Heading
আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১৩:৪৮
নিজের গ্রামটা খুব পছন্দের একটা জায়গা কবিরের। এ গ্রামেই ওর জন্ম। নদীর ধার ঘেঁষে পাহাড় জঙ্গল আর সমতল ভুমি মিলে সে জায়গা। সমুদ্রটাও অদূরে আর তাই জোয়ার ভাটার সময় নদীটা চেহারা পরিবর্তন করে অচেনা হয়ে যায়।
এটা কবিরের নিজস্ব ভুবন।
এ রকম একটা সুন্দর জায়গায় জন্ম গ্রহণ করার ব্যাপারে ওর নিজের কোন কৃতিত্ব নেই। কৃতিত্বটা সবই তাঁর যিনি সৃষ্টি করেছেন সেই প্রভুর। তার জন্য সব সময় প্রভুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায় কবির।
পাহাড়ে উঠার শখ ওর আজন্ম। কিন্ত এ ব্যাপারে অন্য দশ জনের সাথে ওর একটা পার্থক্য আছে।
সবাই পাহাড়ে ওঠে যার যার নিজস্ব পছন্দের ভিত্তিতে। তবে অন্য সবাই উঠার জন্য পাহাড় বেছে নেয় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, সময় থাকতে নির্বিঘ্নে ঘরে ফিরতে হবে সে চিন্তাটা সকলে মাথায় রাখে।
কিন্তু কবিরের বেলাই বিষয়টা একেবারেই ভিন্ন। পাহাড়ে উঠাতেই ওর যত আনন্দ। কখন নামতে হবে, হাতে সময় আছে কিনা, সে সব ভাবনা ওকে একেবারেই স্পর্শ করে না।
তাইতো উঠার জন্য কবির সবচেয়ে উঁচু পাহড়টা বেছে নিয়েছে যার চুড়াটা দেখা যায় না, মেঘে ঢেকে থাকে সব সময়। স্বর্গ যেন সর্বক্ষণ সেখানে মর্তকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনে চুম্বনে শিক্ত রাখে।
অজানা গন্তব্যে যাত্রার প্রতি আলাদা একটা টান আছে কবিরের।
সাধারণত সবাই অজানা পাহাড়ে উঠার সময় বার বার পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে নেয়, ফেরার রাস্তা ঠিক আছে কিনা সেটা যাচায় করতে। সকলেই উপরে ওঠে ফেরার কথা মাথায় নিয়ে।
কিন্তু কবিরের উপরে উঠার হিসেবটা সকলের থেকে ভিন্ন। সে উপরে ওঠে আর কখন ফিরবে না বলে। পিছনে ফেরার রাস্তা সে মুছে ফেলে উপরে ওঠে। পিছনের কথা স্মরণে থাকে কিন্তু জীবনে অগ্রসর হয় সামনে তাকিয়ে।
কবির তার ছেলে মেয়ে দুটোকেও সে চেতনায় বড় করে জীবনে উচ্চতায় উঠার শিক্ষা দিয়ে মানুষ করেছে। ওরা বড় হয়ে যে যার জগতে বাস করছে এখন। যে উচ্চতায় তারা উঠেছে সে উচ্চতায় টিকে থেকে সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মনে প্রাণে ধ্যান ধারনায় সেখানকার একজন হয়ে থাকার অনুপ্রেরণা তাদেরকে সব সময় জুগিয়েছে কবির।
নিজেদেরকে বিশাল সমুদ্রের এক একটা আলাদা ছোট বড় ঢেউ না ভেবে সমুদ্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ ভাবতে শিখিয়েছে তাদেরকে।
ছেলে মেয়েদেরকে নিজ নিজ পছন্দের ভুবনে নিজ নিজ উচ্চতায় আরোহণের জন্য সাধ্যমত সহায়তা করতে করতে কবির এখন তার নিজের পাহাড়ে উঠার পথের শেষ প্রান্তে এসে দাড়িয়েছে।
আজ এখন জীবনের যে প্রান্তে ও নিজেকে এনে দাড় করিয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ ওর নিজের পছন্দের, নিজের অর্জন। সাফল্য বিফলতা যা কিছু সব তার নিজের।
জীবনের অতিক্রান্ত রাস্তা বিস্মৃত প্রায়, মৃত বলা যায়, আর কবির সেগুলো মনেও করতে চায় না। মৃতকে মৃত থাকতে দিতেই সে পছন্দ করে। যাপিত জীবনে হরিষে বিষাদের যা কিছু ঘটেছে তার জন্য কোন আক্ষেপ নেই।
চুড়ার কাছাকাছি জীবনের এ প্রান্তে এসে যেখানে ও দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে সামনেটা শুধু ধোঁয়াশা মেঘে ঢাকা। মানুষের জীবনের চ্যালেঞ্জ গুলো ফুরিয়ে গেলে মানুষ যেমন কি করবে সে সম্পর্কে মনে একটা অসারতা তৈরি হয়, জীবনের এ পর্যায়ে পৌঁছে মেঘে ঢাকা পাহাড়ের চুড়ার দিকে তাকিয়ে কবিরেরও তেমনটিই মনে হচ্ছে।
কি আছে ওই না দেখা চুড়াতে! ওখানে না গেলে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই।
পাহাড়ের যেটুকু উঠেছে সেটুকু দেখে শুনে বুঝে পথ চলেছে। কিন্তু সামনের পথটুকু চলার জন্য কোন ইন্দ্রিয়ই আর তাকে সহায়তা করতে পারবে না। ইন্দ্রিয়ের দৌড় শেষ, বাকিটুকু নিয়তি। কল্পনার উপর নির্ভর করেই বাকি পথটুকু পেরোতে হবে।
একদম অজানা অচেনা পথে পা বাড়ানোর সময় হয়ে এসেছে।
এ সময়টাতে চলার গতি একটু স্লথ করে পিছন ফিরে জীবনের মাড়ানো পথটুকু দেখার ইচ্ছে জাগছে কবিরের মনে। জীবন পাহাড়ের এ উচ্চতায় দাঁড়িয়ে মাড়িয়ে আসা পথটুকু পরিষ্কার ভাবে দেখা যায়। বাকি যারা আশে পাশের পাহাড়ের বিভিন্ন উচ্চতায় আরোহণ রত তাদেরকেও মোটামুটি পরিষ্কার দেখা যায় এ উচ্চতা থেকে। এ অব্দি উঠার পথের বর্ণনা আরোহণরত অন্যান্যদের সাথে কবির ভাগাভাগি করতে পারে যেটা ওদের প্রয়োজন।
জীবনের উত্থান পতনের বাঁকে বাঁকে ভুলত্রুটি আর সাফল্যের সবটুকু পরিষ্কার ভাবে ধরা পড়ে এ উচ্চতায় দাঁড়িয়ে। এ দীর্ঘ জীবন চলা যা কিছু শিখিয়েছে তার উপর ধ্যান দিয়ে সেগুলো অন্যান্য আরোহীদের জানানোর একটা তাড়না অনুভব করল কবির।
জীবনের প্রতিযোগিতায় সঙ্গী সাথীদের পিছে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে যায়, অপরকে উজাড় করে দেয়ার জন্য সেটাই প্রকৃষ্ট সময়। জীবনের কাছ থেকে যখন পাওয়ার তেমন কিছুই থাকে না তখন দেয়াতেই কেবল আনন্দ।
এ উচ্চতায় উঠে সম্পূর্ণ অজানা সামনের দিকে তাকিয়ে হাহুতাস না করে পিছনের দিকে তাকিয়ে জীবনে ঘটা সাফল্যের উল্লাস আর পরাজয়ের গ্লানি গুলো চিন্তা করে সবার মত কবিরেরও চোখ দুটো আনন্দ বেদনার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে উঠল।
এ সময়টাতে সকলেই নীরবে অশ্রু সংবরণ করে জীবনটাকে অনেকটা অর্থহীন ভেবে জীবনের সব চাওয়া পাওয়াকে বিসর্জন দিয়ে কেবলমাত্র ওই মেঘে ঢাকা ধোয়াসে পাহাড়ের চুড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে সময় কাটিয়ে দেয়। জীবনের সব জানালা বন্দ করে ওই একটা জানালাই খোলা রাখে।
কিন্ত কবির শুরুর মত শেষটাও নিজের মত করে করতে চায়।
পাহাড়ের শৃঙ্গে উঠার এ যাত্রা পথে সে কত শত জনকে পা পিছলে গড়িয়ে পড়ে অকালেই শেষ হতে দেখেছে। কিন্তু কবির সেসব ভাগ্যবানদের একজন যারা জীবনের সব পিচ্ছিল পথ পার হয়ে এ অব্দি পৌঁছানর সৌভাগ্য হয়েছে।
প্রতিযোগিতা পূর্ণ জীবনের পদে পদে মগজ আর অন্তর অধিকাংশ সময়ে দ্বিমুখী আচরন করেছে। জীবন চলার প্রতিপদে অদৃশ্য এক শক্তির উপস্থিতি অনুভুতিতে ছিল ঠিকই কিন্তু অনুভবে তেমন আসেনি। অনুভূতি তাড়িত কাজগুলো অনেকটা আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজালে আটকে থাকে। অনেকটা অংকের হিসেবের মত, ছোট কালে নামতা পড়ার মত। কিন্তু অনুভব মানুষের মধ্যে এক ধরণের দায়বদ্ধতার জন্ম দেয়। আনুষ্ঠানিকতার বেড়াজাল ছিন্ন করে আত্ম থেকে বেরিয়ে আত্মার সন্তোষটিতে কিছু করার তাড়না অনুভূত হয়।
ফুল ফোটানোর মধ্যেই আনন্দ। যেখানে আমিত্বটা একেবারেই গৌণ ফুল ফোটাটাই মুখ্য।
জীবনের এ পর্যায়ে কবিরের আজন্মলালিত সে অনুভূতিটা তার গন্ডি পেরিয়ে অনুভবের রাজ্যে প্রবেশ করেছে। মগজ আর অন্তর একাকার হয়ে অভিন্ন উদ্দেশ্যে ধাবিত হওয়ার প্রকৃষ্ট সময় এটা। এটাই বোধহয় বার্ধক্যের শিক্ষা।
জীবন তাকে চড়াই উতরায় পার হয়ে চুড়া পর্যন্ত উঠতে দেয়ার যে সৌভাগ্য দান করেছে তার জন্য এখন কৃতজ্ঞতার অশ্রুজলে তার চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।
সে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দেয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে এ পৃথিবী থেকে তার তিরোধানের সাথে সাথে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার অভিজ্ঞতালন্ধ জ্ঞান আর অনুভবকে নষ্ট হতে না দিয়ে তা পাহাড়ে আরোহণরত বিভিন্ন স্তরের মানুষদের মধ্যে বিতরন করা। যাতে অনন্যারা তার সাফল্য থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে আর বিফলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তাদের অনাগত জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে পারে।
জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সময়ের কাছে হার মেনে জীবনের মূল প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে পথের শেষ অংশটুকু অতীব অর্থবহ করে পরিসমাপ্তি করার মানসে শুধুমাত্র চুড়ার চিন্তায় নিমগ্ন থেকে সময়টুকু কাটিয়ে দিলে দীর্ঘ জীবন চলা তাকে যে সুখ দুঃখ, সাফল্য ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা দান করল তা সব বিফলে যাবে।
জীবনের অন্তিম শয্যা গ্রহন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আর সে সময়টা আগে থেকে জানা অসম্ভব। সেটা অবধারিত আর নির্ধারিত সময়েই ঘটবে। জীবনটা ছিল যেন কেবল নেয়ার প্রতিযোগিতা, যার কোন অন্ত নেই কিন্তু জীবনের এ সময়টাই নেয়ার চাহিদা শূন্যের কোঠাই পৌঁছে যায়।
বার্ধক্যে পৌঁছানো মানুষ অভিজ্ঞতায় ভরপুর। ইন্দ্রিয়ের চাহিদা কমে যায় তাই নেয়া নয় দেয়াতে আনন্দ পায় বেশী করে। প্রকৃতপক্ষে দানের এটাই সময়।
কবিরের মন ভরা দেয়ার স্বাদ আর তাড়না তাকে ক্ষুধার্ত করে তুলেছে। অন্য দিকে জীবনের বিভিন্ন স্তরে অগ্রসরমান অসংখ্য মানুষ নেয়ার জন্য ক্ষুধার্ত হয়ে আছে। তাদের যা প্রয়োজন তার প্রাচুর্যতায় কবিরের ভাণ্ডার উপচে পড়ছে।
কিন্তু কি করবে সে কোথা থেকে শুরু করবে! তার কষ্টার্জিত অভিজ্ঞতাগুলো এমনিতেই শেষ হয়ে যাওয়ার আগে সে ভান্ডার যাদের প্রয়োজন সে সব মানুষের কাছে কি ভাবে পৌঁছাবে সে সব! জীবনের মোহনায় দাঁড়িয়ে সে চিন্তাই বিভোর কবির।
মানুষের চিন্তা শুধুমাত্র শক্তিশালী নয় সবচেয়ে শক্তিশালী বস্তু এ বিশ্বচরাচরে। কবিরের গগনবিদারী চিন্তাশক্তির ঢেউ একদিকে যেমন জ্ঞান তৃষ্ণায় হাবুডুবু খাওয়া মানুষকে আকর্ষণ করবে তেমনি যারা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে লন্ধ অভিজ্ঞতা বিতরনের জন্য তৃষ্ণার্থ এ দুধরণের মানুষদের চিন্তা সরোবরে ঢেউ তুলবেই।
শুধু পানি নয় পানীয় অনেক জিনিস দিয়েও তৃষ্ণা নিবারণ করা যায়। তবে সাধারণ পানির পরিপূরক অন্যান্য সামগ্রির প্রাপ্তিতা সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে। সমাজে পিপাসার্ত মানুষের অভাব নেই।
সঞ্চিত কোন সম্পদের সার্থকতা আসে কেবল তা অন্যকে বিলানোর মাধ্যমে। কষ্টার্জিত যে কোন সম্পদ ভোগ করার মধ্যে যে আনন্দ তার থেকে বেশী আনন্দ সে সম্পদ দান করার মধ্যে।
সারা জীবন ধরে কষ্টার্জিত সম্পদ যদি গুদাম ঘরে পচে নষ্ট হয় তবে তার যন্ত্রণা কেবল উপার্জনকারীই বুঝতে পারে।
জীবনের প্রান্তে এসে অসংখ্য মানুষ তাদের অর্জিত জ্ঞান দান করার জন্য ভিতরে ভিতরে গুমরে মরে। অন্য দিকে গ্রামে গঞ্জে জ্ঞানের আলো বিবর্জিত জ্ঞান বুবুক্ষ মানুষ জ্ঞানালোকের একটু ছিটে ফোঁটা পাওয়ার জন্য তাকিয়ে থাকে। এ দুটি শ্রেণীর মধ্যে সমন্বয় ঘটানোটাই মুল চ্যালেঞ্জ।
কবির জীবন সায়াহ্নের এ সময়টুকুকে জীবন পরিক্রমার সব থেকে মূল্যবান বিবেচনা করে মেঘে ঢাকা অজানা চুড়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অর্জিত অভিজ্ঞতাকে সবার সাথে ভাগ করে নেয়ার মনস্ত করল।