Heading
আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১১:০৮
পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা ছোট একটি গ্রামের বাসিন্দা অমর। মুল শহর থেকে মাইল দশেক দূরে একটি ছোট রেল স্টেশানের গা ঘেসে ছোট বড় পাহাড় আর টিলার ভিতর গ্রামটা। সব মিলে দেড়শ দুশো পরিবারের বাস।
তিন পুরুষের যৌথ পরিবার ওদের। সব মিলে বিশ জন সদস্য। শতায়ু ওর দাদা যিনি এখনো ভাল ভাবে হাটা চলা করেন, তিনিই সংসারের প্রধান এবং সব ব্যপারেই তার সিদ্ধান্তই শেষ কথা।
এ গ্রামে যে কোন ব্যাপারে ওর দাদার কথা সবাই মেনে চলে। তিনি গ্রামটাকে ভূস্বর্গ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। আর তার মূল মন্ত্র হচ্ছে ‘নিজেকে নয় অন্যকে নিয়ে ভাব’। গ্রামের সব পরিবারকে এ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারলে এই দুশো পরিবারের গ্রামটা ভূস্বর্গের ভিত রচনা করবে। আর সেটা তিনি নিজের যৌথ পরিবার থেকে শুরু করেছেন।
অমরের পরদাদা অনেক সম্পদের মালিক ছিলেন, জাহাজের ব্যবসা ছিল তার। বিভিন্ন দেশ আর বন্দরে বন্দরে ঘুরে ঘুরে জীবন কেটেছে তার। চার ছেলের তিন জনই ভিন দেশে পড়াশোনা করে সেখানেই বসত গড়েছে।
জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তার যেন জীবন সম্পর্কে নতুন চেতনা বোধের উন্মেষ ঘটেছিল। তখন তিনি সব ছেড়ে এই পাহাড়ী অঞ্চলে বসতি বানিয়ে এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
-সুখের পিছনে প্রানান্ত হয়ে ছুটলে, শান্তি পালিয়ে যায়। সম্পদ সুখ দিতে পারে বটে তবে সেটা আপেক্ষিক। শান্তির জন্য বাহিরে নয় নিজের ভিতরটা খুঁজতে হয়। সুখ হচ্ছে শারীরিক আর মানসিক, আর শান্তি হচ্ছে আত্মিক। সারা জীবন সুখের খোঁজে পাগল হয়ে ছুটেছি। আর না এখন আমি শান্তি চায় খোকা।
ছোট ছেলে অর্থাৎ অমরের দাদা তিনি তার বাবার কথার মর্ম বুঝে ফিরেছিলেন বাবার সাথে। অন্য কোন ছেলেকেই তাদের বিলাসবহুল জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেশে ফিরাতে পারেননি।
দাদা বলেন- মানুষের মধ্যে প্রাইভেসির আকাঙ্ক্ষা বাড়ছে, অর্থাৎ মানুষ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে, অন্যের সাথে কোন কিছু ভাগাভাগি করতে অনীহা জন্মাচ্ছে, আপন জনদের মধ্যে পারস্পারিক অবিশ্বাস আর ঘৃণা বাড়ছে আর সেটাই অশান্তির মূল কারণ।
অমর শহরে একটা প্রাইমারী স্কুলে মাস্টারি করে। সপ্তাহের পাচ দিন সকাল আটটার দিকে লোকাল ট্রেন ধরে শহরের মেইন স্টেশানে নেমে মিনিট দশেক হেটে স্কুলে যায়। আবার আড়াই টায় ছুটি হওয়ার পর তিনটের ট্রেনে চড়ে ষাঁড়ে তিনটের মধ্যে ফিরে এসে নামে গ্রামের সাথে লাগোয়া এই ছোট স্টেশানে।
সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, পর দিন সাপ্তাহিক ছুটি। তাই ভেবেছিল স্টেশানে নেমে বাজারে একটু সময় কাটিয়ে বাড়ী ফিরবে।
ছোট স্টেশানের এই একটা সুন্দর দিক, ট্রেন থামলে অল্প কিছু যাত্রী উঠা নামা করে আর ট্রেনটা ছেড়ে গেলেই প্লাটফর্ম একদম ফাঁকা হয়ে যায়।
কিছু কিছু দৃশ্য থাকে যা প্রথম দেখাতেই নজর কাড়ে। সেদিন বিকেলে ট্রেন থেকে নামতেই ওর দৃষ্টি আটকে গেল ফাঁকা প্লাটফর্মের গাঁ ঘেঁসে সবুজ ঘাসের মাঝে তৈরী সিমেন্টের একটা বেঞ্চের দিকে। ঝাঁকড়া চুল আর খাট করে ছাঁটা দাড়িতে ঢাকা মুখমণ্ডলে বয়স্ক একজন মানুষ সামনে পাহাড়ের সারির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। মনে হচ্ছে চোখ মেলে থাকলেও কিছুই যেন দেখছেন না।
ছোট এলাকা সব মানুষই বলতে গেলে জানাশোনা, কিন্তু ঐ মানুষটাকে এখানকার কেউ বলে কিছুতেই মিলাতে পারল না অমর। নির্জন প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে সেদিকেই তাকিয়ে দেখছিল অমর। ভাবল মানুষটি একবার তার দিকে তাকালে সে এগিয়ে যেয়ে কথা বলবে।
মানুষটির দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে অমর পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বেঞ্চটার কাছে দাঁড়ালো। কিন্তু তাতেও কাজ হল বলে মনে হল না।
-আমি কি এখানে একটু বসতে পারি?
অমরের কথাই মনে হল তিনি সম্বিত ফিরে পেলেন।
অমরের দিকে তাকিয়ে তার আপদমস্তক খেয়াল করে হাসি মুখ করে বললেন –বস, আমার কোন আপত্তি নেই।
কথাবার্তাই গাম্ভীর্য পরিষ্কার। পরনে ভাল মানের পাঞ্জাবি পাজামা। বয়স হলেও ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী বলা যায়।
-আপনি এখানে কোথায় মানে কার বাড়ীতে এসেছেন? আমি এ এলাকার ছেলে তাই জিজ্ঞেস করলাম। কিছু মনে করবেন না।
-আরে কি যে বল, কি মনে করব।
অমর হাসিমুখে নিজেকে অল্পে তুষ্ট একজন সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার বলে পরিচয় দিয়ে বলল –আমি একজন শান্তি প্রিয় মানুষ, সপ্তাহে পাচ দিন স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়ানোই ব্যস্ত থাকি আর সাপ্তাহিক ছুটির দুদিন পারিবারিক জমিতে কাজ করি। ছুটির দিনে বিকালে বাজারে চেনা জানা মানুষের সাথে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গল্প হাসি তামাসা করে সময় কাটাই। রাত দশটা বাজলে চোখ দুটো খুলে রাখতে পারিনা।
আগন্তক অমরের সরলতা পূর্ণ কথা মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলেন।
অমর ওর দাদু আর তার স্বপ্নের কথা সবিস্তারে আগন্তককে বর্ণনা করল।
-আর যে একটা জিনিস আমাকে উদ্বেলিত করে সেটা হচ্ছে অচেনা মানুষকে আপন করা। দাদুর কথা মত আমাদের বাড়ীতে বড় একটা গেস্ট রুম সব সময় তৈরী থাকে আজানা কাউকে পেলে আমরা তাকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করি, আর কত তাড়াতাড়ি আগন্তক কাউকে আপন করা যায় সে চেষ্টা করি। দাদু আপন পরের সংজ্ঞাটা প্রসারিত করতে চান।
-চমৎকার, কি সুন্দর ঝরঝরে জীবন তোমাদের। আগে আমার খুব ভারী জীবন ছিল কিন্তু এখন আমিও তোমার মত ঝরঝরে ফুরফুরে সুখী মানুষ।
অল্পতেই অসম বয়সী দুজন দুজনকে বেশ পছন্দ করে ফেলল।
-তুমি ঠিকই ধরেছ, আমি এখানকার কেউ না, আর নির্দিষ্ট কোন কাজে বা কারো কাছে আসিনি।
আগন্তকের কথাই অমর একটু অবাকই হল।
-ছোট জায়গার এ এক অনন্য বৈশিষ্ট্য, সৌন্দর্যও বলা যায়। কেউ আগন্তক হয়ে বেশীক্ষণ থাকতে পারে না, মানুষ তাকে আপন করে নেয়।
অল্প পরিচয়েই খুব আন্তরিক হয়ে উঠলো ওরা।
-সকালের ট্রেনে এসে এখানে নেমেছি। আগে কোনদিন এদিকে আসা হয়নি।
অমর কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাল।
-না বাবা, বাড়ীতে রাগারাগি করে মনের দুঃখে বা আপন মানুষ জন তাড়িয়ে দিয়েছে এমনটি না। যেটা সাধারণত ঘটে। আমারটা পুরো উল্টো বলতে পার।
অমর আরো বেশী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল আগন্তকের দিকে।
-সারা জীবন পরিশ্রম করে মেধা খাটিয়ে অনেক অনেক সম্পদের মালিক হয়েছি। ছেলেমেয়েরা বিদেশে লেখাপড়া করে সেখানেই নিজেদের মত জীবন গড়ে বসবাস করছে। আমার অনেক সম্পদ সম্পত্তি আছে যা অল্পতে বলে শেষ করা যাবে না। যে গুলোকে জীবনে সফলতা আর সুখের মাপকাঠি বলা যায় তার সবই আছে আমার।
অমর প্রায় হা হয়ে শুনতে লাগলো সব কথা। এত এত সম্পত্তির মালিক এমন হালকা ভাবে কথা বলছে! অবাক হয়ে ভাবল অমর।
-যাদের জন্য এগুলো করা তাদের কারোরই এসব কিছুর প্রয়োজন নেই। সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে ওরা কেউ আর ফিরবে না। বরং আমাকেই ওদের ওখানে যেয়ে থাকতে বলে।
একটু থামলেন তিনি, কিছুটা আত্মসমাহিত হলেন।
-তা কি সম্ভব বল!
কথাটা বলে একটু থেমে তিনি অমরের দিকে তাকালেন।
-এখানে আমি একদম একা, নিজের বলতে যাদেরকে বুঝাই তাদের কেউ নেই। তাই গিয়েছিলাম ওদের ওখানে সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে, কিন্তু দেখলাম ওদের সংসারে ওই পরিবেশে বড় হওয়া নাতি পোতাদের সান্নিধ্যে আমি বেমানান, একা।
একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে একটু ঘন হয়ে বসলেন তিনি।
-দেশে ফিরে এখন বাগান বাড়ীতেই থাকি বলতে পার। আমার প্রাসাদ সম বাড়ীতে সব মিলে প্রায় বিশ জনের মত মানুষ কাজ করে। সবাই অনেক বছর ধরে আছে, আপন জনের মত হয়ে গেছে, কিন্তু ওরা কেউ আমার আপন না। আমার চারদিকের সব মানুষের সাথে আমার কেবল মাত্র লেন দেনের সম্পর্ক, হিসেবের সম্পর্ক।
অমর নীরবে শুনছে আগন্তকের কথা।
-ইন্ডাস্ট্রির সাথেই দশ একর জমির উপর নির্মিত আমার বাগান বাড়ী। দেশী বিদেশী নানা জাতের ফল ফুলের গাছ লাগিয়ে এক মিশ্র প্রকৃতি সৃষ্টি করেছি সেখানে। দিনের কাজ শেষে বাকি সময়টা বাসার ভিতরে হেটে বসে মানুষের সাথে নানা কাজের কথা বলে সময় কেটে যায়। বাগানটাতে হাটাহাটি করে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার চেষ্টা করি।
বাগানে সব দেশী ফল তো আছেই। সাথে অনেক প্রজাতির বিদেশী ফলের চাষ আছে, আঙুর, মাল্টা, ড্রাগন ফ্রুট ইত্যাদি।
জ্যৈষ্ঠের শুরু। আম গাছের তলা গুলো পাখীতে খাওয়া বা ঝড়ে পড়া কাঁচা পাকা আমে ছেয়ে গেছে। এভাবে কোন কিছু পড়ে থেকে নষ্ট হতে দেখলে আমার মনের ভিতর একটা আভিজাত্যের ভাব ফুটে উঠে এক ধরণের আনন্দ অনুভব করি।
কোন কিছু তাচ্ছিল্য ভরে নষ্ট করার মধ্যে একটা পৈশাচিকতার অনুভব আছে। মনে মনে যখন ভাবি পাখীরা আমার বাগানের ফল খাচ্ছে তখন কিছুটা ঐশ্বরিক ভাব মনে উদয় হয়।
সেদিন হাটার সময় খেয়াল করলাম একজন মালি ঢিল ছুড়ে আম গাছ থেকে পাখী তাড়ানোর চেষ্টা করছে। বুঝলাম আমাকে দেখে ও ওর কাজ দেখাচ্ছে, ঠিক মত পাখী তাড়ালে তো এত পাখী খাওয়া আম নিচে পড়ে থাকার কথা না।
মাঝ বয়েস পার করা হেড মালি। পাচ জন মালিকে ও পরিচালনা করে। আমার এখানে কাজ করে দশ বছরের উপর হবে, আবুল ওর নাম। বাগান বাড়ীর কর্মচারীদের জন্য গেটের বাইরে কোয়াটার আছে, অন্যান্যদের মত সেখানে ও থাকে পরিবার নিয়ে।
-থাক, খাক না এমনিতে তো নষ্ট হচ্ছে। আমি ওকে পাখী তাড়াতে নিষেধ করলাম।
অদূরে দেখলাম বিদেশী ফল গুলোও গাছে ঝুলছে আর তলায়ও পড়ে আছে। কিন্তু লক্ষ্য করলাম সেগুলো খুব একটা পাখীতে খাওয়ার জন্য তলায় পড়েছে তেমনটি না, বোটা পচে খসে পড়েছে।
ভাবলাম –দেশের পাখীরাও বিদেশী ফল তেমন পছন্দ করে না।
-বাবু, সেদিন বাবুর্চির সাত বছরের ছেলেটা তলার আম কুড়চ্ছিল, আমি নিষেধ করেছি। বলা কি যায়! আজ কুড়বে তারপর অভ্যাস খারাপ হয়ে কাল গাছ থেকে পাড়বে। ওর হাত থেকে আমগুলো কেড়ে নিলে ছেলেটা বেশ কাঁদল কিন্তু আমি একদম পাত্তা দিয়নি তাতে।
পরিষ্কার বুঝলাম আমাকে খুশী করতে মালি একদম মরিয়া।
হাটা শেষ করে বাসার সন্মুখে বড় বারান্দায় পাতা সোফায় বসলাম। প্রায় চল্লিশ বছর পার করা বয়সী বাবুর্চি মেরু মিয়া লেবুর সরবত নিয়ে আসলো।
আমি সাধারণত কাজের মানুষদের মুখের দিকে ভাল করে তাকায় না। কিন্তু সেদিন মেরু মিয়া টেবিলে সরবতের জগ আর গ্লাস রাখার সময় ওর মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। শুখনো মুখ, একেবারে ভাবলেস হীন। ভাবলাম গতকাল আবুল ওর ছেলেটার কাছ থেকে তলায় পড়ে থাকা আম কেড়ে নিয়েছে বলে কি মনটা খারাপ!
আমার এত অঢেল সম্পত্তি, সেগুলো যাদের ভোগ করার কথা অর্থাৎ আমার ছেলেমেয়ে তাদের এটার কোন প্রয়োজন নেই। আর যারা আমাকে সেবা করে জীবন চালায়, আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখে তাদের সেগুলো প্রয়োজন থাকলেও তারা আমার আপনজন নয় বলে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেলেও তাদের খাওয়ার কোন অধিকার নেই।
-পাখী আমার বাগানের ফল খেলে আমার মনের মধ্যে খুশীর উদ্রেগ হয় তাই আবুলকে গাছ থেকে পাখী তাড়াতে নিষেধ করলাম, কিন্তু মেরু মিয়ার সাত বছরের ছেলের হাত থেকে তলায় পড়া আম কেড়ে নিলে ছেলেটা কাঁদল সে ঘটনা আমার মনে কোন আঁচড় কাটল না!
ভাবলাম- রক্ত মাংসের মানুষ আমি, আমিত্ব থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসা সম্ভব না, তবে আপন পরের পরিধিটা আরো একটু প্রসারিত করলে জীবনটা বোধহয় অর্থ পূর্ণ হবে। সেভাবেই আমার সম্পত্তিতে যারা কাজ করে সব মিলে পাঁচশোর মত মানুষ হবে, আমার সম্পত্তির আয়ের সিংহ ভাগ তাদের ভোগ করার বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়েছি এই নিরুদ্দেশ যাত্রায়।
-এখন নিজেকে ফুরফুরে লাগছে হালকা পালকের মত।
অমর মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষন তার কথা শুনছিল।
-সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এল। চলুন আজ বাড়ী গিয়ে দাদুর সাথে একত্রে বসে চা খাব।
অমর আগন্তককে সাথে নিয়ে বাড়ীর দিকে পা বাড়াল।