জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -১৬

আপডেট: ১৭ Jul ২০২২, ১৩:৫১

অমৃতের সন্ধানে- ১৬ 

 

এ বছর বর্ষা বেশ আগে ভাগেই শুরূ হয়ে গেছে বলে মনে হয়। সারা দিন শুধু বর্ষা। কতক্ষন ঘরে শুয়ে বসে বই পড়ে আর রেডিও শুনে সময় কাটানো যায়। মানিকের অস্বস্তিটা শুরূ হলো আবারো।
অতি বর্ষনের সুযোগে মুক্তিযোদ্ধারা হানদারদের উপর একের পর এক আঘাত হেনে ওদেরকে পর্যদুস্ত করে তুলেছে। এ ধরনের গা গরম করা খবরে মানিকের অস্বস্তিটা আরো বেড়ে যায়। খবরগুলো যেন ওকে চোখে অঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, দেশের জন্য সবাই যখন প্রাণ দিতে ব্যস্ত তখন ও কি করছে! প্রসঙ্গটা ও কারো সাথে আলাপও করতে পারে না।
ওর মনটা বিষিয়ে উঠলো কিছুদিনের মধ্যে আবার। কারো সাথে ওর ভাবনাটা আলোচনা করার জন্য ও ব্যকুল হয়ে উঠলো।
মানিকের ফিরে আসার খবরটা শুনলো শিউলি।
ওর দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই ডুবে গেলো শিউলি আরো গভীর ভাবে। ওর মনে হলো কেউ বা কোন কিছুই মানিককে ওর থেকে আলাদা করতে পারবে না। তায় ওকে হারানোর কোন ভয় নেই। সেবার কাজে ডুব দিলেই যেন মানিককে আরো আপন করে পাওয়া যায়।
সেদিনও সকালে একটু দেরীতেই ঘুম থেকে উঠলো মানিক। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই বুঝলো টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে থামার কোন লক্ষন নেই। বিরক্তিতে মনটা ভরে উঠলো।
বাড়ীর বাইরে খোলা জাইগায় একটু বসার জন্য কাচারিঘরে গেল। বেশ মানুষের সমাগম সেখানে। একটু অবাক লাগলো। একবার মনে হলো ফিরে যাই। আবার মনে হলো দেখিই না কিসের ভীড়।
ও ভীড় কাটিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো। দৃশ্যটা একটা সুখ সপ্নের মত মনে হলো ওর। শিউলি গভীর আগ্রহের সাথে একজন রোগীর সাথে কথা বলছে। অন্যেরা কেউ বা দাড়িয়ে আবার কেউ বা বসে ওকে ঘিরে। ওর পেছনে একটা আলমারিতে বেশ কিছু অসুদের প্যাকেট আর শিশি বোতল।
দাড়িয়ে কিছুক্ষন দেখলো ওকে। সম্পূর্ণ ভাবে কাজে নিমগ্ন শিউলি।
যেন শিল্পীর নিপূন হাতে আকা ছবি।
অনেকদিন আগে একটা পত্রিকায় ও কিছু পেশাজীবি মানূষের কর্মে নিমগ্ন থাকার ছবি দেখেছিল। কোন এক নামকরা আলোক চিত্র শিল্পীর তোলা ছবি। ক্যাপশানটি ছিল কর্ম নিমগ্ন মানুষ। আরো লেখা ছিল কোন মানুষ যখন সব ভূলে নিজ কাজে নিমগ্ন থাকে তখন তার নিষ্কলুষ অকৃত্রিম আসল চেহারাটা ফুটে ওঠে।
বিধাতার দেয়া সব চেহারা অকৃত্রিম। মানুষ বিভিন্ন ভাবে তার উপর কৃত্রিমতার ছাপ ফেলে। এই মুহুর্তে মানিক শিউলির সেই অকৃতিম চেহারাটায় দেখতে পাচ্ছে ও।
গাড়ো সবুজ রং এর উপর মেটে রংএর ডট ডট দেয়া একটা শাড়ী ওর পরনে, হালকা কালচে চুলগুলো ছেড়ে দেয়া, বাতাস বারবার এলোমেলো করছে সেগুলো। বাতাস মাঝে মধ্যেই পরনের শাড়ীর আচলটাকেও আন্দোলিত করছে। মুখটা একটু গম্ভীর, আত্মবিস্মৃত।
ওকে দেখলে বাইরের প্রকৃতির দিকে তাকানোর দরকার হয় না। এই মুহুর্তে ওকে প্রকৃতির মূর্ত কন্যা বলে মনে হচ্ছে।
বাইরে কালো মেঘেভরা আকাশের বুক চিরে অবিরাম ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। কখন শুরূ হয়েছে কে জানে আবার কখন যে শেষ হবে তা বোঝার কোন উপায় নেই। ফোটা ফোটা বৃষ্টির ভারে আর মৃদু মন্দ বাতাসে গাছের ডাল পাতা নির্লিপ্তভাবে অমৃত আস্বাদনে নিমগ্ন। কালো মেঘে ভরা আকাশ থেকে আসা বাতাসে ডাল পাতা আন্দোলিত হয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে।
মনে হচ্ছিল প্রকৃতির সাথে একাকার হয়ে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মাঝে অমৃতের আস্বাদ পেয়েছে শিউলি। আহ শিউলি যেন সেই অমৃতের আস্বাদনে নিমজ্জিত। ও যেন ধ্যাননিমগ্ন এক অপ্সরী। পৃথিবীর কোন যন্ত্রণা জ্বালা ওকে ছুতে পারছে না, যা কিছু পার্থিব সব মিথ্যে ওর কাছে।
ওর দিকে কতক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে ছিল তা মানিক সঠিক ভাবে জানে না। হটাৎ করে ওর সাথে চোখাচোখি হওয়াতে শিউলির ঠোটে একটা মুচকি হাসির ঝলক বয়ে গেল।
সেই হাসি, নির্মল নিষ্কলুল কথা বলা হাসি।
মানিক যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। নিজেকে মোহভঙ্গের মত লাগলো।
মনে হলো ওকে বলে- না, ও ভাবেই তুমি থাক প্রকৃতির কন্যা হয়ে, এর থেকে একটুও নড়চড় হলে চলবে না। ওভাবেই তোমাকে মানায়, আমি ও ভাবেই যে তোমাকে দেখতে চায়।
মানিক নিঃশব্দে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো।
একটা প্রশান্তির হাওয়া মানিকের দেহ মনে ছুয়ে যেতে লাগলো। মানূষের সেবাই নিমগ্ন শিউলির বিমূর্ত অবয়বটা মানিকের মনে চিরখচিত হয়ে রইলো।

বেলা প্রায় গড়িয়ে গিয়েছে। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। নানীর কোলে মাথা রেখে মানিক একটা বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছে।
শিউলি প্রবেশ করলো।
-রাঙাদাদি আলো জ্বালানো হয়নি এখনো? হাসি মাখা ক্লান্তি ভরা মুখ খানি শিউলির।
মানিক বই থেকে মুখটা তুলে তাকালো। বোঝা গেল দিনের কাজ সেরে হাত মুখ ধুয়ে একটু পরিপাটি হয়ে এসেছে ও।
ওঁর মুখটা ভারী সুন্দর লাগলো মানিকের কাছে।
-মানিক কি সব সময় তোমার কোলে শুয়ে ঘুমোই?
-তাহলে তো কোন চিন্তায় ছিল না। ওকে ধরে রাখা খুবই দুস্কর।
একটা পান পাতা হাতে নিতে নিতে রোকেয়া বেগম জবাব দিলেন।
মানিককে সত্যিই আটকে রাখা অসম্ভব। মনে মনে ভাবলো শিউলি। ও খরস্রোতা নদীর মত। চলাতেই ও ছন্দময়। শুধু চলায় নয় উজানে স্রেতের বিপরিতে চলাতে ওর আনন্দ। চলার গতিতেই ওর সান্নিদ্ধে আসা জঞ্জাল শুলো পরিস্কার করে ও চলতেই থাকে। কাউকে ও বাধতে চায় না আর কোথাও বাধা পড়া যেন ওর অভিধানে নেই।
-বেলালের ঘরটা এখন ফাঁকা, কেউ থাকে না সেখানে। আর থাকার মত কেউতো নেই।
কথাগুলো বলতে বলতে শিউলি রাঙাদাদি আর মানিকের মুখের দিকে তাকালো। ওরাও তাকাল শিউলির দিকে।
কথাগুলো সবার কানেই যেন কেমন শোনালো, শিউলির নিজের কাছেও।
শিউলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। কথাগুলো ও কেন বললো তা যেন ও নিজেই জানে না।
একটু ইতস্ততঃ ভাবে ও পুনরায় বললো - না, ঘরে অনেক বই পত্র আছে মানিকের হয়তো ভালো লাগবে।
রোকেয়া বেগম শিউলির মুখের দিকে গভীর ভাবে তাকালেন। এমন গভীর করে আগে কখনো দেখিনি ওকে। কি একটা যেন অনুধাবন করার চেষ্টা করলেন রোকেয়া বেগম।
শিউলি ওর থেকে চোখটা সরিয়ে নিল।
তিনি পাশে উপবিষ্ঠ শিউলির মাথায় হাত রাখলেন। শিউলি আদরের পরশ পেয়ে ওর কোলে নিজের মুখ লুকালো।
ওকে বুকের মধ্যে নিয়ে আদর করতে করতে স্মিত হেসে রোকেয়া বেগম বললেন- আচ্ছা ঠিক আছে তা দেখা যাবে।
দুটি আদর পাগল মন এই আদরের অতিসয্যে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ ভাবে সমর্পন করে নীরবে বসে রইলো।

বেলালের ঘরে মানিকের মোটামুটি ভালোই লাগলো, অনেক বই, বেশ পরিপাটি করে সাজানো।
কি কি ধরনের বই এখানে আছে এবং কি ভাবে সাজানো? মানিকের প্রশ্নের জবাবে ওর জানা নেই বলে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল শিউলি।
মানিক একটু অবাকই হলো। তাকালো ওর দিকে।
বইগুলোর কথা বলেইতো শিউলি ওকে এখানে আনলো অথচ কি ধরনের বই আছে সেটাই জানে না।
বেশ অনেক গুলো বই। মানিক সোৎশায়ে বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে মনোনিবেশ করলো। বেশ ভালোই হলো মানিকের।
ও যখন বইগুলো দেখতে নিমগ্ন শিউলি তখন ওর দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে।
-তুমি নিজের মত করে সাজিয়ে নাও। আমি তোমাকে আমার সবটুকু সাধ্য দিয়ে আন্তরিকতা দিয়ে সহায়তা করবো।
কথাগুলো অনেকটা স্বগত স্বরেই বললো শিউলি ।
বই থেকে মুখ তুলে তাকালো মানিক।
ধীর পায়ে শিউলি বেরিয়ে গেল।
ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে মানিকের মনে হলো যেন শিউলি অনেক কিছুই বলে গেল যার পুরোটা ও শুনতে পায়নি।
বেলালের ওভাবে চলে যাওয়াটা মানিকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। বেলালতো সুদূর লন্ডন থেকে ছুটে এসেছিল শিউলিকে বিয়ে করে সাথে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাহলে এমন কি ঘটলো যে ওকে বিয়ে না করেই এভাবে চলে যেতে হলো!
ভাবলো বেলাল সন্মদ্ধে একদিন খোলাখুলি ভাবে জিজ্ঞেস করবে শিউলিকে।
সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করলো একদিন বেলালের কথা।
অনেকক্ষন চুপ করে ছিল শিউলি। তারপর নির্লিপ্তভাবে বললো - বেলাল চলে গেছে নিজের ইচ্ছায়। এখন ও অনেক দূরে, অনেক ব্যস্ততা ওর। আর কখনো দেখা হবে কিনা জানিনা।
এর পর বেলাল প্রসঙ্গে আর কোন কথা হয়নি কোনদিন।
একদিন সন্ধ্যের পর মানিক বইগুলো নড়াচড়া করছিলো। শিউলি ঢুকলো। কর্মক্লান্ত কিন্তু স্মিত হাসিতে ভরা মুখটা।
ওকে দেখে মানিক হাসলো, খুশি হলো বোঝা গেল। আজ ওর তৎপরতা দেখে মনে হলো মানিক একটু উদগ্রীব হয়েই ওর আগমনের অপেক্ষা করছিলো।
-আজ এত দেরী হলো। রূগী খুব বেশী ছিল?
প্রতিদিন সন্ধ্যের আগে বা একটু পরে রূগী দেখা শেষ হলেই শিউলি আসে এখানে। কত কথা হয় ওদের সারা দিনের কথা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। কথা না থাকলেও ওরা নীরবে বসে থাকে।
মানিক ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে। দেরী হলে হয়তো দরজার দিকে বা পথের দিকে তাকিয়ে ভাবে ওর কথা। হয়তো বাতাসের শব্দকে ওর পদশব্দ বলে ভুল করে। ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে শিউলির।
-প্রতিদিন কোন না কোন মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিচ্ছে!
কোন ভূমিকা না দিয়েই কথাগুলো বললো মানিক। ওর চোখে মুখে কিছুটা অসহিষ্ণুতার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো।
-যুদ্ধ চলছে, আরো চলবে, হয়তো অনেকদিন চলবে। সবাইতো কিছু না কিছু করছে দেশের জন্য!
প্রশ্নটা যেন মানিকের নিজের প্রতি।
শিউলি জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে মানিকের দিকে তাকিয়ে।
-আপনিও তো সেবার মাধ্যমে আপনার কাজ করে চলেছেন। কিন্তু আমি কি করছি! জিজ্ঞাসা ওর নিজের কাছে কিন্তু উত্তরটা খুজছে শিউলির কাছ থেকে।
মানিক একদৃষ্টে শিউলির দিকে তাকিয়ে। ওর চোখ দুটো ফেটে যেন জল বেরিয়ে আসতে চায়ছে। যেন চাপা কান্না। অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা আর অসহায়তার যন্ত্রনা যেন চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।
শিউলির কাছে কি চায় মানিক! ওর অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, কোন দিক নির্দেশনা, না অন্য কিছু!
মানিককে বোঝা বড় দায়।
ওকে দেয়ার উপযুক্ত যদি তার কাছে কিছু থাকে তবে তা উজাড় করে সবটুকু ঢেলে দিয়ে শিউলি যে নিজেকে কৃতার্থ করতে চায়। সেকথা মানিককে কি করে বুঝাবে শিউলি।
শিউলি ওর কাছে এগিয়ে গেল নিঃসঙ্কোচে। ওর এলোমেলো চুলেভর্তি আনত মাথাটা একটু টেনে ওর হাতের আঙুল চুলগুলোর ভিতর সঞ্চালন করতে লাগলো।
একটা মাদকীয় গন্ধে ভরা ওর চুলগুলো। শিউলি ওর চুলের মধ্যে মুখ গুজে চোখ দুটো বন্দ করলো।
মানিক ওকে না চাইতেই সব দিয়েছে। ওকে ভালোবাসতে শিখিয়েছে, মানুষকে পৃথিবীকে আর নিজেকে।
কি বলবে শিউলি, কিছুই বুঝতে পারছিলো না।
বেশ কিছুক্ষন কাটলো এ ভাবে।
- তুমি আবার যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য যেতে চাও মানিক! অকৃত্রিম স্নেহ আর অনুরাগ ভরা কণ্ঠ।
মানিক বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের মত মুখ উঠিয়ে তাকালো।
যে কথাটা ওর মনের মধ্যে গুমরে মরছিল যা কারো কাছে ও প্রকাশ করতে পারছিলো না। তা এত সহজেই শিউলি প্রকাশ করে দেয়াই ও অবাক হলো।
হালকা হয়ে গেল সারা দেহ মন।
ওরা পাশাপাশি দুটো চেয়ারে বসলো। শান্ত সৌম্যতায় ভরা দুটো অবয়ব।