জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' পর্ব -৫।

আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২২, ১১:৩৮

অম্বরাবনী -৫ 

 

সেবামুলক প্রতিষ্ঠান, চাকরীর ক্ষেত্রে অনেক ব্যস্ততা। সমাজের নীপিড়িত মানুষদেরকে নিয়ে ওর কাজ। সব সময় ওদের খোজখবর রাখার ছলে নিজের সব কিছুকে ভূলে থাকার সহায়ক হল অবনীর কাজটা।
ভালো বেতন। প্রতি কয়েক মাস পর পর বিদেশ ভ্রমন। ব্যস্ততার সাথে সাথে টাকা পয়সা নাম যশ সবই দিল বিধাতা।
নিজের ছোট্ট শহর বাড়ী সব ছেড়ে চলে আসলো অবনী বড় এক অজানা শহরে। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত এখানে। কাজের মধ্যে নিজেকে একদম ডুবিয়ে রাখতে চায়লো অবনী।
এত বড় শহর, এত মানুষ এত কোলাহল তবু সবাই যেন একা এখানে। একজনের সাথে অন্যজনের সম্পর্ক শুধু কাজের। সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে। একে অন্যের দিকে ফিরে তাকানোর যেন ফুফরত নেই।
মনটা কষ্টে ভরে থাকলেও ভালোই হলো অবনীর। জীবিকার প্রয়োজন প্রতিটি মানুষকে এমনভাবে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে যে এখানে ওকে কটাখ্য করার মত সময় মানুষের নেই।
অবশেষে ওই চাকরীটার জের ধরে জাতিসংঘের আওতায় একটা চাকুরী পেল অবনী। আর জাতিসংঘের চাকরীই ওকে শুধু নিজের পরিবার আর প্রতিবেশীই নয়, নিজের দেশ ছেড়ে সম্পুর্ণ ভিন্ন পরিবেশে নিয়ে এলো।
অনেক বছর ধরে অনেক দেশ ঘুরে ঘুরে চাকরী করলো অবনী। কত মানুষ কত সংস্কৃতি আর কত দেশ দেখলো। দেখলো নীপিড়িত আর নির্যাযিত মানুষের শত সহস্র মুখ।

বর্তমানে অবনী মোজাম্বিকের একদম উত্তরে অবস্থিত প্রাদেশিক শহর এই নাম্পুলাতে। সারাক্ষনই অফিসের কাজে ব্যস্ততায় দিন চলে যায়।
ছোট টিলার উপর একতলা একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে। এদেশের কৃষ্ণাংগ এক যুবক ছেলে নাম সালভাদোর ওর রান্না সহ অন্যান্য কাজ কাম করে দিয়ে রাতে চলে যায়।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন, অবনী একাকী বসে। ঘুমটা ভেঙেছে একটু দেরীতে। নাস্তা সেরে অলসতা বসত আবার বিছানায় গাটা এলিয়ে দিয়েছে।
সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো ওর একদম অপছন্দ। সকালে ঘুম থেকে দেরী করে উঠাটায় একমাত্র মজা। তারপর সময় কাটতেই চায় না। ওর এই পৃথিবীতে সবার সাথে কাজের সম্পর্ক। ছুটির দিন গুলোতে তায় কথা বলার মত কেউ থাকে না। সবায় নিজের মানুষদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে ছুটির দিনে।
দরজায় নক করার শব্দে বুঝলো সালভাদোর। কোন রকমে দরজাটা খুলে দিয়ে আবার গাটা বিছানায় এলিয়ে দিল।
মাল্টিন্যশনাল কোম্পানীতে ওর বস মিশেলের সক্রিয় সহযোগীতায় এই জাতিসংঘের চাকরী ও পেয়েছিল।
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে চাকরীর ইণ্টারভিউয়ের কথাটা মনে পড়লো অবনীর। ওর এপ্লিকেশানে উল্লেখিত জীবন বৃর্তান্ত দেখেই ভাইভা’তে ডাক পড়লো। দেশী বিদেশী মিলে পাচ জন ওরা বোর্ডে।
বুকটা দুরূ দুরূ করলেও অবনী বুকে সাহস যোগালো - না হলে না হবে।
ইন্টার্ভিউয়ের জন্য রুমে ঢুকেই সবাইকে নিয়ম মাফিক সন্মান জানিয়ে বসতেই প্রথমেই বোর্ডের সবাই ওর কপালের পোড়া দাগটার দিকে তাকালো।
অবনী একটু অস্বস্তি বোধ করলো, আত্মবিশ্বাসের উপরে কিছুটা নেতীবাচক প্রভাবও পড়লো। এ ধরনের অভিজ্ঞতা অবশ্য অবনীর নতুন কিছু নয়। আর ওতো সব সময়ই প্রায় হেরে যাওয়া গেম খেলতেই অভ্যস্ত। উজানে বৈঠা বাওয়ার জন্যই যেন ওর জন্ম। অবনী নিজেকে প্রকিতিস্থ করলো।
বোর্ডে উপবিষ্ট প্রথম জন অবনীকে ওর নিজের পরিচয় দিতে বললো।
অবনী ধন্যবাদ জানিয়ে শুরূ করলো। ও ওর জন্ম তারিখটা ২৯ শে ফেব্রুয়ারী বলে উল্লেখ করতেই বোর্ডের চেয়ারম্যান ফ্রান্সের বাসিন্দা মিঃ মিসেল নুভেলন ওকে থামিয়ে আবার বলতে বললেন।
তারিখটা পুনরায় বললো অবনী। সবাই মৃদু হাসলো একটু। হাসলো না কেবল মিসেল। তিনি বরং একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। মিসেল কি ভাবছিলো বলা মুস্কিল। তবে অন্যান্যরা নানা প্রশ্ন করলেও মিসেল বাকি সময়টা নিশ্চুপ বসেই কাটিয়ে দিলেন।
ওদের হাসির কারণটা অবনী বোঝে, কেননা এ ধরনের পরিস্থিতির সন্মুখিন ইতিপূর্বে বহুবার হতে হয়েছে ওকে। কিন্তু এতে কি করবার আছে ওর। ব্যপারটা যদি দোষের হয় তবে দোষটা কার!
এই মুহুর্তে সিষ্টার রবিনসনের কথা মনে পড়লো অবনীর। হালকা পাতলা শরীরে মায়াভরা ছোট্ট মুখখানি। বৃদ্ধা ওর মিশান স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন।
জন্ম তারিখের বিষয়টা সর্বপ্রথম অবনীর দৃষ্টিগোচর হয় যখন ম্যাট্টিক পাশ করার পর ও একটা অভিজাত মিশন স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায়।
স্কুলের নিয়মানুযায়ী সবার জন্মদিনে কলেজিয়েট স্কুলের সব ছাত্র বা ছাত্রিকে স্কুল ইউনিফরম ছেড়ে নিজ নিজ পছন্দের কাপড় পরে ক্লাসে আসার প্রচলন ছিল। তাতে সুবিধা হচ্ছে সেদিন কার কার জন্মদিন সেটা আর আয়োজন করে জানানোর প্রয়োজন হত না। পোশাকই সবাইকে সেটা বলে দিত। তারপর সবাই ওদেরকে শুভেচ্ছা জানাত আর আর্শিবাদ করতো।
সকালের এ্যাসেমব্লির পর ক্লাসের অন্য একজন ভলেনটিয়ার ষ্টুডেণ্ট বার্থডে ছাত্র ছাত্রীকে সাথে করে প্রিন্সিপালের রূমে নিয়ে যেত। প্রিন্সিপাল বার্থ ডে স্টুডেন্টকে আদর করে শুভেচ্ছা জানাতেন। ঐ দিন ক্লাসেও ওরা আলাদা ভাবে বিবেচিত হয়। বার্থডে ছাত্র ছাত্রীদের জন্য ক্লাসে সবার সামনে বেঞ্চে বসার ব্যাবস্থা করা হত।
স্কুলের সব ছেলে মেয়েই প্রতিবছর তাদের এই বিশেষ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকতো। সেদিন নিজের পছন্দের রংবেরঙের পোশাক পরবে, সবাই ওদেরকে আর্শিবাদ করবে, আরো কত কি।
প্রায় হাজার খানেক ছাত্র ছাত্রীর স্কুল তাই প্রতিদিনই সব ক্লাস মিলে গড়ে চার পাচ জন ছাত্র ছাত্রীর জন্মদিন থাকত। শুধু অবনী ছাড়া। কারণ ওর জন্ম দিনটি প্রতিবছর আসে না। ঐ স্কুলে লেখাপড়ার সময়কালে দিনটি আসেনি অবনীর জীবনে।
বিষয়টা ধীরে ধীরে সবার নজরে পড়ে। পড়ারই কথা। প্রতিবছর সবারই বার্থডে আসে, ঘটা করে সবাইকে সেটা জানানোও হয়। শুধু বাতিক্রম অবনীর বেলায়। তা নিয়ে সবাই ওকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু কি জবাব দেবে অবনী?
এত বড় স্কুলে প্রতিদিন কারো না কারো জন্মদিন থাকে। সেটা বিশেষ করে মর্নিং এসেমব্লিতে নিজ খুশিমত পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু অবনীর ব্যপারে বিধাতার এই খেয়ালী ব্যবস্থাটা প্রতিদিন সকালেই অবনীকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়।
ওর ক্লাসে যারা ওর সাথে বিশেষ করে পড়াশোনা এবং বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় হেরে যায় তারা মিলে হিংসা করে ওকে ‘বয় উইদাউট বার্থডে’ বলে কটাখ্য করে।
কি বলবে অবনী ওদের। কত ভেবেছে -ইস ওর জন্মটা লিপ ইয়ারের উনত্রিশ ফেব্রুয়ারি না হয়ে যদি একদিন আগে বা পরে হতো, তাতে কারই কি বা এসে যেত!
কিন্তু কি করবে অবনী ওসব কথা ভেবে!
আবার ভাবে -ঠিক আছে বিধাতার কথা না হলে বাদই দিলাম। জন্মটা না হয় ঐ দিনে হয়েছে, কিন্তু স্কুলে ভর্তির সময় একদিন আগে বা পরে জন্ম তারিখটা দেখালে কার কি ক্ষতি ছিল!
কিন্তু এখনতো আর ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
-হায়রে! ওর আপনজনরা কি কখনো ভাবতে পেরেছিল যে ওর এ রকম একটা জন্ম তারিখের জন্য ওকে একদিন বিনা দোষে এমন কষ্ট ভোগ করতে হবে!
দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভাবে অবনী।
অবনী কতবার ভেবেছে এ স্কুলটা ছেড়ে একটা সাধারণ স্কুলে চলে যাবে। যেখানে অন্ততঃ ঘটা করে বিধাতা কতৃক প্রদত্ত আর ওর বেখেয়ালি আপনজন কর্তৃক গৃহীত একটা ব্যবস্থার জন্য প্রতিনিয়ত ওকে শাস্তি ভোগ করতে হবে না।
স্কুলটাতে ভর্তি হতে পারা একটা খুব বড় ধরনের পাওয়ার ব্যাপার। তা জানে অবনী। কিন্তু বড় কিছু পাওয়ার জন্য এত যন্ত্রনা সহ্য করতে হবে তা ওর জানা ছিল না। এই প্রতিনিয়ত যন্ত্রনা ওর কাছে ক্রমে অসহনীয় হয়ে উঠতে লাগলো।
স্কুলটা বোধহয় অবনী ছেড়েই দিত। সব ছেড়ে দিয়ে ও ওর অন্য দশজন বন্ধু–বান্ধবদের সাথে সাধারণ একটা স্কুলেই ভর্তি হতো। তাহলে আর এ ধরনের অনর্থক ওর কষ্টের জায়গাটা ঘেটে কেউ বের করতো না। সেখানে জন্মদিনের মত জন্মসূত্রে প্রাপ্ত বিষয়গুলোকে নিয়ে কেউ ঘাটাঘাটি করে না। কারণ সেখানে যারা লেখাপড়া করে তাদের অধিকাংশেরই ও বিষয়গুলো আলো ঝলমলে নয়।
ওই স্কুলে বড় একাকী ভীনদেশী বলে মনে হতো অবনীর। খুব অসহায় লাগতো মাঝে মাঝে। তখন অবনী স্কুলটা ছেড়ে চলে গেলে ওর জীবনের গল্পটা বোধহয় অন্যরকম হতো।
কিন্তু বাধ সাদলেন সিষ্টার রবিনসন বারোই, প্রিন্সিপাল। অশীতিপর মহিয়সী রমনি, সর্বদা হাসিমাখা মুখ। একহারা শরীরের গড়ন, একটুও বাড়তি মেদ নেই দেহের কোথাও। প্রকৃতই বাড়তি কোন কিছুই ছিল না তার জীবনে। পুরূ গ্লাসের চশমা পরেন, বয়সের ভারে চলাফেরার গতিও স্লথ। কিন্তু সে ভার ওকে একটুও নোয়াতে পারেনি, না শারীরিক না মানষিক ভাবে। সাদা পোশাকে অপরূপ দেখায় সিষ্টার রবিনসনকে।
ওকে কখনো কেউ রাগ করতে দেখেনি বা উচ্চস্বরে কথা বলতেও কেউ শোনেনি। সবার জন্য তিনি যেন এক নিরাপদ আশ্রয়।
কোন ক্লাস নেননা তিনি । শুধু সকালের প্রেয়ার পরিচালনা করেন। দিনের মধ্যে অন্ততঃ একবার সব ক্লাসে যাবেনই। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে নীরবে বসে কিছুক্ষণ অবলোকন করে চলে আসেন। ‘বার্থডে ষ্টুডেণ্ট’স সকালে তার অফিসে দেখা করে জন্ম দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করে।
ক্লাসের যে কোন একজন ভলেনটিয়ার চাত্র বা ছাত্রী নিয়মানুযায়ী বার্থডে ষ্টুডেণ্টের সাথী হয়ে সাথে যায়। অবনীর যেহেতু নিজের বার্থডের কোন ঝামেলা নেই তায় মোটামুটি ওকেই নিয়মিত ভাবে সব বার্থ ডে ষ্টুডেণ্টসদের সাথী হয়ে প্রিন্সিপালের অফিসে যেতে হয়। এ ব্যপারটাতে ওর কোন প্রতিদ্বন্দি নেই।
যার ফলে ওর মুখটা প্রিন্সিপালের চেনা হয়ে গেছে। বৃদ্ধা ওর সবটুকু অন্তর দিয়ে বার্থডে ষ্টুডেণ্টকে আর্শিবাদ করেন এবং নানান উপদেশ দেন। বার্থডে ষ্টুডেণ্টদের আনন্দের অতিশয্যে উপদেশগুলো তাদের কানে না গেলেও সবার অলক্ষে সব আর্শিবাদ আর উপদেশগুলো অবনী অকাতরে গ্রহন করে।
ভারী ভালো লাগে প্রিন্সিপালের দেয়া উপদেশগুলো। তিনি কথা বলার সময় অবনী অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে।
একদিন বার্থডে বয়কে আর্শিবাদ শেষে ওরা বেরিয়ে আসবার সময় সিষ্টার রবিনসন অবনীকে দাড়াতে বললেন। সবাই বেরিয়ে গেল ও বাদে।
একটু অবাকই হলো অবনী।
প্রিন্সিপাল আলতো ভাবে ওর অফিসের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন। তারপর অবনীর হাত ধরে সযত্নে ওকে সামনের সোফাটাতে বসিয়ে নিজে পাশে বসলেন।