জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী'' পর্ব -৮।

আপডেট: 2022-11-10 10:31:21

অম্বরাবনী- ৮

 

আরো দুবার বাজলো কলিং বেলটা। ছুটির দিন, কে এলো? ভাবছিল অবনী।
অপরিচিত বা নতুন পরিচিত কেউ হলে ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। কারণ কপালের দাগটা মোটামুটি ঢেকে যাওয়াই সেদিকে আর অযথা কারো দৃষ্টি আকর্ষিত হয় না।
শুধু চেনা মুখ গুলো নিয়ে এখন সমস্যা। ওরা কপালের দাগটা দেখতে না পাওয়াই অযথা কৌতুহলী হয়ে ওঠে। ওরা যেন কপালে দাগবিহীন অবনীকে দেখতে প্রস্তুত নয়। বরং এমনি অবস্থায় ওকে দেখলে অনেক চেনা মানুষ নিজেদের কাজ ফেলে পারলে ওর কপাল থেকে চুল উঠিয়ে দাগটা দেখে নেয়।
অবনী এমনিতেই বরাবরই চেনা মুখ গুলো থেকে দূরে থাকতে চায়। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে চেনা মুখ গুলো সম্পর্কে অবনী এক দারূন অনীহা বুকে পোষন করতে লাগলো। চেনা মুখের অযথা কৌতুহলী দৃষ্টি আর মন্তব্য থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য আরো বেশী করে মরিয়া হয়ে উঠে অবনী।
সমস্ত চেনা মুখের সাথে ওর যন্ত্রনাক্লিষ্ট অতীতের একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সত্য বলতে, চেনা কাউকে দেখলে ওর মন প্রাণ স্বাভাবিক ভাবেই চঞ্চল হয়ে ওঠে, কথা বলার জন্য কুশলাদী জিজ্ঞেস করার জন্য। প্রাণের টানে মনের টানে সব ভুলে যখনই ছুটে যায় ওর আপন কারো সাথে কথা বলতে, তখনই পুরানো ক্ষতের উপর আঘাতটা আসে। সব কিছুর আগে ওর যন্ত্রনা যেটাকে ও ঢেকে দিয়েছে সে প্রসঙ্গটায় আলোচনায় টেনে আনতে চায় তারা। ওদের কৌতুহলের জবাবে অবনী জোর করে হাসি টেনে প্রসঙ্গ পালটাতে চায়। মুখের উপরে ফুটে ওঠা কষ্টের রেখাগুলো ঢাকার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
আপন জনেরা ভূল বোঝে ওকে। যারা কখনো ওর কষ্টের এতটুকু ভাগি যারা কোনদিন হতে চায়নি আজ তারাই অযাচিত ভাবে বাস্তবকে পাশ না কাটিয়ে তা মেনে নেয়ার উপদেশ শোনায়। কষ্টে ওর বুকটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
আরো বেশী বিড়ম্বনায় পড়তে হয় যখন ওকে একই জায়গাই নতুন পুরোনো দুজনের মুখোমুখি হতে হয়। দুজনার চোখে ওর দুটো রূপ। ব্যপারটা সত্যিই অসহনীয় হয়ে ওঠে যখন নতুনের সামনে পুরোনো কেউ বুঝে না বুঝে ওর ঢেকে রাখা ক্ষতটা আগলা করতে চায়।
একটা অসহনীয় যন্ত্রনা। নতুনের সামনে গড়া ওর ইমেজ যখন পুরোনোদের দৌরাত্বে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, অবনী তখন এ অবস্থা থেকে পরিত্রান পেতে হাফিয়ে ওঠে। দুরে কোথাও একদম অচেনা জায়গায় লুকানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
আপন বা চেনা কাউকে দেখলে আজকাল অবনী এড়িয়ে যায়। ব্যস্ততা দেখায়, না দেখা বা না চেনার ভান করে।
এ ধরনের পরিস্থিতি অবনীকে দারূন পীড়া দেয়। কারণ এগুলো ও করে আপন কাউকে অপছন্দ বা এড়িয়ে যেতে নয়, নিজের ব্যথা ঢাকতে। ওর বিবেক ওকে দংশনে দংশনে জর্জরিত করে। আপন জনেরা অনেকে কষ্টও পায় অকারণে।
অবনী ওর পুরোনোকে ঢাকতে চায় কারণ সেটা কেবল অসহ্য বেদনাদায়ক। আর পুরোনো মুখগুলো যারা প্রকৃত অর্থে ওর আপনজন তারা অবনীকে নতুন চেহারায় দেখতে অভ্যস্ত নয়।
এ অবস্থার জন্য দায়ী কে!

দুরূ দুরূ বুকে দরজাটা খুললো অবনী। অচেনা মুখ। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো। অন্য বাসায় যাবে, ভুল করে বেল টিপছিল।
অবশেষে একদিন নিজের লজ্জাকে ঢেকে ওর চেনা জানা সবার কাছ থেকে পালিয়ে সাত সমুদ্র পাড়ী দিল অবনী।
অন্য এক মানুষ এখন অবনী। সবার কাছে ও নিজের মত করে গড়া অবনী। ওর অতীত ক্ষত আগলা করার মত কেউ এখানে নেই।

কাজের ছেলে এ দেশের নাগরিক, সালভাদোরের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল অবনী। দুটো বেজে গিয়েছে দুপুরের খাবারের সময় হয়েছে।

প্রায় দুই যুগেরও বেশী সময় ধরে যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটি। চারিদিকে শুধু ধ্বংসাবশেষ আর হাহাকার। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে শান্তিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। বিবাদমান দল দুটি শান্তিচুক্তির আওতায় যুদ্ধ বন্দ করেছে। অস্ত্র সংবরনের সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। রাস্তাঘাট সহ বিভিন্ন ইউটিলিটি সার্ভিস চালুর কাজ চলছে।
অবনী জাতিসংঘ অফিসের সিএও অর্থাৎ চিফ এ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার। এ ধরণের নিয়োগ ওর জন্য প্রথম তায় অবনীও এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছে।
উত্তর দক্ষিন লম্বা বিশাল দেশটির উত্তরাংশের প্রদেশের রাজধানী নামপুলা। ছোট্ট শহর সেখানে একটি পরিত্যক্ত থ্রি ষ্টার হোটেল ঠিকঠাক করে ওদের অফিস স্থাপন করা হচ্ছে।
প্রথম প্রায় একমাস খুব অসুবিধার মধ্যে কাটলো। বিদ্যুৎ নেই, রানিং ওয়াটার নেই। শুধু সন্ধ্যের পর থেকে দুঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। ঐ সময়ের মধ্যেই গোসল সহ অন্যন্য সব কিছুই শেষ করতে হয়।
যাহোক, দিনে দিনে সব কিছুরই উন্নতি হতে লাগলো। শহরে লোকজন আসতে শুরূ করলো। বসতবাড়ী দোকানপাট স্কুল কলেজ সবই ধীরে ধীরে চালু হলো। অবনীর অফিসে অন্যান্য সব ষ্টাফরা যোগদান করায় অফিস কর্মমুখর হয়ে উঠলো।
পাচটায় অফিস ছুটি হওয়ার পর সোজা বাসায় ফেরা। বাসায় মোজামবিকান কালো চামড়ার কাজের ছেলে সালভাদোর বাদে আর কেউ নেই। ও ভোরেই চলে আসে আর থাকে রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত। রাতের খাবারের পর ও নিজের বাড়ীতে চলে যায়।
রাতে পার্টি থাকলে বা অন্য কারণে বাইরে খেলে সেদিন সালভাদোর সন্ধ্যের পরপরই চলে যায়।
অফিসে অনেক রকম ব্যস্ততা থাকে। নানান দেশের লোক সেখানে কাজ করে। চাক্ষুস ভাবে সবাই একে অপরের থেকে ভিন্ন। সব মহাদেশের মানুষতো আছেই এমনকি বলা যায় বড় বড় সব জতি গোষ্ঠির মানুষও কাজ করছে এখানে। সবার কাজ যেহেতু একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তায় ওদের সকলের ভাবের আদান প্রদানও একই অক্ষে আবর্তিত হয়।
কিন্তু কাজ শেষে ওরা সবাই অন্য মানুষ, যে যার মত। বিশেষ করে অবনীর কাছে সবাই অচেনা হয়ে যায়। কারন ওদের সময় কাটানোর উপায়, ওদের মূল্যবোধ, নৈতিকতার মাপকাঠি সবই ভিন্ন।

আফিসের পর অবনী একদম একা হয়ে যায়। সময় কাটতে চায় না।
তবুও এ জীবন অনেক ভালো অবনীর। আপন বলতে যা বুঝায় তার সব কিছুকে ছেড়ে আসার যে যন্ত্রনা তাতো ওর মনের গভীরে। মনের ক্ষত দিয়ে ঝরা বেদনার রক্ত কেউ দেখতে পায় না।
সন্ধ্যের পর ইউরোপিয়ান আর আমেরিকানরা হয় মদের দোকানে না হয় রেষ্টুরেণ্টে বসে মেয়ে বন্ধুদের নিয়ে মদ খাচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে না হলে ডিসকো বা নাইট ক্লাবে ফুর্তি করছে। না, তবে ওরা লম্পট বা কাজে ফাকিবাজ নয়। ওরা সারা দিন কাজেও যেমন ডুবে থাকে তেমনি কাজের পর মন ভরে ফুর্তি করে রাতে ঘুমে ডুবে থাকে।
আর মোজামবিকানরা মনে হয় ঘরে বাইরে যার যেটা ভালো লাগে সেটাই করে। ধর্মীয় বা সামাজিক বিধি নিষেধ খুব একটা কার্যকরী নয় এখানে। মনে হয় ওরা সকলেই মানুষিক রোগী। কোন নীতি নৈতিকতা নয় বরং নিরেট বাস্তবতাকেই কেবল ভয় পায়।
শুক্রবার বিকাল থেকে নামপুলার চেহারা পরিবর্তন হতে থাকে। সাপ্তাহিক ছুটি গুরূ হওয়াই বিকাল থেকে ছোট্ট শহরটা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। সারা রাত ধরে রাস্তার মোড়ে মোড়ে বিভিন্ন ডিসকো ক্লাবে মানুষের ঢল। ভিতরে জায়গা না হওয়াই সাউন্ড সিষ্টেমের পরিবর্তন করে ড্রামের বিটের শব্দ বাইরে আসার ব্যবস্থা করা হয় তাতে করে বাড়তি মানুষ বিয়ারের ক্যান হাতে অন্ততঃ রাস্তায় নাচতে পারে।
কাজের ছেলে সালভাদোরকেও ঐ নাচার জন্য অবশ্যই শুক্র আর শনিরার রাতে ছুটি দিতেই হয়।
অন্য দিন গুলোতেও বিকাল থেকে ড্রামের বিট আর ডিসকো কম বেশী আছেই কিন্তু বিশেষ করে শুক্রবার দিন বিকাল থেকে এত মানুষ আর ড্রামের বিটের মধ্যে অবনী আরো একাকী হয়ে যায়।
সপ্তাহের প্রথমদিন ওর অন্যান্য সহযোগীরা যেখানে সপ্তাহান্তের বিভিন্ন সুখ স্মৃতি রোমত্থন করতে করতে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে সপ্তাহ শুরূ করে, অবনী সেখানে তিক্ত একাকিত্ত আর অনিদ্রায় কাটানো আরো একটা ইউকেন্ড শেষে ঘুমের ঘাটতির জন্য ফোলা ফোলা দুটো চোখ নিয়ে অফিসে যোগ দেয়।
কি অসহ্য নিঃসঙ্গতার যন্ত্রনা।
ওর নিজ অর্জিত জগতের সাথে আজ নিজ পরিবার আর ফেলে আসা বন্ধু বান্ধবদের জগতের অনেক পার্থক্য। শুধুমাত্র বৈষিয়কতার মাপকাঠিতেই নয় মূল্যবোধের বিবেচনায়ও।
টেলিফোনে নিজের কারো সাথে বলতে গেলে, বৈষয়িক দুএকটি প্রয়োজনীয় বিষয় বাদে ভাবের আদান প্রদান হয়না বললেই চলে। অন্যদিকে অবনী বর্তমান পরিবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এদের সাথে আদান প্রদান শুধু কাজের, ভাবের নয়।

হাজারো কোলাহলের মাঝে অবনী একদম একা। যতক্ষন কাজে থাকে ততোক্ষন নিজেকে আশেপাশের সকলের একজন মনে হয়। কিন্তু অফিসের বাইরে অবনী দ্বীপের বাসিন্দা একদম নিঃসঙ্গ।
নিজ ঘরের কোণে মনের ভিতরে গুমরানো কষ্টগুলোকে একদম গিলে ফেলা যায় সকলের অলক্ষে। কিন্তু সমস্যা হয় ব্যপারগুলো যখন সবার সামনে ঘটা করে ঘটে।
অফিশিয়াল বিভিন্ন পার্টিতে ওকে অবশ্যই যেতে হয়। সেখানে ওর পদ অনুযায়ী ওকে ঠিকই প্রাপ্য স্থানটা দেয়া হয়। পশ্চিমা বিশ্বের লোকজনের আধিপত্যে অবনী চাক্ষুস সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। নতুন কোউ আসলেই সংগত কারণেই অন্যান্য সবার মত ওর পরিচয়ও জানতে চায়। তাতে অবনীর কিছু আসে যায় না। কিন্তু দেশের পরিচয় ধরে ওকে যখন অনন্যারা অবমূল্যায়ন করতে থাকে বা করূনার কথা বলে তখন অবনীর মন চায় ওদের সাথে মারামারি চেচামেচি করতে। কিন্তু সেটা যে অশোভনীয় তা বুঝে ও বিরত থাকে।
অনেকবার ও এ ধরনের পরিস্থিতিতে চেষ্টা করেছে আসল চিত্রটা তুলে ধরতে। দেশের মানুষ প্রতিকুল প্রকৃতি আর দারীদ্রতার বিরূদ্ধে যে ভাবে লড়ায় করে বেচে আছে তা গর্বভরে বর্ণনা করতে। কিন্তু তাতে ফল কিছু হয়নি বরং ওর যারা অধীনস্ত অফিসার কিন্তু উন্নত বিশ্বের বাসিন্দা তারাও প্রথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মত একটা দেশের কিভাবে উন্নতি করতে হয় সে সম্পর্কে তাদের পুথিগত বিদ্যা থেকে শিক্ষাদান করার প্রয়াস পায়। আফিসের দৈনন্দিন কাজে যারা ওর কাছ থেকে বিভিন্ন নির্দেশ আর ওর অভিজ্ঞতালব্ধ উপদেশ গ্রহন করে কৃতার্থ হয় তারাও হয়ে ওঠে দারীদ্রমোচনে ওর শিক্ষক।
না খেয়ে থাকা বা বন্যায় পানি বন্দী মানুষের জন্য ওদের ফাঁকা হাহুতাস অবনীকে ছোট করে। দেশের কত ভাল ভাল জিনিস আছে কত নামকরা ব্যক্তিত্ব আছে, ওরা কখনো ভুলেও সেকথা বলে না।
নিজেকে আরো ছোট মনে হয় যখন ওর অধীনস্ত বা কলিগ কেউ বলে- এবার ঝড় বন্যা বা জলোচ্ছাস হলে বলো আমাদের দেশের অনেক চেরিটেবল প্রতিষ্ঠানের সাথে আমার যোগাযোগ আছে সাহায্য পাঠাতে সহায়তা করব।
অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে প্রস্তাব করে - তোমার দেশে পরবর্তি দুর্যোগের সময় আমাদেরকে জানালে আমরা আমাদের অফিসের সবাই মিলে সাহায্য পাঠাবো।
অবনী জানে দারীদ্রতা দেশের মানুষের নিত্য সাথি আর প্রাকৃতিক দুর্যোগতো আসছে বছরেও হবে। ঐ অসহায় মানুষ গুলোর জন্য এদের দান অনেকের জীবন বাচাতেও নিঃসন্ধেহে সহায়ক হবে। কিন্তু ওর কাছে পুরো ব্যপারটা এমন অসম্মানজনক মন হয় কেন, তা ও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না।
-এরা দয়া দেখায় নিজেদেরকে অতিমানব ভাবার জন্য, দরদে নয়। ভাবে অবনী।
পরের বছর বন্যা ঠিকই হলো। ওকে মনে করিয়ে দিতে হলো না। ঐ সাদা মানুষগুলো ঠিকই খোজ নিয়ে চাঁদা উঠানোর প্রস্তাব করলো।
কিন্তু অবনীর মন কিছুতেই সাঈ দিল না তাতে। ও জানে বন্যায় দেশের এক তৃীতিয়াংশ ডুবে আছে। লক্ষ কোটি মানুষ খাদ্য অভাবে, আশ্রয় অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। তবুও ওর মনটা পাথরের মত কঠোর হয়ে গেল। অবনী গল্প সাজিয়ে ওদেরকে বললো, এবারে সরকার সাহায্য না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ এবারের বন্যা দেশ নিজের সামর্থেই মোকাবেলা করবে। আমরা নিজের পায়ে দাড়িয়েছি।
তার কথা কেউ বিশ্বাস করলো কিনা বোঝা গেল না। তবে ওরা একটু স্তম্বিত হয়ে গেল।
-আমি মিথ্যা বলছি সেটা অন্যেরা বুঝলো কিনা জানিনা। আর বুঝলেও কিছু আসে যায় না তাতে। তবে আমিতো জানি কত বড় মিথ্যা আমি বলেছি, কত লোকের জীবন মরনের সমস্যাকে আমি মিথ্যায় ঢেকে দিয়েছি! আমার আপন মানুষগুলো যখন একটু সাহায্য পাওয়ার জন্য দুহাত বাড়িয়ে আছে তখন আমি মানুষের জীবনের থেকে নিজের ও দেশের ইমেজকে প্রাধান্য দিয়েছি।
এটা কি মিথ্যা মূল্যবোধ!
কথাগুলো ভাবতে নিজের উপর ঘৃনা আসলো অবনীর। একটা অপরাধ বোধে নিষ্পেষিত হতে লাগলো ও।
আজকাল নিজেকে মাঝে মাঝে নিজের কাছেই অচেনা লাগে অবনীর। কোথায় যেন কোন অদেখা সুতোর টান ওকে ওর নিজের থেকে দূরে টেনে রাখতে চায় সবসময়। 
নিজের বলতে যাকিছু তার সবই অবনীর বর্তমানের সাথে বেমানান। যে বর্তমানকে এত সংগ্রম এত লড়াই করে তীলে তীলে গড়ে তুলেছে।
অবনীর জীবনটা মাটি দিয়ে গড়া মানুষের শরীরের মত। মাটির গড়া, কিন্তু কারিগরের অমোঘ নিয়মে মাটির সাথে এর যত শত্রুতা। মাটি একটু সুযোগ পেলেই এটাকে আবার মাটি বানিয়ে ফেলতে চায়। যত পচা গন্ধ নিয়ে শরীরের বসবাস। সেগুলোকে আবরনের আড়ালে ঢেকে রাখতে হয়, না হলে জীবন চলে না।
কিন্তু মানুষ যে মাটির তৈরী সেটা প্রমান করতে মাটির শরীর থেকে সময়ে অসময়ে পচা দুর্গন্ধ বের হয়। আহ, এগুলো নিয়েই মানুষের বাস! এগুলো নিয়েই অবনীকে বাচতে হবে! 
অবনী শত মানুষের ভীড়ে একদম একা। জ্বলজ্বল করে জ্বলা আলোর মধ্যেও সে অন্ধকারাচ্ছন্ন। অফিসের কাজ আর অফিস সংক্রান্ত কথাবার্তার বাইরে ওর জগতে ও একদম একা, দ্বীপবাসি।