জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১৭।

আপডেট: ১৫ জানুয়ারী ২০২৩, ১০:০৭

অম্বরাবনী-১৭ 

 

কেসে গলাটা পরিষ্কার করে নিল ডালবেহারা। বুঝলাম মাঝে মাঝে আবেগের অতিসহ্য ওর কন্ঠনালীকে বাধাগ্রস্থ করছে।
-আমাদের সাথে ওদের পার্থক্য শুধু রঙ্গ মঞ্চের। পরিচালকের দেয়া রাজ পোশাকে রঙ্গমঞ্চের উপর নির্মিত সিংহাসনে বসে থাকা রাজা, নাটকের রাজকার্য্য নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকে। জীবনের কথা ওরা বলে না। ওরা তখন নিজের থাকে না, হয়ে যায় পরিচালকের নাটকের রাজা।
-এমনি সময়ে ওরা সারাক্ষন কেবল পরিচালকের দেয়া রাজপোশাকে রাজমুকুট পরা অবস্থায় কাহিনীর রাজ্য নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। এ সময়ে কেউ ওদেরকে আসল জীবনের কথা বলতে এলে ওরা তাদেরকে সাধারণ রক্তমাংসের মানুষ না ভেবে নাটকের একটা চরিত্র ধরে নিয়ে পরিচালকের শেখানো ডায়লগে কথা বলে। অংকের সোজা হিসেবে কাউকে ফাসিতে চড়াতেও দ্বিধাবোধ করে না। নিয়মের দোহায় দিয়ে নৈতিকতাকে গলা টিপে হত্যা করে।
-অংকের নিয়মে, শুধু বুদ্ধি দিয়েই সব বিচার করে। বিবেক, মন এগুলো কাহিনীকারের কাহিনীতে থাকে না বলে ওদের কাছে সেগুলো মুল্যহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু তাই বলে সত্যিকারের ওরা বিবেকহীন বা হৃদয়হীন নয়। যদি কোন কারণে রাজপোশাক আর মুকুটটা খুলতে হয় কেবল তখন ওরা ওদের নিজেকে খুঁজে পায়।

আনমনে কথাগুলো বলছিল ডালবেহারা। আল্টানটিকের ভেঙ্গে পড়া ঢেউয়ের গর্জনে সে কিছুটা চমকে উঠে নড়েচড়ে বসল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরা একটা নিশ্বাস টানলো।
-এই আমি, ভারতের পশ্চাদপদ উড়িষ্যা রাজ্যের অজ পাড়াগায়ের প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকের দরীদ্র পরিবারের সাত সন্তানের একজন। বাবা কখনো কখনো স্কুল থেকে একটা পেন্সিল বা কয়েকটা সাদা কাগজ লুকিয়ে নিয়ে এসে আমাদের পড়ার সরঞ্জাম জুগিয়েছেন। মা হয়তো না বলে জমিদাদের ঝিল থেকে শাপলা তুলে এনে সংসারের খরচ বাচিয়েছেন।
-জানিনা, বাবা মায়ের ঐ পাপের শাস্তি কি হবে! মেধার জোরে আর বিশ্বপরিচালকের নেকনজরের বদৌলতে আজ আমি এখানে। বাকিরা ওখানেই পড়ে আছে। ওরা মা বাবার কথা স্মরণ করে জল ছল ছল চোখে তুলসি তলায় সকাল সাঁঝে পুজো করে। একে অপরের সুখ দঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। একজনের বাড়ীতে কালে ভদ্রে ভালো রান্না হলে আরেক জনের বাড়ীতে পাঠায়। একজনের রোগ শোক হলে টাকা সাহায্য দিয়ে ডাক্তার দেখাতে না পারলেও চিৎকার করে বুক খালি করে ওরা একে অপরের জন্য কাঁদে।
-কিন্তু আমি! একটা দীর্ষ নিশ্বাস ফেললো ডালবেহারা।
-প্রথম যখন চাকরীতে যোগ দিয়ে বিদেশ পাড়ি দিলাম তখন সত্যিই আমি স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। মাসের পর মাস বাবাকে চিঠি লেখার সময় পেতাম না। কত ব্যস্ততা তখন। বাবা চিঠি লিখে অভিযোগ করতো। প্রায় বছর দুই পর প্রথম যখন ছুটি নিয়ে বাড়ী ফিরলাম বাবা আর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কত কান্নাকাটি করলো। চিঠি না লেখার জবাবে বাবাকে বলেছিলাম চিঠি না লেখা মানে বুঝতে হবে আমি ভাল আছি।
-আমার জবাব শুনে বাবা বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। বাবার সে করূন চাহনিটার ভাষা তখন বুঝিনি। কিন্তু অনেক পরে এখন সেই চাহনিটা আমার বুকের মধ্যে খচ খচ করে ক্ষত করে।
-মা জিজ্ঞেস করেছিলো তোর বড় বড় কাজ আছে জানি তবু তার মধ্যে কি আমাদের কথা একটুও মনে পড়ে না?
কথা বলতে বলতে ডালবেহারা আমার একটা হাত ওর হাতের মধ্যে নিয়ে চেপে ধরলো।
-জানো অবনী, সত্যি কথা বলতে কি, সে সময় পাশ্চাত্যের এসব চাকচিক্য আমাকে নেশাগ্রস্থ করে ফেলেছিলো। আসলেই আমি স্বার্থপর হীনমনা, সেদিন মাকে সত্যি কথাটা না বলতে পারলেও আজ তোমাকে বলছি ওদের কথা আমার তখন একদম মনে পড়তো না। তখন আমি শুধু বর্তমানের উপর নির্ভর করে নিজের উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলাম। আমার দৃষ্টি ছিল কেবল সামনের দিকে।
আমার মনে হলো ডালবেহারা ওর ভিতর জমে থাকা অপরাধ বোধটা কিছুটা অবান্তর স্বীকারোক্তির মাধ্যমে হালকা করতে চায়ছে।
-ফিরবার সব রাস্তা যেহেতু এক এক করে নিজ হাতেই বন্দ করেছি তাই সব কিছু মেনে নিয়ে এখানে একটু ভালো ভাবে মরতে পারার আশা নিয়েই বুক বেধে ছিলাম।
-ঘোরটা আমার পুরোপুরি কাটলো নিউইয়র্কের রাস্তায় যেদিন বর্ণবৈষম্যে বিশ্বাসী একদল এদেশীয় যুবক এশিয়ান বলে আমাকে আক্রমন করলো।
-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছুদিন যাবত এধরনের ঘটনা ঘটছিলো নিউ ইয়র্কের রাস্তা ঘাটে। কিন্তু ওই যে তোমাকে বললাম আমি তখনো ঘোরের মধ্যে ছিলাম। খবরের কাগজে এ ধরণের খবর চোখে পড়লেও তা আমার মনকে একদম দোলা দেয়নি। কারণ প্রতিদিন সকালে আমি আয়নাতে নিজেকে নাটকের সাজানো রাজা ভেবেই পথ চলতাম।
-কিন্তু আমার সে ঘোর ওরা ভেঙ্গে দিল। কত কিছু বলে যেমন, জীবনের বেশীটা সময় এখানে কাটিয়েছি, ভারত আমি চিনি না ইত্যাদি কত কিছু বললাম কত মিনতি করলাম ওই যুবকগুলোর কাছে।
আমার হাতটা স্বস্নেহে টেনে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ডালবেহারা বললো।
-জান অবনী সে রাতে ওদেরকে যে কথাগুলো বলেছিলাম তার এক বর্ণও মিথ্যা না। কিন্তু চামড়াটাতো ঢাকতে পারিনি। বিধাতার দেয়া চামড়ার রংটা অস্বীকার করে আমার ভিতরটা পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা কি হয়!
-উপায়ন্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত মানি ব্যাগ থেকে আমার এদেশীয় স্ত্রীর একটা ছবি বের করে ওদেরকে দেখিয়ে তারপর আমার স্ত্রী ক্রিষ্টিনার টেলিফোনে অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি ছাড়া পেলাম।
-আমার অপরাধ আমি দেখতে এদেশেীয়দের মত না। আমার জাতিসংঘের চাকরীর পরিচয়পত্র, এদেশীয়দের মত করে আমার ইংরেজী বলার ধরণ কোন কিছুই কাজে লাগলো না।
একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললো -প্রতিনিয়ত অফিস আদালত দোকান পাট রাস্তা ঘাটে সবার চোখে চোখে ভীনদেশী হয়ে যারা এখানে বসবাস করে তারা ভীতু কাপুরূষ। সাজানো নাটকের পোশাক পরে অভিনয় করতে করতে ঐ পোশাক থেকে বেরিয়ে বাইরের মুক্ত বাতাসে বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিতে ওরা ভয় পায়। এ অবস্থার মধ্যে জীবন কোনমতে টেনে টুনে হয়তো পার করা যায়। কিন্তু যদি কখনো জাতিগত বৈষম্যের মত বাস্তবতা সামনে আসে তখন সবকিছু একদম শূণ্য হয়ে যায়।
-আমার মত যাদের অনেক দেরী হয়ে গেছে তারা প্রতিদিনের হিসাব করে করে জীবন চালায়। প্রতিদিনের শুরূতে সাজঘরে নাটকের বেশভূশাটা ভাল করে পরীক্ষা করে দিন শুরূ করে।
-সেদিন বাসায় ফিরে অনেক আফসোস করলাম, কাঁদলাম। ঐ প্রথম জীবনটা আমার সামনে থমকে দাড়ালো। নিজেকে নতুন করে দেখার চেষ্টা করলাম।
-আমার জীবন নাটকের মহাপরিচালককে স্মরণ করলাম। তাঁর পরিকল্পনার কাছে নতী স্বীকার করে পিছনে ফিরে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু পিছনটা এত দূরে ফেলে এসেছি যে এই উচ্চতা থেকে সেদিকে তাকাতে মাথাটা ঘুরে উঠলো।
চশমাটা খুলে রূমাল দিয়ে সেটা মুছলো ডালবেহারা। একই সাথে ওর বৃদ্ধ হাড্ডির প্রকোষ্ঠে ঢুকে থাকা চোখ দুটোও মুছে নিল।
তারপর কিছুটা আশ্বস্ত স্বরে বললো - মহাপরিচালকের রাজপোশাকটা খুলে রঙ্গ মঞ্চ থেকে যখন নামলাম তথন দেখি সেখানে আমার পরিচিত কেউ নেই। বুঝলাম কোন উপায় নেই, যে কোন রকমে এ অবস্থায় বাকি সময়টা কাটানো ছাড়া আর কোন বিকল্প আমার নেই।
- ত্রিষ্টিনা আলাদা বাস করে বেশ অনেকদিন থেকেই। তাতে ওর কিছু এসে যায় না। না নিজের না সমাজের কাছে। এটা এখানকার একটা স্বাভাবিক চলন বলা যায়। আর ক্রিষ্টিনা তো এ ধরনের চলনের সাথে আজন্ম অভ্যস্ত।
-আমাদের একটা মেয়ে আছে। আঠারো বছর পার হয়েছে কয়েকদিন হলো। ও লন্ডনে পড়াশোনা করছে। থাকে ওর এক বয়ফ্রেন্ডের সাথে। ওর নাম ক্যরোলিন। দেখতে ইউরোপিয়ানদের মত। ওর দেহে কিছু ইন্ডিয়ান রক্ত মিশেছে বটে তবে ওর রংটাকে খুব একটু খেয়াল না করলে বোঝা যায় না। আর ক্যরোলিনও সেটাকে ঢাকা দিয়েই রাখতে চায়।
-আমার জীবনটা শুধু কম্প্রোমাইজে ভরা। পদে পদে কম্প্রোমাইজ করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিনয়ে আমি একজন পাকা অভিনেতা হয়ে উঠেছি।
-কৃষ্টিনার সথে আমার বন্ধুত্বটা একটা কন্ট্রাক্ট। এভাবেই শুরূটা। গোড়া আগলা হয়ে নিজের সব বাস্তবতাকে ভূলে এদেশে হেসে খেলে জীবনটা কাটানোর স্বপ্ন নিয়েই ক্রিষ্টিনার সাথে আমার কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ হয়। প্রয়োজনটা মিটে গেলেই অর্থাৎ এদেশের নাগরিকত্বটা নিতে পারলে আমাদের কন্ট্রাক্ট শেষ হবে। ক্রিষ্টিনারও নিউইয়র্কে একটা নিরাপদ থাকার জায়গা আর পড়াশোনা চালানোর জন্য কিছুটা খরচেরও দরকার ছিল সেসময়।
একটু থেমে ডালবেহারা আবার বললো -আসলে মানুষের সব সম্পর্কইতো একধরণের কন্ট্রাক্ট। কোন কনট্রাক্টের সময় বেধে দেয়া থাকে আর কোনটার থাকে না। অর্থাৎ কন্ট্রাক্টের ধারাগুলোর পার্থক্য আরকি।
-ক্রিষ্টিনা খুবই ভালো মেয়ে, অন্য যারা টাকার বিনিময়ে কন্ট্রাক্ট করে তাদের মত নয়। আমরা প্রকৃত অর্থে একজন অপরজনকে ভালো বাসতে শুরূ করি। আর তারই ফসল ক্যারোলিন।
-পুতুলের মত, পরীর মত মেয়েটাকে পেয়ে আমরা দুজনেই স্বপ্নের ঘেরে বিভোর থাকতাম। কিন্তু জানো অবনী স্বপ্ন ঠিকই দেখতাম দুজনেই, কিন্তু দুরকম। স্বপ্নটা মনে মনে থাকলে কোন সমস্যা হতো না কিন্তু সেটা যখন বাস্তবে আসতে শুরূ করলো তখন বুঝলাম ক্রিষ্টিন আর আমি একই ছাদের নিচে বাস করলেও বা একই বিছানায় রাত কাটালেও আমরা ভিন্ন মেরূর মানুষ। আমরা ভিন্ন চিন্তার মানুষ।
-আমি ক্যারোলিনকে ডে কেয়ার সেন্টারে পাঠানো বা অত ছোট বয়সে আলাদা খাটে শোয়ানোতে একদম স্বস্তি পেতাম না। ক্রিষ্টিনার সাথে বিয়ের অনেক আগে থেকেই আমি পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে পরিচিত। বাচ্চাদের ডে কেয়ার সেন্টারে রাখা বা ছোট্ট বয়সে আলাদা শোয়ার রীতি আমার অজানা নয়। বরং এ ধরণের ব্যবস্থা যে সময়ের দাবী এবং বিজ্ঞান সন্মত তা নিয়ে ছুটিতে মাঝে মধ্যে যখন দেশে গিয়েছি তখন অনেক আপনজনদেরকে এ ধরনের ব্যপারে পরামর্শ দিয়ে নিজেকে আধুনিকতার একজন ধারক এবং বাহক ভেবে কৃতার্থ হয়েছি।
-কিন্তু যখন নিজের সন্তান হলো তখন আমার সব আধুনিক চিন্তাভাবনা বিষর্জন দিয়ে আমার কাছে আমার মা যেমন ছিল তেমনি ভাবে ক্রিষ্টিনা আর ক্যারোলিনের সম্পর্ক চিন্তা করলাম।