জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে আমার ৫ম উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -১।

আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:১৩

অম্বরাবনী-১ 

 

গল্পের চরিত্র হওয়ার মত কোন বিশেষত্ব অবনীর কোন দিনও ছিল না। ওর সব কিছুই একদম সাদামাটা, ও দশ জনের মধ্যে যেন দশমতম।
একটা খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত পরিবারে ওর জন্ম। যেখানে সবার সাধ আহাল্লাদ চাওয়া পাওয়াটা সোজা সরল। ওর জীবনে আকাঙ্ক্ষার বাড়ম্বরতা যেমন ছিল না তেমনি ছিল না আহামরি কোন আকাঙ্ক্ষা পুরণের প্রতিযোগিতা।
অবনী ওর বাবা মায়ের পঞ্চম সন্তান।
শুখিয়ে যাওয়া বড় কোন নদীর সাথে ওদের বর্তমান অবস্থাটা তুলনা করা যায়। হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা শুখিয়ে যাওয়া নদীর শুণ্য হাহাকার করা অবয়বের মত প্রায় বিশ একর জমির উপর দাড়িয়ে থাকা ওদের চুন শুরকি খসে পড়া বিশাল বাড়িটা পুরোনো জমিদারীর সাক্ষ বহন করছে।
ওর জন্মটাও অনেকটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুর্ঘটনার মত। রক্ষনশীল মনোভাবাপন্ন মানুষের সন্তানের প্রত্যাশা করার যে সমস্ত কারণ গুলো সাধারণত থাকে তার কোনটিই অপূর্ণ ছিল না অবনীর বাবা মায়ের। যেমন প্রথমে ছেলে সন্তান তারপর মেয়ে, তদুপরি একাধিক ছেলে সন্তান ইত্যদি। এ সবের কোনটায় বিধাতা অপূর্ণ রাখেনি। তায় তিন পুত্র আর একটা কন্যা সন্তান লাভের পর ওর বাবা মায়ের মনের কোণে অতিরিক্ত আর কোন সন্তান লাভের বিন্দুমাত্র লুকানো আশাও ছিল না।
অবনীর জন্ম এমন একটা সময়ে যখন ওর বাবা মা চার সন্তানকে নিয়ে গঠিত সংসারে পরিপূর্ণ পরিতৃপ্ত এবং বলতে গেলে পিঠাপিঠি তিন ছেলে আর মেয়ের কোলাহলে কিছুটা পরিশ্রান্তও বটে। ওদের চার ভাইবোনের বয়সের পার্থক্য মোটামুটি দেড় থেকে দুই বছর করে। অপরিকল্পনার ছাপটা সুস্পষ্ট।
চতুর্থ সন্তানকে জন্মদানের পর ওর মায়ের শরীরটা একদম ভেঙ্গে পড়েছিল। ডাক্তার সহ অন্যান্য আপনজন যারা ছিলেন তারা সবাই বারবার সতর্ক করলেন আর কোন সন্তান যেন ওরা না নেয়। তাতে মায়ের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে।
সবার যুক্তি পরামর্শ মত গর্ভধারণ না করার জন্য তখনকার দিনে প্রচলিত সব চিকিৎসা ওর মাকে প্রদান করা হলো। কিন্তু বিধাতার খেয়ালতো আর কোন বাধা মানে না। তবে হ্যে, এবারে বিধাতা তাঁর ইচ্ছেটা পূরন করতে পাঁচ বছর সময় নিলেন।
অসুস্থ মায়ের শরীরে অবনীর অঙ্কুরোদ্গম। রোগা ছিপছিপে স্বাভাবিকের প্রায় অর্ধেক ওজনের একদলা মাংসপিন্ড সম্বলিত সন্তানের জন্ম দিলেন ওর মা অসুস্থ শরীরে।
ওদের সন্তান লাভের মোহ পুরোপুরি নির্বাপিত এবং অবনীর আসার সকল দ্বার রূদ্ধ করে সবাই নিশ্চিন্ত। তায় প্রকৃত অর্থে সবার ইচ্ছের বিরূদ্ধে এবং সবারই প্রবল বাধার মুখে কেবল মাত্র বিধাতার নির্দেশেই ওর জন্ম।
এমন একটা জন্মকে স্মরণীয় করে রাখার খেয়ালটা বোধহয় স্বয়ং বিধাতাও সংবরন করতে পারলেন না। অবনীর জন্মটা স্মরণীয় করে রাখতে বিধাতা তারিখটি ঠিক করলেন লিপ ইয়ারের উনত্রিশে ফেব্রুয়ারী।
কিন্তু অযাচিত ভাবে জন্ম গ্রহন করা ছেলেটির ব্যতিক্রমী জন্ম তারিখটা বোধহয় বিধাতা ছাড়া অন্য কারো মনে রেখাপাত করলো না। সবার কাছে মাসের অন্য যে কোন তারিখের মত ওর জন্ম তারিখটাও একই রকম অনুভূত হলো।
বলতে গেলে সবাই এই অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথির আগমনে কিছুটা বিরক্তই হলো। মুরব্বীরা ওর মায়ের নাম ধরে বললেন -রোকেয়া তোমার যা শরীরের অবস্থা তাতে তোমার ছেলেকে দেখাশোনার জন্য কাউকে রাখা ছাড়া উপায় নেই। নিজে বাচবে না ছেলেকে বাচাবে?
সবাই আফসোচ করে বললো - পোড়া কপাল ছেলেটা এমন সময় জন্মালো। আর ছেলেটার যে রোগা শরীর তাতে টিকবে কিনা কে জানে!
কিন্ত বিধাতার কি খেয়াল! রোগা ছিপছিপে দেহী অবনীতো টিকে গেলই, অধিকন্তু ও জন্ম গ্রহন করার পর ওর মা অনেকটা অবিশ্বাস্য ভাবেই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন। তায় অবনীর বেড়ে ওঠার জন্য যে আদর এবং যত্নের প্রয়োজন তার আর কমতি থাকলো না।
অতিরিক্ত কোন টাকা খরচ করে কাউকে রাখতেও হলো না। তদুপরী স্ত্রী সুস্থ হয়ে ওঠাতে ওর বাবাও ধীরে ধীরে খুশি হয়ে উঠলেন।
টানাপোড়নের ভিতর দিয়েই অবনীর জীবন এগিয়ে চললো। চার সন্তানের হট্টোগোলের মধ্যে রোগা ছিপছিপে শরীরের অবনী যেন অতিরিক্ত কোন ব্যাপারই সৃষ্টি করতে পারলো না। প্রথমতঃ খাওয়াদাওয়ার প্রতি ওর আজন্ম অনীহা আর দ্বিতীয়তঃ ওর বিভিন্ন বয়সী বড় ভাইদের ছোট হয়ে যাওয়া জামা জুতাই ওর জন্য যথেষ্ট ছিল। সত্যি বলতে কি, সংসারে কোন বাড়তি ব্যয়ের কারণ হলো না অবনী।

ওর রূগ্ন শরীরটা অন্য সবার চোখ এড়িয়ে গেলেও ওর মা সেটা নিয়ে সবসময়ই খুব চিন্তিত থাকতেন। তার এ সন্তান বেশীদিন বাচবে না বলে তার মনে একটা আশঙ্কা সব সময় লেগে থাকতো। রোকেয়া বেগম রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে নিরবে চোখের জল ফেলতেন। রূগ্ন দেহ থেকে রূগ্ন একটি সন্তানের জন্ম দিয়ে নিজে সুস্থ হয়ে উঠার ব্যপারটা তাকে দারূন ভাবে পীড়া দিত।
অবনীকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ওর শীর্ণ হাত পা গুলো নাড়াচাড়া করতে করতে ওর মা ভাবতেন একে পৃথিবীর আলো না দেখতে দেয়ার জন্য তিনি ওর আসার সব পথ বন্দ করে দিয়েছিলেন। মা হয়ে এমন কাজ তিনি কি করে করতে পারলেন! ভাবতে ভাবতে তার দুচোখ বয়ে নীরবে অশ্রু ঝরতো।
গভীর একটা অপরাধ বোধ সব সময় ওকে কুরে কুরে খেত।
বাবা নানান কাজে ব্যস্ত, তাছাড়া ছেলেমেয়েদের ব্যপারে চিরকালই একটু উদাসীন তিনি। ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন আর্থিক চাহিদা পুরনই তিনি তার মূল দায়িত্ব মনে করতেন।
অবনীর অন্যান্য ভাইবোনেরা সবাই ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী এবং ডানপিঠে গোছের ছিল। ওদের সাথে চাক্ষুস ভাবেই অবনী বেমানান। ওরা যখন নিজেদের ভাগটা বুঝে নিতে একে অপরের সাথে পেশী শক্তি ব্যবহারে লিপ্ত অবনী তখন নিরাপদ দুরত্বে নির্লিপ্ত দাড়িয়ে সব অবলোকন করে।
বড়রা সবাই ওকে সবসময় নিজেদের প্রয়োজনে ছোট খাট কাজে খাটিয়ে তৃপ্তি পায়। অবনীও নির্দিদ্ধায় ওদের খুব বাধ্যগত থাকে। অবনী নীরবে সকলের সব আদেশ নিষেধ বিনা ওজরে মেনে নেয়।
বোঝা যায় ছোট কাল থেকেই ওর মনের ভিতর ওর ভাই বোনদের সম্পর্কে একটা অজানা ভীতি কাজ করে। সব ভাই বোনেরা ওকে দিয়ে বিনা কারণে সময়ে অসময়ে ফায় ফরমাস খাটানোটাকে একটা মজা হিসাবে গন্য করে।
ব্যপারটা অন্য কেউ খেয়াল না করলেও ওর মা ঠিকই খেয়াল করেন। এ সব কিছু দেখে ওর মায়ের মনে হয় সত্যিই বোধহয় এ সংসারে অবনী অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অতিরিক্ত।
তিনি ভাবেন -কথাটা যেন এ বয়সেই ঐ রোগা শরীরের ভিতর লুকিয়ে থাকা ওর মনটাও টের পেয়েছে। ও বোধহয় জানে কিভাবে সবাই মিলে ওকে এ সংসারে আসতে না দেয়ার, এ পৃথিবীর আলো দেখতে না দেয়ার চেষ্টা করেছে। কেউই ওকে চায়নি। তায়তো অতটুকু অবনী সবার থেকে, সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখে।
কথাটা চিন্তা করতেই অবনীর মায়ের চুচোখ বয়ে কেবল অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
তিনি অনেক সময় অন্যান্য ছেলেমেয়েদের বকুনী দিয়ে ওদের ফায় ফরমাস খাটা থেকে অবনীকে মুক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন। শরীর আর হৃদয়ের সকল উষ্ণতা দিয়ে অসহায় ছেলেকে বুকের মধ্যে আগলে রাখেন।
-ওর এ পৃথিবীতে আসাটা যদি একটা ভুল হয় তবে সে ভুলটা আর যার হোক অবনীর নয়! ওর মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবেন ওর মা।
রোকেয়া বেগম তার এই রূগ্ন সন্তানটিকে নিয়ে সব সময় একটা দুর্ঘটনার আশংকাই থাকেন। তিনি অবনীকে যথাসম্ভব অন্যান্যদের থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেন। মাঝে মাঝে ওর ভায়েরা যখন ওকে অতিরিক্ত খাটুনী খাটায় তখন তিনি অবনীকে ওদের অন্যায় আচরন থেকে ছাড়িয়ে ঘরের এক কোনে নিয়ে যান। তারপর অশ্রুভরা চোখে ওর ছোট্ট মুখটা উচু করে দুহাতের তালুর মধ্যে ধরে একটু ঝাকুনী দিয়ে বলেন -তুইও ওদের মত এ সংসারের একজন, তুই কেন সেটা বুজিঝনে। ওরা তোকে খাটিয়ে খাটিয়ে শেষ করে ফেলবে। অত কাজ করলে তোর এই শরীরে সহ্য হবেনা। ওরা তোকে বাচতে দেবেনা বাবা।
অবুঝ অবনী কিছু না বুঝে নীরবে মায়ের বুকে মুখ লুকায়।

এতগুলো ছেলেমেয়ে নিয়ে বড় সংসার। রান্নাবান্না সহ ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা এবং বাড়ীর যাবতীয় কাজ করতে করতে কখন যে বেলা গড়িয়ে যায় তা রোকেয়া বেগম খেয়ালই করেন না। এত ব্যস্ততার মধ্যে রূগ্ন ছেলেটাকে যে একটু বসে নিজে হাতে খাওয়াবে সে ফুসরতও অনেক সময় হয়ে ওঠে না।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়ই কেবল অবনীকে তিনি সময় দিতে পারেন। ক্লান্ত শরীরে ঘুম ঢুলু ঢুলু চোখে অবনী না ঘুমানো পর্যন্ত ওর সাথে গল্প করে। ওর সব কথাতেই তিনি সায় দেন। নানা রকম প্রশ্নের জবাবে তিনি তার কল্পনার জগতে অবনীকে রাজপুত্র সাজিয়ে তার জবাব দেন।
সারাদিন চুপচাপ থাকার পর রাতে ওর মায়ের কোলে শুয়ে অবনী যেন ওর মায়ের সাথে কথা বলার প্রতিযোগিতায় নামে। কত কথা জমে থাকে ওর বুকের গভীরে। চোখ দুটো বন্দ হয়ে আসা পর্যন্ত অবনী কথা বলতেই থাকে।
সারাদিন ওর ভাইবোনদের বিভিন্ন রকমের খেলাধুলা, ওকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়া ইত্যাদি কথা বলে খিল খিল করে প্রাণ খুলে হাসে। ওর হাসিতে হৃদয়টা ভরে যায় রোকেয়া বেগমের। কিন্তু অবনী ঘূণাক্ষরেও কখনো কোন ভাই বোন বা কারো সম্পর্কে কোন অভিযোগ করে না।
-জান মা আজ বিকালে খেলতে খেলতে ওদের বলটা হারিয়ে গেল। কিন্তু ওরা মনে করলো কেউ একজন লুকিয়েছে। সবাইকেই জেরা করেও বলটা খুজে পাওয়া গেল না। ওরা প্রায় মারামারিই শুরূ করে দিল। আমি পাশে দাড়িয়েছিলাম বল কুড়ানোর জন্য। আমি বললাম বলটা বোধহয় জংগলের ভিতর হারিয়ে গেছে। বড় ভাইয়া না খুজেই আমার গালে জোরে একটা থাপ্পড় দিয়ে বললো তা তুই দেখিসনি কেন?
এতগুলো কথা একসাথে বলে একটু থামলো অবনী।
-আমি কি বলবো বল মা? বড় ভাইয়াটার মাথায় একদম বুদ্ধি নেই।
কথাটা বলে অবনী হটাৎ করে চুপ হয়ে গেল। গালের ব্যথাটা যেন এতোক্ষনে বোধ হলো ওর। নিজের হাতটা দিয়ে থাপ্পড় খাওয়ার জায়গাটাতে হাত বুলাতে লাগলো।
ঘুমে ঢুলু ঢুলু মা বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠ হওয়ার মত হন্তদন্ত হয়ে উঠে আলোটা জ্বালিয়ে বললেন -দেখি কোথায় লেগেছে বাবা।
অবনী ওর চোয়ালের উপর হাত বুলাতে বুলাতে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
তখন ভাইদের ভয়ে ব্যথাটা টের না পেলেও মাকে বলতে পেরে এতক্ষনে ব্যথাটা ও টের পেয়েছে মনে হলো। মা ওকে বুকে জড়িয়ে ওর চোয়ালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সব ভুলে ঘুমিয়ে পড়ে অবনী।
অল্পতে সন্তষ্ট অবনী। মায়ের আদরটা পেলেই ওর যেন সব পাওয়া হয়ে যায়।