জীনন থেকে নেয়া ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -১৯ ।

আপডেট: ০৭ অগাস্ট ২০২২, ১৫:২৪

অমৃতের সন্ধানে- ১৯ 

 

বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো মানিক। বেলাটা হেলে গিয়েছে পশ্চিম দিগন্তে। ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে কতক্ষন চিন্তাই ডুবে ছিলো কে জানে। পাজ্ঞাবিটা একদম ঘেমে ভিজে উঠেছে। চশমাটা পুরোপুরি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। কোন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
পকেট থেকে রূমালটা বের করে চশমাটা মুছে নিল। বিকেল হয়ে গেছে বেলা ডুবতে বোধহয় আর বেশী দেরী নেই। চারিদিকে কাউকেই দেখা গেল না। সামনে কেবল অথৈ পানি।
নদীর ওপারে অমৃতনগর, ফেরিটা পার হওয়াই যা ঝামেলা। ওটা পার হতে পারলেই এপারের সব কিছুর সব ধরা ছোয়ার বাইরে চলে যাবে। আজ মনে হচ্ছে নিশ্চিত অমৃতের সন্ধান পাওয়া যাবে।
মরিচিকার পিছনে ছুটতে ছুটতে মানিক এখন ক্লান্ত। তায় এ সন্ধানে ওর আকাঙ্ক্ষা আছে তবে উদ্দিপনা নেই।
ওপারে একবার গেলে নাকি কেউ আসতে চায় না। কোন কাজকর্ম নেই, জ্বালা যন্ত্রনা নেই। চাহিদাও নাকি নেই কোন কিছুরই। জায়গাটা এমন হলে তা ছেড়ে কেউ আসবে কেন! তাড়িয়ে না দিলে।
একটু সামনে ঘাটটার গা ঘেসে একটা ছাপড়া ঘর। ভারী অবাক লাগলো, সেই কখন ধরে এখানে অপেক্ষায় আছে কিন্তু নজরে পড়েনি!
ওটাতে কি আছে কে জানে! না গেলে কল্পনা করা যাবে বটে কিন্তু তা যে ঠিক কিনা সেটা বিধাতা বাদে সবার অজানা। জীবনটাও একই রকম। বাকি টুকুতে কি আছে না গেলে বোঝা যায় না।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল মানিক।
একটাই ঘর, চা বিস্কুটের দোকান। তরজা বাশের বেড়া, উপরে কিছু খড় আর গাছের ডালপালা মিশিয়ে ছাপড়া দেয়া। চারদিক দিয়েই আলো বাতাস ঢোকে। যেন মাকড়াসার জাল।
একটা মানুষ বসে, কৃশাঙ্গ পৌঢ় বলা যায়। হাড্ডির খাচার শরীর যেন, একটুও মাংস মেদ নেই। চোখ দুটো চোয়ালে ঠেলে বেরিয়ে যাওয়া হাড্ডির প্রকোষ্ঠে পুরোপুরি আবদ্ধ, ছোট মার্বেলের মত জ্বলজ্বল করছে। চোয়াল দুটো বসা, হাড্ডিগুলো পাতলা চামড়ার আবরনে ঢাকা।
সময় ওর শরীরটাকে বর্ধন করেছে কিন্তু পৃথিবীর কোন পুষ্টি ওর শরীরে নেই বললেই চলে। অনেক লম্বা বলে মনে হলো লোকটাকে। নিচু একচালা দোকানটার মধ্যে মাচার উপর কোন রকমে শরীরটা ভাজ করে বসে আছে।
লুঙিটা গুটানো দুহাটু অব্দি। চামড়া কুচকানো অস্বাভাবিক লম্বা হাটু দুটোর মাঝখানে বকের মত করে লম্বা গলাওয়ালা মাথা বের করে ও তাঁকিয়ে আছে। ভাবলেশহীন দৃষ্টি। মনে হয় সব ভূত ভবিষ্যৎ ওর জানা।
অদ্ভুত স্বরে কথা বলে, কিচ কিচ করে। ইঁদুর বাদরের মত। ভৌতিক এক কণ্ঠস্বর।
ওর কাছ থেকেই মানিক জানলো বাকি সবাই অদূরেই একটা নামকরা বটগাছ আছে ওটা দেখতে গিয়েছে।
সামনে পাতা বেঞ্চটার উপর বসলো মানিক। ভাবল একটু চা খেলে মন্দ হয় না।
-বেলাতো আর বেশী বাকি নেই। পরের ফেরিীটা কখন কে জানে। বেলা থাকতে ওপাড়ে পৌছানো যাবে কিনা তাও নিশ্চিত না। নিজের মনে ভাবল মানিক।
-স্যার, ফেরী পাওয়া তো ভাগ্যির কতা।
চা দিতে দিতে দোকানী বললো।
-কেন?
প্রশ্নের কোন সরাসরি উত্তর দিল না, প্রশ্নটা ও শুনলো কিনা ঠিক বোঝা গেল না।
-আপনারা তো স্যার ভাগ্যিবান বলতি হবে।
মানিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে ওর দিকে তাকালো।
-আপনারাতো ফেরিটা চোকি দেকিছেন, অনেকে চোকি না দেকেই ফিরে চলে যায়।
সে ভাবেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মানিক।
-ফেরির কোন ঠিক ঠিকানা নেই স্যার, ও কারো ইচ্ছেয়, কারো টাইমে চলে না। কখন আসে কখন যায় তা ও বাদে আর কেউ বলতি পারে না।
মানিক ওভাবেই তাকিয়ে। দোকানীর কথার অর্থ পুরোপুরি বোধগম্য নয়।
ওর কণ্ঠস্বর আর কথা বলার ধরন অস্বাভাবিক লাগলো।
-কিন্তু স্যার, যার সময় হবে ফেরিটা সে ঠিক ঠিকই পেয়ে যাবে।
দোকনীর চোখে মুখে একটা দৃঢ় বিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠলো।
-তা তুমি জাননা ওটার সময়। মনে হলো ওকে জিজ্ঞেস করে।
-কোনটাতে আমার জাগা হবে সেটায় জানিনে। তা আবার অন্যগুলোর খবর কি করে রাখি।
অবাক লাগলো। অন্তর্যামী নাকি লোকটা!
-আজ কত বছর ধরে বসে আছি, কত ফেরি এলো আর গেল এ অবধি কোনটায় আমার জাগা হলো না।
একটু থেমে আবার বললো- তাতে আর আমার কি আসে যায় বলেন, একটা পা’তো ওপারে দিয়েই আছি। জাগা হলিই আর এক পা পার করবো। একটু খানি জাগা হলিই আমার হয়ে যাবে।
কালো হয়ে যাওয়া পুরানো অন্য চায়ের কাপটা ধুতে ধুতে ছোট্ট একটা স্বস্তির নিশ্বাস টেনে বললে - সাথে তো কোন মালামাল নেই আমার। এই সব যা দেকতিছেন এর কিচ্ছুই আমার না।
আত্মতৃপ্তিতে ভরা স্মিত হাসিতে ওকে এত হালকা মনে হলো যে একটু দমকা বাতাসে ও ফুরফুর করে উড়ে ওপারে চলে যেতে পারবে।
ওর শরীর, ওর শতছিন্ন পরিচ্ছদ আর সম্বলহীনতা এই মূহুর্তে মানিকের কাছে কেন জানি হিংসার বস্তু হয়ে দাড়ালো।
-তাহলে আমার সারা জীবনের এসব উপার্জন। একি অর্থহীন বোঝা! ভাবনাগুলো দারূন ভাবে ধাক্কা দিল মানিককে।
-কিচ্ছুই অর্থহীন না আবার সবই অর্থহীন। কেমন মজার কতা না। এই যেমন ধরেন আমার মত মূর্খকে যদি কওয়া হয় যে আকাশে এমন বড় বড় উড়ন্ত পাথর ভাসে বেড়াচ্ছে তা যদি কোনভাবে এই দুনিয়ার সাথে ধাক্কা লাগে তালি তো রোজ কিয়ামত। কতাটা অপনার মত এক সাহেব আমকে বলেছিলো। আমি খুব হেসেছিলাম।
-আমি যদি আপনারে কই যে স্যার এ নদী পার হতি গিলি এত দুরি আসার দরকার কি? বাড়ী বসেই ফেরী পাওয়া যায়। তাইলে আপনিও আমার মত হাসপেন।
দোকানী যতোই কথা বলছিলো মানিক ততোই অবাক হচ্ছিলো।
-মনের মদ্যি অত চিন্তা করে কি করবেন। কোন কুল কিনারা করতি পারবেন না। বিধি যা করে তাতো অন্য কেউ ফিরাতে পারে না। বিধির লিখন খণ্ডানোর জন্যি খালি হাসফাসই করে মানুষ, ফল হয় না। সব কিছু মানে নিয়াই ভালো। মানে নিলি বোধহয় তিনি খুশি হয়।
-সব মানে নিয়ে চেষ্টা চালায় যান। তাতো আর মানা করিনি কেউ। যার কাজ সেই করূক।
লম্বা একটা নিঃশ্বাস টানলো দোকানী।
-কোন কিছুর জন্যিই উতালা হবেন না। কোন লাভ হয় না। যাই হোক না কেন বেলাতো গড়াই যায়। অত চিন্তা কি, বেলা ডুবে গিলিইতো ডিউটি শেষ।
মানিকের হাত থেকে কাপটা নিতে নিতে দোকানী তার দিকে তাকালো। পানি টলমলে ওর চোখদুটো। ঠিক যেন সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটার মত।
-আপনি ফিরে যায়ে বাকি কাজ শেষ করে আসেন। সময় হলি ফেরিও আসপে আর সেকেনে আপনার জাগা ঠিকই হবে।
ওর কথায় মানিক যেন সম্বিৎ ফিরে পেল।
ভাবল জিজ্ঞেস করে- তা তুমি এখানে পড়ে আছো কেন?
-আমার কতা বাদ দেন, আমিতো সব মায়া কাটায়ই ফেলিছি।
আবারো সেই অন্তর্যামীর মত উত্তর। শতছিন্ন বস্ত্রে আবৃত কংকালসার এই বৃদ্ধের পার্থীব নিঃস্ব অবস্থা জীবনের অর্থ সম্পর্কে মানিকের সব ধারণার মূলে যেন কুঠারাঘাত করলো।
ওর চোখ দুটো আরেক বার ভালো করে দেখার খুব ইচ্ছে হলো মানিকের। কিন্তু পারলো না, একেতো হাড্ডির কোঠরের মধ্যে ঢুকোঁনো তার উপর কথা বলতে বলতে ও মুখটা ঘুরিয়ে অবিরাম বয়ে চলা দিগন্ত বিস্তৃত নদীর দিকে তাকিয়ে কথা বলছিল।
-সব মায়া স্যার, মায়া! যতখানি বাকি আছে তা কাটায়ে আসতি হবে।
দোকানী বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস টেনে তা ছাড়তে ছাড়তে বললো -নাইলে যাবার বেলা অনেক কষ্ট হবে।
মানিক ওর দিকে তাঁকিয়েই রইল।
-পরের জাগা পরের ঘর, মনিব যখনি কবে তখনি চলে যাতি হবে। সবই তো তার খেয়ালেই চলে। কথাগুলো ও স্বগত স্বরে বললো।
মানিক ভাবল জিজ্ঞেস করে- ফেরিটা আবার কখন আসবে?
-স্যার, সব কতা আগে থাকতি জানে গেলি তা কখনো ভালো হয় না। ধরেন তা যদি সুখির কতা হয়, আগের থেকে জানতি পারলি সুখটা কমে যায়। কারণ মানসের মন বড় অবুঝ, খারাপটাই চিন্তা করে বেশী তাই আগাম সুখের খবরেও মনের মদ্যি বিনা কারণে সন্দেও জমা করে। আর দঃখির কথা হলি তো কতাই নেই, সন্দেহ বাতিক মনে আসল দুঃখ শুরূ হওয়ার আগেই নকল দুঃখ শুরূ হয়ে যায়। কপালের লিখন খন্ডাবে কার সাধ্যি। মানে নিলেই সব সমাধান হয়ে যায়। মানে নিলি মন শান্ত হয় তাতে করে পরিস্থিতি চিন্তা করে সমাধানের পথ বের করা যায়।
বৃদ্ধ একটু থেমে আবার বলল –সব মায়া বোঝলেন স্যার মায়া, মায়ার বাধন! এ বাধন বড় শক্ত। এ যাকে যত শক্ত করে বাধেছে আর ততো জ্বালা। আর যে সে বাধনের সন্ধান পায়নি সেত জ্যন্ত মরা।
ছোট একটা নিঃশ্বাস টেনে দোকানী হাতের ছোটখাট কাজে মন দিল।


Read More