Heading
আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:২৮
সারাটা জীবন নীলিমা চৌধুরী নিজেকে নিয়ে আর নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। বিবাহিত জীবনের প্রথম কয়েকটা বছর রাজধানীতে পোষ্টিং থাকায় স্বামীর সাথে চৌধুরী কুজ্ঞে একত্রে কাটানো ছাড়া বাকি জীবনটা একাকীই কেটেছে তার।
সে দিনগুলোতেও প্রকৃতপক্ষে তিনি এবং তার স্বামী নিজ নিজ ভুবনেই বিচরণ করতেন। তারপর, বাইরে পোষ্টিং হওয়ার পর থেকেই ওদের আলাদা জীবন। একদম শেষের দিকে আবার যখন পোষ্টিং নিয়ে রাজধানীতে আসলেন ততোদিনে সামাজিক একটা সম্পর্ক টিকে থাকলেও দুজনে দুটো পৃথক জগতের বাসিন্দায় পরিণত হয়েছিল ওরা।
চাকরীটা শেষ হলো, সব ব্যস্ততার অবসান হলো। ঠিক তখনই আমির চিরবিদায় নিল।
জীবন চলাটা একটা ধাক্কা খেল নীলিমা চৌধুরীর। জীবন যেন থেমে যেতে চায়লো।
জীবিত থাকতে যে মানুষটার প্রয়োজন তেমন ভাবে কখনোই অনুভূত হয়নি। তার মৃত্যুতে মনে হতে লাগলো যে পায়ের নিচের মাটি যেন একটু একটু করে আগলা হয়ে যাচ্ছে। আমির ছাড়া চৌধুরী লজটা একেবারে শূণ্য মনে হতে লাগলো।
জীবিত অবস্থায় যে মানুষটির কোন প্রয়োজন বোধ হয়নি, মরণের পর ওর কাছাকাছি আসার জন্য মনটা আনচান করে নীলিমা চৌধুরীর।
তাইতো এতদিনকার জীবনের পাতাটা উল্টে নতুন করে চৌধুরী এষ্টেটে জীবন শুরূ করার জন্য এখানে ছুটে এসেছেন নীলিমা চৌধুরী। নতুন করে শুরূ হওয়া অধ্যায়টাকে আকড়িয়েই জীবনের বাকিটুকু কাটিয়ে দেবে বলে সব কিছু ত্যাগ করে নীলিমা চৌধুরী এখানে এসেছেন। এখানকার সব মানুষের সাথে সব কর্মকান্ডের সাথে নিজেকে নীবিড় ভাবে জড়িত করতে চায়ছেন।
কিন্তু কি হচ্ছে এসব! কি সব শুনল আজ!
যাদেরকে কেন্দ্র করে চৌধুরী এষ্টেটের সব কর্মকান্ড পরিচালিত হয়, যারা এর চালিকা শক্তি, তারা সবাই যেন নিজেদেরকে জোর করে, কোন কোন সময় অস্বাভাবিক ভাবে নিজেদেরকে এখানকার সব কিছুর ভিতর ডুবিয়ে রাখতে চায়। ওরা সবাই আছে সার্বক্ষনিক, কিন্তু কেন জানি স্বতঃস্ফুর্ততার অভাব। অন্য কোন বাস্তবতা থেকে নিজেকে লুকানোর প্রয়াস যেন।
ডাঃ অনিরূদ্ধ দিনে দিনে রামদয়ালের সাথে নীবিড় ভাবে মেলামেশা করতে করতে আযুর্বেদ চিকিৎসা সম্পর্কে একটা মোটামুটি জ্ঞান অর্জন করেছে। আজকাল অনেক রোগীকেই সে তার অসুদপত্র দেয়ার পাশাপাশি রামদয়ালের সাথে আলোচনা করে আযুর্বেদিক অসুদপত্রও দেয়া শুরূ করেছে। তাতে রোগীরাও স্বচ্ছন্দ বোধ করে আর রোগীর স্বস্তিতে ও নিজেও তৃপ্ত হয়।
আজকাল হাতে কাজ না থাকলে রামদয়ালকে সঙ্গে নিয়ে অথবা একাকী আযুর্বেদ বাগানের ভিতর হাটাহাটি করে অনিরুদ্ধ। বিভিন্ন জাতের গাছগুলো চিনে আর ওগুলো পরিচর্যা করে সময় কাটিয়ে দেয়।
আযুর্বেদ বাগানের প্রতি অনিরুদ্ধর দরদ বাগানটির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। গত কয়েক বছরের অযত্নের ফলে বাগানের যে দুর্দশা হয়েছিল তা থেকে ধীরে ধীরে সুস্থ সবল হয়ে উঠছে বাগানটা। তাছাড়া নতুন করে কিছু কিছু গাছও লাগানো হচ্ছে।
সেবাই বিশ্বাসী অনিরূদ্ধ আজকাল প্রায়ই রামদয়ালকে সাথে নিয়ে দূর গ্রামে রোগীদের দেখতে যায়। এছাড়াও ঐসব দরীদ্র আর নিরক্ষর মানুষদের বিভিন্ন পারিবারিক আর সামাজিক সমস্যা নিরসনের ব্যপারেও অনিরূদ্ধ নিজেকে নীবিড় ভাবে জড়িত করেছে।
গ্রামের মানুষদের সাথে মিসতে আর গ্রামের পথে হাটতে হাটতে অনিরূদ্ধর কথা বলার ভঙ্গিমায়ও যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি পরিবর্তন এসেছে ওর পোশাক পরিচ্ছদে। সে হয়ে উঠেছে ওদেরই একজন।
জীবনের বেশীর ভাগ সময় বিদেশে কাটিয়ে বইয়ের বাংলা আর উন্নত বিশ্বের পোশাক পরা শিখলেও অনিরূদ্ধ আজকাল আঞ্চলিক ভাষায় যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলে তেমনি প্যন্টের উপর একটা হাউয়াই সার্ট আর পায়ে চটি বা পাজামা পাঞ্জাবী পরে গ্রামের মানুষদের সাথে স্বচ্ছন্দ বোধ করে।
ওর দিন শুরূ আর শেষ হয় গ্রামের মানুষের প্রয়োজনের সাথে তাল মিলিয়ে। আগের মত দিন গুনে আর ঘড়ি ধরে নয়।
অনিরুদ্ধর এ ব্যপারগুলো লাবনীর একদম অপছন্দের। সে এটাকে একটু বাড়াবাড়ি মনঃে করে।
অনিরূদ্ধকে আজকাল সকালে নাস্তার টেবিলে পাওয়া যায় না বললেই চলে। ওর অনুপস্থিতিটা যেন অন্য কারো নজরেও পড়ে না।
কিছুটা অস্বস্থিতে পড়ে সেদিন ডাঃ লাবনী নিজেই প্রসঙ্গটা উঠালো।
-অনিরূদ্ধ ওর কাজ নিয়ে খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অনেক রাত করে ফিরতে হয় ওকে। রোগীদের ডাকেই সকালে ঘুম ভাঙে ওর। তায়তো আমিই বলেছি নাস্তার টেবিলে না আসতে।
লাবনীর মন্তব্যের জবাবে বললো অমর।
অর্থাৎ ওর সব ব্যপারই অমর জানে। ভাবলো লাবনী।
কথা বলতে বলতে অনিরূদ্ধর প্রতি যেন একটা গভীর কৃতজ্ঞতাবোধ অমরের চোখে মুখে ফুটে উঠলো।
-চৌধুরী এষ্টেটের প্রেমে পড়েছে ও, বুঝলেন ডাঃ লাবনী।
খাবারের একটা প্লেট লাবনীর দিকে এগিয়ে দিতে দিতে স্মিত হাসলো অমর।
নীলিমা চৌধুরী প্রবেশ করলেন।
ওদের ওভাবে একান্তে কথা বলতে দেখে মনে হলো খুশী হলেন।
-লাবনীর বাবার কাছ থেকে গত কালই একটা চিঠি পেয়েছি। তিনি অচিরেই আসবেন বলে লিখেছেন।
নীলিমা চৌধুরীর কথায় দুজনেই তাকালো তার দিকে।
-তোমার বাবা একটু চিন্তায় থাকেন বোঝা যায়। আর থাকবেন না কেন, বয়স হয়েছে। আমি নিজেওতো বুঝি যে, শেষ বয়সে সব বাবা মা’ই চায় সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত আর সংসারী দেখে যেতে।
একটু থামলেন নীলিমা চৌধুরী। মনে হলো আরো কথা বলার আগে আবার গুছিয়ে নিলেন নিজেকে কিছুটা।
-তোমরা দুজনেই জীবনের পথে অনেকখানি এগিয়েছ যে যার মত। তোমাদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে, পছন্দ অপছন্দ আছে, থাকাও দরকার, স্বপ্ন না দেখলে মানুষতো যড় পদার্থে পরিণত হবে। কিন্তু সে সব কিছুকেই বাস্তবতার নিরীখে বিচার করে দরকার হলে এ্যাডজাস্ট করতে হবে, জীবন চালানোর জন্য, জীবনকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য। জীবন কিন্তু স্বপ্ন না, বাস্তব। ও নিজ গতীতে নিজ সময়সূচিতে চলে। কেউ দেরী করে ফেললে তাকে ফেলেই জীবন এগিয়ে যায়।
অমর আর লাবনী দুজনেই কিছুটা অবাক হয়ে শুনছিল নীলিমা চৌধুরীর কথা।
ওদের দুজনকে খাবার পরিবেশন করে তিনি আর বসলেন না।
-তোমরা খাও, আমার একটা কাজ আছে, আমি একটু পরে খাবো।
অনিরূদ্ধ আপনমনে রোগী দেখছে। বেশ কিছু রোগী লাইনে দাড়িয়ে। আজ সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসেনি অনিরূদ্ধ। ব্রেকফাষ্ট সেরে ওদিক দিয়ে লাবনী নিজ চেম্বারে যাওয়ার সময় একবার ভাবলো যায় অনিরুদ্ধর চেম্বারে।
-চা খেতে আসবো ব্রেকের সময়।
ওর রূমে উকি দিয়ে ওকে ব্যস্ত দেখে দরজার সামনে দাড়িয়ে কথাগুলো বলে দাড়ালো না ডাঃ লাবনী।
লাবনী ঠিক দশটার সময় উঠলো চা খেতে খেতে অনিরূদ্ধর চেম্বারে বসে কথা বলবে মনে করে।
রোগীর লাইন শেষ, অনিরূদ্ধ রূমে নেই!
ডাঃ লাবনীকে দেখে কম্পাউন্ডার করিম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসলো। দাত বের করে হাসতে হাসতে ডাঃ লাবনীকে ভিতরে বসতে অনুরোধ জানালো।
লাবনী ভিতরে বসলো। অনিরূদ্ধ আশে পাশেই আছে এখনি আসবে ভেবে একটা পত্রিকা হাতে তুলে নিল।
করিম পাশেই দাড়িয়ে। মাঝে মাঝে কেসে গলাটা পরিষ্কার করে নিচ্ছে। ও হয়তো কিছু বলবে ভাবলো লাবনী।
-কিছু বলবে করিম?
কথাটা বলে লাবনী তাকালো ওর দিকে।
ওর চাহনী আর হাবভাব ভালো লাগলো না লাবনীর।
-আপা, আপনি একা একা থাকেন তায় বোধহয় মনটা হাফিয়ে ওঠে?
ওর কথাগুলো খুবই অপ্রাসঙ্গিক আর কদর্য মনে হলো লাবনীর। একটু শংকিত হলেও অবাক হলো তার থেকে বেশী।
করিম কখনোই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না আর সবসময় ওকে ম্যাডাম বলেই সন্মোধন করে। লাবনীর ব্যক্তিত্বের এমন কি দুর্বলতা ও লক্ষ্য করলো যার প্রেক্ষিতে ওর মনে এমন একটা কদর্য ধারণা জন্মাতে সহায়ক হলো।
প্রায় প্রতিদিন চা বিরতির সময় ডাঃ লাবনী এখানে আসে। সব সময় অনিরুদ্ধর এখানে আসার ব্যপারটা অবশ্ব্য ওর ব্যক্তিত্বে বেধেছে। কয়েকবার মনেও করেছে এভাবে একতরফা ভাবে আসবে না ও। অনিরূদ্ধকে বলেছেও যে অনিরূদ্ধ মাঝে মাঝে ওর ওখানে না গেলে সে আর আসবে না। কিন্তু ফল হয়নি তাতে।
একবার সত্যি সত্যিই রাগ করে অনিরূদ্ধর চেম্বারে আসা বন্দ করলো লাবনী। কিন্তু কোন ফল হলো না। অনন্যপায় হয়ে কয়েকদিন পর যখন গেল ওর ওখানে, ভেবেছিল নিশ্চয় ওর অভিমানটা বুঝবে অনিরূদ্ধ। কিন্তু এই কয়দিনেই অনিরূদ্ধ ওর রূটিন পরিবর্তন করে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে রামদয়ালের সাথে ওর আযুর্বেদ বাগানে হাটাহাটি করে ওই সময়টুকু কাটানোর অভ্যাস রপ্ত করে ফেলছে।
লাবনী জানে অনিরূদ্ধর সাথে এ ধরণের অভিমান সব সময় উল্টো ফল বয়ে আনে।
এ ধরণের ব্যপারগুলো ব্যস্ত অনিরূদ্ধ বোধহয় খেয়ালই করে না। আর কে কি ভাললো তা মরিয়া হওয়া ডাঃ লাবনীর চোখও এড়িয়ে যায়।
কিন্তু করিমের চোখে বিষয়টা বেশ প্রকট হয়ে ধরা দেয়াই বিষয়টা নিয়ে ও নিজের মত করে অনেক ভাবনা চিন্তা করল।
-ডাঃ অনিরূদ্ধ কোথায়?
একটু কর্কশ কণ্ঠ লাবনীর।
-তিনি চা হাতে আযুর্বেদ বাগানে।
অবাক হলো লাবনী। কিছুটা রাগও হলো মনে মনে।
-আমি এসেছি তা কি জানে সে?
-আপনি আসবেন তাতো আপনিই নিজেই ওনাকে বলেছেন।
হাসছে করিম।
করিমের ঐ ঈঙ্গিতপূর্ণ হাসিটা অসহ্য লাগলো লাবনীর। অপমানে ও যেন মরিয়া হয়ে উঠলো।
-ঠিক আছে আমি যাচ্ছি ওখানে। তুমি এখানে হা করে দাড়িয়ে না থেকে আমার চা’টা ওখানে নিয়ে আস।
লাবনীর কণ্ঠে যেন ধমকের সূর। ও জানে করিমকে এভাবে ধমক দেয়ার কোন অধিকার ওর নেই। আর কাউকে ধমক দিতে অভ্যস্ত নয় ও। তবুও করিমের উপর অধৌর্য্য হয়েই ধমকটা দিল।