Heading
আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২২, ১৮:২০
প্রত্যন্ত গ্রামের এক সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার হিসেবে নিয়োগ পেল বাবুল।
গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করার ব্যাপারে ওর মধ্যে একটা আবেগ কাজ করে। কারণ ওর ধারনায় দেশের আশি ভাগ মানুষের জীবনের প্রথম সোপান সেখানেই।
মাস্টার্সের রেজাল্ট বেরনোর আগেই চাকরীটা পেল সে। রেজাল্ট বেরনোর পর সিভিল সার্ভিস সিলেকশান পরীক্ষা দিয়ে ভাল কোন চাকরীতে যোগদান ইত্যাদি মিলিয়ে দু এক বছর লেগে যাবে। এ সময়টাতে ছেলের গ্রামে প্রাইমারী স্কুলে জয়েন করার বিষয়ে বাবা আনোয়ার জোয়ারদার যিনি একজন অবসর প্রাপ্ত ব্যাংকার তিনি খুব আপত্তি করলেন।
ওর বড় ভাই এ্যাডমিন ক্যাডারে চাকরী করে আর ছোট বোনটা ব্যাংকে জয়েন করে নতুন চাকরী শুরু করেছে। বাবুল সবার থেকে আলাদা, ছোট বেলা থেকেই ডান পিঠে স্বভাবের। পড়াশোনার সাথে খেলাধুলা আর বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সাথে সব সময় জড়িয়ে থাকে।
ট্রেনে করে প্রায় চার ঘন্টার জার্নি তারপর নৌকা করে ঘন্টা তিনেকের মত পথ পেরিয়ে দরবেশ পুরে পৌছালো বাবুল। নদীই এখানে যাতায়াতের একমাত্র রাস্তা।
নদীর ঘাটের সাথে লাগোয়া ইউনিয়ন বাজার আর সেখানেই দরবেশ পুর সরকারী প্রাইমারী স্কুল। খুব ভোরে রওয়ানা দিয়ে ওখানে পৌছাতে বিকেল চারটা বেজে গেল।
এখানে একজন সূফী দরবেশের মাজার আছে। সবাই বলে তিনি ইংরেজ শাসন আমলে যুবক বয়সে পারস্য থেকে এসেছিলেন। সারা জীবন মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করার কাজে মগ্ন থেকেই মৃত্যু বরন করার পর তিনি এখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের সব মানুষ তাঁর ভক্ত। প্রতি বছর তাঁর মৃত্যু দিবসে দেশের নানা জায়গা থেকে মানুষ এখানে জমায়েত হয় পাচ দিন ব্যপি মেলা আর আলোচনা সভায় অংশ গ্রহন করার জন্য।
সে আমলে সরকার এখানে একটা ডাক বাংলো নির্মাণ করেছিল যাতে দূর দুরান্ত থেকে আসা অতিথিরা রাত্রি যাপন করতে পারে।
সে ডাক বাংলোতেই উঠেছে সরকারী প্রাইমারী স্কুলের মাস্টার বাবুল।
পুরনো ডাক বাংলো, কেউ থাকে না এখানে। মেলা উপলক্ষে বছরের ঐ সময়টাতে সরকারের তরফ থেকে ডাক বাংলোটা ঘষে মেজে রং চং করে পরিপাটী করা হয়। বিদ্যুতের লাইন ঠিক করে ফ্যান, বাতির ব্যাবস্থা করা হয়। তখনই কিছু দিনের জন্য অতিথিরা এখানে থাকেন।
এ অঞ্চলে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। অনুষ্ঠানের সময় বড় বড় জেনারেটর লাগিয়ে দিন রাত বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়। অন্য সময় সন্ধ্যা থেকে কয়েক ঘন্টার জন্য বাজার কমিটি একটা জেনারেটর চালাই। রাত ষাঁড়ে আটটার পর সেটা অফ করে দেয়া হয়। তারই একটা সংযোগ ডাক বাংলোতে দেয়া আছে। কিন্তু ব্যবহারের অভাবে অকেজো হয়ে ছিল। বাবুলের আগমনের কথা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব সেটা ঠিকঠাক করার ব্যবস্থা করেছেন।
ডাক বাংলোর জন্য একজন বৃদ্ধ বয়সের কেয়ারটেকার আছে নাম মেরু মিয়া। বাংলোর সীমানার মধ্যেই তার জন্য দুই রুমের থাকার ঘর, আর সাথেই রান্নাঘর।
বাবুলের আসার খবর পেয়ে চেয়ারম্যান সাহেব ছুটে আসলেন ডাক বাংলোতে। মাহাতাব খান তার নাম, বয়স ষাট ছাড়িয়েছে। তারা এ অঞ্চলের বনেদি বংশ। উচ্চতা ছ ফিটের কাছাকাছি, ছিপছিপে গড়ন, শ্যামলা গায়ের রং, সব সময় হাসি লেগেই থাকে তার মুখে। যাকে বলে প্রকৃতিগত ভাবে সুখী মানুষ। প্রথম দেখাতেই বাবুলের খুব পছন্দ হল তাকে।
-তোমার মত একজন মানুষ আমাদের এই অজ পাড়াগায়ে মাস্টারি করতে এসেছে এটা এ অঞ্চলের মানুষের সাত পুরুষের ভাগ্য। এখানে তোমার থাকতে কষ্ট হবে জানি, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি বাবা, তোমাকে ভাল রাখতে আমাদের প্রচেষ্টার কোন ত্রুটি থাকবে না।
গেল ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠান হয়েছে আর এখন ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি তাই বাংলোটা মোটামুটি ভাল অবস্থাতেই আছে।
কয়েকটা প্ল্যাস্টিকের চেয়ার পেতে চেয়ারম্যান সাহের সহ কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বাংলোর সামনে বসে কথা বলছিলেন। মেরু মিয়া চা বিস্কুট পরিবেশন করল।
-হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে এসে দরবেশ বাবাই এ অন্ধকারাচ্ছন্ন তল্লাটে বাতি জ্বেলেছিলেন। আমার পরদাদা তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন তিনিই এখানে প্রথম বসত গড়েন। বাতিটা এখনো জ্বলছে কিন্তু সে উজ্জ্বলতা যেন আর নেই। তুমি এসেছ দেখ কি হয়।
-আগামী কাল সকাল নয়টাই স্কুলে দেখা হবে। কথাটা জানিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব সন্ধ্যা গড়ানোর আগেই চলে গেলেন।
চেয়ারম্যান সাহেবের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হল বাবুল।
সন্ধ্যা হয়ে এল বাবুল রুমে গেল। ইতিমধ্যেই মেরু মিয়া লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে।
রুমটা বেশ প্রশস্ত। ভিতরে একটা ডাবল বেডের খাট, পাশে কাঠের একটা আলনা, একটা টেবিল একটা চেয়ার। দেয়ালের গা ঘেসে একটা ষ্টীলের আলমারি। এট্যাচ বাথরুম, পানি ভরা একটা বড় বালতি আর মগ।
মেরু মিয়া আসলো। পাচ ফুটের মত হবে ওর উচ্চতা। ছিপছিপে শরীরের গড়ন, একদম যাকে বলে মেদহীন। পুরনো রঙ ফাটা নীল রঙের হাফ হাতা সার্ট আর একই রঙের প্যান্ট তার পরনে। এটা লিভারি অর্থাৎ কেয়ারটেকারের উর্দি বুঝতে কষ্ট হল না।
-স্যার, মাছ খান তো, রাতে এ নদীর পাবদা মাছ, পুইশাক আর ডাল রান্না করছি?
কোন কিছুতেই তার অরুচি নেই বলে জানাল বাবুল।
মেরু মিয়ার মুখমণ্ডলটা খুব ছোট, চোয়াল দুটো ভিতরে ঢুকানো, মার্বেলের মত দুটো চোখ গর্তের মধ্যে ঢুকে বসে আছে, মুখটা যেন পাথর কাটা। নাকটা লম্বা সুচালো, কান দুটো খরগোসের মত খাড়া খাড়া। মুখে একগুচ্ছ ছাগলে দাড়ী, ছোট ছোট করে ছাটা চুল।
গলার স্বর নালীর বোধহয় সমস্যা আছে, কিচ কিচ করে কথা বলে। সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে কিন্তু মনে হচ্ছে ও বেশ খানিকটা দূরে। ভাবনেশহীন মখাবয়ব।
মেরু মিয়া বেরিয়ে গেল। হাতে মুখে পানি দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সামনে বারান্দাই এসে দাড়াল বাবুল। এল আকৃতির বাংলোটার এলের লম্বা বাহুর গোটা পাচ ছয়টা রুমের একেবারে শেষের রুমটা তার। বাংলোর সামনে লম্বা বারান্দা। অন্য সব রুমের দরজা বন্ধ।
জ্যোৎস্না রাত, বাইরে কোন লাইট না থাকলেও মোটামুটি সব দেখা যাচ্ছে। সামনে চেয়ারগুলো পাতায় আছে তার একটাতে বসলো সে।
শীত চলে গেলেও গরম পড়েনি। চমৎকার একটা আবহাওয়া। পাতলা একটা টি সার্টই যথেষ্ট।
পূর্ণিমার বোধহয় কয়েকটা দিন বাকি আছে। সন্ধ্যার পর পরই চাঁদটা বেশ উপরে উঠে এসে বাংলোর পূর্ব দিকে বড় বড় গাছের ডাল পালার আড়াল থেকে উঁকি ঝুঁকি মারছে।
-স্যার, ষাঁড়ে আটটার সময় লাইট অফ হয়ার আগে খেয়ে নিলে ভাল হয়। অবশ্য হারিকেন জ্বালানো থাকবে। খাবার দিয়েছি, আপনি খাওয়া সারলেই আমি থালা বাটি নিয়ে যাব।
মেরু মিয়ার ডাকে রুমে ঢুকে খাবার শেষ করতে করতে লাইট অফ হয়ে গেল।
হারিকেনটা জ্বালানই ছিল। মেরু মিয়া জোরটা বাড়িয়ে দিল।
খাবার শেষে বাবুল বাইরে বেরিয়ে খোলা জায়গায় বসলো।
মেঘ মুক্ত আকাশ, ঝলমলে রুপালী চাঁদটা প্রায় মাথার উপর চলে এসেছে। মেরু মিয়া আসলো। ওকে বসতে বললেও ও দাড়িয়েই রইল।
ওর দুটো মেয়ে। বড়টা জন্ম থেকেই বোবা। বছর পনেরো বয়স হয়েছিল, একদিন গোসল করতে নেমে নদীতে ডুবে মারা যায়। ছোট মেয়েটাকে এ অঞ্চলের একটা ছেলের সাথে বিয়ে দিয়েছিল। শহরে গার্মেন্টসে কাজ করত দুজনই। গত দু বছর হল মেয়েটা নিখোঁজ, জামাই নাকি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। মেরু মিয়ার বউ সে দুঃখে গলাই কলসি বেধে এ নদীতেই আত্মহুতি দিয়েছে।
-শুয়ে পড়েন স্যার, সকালে নাস্তা খেয়ে সাড়ে আটটা নাগাত বেরিয়ে পড়তে হবে। স্কুলে পৌছাতে আধা ঘন্টা মত লাগবে।
দু মিনিটেই ওর জীবনের গল্প শেষ করে মেরু মিয়া বাবুলকে শুতে যাওয়ার তাড়া দিল।
পরদিন সকাল নয়টার দিকে স্কুলে পৌছালো বাবুল। চেয়ারম্যান সাহেব আগেই পৌঁছে অন্যান্য মাস্টার সহ বাবুলকে অভ্যর্থনা করে টিচার্স রুমে বসে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সবাই ঘুরে ফিরে বাবুলের মত একজন মানুষ চাকরী নিয়ে এখানে আসাটা বিস্ময়কর বলতে লাগল।
-তোমার জন্য এটা কিছুদিনের অবকাশ যাপনের মত হলেও আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া।
হেড মাস্টার, মাথার চুল পুরোটাই সাদা, খাট করে ছাঁটা সাদা চাপ দাড়িতে পঞ্চাশের মাঝামাঝি পিতৃতুল্য মানুষটাকে খুব ভাল লাগলো বাবুলের।
-কতদিন থাকবো তা নিয়তিই জানে। তবে স্যার, দায়িত্ব নিয়ে বলছি -অবকাশ যাপনের জন্য আমি এখানে আসিনি, প্রাইমারী স্কুলের ছেলেমেয়েদের পড়ানো আমার আজন্ম আকাঙ্ক্ষা।
বাবুলের মন্তব্যে সবাই তাকাল তার দিকে।
-আমি মনে করি এ বয়সের বাচ্চারা অক্ষর জ্ঞান আর একটু আধটু অংক ধারাপাত শিখলেই যথেষ্ট, সেটা খুব একটা বড় কিছু না। যেটা সবচেয়ে বেশী দরকার সেটা হল মনুষ্যত্ব শেখানো। আর তার জন্য এখনই প্রকৃষ্ট সময়।
-সেটা কি রকম? হেড মাস্টার সাহেব প্রশ্নটা করলেন।
-সেটা কঠিন কিছু না। ধরুন, গভীর ঘুম থেকে সকালে বাচ্চারা উঠলে স্বভাবতই ওদের চোখে ময়লা জমে দৃষ্টি ঝাপসা থাকে, তাই সময় নষ্ট না করে চোখ দুটো বার বার পানির ঝাপটা দিয়ে ধুয়ে ফেলার জন্য যে ভাবে বাবা মা ওদেরকে শেখান, ব্যাপারটা অনেকটা সেরকম।
-ধুয়ে ফেলতে দেরী হলে চোখের উপর অযথা চাপ পড়ে চোখের ক্ষতি হয়। তাই দেরী না করে সকালেই ঘুমে ভরা চোখ দুটো পানির ঝাপটা দিয়ে ভাল করে ধুয়ে দিলে চোখের জ্যোতি পরিষ্কার হয়ে দিনটা ভাল কাটে, আর চোখও অনেক দিন ভাল থাকে।
সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে বাবুলের দিকে।
-এ নিয়ে বিস্তারিত পরে আলাপ করা যাবে। আজ আমি ক্লাস ফোর আর ফাইভের ছেলেমেয়েদেরকে চোখ ধুয়ে নেয়ার সে রাস্তা দেখাবো। এখনি সময়, না হলে দেরী হয়ে যাবে।
-আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি শুরু কর, বাচ্চাদের সাথে আমরাও দেখি সেটা। আজকে না হয় আমি পরিষদের কাজে যাব না।
চেয়ারম্যান সাহেবের কথাই সবাই মৃদু হাসল।
বাবুল বাচ্চাদের একত্রে করে নিজের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বলল -আমি তোমাদের নতুন শিক্ষক। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত তোমাদেরকে কোন পরীক্ষা দিতে হবে না আজ থেকে। খুশী সবাই?
বাচ্চারা সম্মিলিত ভাবে উচ্চস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিল। পরীক্ষা না দিতে হলে সবাই খুশী।
-আজ তোমাদের সবাইকে মজার একটা কাজ করতে হবে।
বাবুলের কথাই ওরা সবাই চুপ হয়ে শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো।
-তোমরা সবাইতো হেটে স্কুলে আস। আচ্ছা, তোমারা কখনো রাস্তায় হাটার সময় হোঁচট খেয়েছো বা কারো পায়ে কাঁটা ফুটেছে?
সবাই সমস্বরে ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিল।
-আচ্ছা, তোমাদের মধ্যে কেউ কোনদিন রাস্তায় পাথরের টুকরো বা কাঁটা পড়ে থাকতে দেখেছো?
এবারেও সবাই ‘হ্যাঁ’ বলে সমস্বরে জবাব দিল।
-বেশ, অন্য কেউ সে পাথরের টুকরোই হোঁচট খাবে বা কাঁটাটা কারো পায়ে ফুটে ব্যথা পাবে ভেবে সেটি রাস্তা থেকে কে কে সরিয়ে ফেলেছো?
এবার সকলে চুপ।
- একটু ভাবতো, তুমি যদি রাস্তা থেকে একটা পাথরের টুকরো বা একটা কাঁটা সরিয়ে দাও তাহলে ওই পাথরটাতে বা ওই কাঁটাতে অন্য কেউ ব্যথা পাবে কি?
-না। সবাই উত্তর দিল।
-আচ্ছা, এবার ভাব, তুমি যে পথ থেকে পাথরের টুকরো বা কাঁটা সরালে সে পথ দিয়ে মানুষ পায়ে ব্যথা না পেয়ে নির্বিঘ্নে যাতায়াত করা দেখে তোমাদের ভাল লাগবে?
এবারে বাচ্চারা সবাই সমস্বরে উচ্চকন্ঠে ‘হ্যাঁ’ বলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জবাব দিল।
-ঠিক আছে, আজ তোমরা এখনই সবাই বেরিয়ে ডাক বাংলো এলাকায় যাবে মেরু মিয়া আংকেলের সাথে। যাওয়ার রাস্তাই আর ডাক বাংলো চত্বরে সবাই কমপক্ষে একটা করে কাজ করবে যেটা অন্যের উপকারে আসে। মনে রেখ, সেটা শুধুমাত্র মানুষের জন্য না, কোন প্রাণী, গাছপালা বা নদীর জন্যও হতে পারে। পরে আমি সবার কাছ থেকে শুনবো সে সব গল্প।
ছেলেমেয়েরা সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে মেরু মিয়ার সাথে বেরিয়ে পড়ল।
বাচ্চারা সবাই চলে যাওয়ার পর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা চেয়ারম্যান আর হেড মাস্টার সহ অন্যান্যরা এগিয়ে আসলো।
-স্যার, এই বয়সে যে বাচ্চা নিঃস্বার্থ ভাবে অন্যের উপকারের উদ্দেশ্যে কিছু করে অন্তরের ভিতর অনন্দের স্বাদ পাবে, সে স্বাদের মজাটা সে জীবনে ভুলবে না, কারণ সেটা স্বর্গীয় স্বাদ। আর কেবলমাত্র স্বর্গীয় স্বাদই চিরস্থায়ী, অন্য কিছু নয়। যে মানুষ জীবনে একবার স্বর্গীয় স্বাদ পাবে সে নিশ্চিত ভাবে ভাল মানুষ হয়ে উঠবে।
সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে বাবুলের কথা।
-জীবনের উদ্দেশ্য যে কি সেটা বলা অসম্ভব। কিন্তু সংক্ষেপে বলা যায় –‘অন্যকে সাহায্য করাই জীবনের উদ্দেশ্য”। আর আমি নিশ্চিত করে বলছি –‘প্রকৃত ভাল মানুষের পার্থিব কোন অভাব বা দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না’।
অশ্রুসজল চোখে চেয়ারম্যান সাহেব বাবুলকে আবেগাপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন।
সেদিন বাচ্চারা সারাদিন কাঁটালো নিজেদের মত করে পরোপকারে কাজ করার প্রত্যয়ে।
মেরু মিয়া সেদিনের পর নিজেকে যেন নতুন ভাবে আবিষ্কার করলো। তার মনে হল সে চিরকাল নিজেকে নিয়ে আর শুধু নিজের সুখ দুঃখ আর স্বার্থের কথা ভেবেছে। অন্যের সুখ দুঃখ নিয়ে ভাবার মধ্যে যে এত প্রশান্তি সেটা তার এতদিন অজানাই ছিল।
মেরু মিয়া নিজের ভাল লাগার জন্য খাঁচায় বন্দী করে অনেকগুলো পাখী পুষত। পরদিন প্রত্যুষে খাচার মুখ খুলে দিতেই পাখীগুলো এক এক করে উড়ে পাহাড় জঙ্গলে চলে গেল।
একদম হালকা ফিরফিরে হয়ে গেল মেরু মিয়া। তার মনে হতে লাগলো সেও যে কোন সময় পাখীর মত ফুড়ুৎ করে উড়ে যেতে পারবে।