য করে দেখ, প্রতিটি প্রতিযোগিতাই হার জিত আছে। অন্য ভাবে বললে বলা যায় হার জিত আছে বলেই তো প্রতিযোগিতা। একজন বা দলকে জিততে হলে অন্যকে হারতে হবে। আচ্ছা আমরা এমন এক ধরনের খেলা খেলতে পারিনা যেখানে সবাই জিতবে?
ছেলেরা সবাই হা হয়ে অবনীর দিকে তাকিয়ে।
-চল আমারা আজ বাকি সময়টুকুতে তেমনি একটা খেলা খেলবো।
কথাটা বলে অবনী উঠে দাঁড়ালো। ছেলেদেরকে একটা বড় বৃত্তাকারে ফাকা ফাকা হয়ে দাঁড় করাল। বলটা নিয়ে মাঝখানে দাঁড়ালো সে।
-এবার আমি বাঁশি বাজিয়ে বলটা একজনের কাছে ছুড়ে দিয়ে বৃত্তের বাইরে চলে যাব। তোমাদের খেলা হবে বলটা কিক মেরে মেরে আড়াআড়ি ভাবে অন্য জনকে দেয়া। তোমরা এখানে বিশ জন আছো সবাই যাতে সমান বার বলটাতে কিক মারার সুযোগ পাই সে দায়িত্ব সকলের। কে কত বার কিক মারার সুযোগ পেলে তা গুনে রাখবে। আমি ঠিক পনের মিনিট পর বাঁশি বাজিয়ে খেলা থামাবো। তখন তোমরা কে কতবার কিক মারার সুযোগ পেলে সেটা বলবে। এ ভাবে পনের মিনিট করে করে খেলা চলবে। যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই মোটামুটি সমান বার কিক মারার সুযোগ না পাবে ততোক্ষণ পর্যন্ত এ খেলা চলবে।
সবাই নিশ্চুপ ভাবে শুনতে লাগলো অবনীর কথা।
-যদি সমতা না আনতে পারো তবে সবার হার, আর সমতা আনতে পারলে সবার জিত।
খেলা শুরু হল। নতুন পদ্ধতির খেলাই সবাই একাকগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করলো।
ঠিক পনের মিনিট পর অবনীর বাঁশিতে সবাই থেমে এক এক করে সবার হিসাব দিল। দেখা গেল বিস্তর ফারাক একে অপর থেকে। ওরা বৃত্ত ছোট করে সবার সাথে সবাই সংক্ষিপ্ত আলোচনা করে নিল।
অবনী বাঁশি বাজিয়ে আবার শুরু করল খেলা। এভাবে ধীরে ধীরে অসমতা কমতে থাকলো আর ওরা সবাই অধিকতর মজা পেয়ে উল্লাসিত হয়ে উঠতে লাগলো। বিরতির সময় সকলে মিলে যার যার সুযোগ কম হয়েছে তাদেরকে নানান পরামর্শ দিয়ে এমনকি তাদের স্থান পরিবর্তন করে করে তাদেরকে সমতাই আনার কৌশল বের করতে লাগলো।
বেলা ডুবার আগে, যখন ছেলেরা সবাই সবাইকে জেতানোর প্রতিযোগিতাই পুরোপুরি নিমগ্ন তখন ওরা অনুভব করলো পনের মিনিটের বেশী সময় পার হয়ে গেলেও বাঁশি আর বাজছে না। অবশেষে সন্ধ্যার আলোর অভাবই ওদের খেলা থামাতে বাধ্য করল।
ছেলেরা সবাই পিছন দিকে খেয়াল করে অবনীকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু তাঁকে কোথাও পাওয়া গেল না।