জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অমৃতের সন্ধানে' পর্ব -২০।

আপডেট: ১৪ অগাস্ট ২০২২, ১৫:৩৮

অমৃতের সন্ধানে -২০ 

 

চারিদিকে কেবল শূণ্যতা। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত ঝাপটা বাতাস ওর নড়বড়ে ছাপড়া দোকানের সাথে ধাক্কা খেয়ে একটা করূন আওয়াজ করছে।
দোকানী ওর জীর্ণ ঘরের চারধারের ঘুণে খাওয়া সহস্র ফুটো ভরা বেড়ার দিকে তাকিয়ে বুকের হাড্ডি গুলোর উপর হাত বুলাতে বুলাতে বললো- এগুলো সময় অসময়ে কত কষ্ট দেয় তবুতো এর মায়াতেই পড়ে আছি।
-এ মায়া এড়ানো যায় না, সম্ভব না। মায়ার মধ্যিইতো বসবাস। এরে এড়ানোর চেষ্টাতো সুপুরূষের মানায় না। অত বেশী চিন্তা করে কি লাভ, কুল কিনারা পাবেন না। পথ হারায় ফেলবেন। যিনি মায়া দেছেন তিনিই এর ব্যবস্থা করবেন। এ নিয়ে চিন্তা করে কিনার করা যাবে না।
আপাতত ফেরী পাওয়ার সম্ভাবনা যেহেতু নেই বললেই চলে, তাই মানিক ভাবল আশে পাশে কোথাও রাত্রি যাপন করে কাল আবার আসবে।
ভাবল দোকানীকে জিজ্ঞেস করে - কাল কখন আসবো?
মানিক কিছু বলার আগেই দোকানী আবার বললো- সেটা পরে দেখা যাবে, এখন রাত্রিরে কোতায় থাকপেন সেইটা ভাবেন, পরেরটা পরে হবে। রাত্রিরে এইখানে খুব ঠান্ডা হয়ে যায় একদম হিমের মতন তা আপনারা সহ্য করতি পারবেন না।
-আমরাতো সব স্প্রিং এর পুতুল। চলেছি ঐ স্প্রিং এর জোরে। ওটার পাক না ফুরোনো পর্যন্ত ঘানি টানে যাতিই হবে। নিজির পিলান মত কিচ্ছু চলে না স্যার, চালায় নিয়তি।
বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো দোকানী।
-হায়রে অবুঝ মানষির মন।
বিনা বাক্যে মানিক দোকানীর কথা শুনতে লাগলো।
-যিডা কপালে মেলে না সিডার স্বপ্ন দেখে অবুঝ মনডারে বুঝায় রাখতি হয়। বিধির লিখন খন্ডানো যায় না। যারা কুল কিনারা খুজে পাচ্ছেনা স্বপ্ন দেখে তার একটা বিহিত কল্লিইতো মনে শান্তি আসে যাবে।
একটু থামল দোকানী, কি যেন একটা ভাবল।
-শুনেছি একেন থেকে আট দশ মাইল দুরি একজন আপামনি নাকি অজপাড়াগায়ে একটা হাসপাতাল খুলেছে। দূর দুরান্তের কত রূগি রাত্রিরে থেকে যায় সেখানে। থাকার ব্যবস্তা নাকি ভালো। দেখেন সেখানে যায়ে, নিয়তি কি করে। রূগিতো আমরা সবাই তায় না স্যার। ওটা ছাড়া রাত কাটানোর মত এ মুল্লুকি আর কিচ্ছু নেই।
-কত মানুষ কত কতা কয়। কেউ কয় খেয়াল আবার কেউ কয় পাগলামী। কিন্তু অমি কই মায়া। মায়ার বাধনে বাদা পড়েছে সবাই। ওই আপামনির অছিলাই এই গো গিরামের অনেক মানুষ মরার হাত থেকে রেহায় পাচ্ছে। সবাই নাকি তিনাকে মা বলে ডাকে।
ছোট করে একটা শ্বাস নিল দোকানী।
-তিনি এ গায়ের না, ভীন গা থেকে আসা। নিয়তিই টানে আনেছে। ভাবছি একবার যাব। না কোন কাজে না, একটু চোকির দেখা।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখে নিল দোকানী।
-বেলা থাকতি থাকতি সেকানে চলে যান। কি চায়লেন আর কি হচ্ছে! মায়া বোজলেন সব কেবল মায়া। যা একটু বাকি আছে তা কাটায় আসতি হবে। নিয়তির এ টান এড়াবেন কি করে!
একটু থেমে দোকানী আবার কিছু একটা বলতে চায়লো।
তখনই মানিকের সহযাত্রিরা কথা বলতে বলতে ফিরে এলো। ওদের কথার শব্দে আর উপস্থিতিতে দোকানী আর কিছুই বললো না। এক দম চুপ হয়ে গেল।
মানিকের মত ওর সঙ্গি সাথীরাও ক্লান্ত।
সব ভিন্নতার প্রতি অনীহা ওদের। পরিকল্পনা মত কিছু না হলে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। সবাই ওরা অমৃতের সন্ধানী কিন্তু মায়াটা বোধহয় পুরোপুরি কাটাতে পারছে না।

-একটু চা খেলে ভালো লাগতো। মানিকের সহযাত্রি একজন বললো।
-এখানে আবার চা, কি যে বল! ওদের একজনের মন্তব্যে সবাই গাড়ীর দিকে পা বাড়ালো।
পাশের মাকড়াসার জালের মত চায়ের দোকানটা বোধহয় ওদের কারো চোখে পড়লো না।
কয়েকটি প্রাণী ওরা, অমৃতের সন্ধানী। কিন্তু শারিরীক প্রয়োজনের কাছে এখনো বাধা। এ যেন শেকড়ের টান মাটির সাথে।
সবাই গাড়ীতে উঠে বসলো। রাতে আশ্রয় নেয়ার ব্যপারটা ব্যখ্যা করে গাড়ী ষ্টার্ট দিয়ে রওয়ানা দিল রাত্রি যাপনের গন্তব্যে।
-সারাটা জীবন শুধু ছুটলাম, যা দেখা যায়, শোন যায় তার সব কিছু পেয়ে নিজেকে তৃপ্ত করবো বলে। কিন্তু সেসব যেন মরিচিকা। তাকে দেখা যায় দূরে দূরে, মনে মনে কল্পনা করা যায় কিন্তু সব থাকে ধরা ছোয়ার বাইরে। ভাবল মানিক।
মানিক গতিতে বিশ্বাসী, কর্মচাঞ্চল্যে বিশ্বাসী। স্থবিরতা ওর কাছে মৃত্যুর সমান। স্থবির বা কর্মচাঞ্চল্যহীন অলস সময়গুলোতে ওর বুকের ভিতর জমে থাকা কান্না গুলো গুমরে উঠে বেরিয়ে আসতে চায়।
ওর বুকের জমে থাকা বোবা কান্নার শব্দটা আর তার অর্থ বোঝার চেষ্টা অনেক করেছে মানিক। কে কাঁদে,কেন কাঁদে!
কাঁন্নাটাকে ও ওর বঞ্চিত মনের বিলাপ মনে হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেছে মনটাকে বোঝাতে। আশে পাশের শত বঞ্চিতের কথা ভেবে মনটাকে বুঝ দেয়ার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু না কান্নটা ওর মনের না বা পাওয়া না পাওয়ার কোন কারণে নয়। এ কান্না ওর ভেতরের আত্মার কান্না। আত্মার অতৃপ্ততার কান্না। ও কি যেন চায়! অন্য রকম একটা কিছু, যা বোঝা বড় কঠিন।
মনের দোড় আত্মার সীমানাই পৌঁছানোর আগেই থেমে যায়। মন থেমে যেয়ে চোখ বন্দ করার পরেই আত্মা তার দরজা খোলে। কিন্তু মনকে ঘুম পাড়ানো সে যে শক্ত কাজ।
মন হচ্ছে বাচ্চা ছেলের মত খেলতে ব্যস্ত, চারপাশে যা কিছু দেখা যাই, ছোঁয়া যাই, ঘ্রান নেয়া যাই বা অনুভব করা যাই তার সব কিছুই পেতে চাই অবুঝ মন। শরীর ক্লান্ত হয়ে চোখ দুটো যখন বন্দ হয়ে আসেতে চায় তখন কান্না কাটি জুড়ে দেই। যেন চোখ বন্দ করলেই সব চাওয়া পাওয়া শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লেই কেবল দেহ মনে প্রশান্তি আসে। মনের চোখ বন্দ হয়ে অমরাত্মার চোখ খুলে যাই। যেখানে হারানোর কোন ভয় নেই, প্রাপ্তির কোন শেষ নেই। এর ফাঁকে ফাঁকে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন এসে অবুঝ মন তা দেখিয়ে ওকে অযথা কাদাই হাসাই।
আহ ঘুমের মাঝে যদি মনের অযথা আনাগোনা বন্দ হয়ে আন্তরাত্মা স্থায়ী আসন গাড়তে পারতো তাহলেই সব জ্বালা যন্ত্রণা চাওয়া পাওয়া শেষ হত!
বেলা গড়িয়ে পড়েছে। মাঠের বুক চেরা লতা পাতায় ভরা আঁকা বাঁকা সরূ রাস্তা ধরে আমরা চলেছি কয়েকজন, অজানা গন্তব্যে আশ্রয়ের খোজে। শারিরীক প্রয়োজনে।
প্রয়োজনটা সব সময় বোধহয় মানুষের সব চাওয়ার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
একজন মানুষ শুধু দেহ নয়। দেহ মন আত্মা এ সব গুলো সত্তা নিয়েই মানুষ।
এ সত্তা গুলোর চাহিদা সব সময় পরিপুরক নয়, পরস্পর বিরোধীও বটে। তায় সবারটা মিলিয়ে অভিন্ন একটা চাহিদা বের করা অসম্ভব।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে বোধহয় তাৎক্ষনিক চাহিদাটায় অতি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সব স্বাভাবিক জীবনই ঐ তাৎক্ষনিক প্রয়োজন মেটাতেই এগিয়ে চলে। প্রয়োজন মেটাতে কৃতকর্মগুলো অন্যান্য সত্তার সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে অনেক সময় অন্তরায় হয়ে দাড়ায়।
বিচিত্র মানুষের জীবন। এতগুলো পরস্পর বিরোধী প্রয়োজন মেটাতে কত কিছুই না করতে হয়। কৃতকর্মের কোন ভূল চোখে পড়লে তা শুধরানোর আগেই জীবনের সমাপ্তির ঘন্টা বাজতে শুরু করে। সব জীবনেরই বোধহয় এটা একটা দুর্বলতম দিক।
সুর্য্যটা হেলে পড়েছে ক্লান্ত হয়ে। রাস্তার গা ঘেসে দাড়ানো গাছের ডালের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিয়ে দিয়ে হেলা পড়া দিনমনি হারিয়ে যাচ্ছে বারবার। বিদায়ের পূর্বে যেন সব কিছু মিলিয়ে নিতে চাচ্ছে।
মনে হচ্ছে কি একটা যেন বলতে চায়!
কিন্তু চলার গতি যেন থামতে নেই। সেত গন্তব্যের সন্ধানে ছুটছে। ওর যেন থামতে মানা, অন্য কিছু শুনতে মানা।

কেউ শরীর আবার কেউ মনের তাড়ায় গন্তব্যের দিকে ছুটছে সবাই
পরে যে কি হবে তা সবারই অজ্ঞ্যত।
যা কিছু এখানে পাবে পেলেই তা শেষ হয়ে যাবে
অন্তরাত্মা রবে ক্রন্ধনরত।

মনে হচ্ছে যেন একটা স্বপ্নীল পরিবেশ। স্বপ্নের রথে চড়ে ওরা চলেছে। শেষ ফেরী পার হওয়ার আগে বাকি থাকা কিছু স্বপ্নের শেষটা মিলাতে।