জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে ছোট গল্প 'চলন্ত ট্রেনে অঠা'।

আপডেট: ১৫ অগাস্ট ২০২৪, ১৫:৪৫

চলন্ত ট্রেনে ওঠা


ট্রেনটা চলছে শম্বুক সময়ের একই গতিতে, বিরামহীন।
চলায় তার ধর্ম, থামলেই যেন সব শেষ।
অনেক গুলো কামরা ট্রেনটাতে -ছোট বড় বিভিন্ন আকারের। সব দরজাই খোলা।
ট্রেনটাতে সবাই উঠছে দু’ধার থেকে। চলন্ত ট্রেনে যখন উঠছে তখন কেউই কামরাগুলো বেছে বেছে পছন্দ করে যে উঠছে সে রকম নয়। তার কোন সুযোগ নেই। যার সামনে ঐ মূহুর্তে যে কামরাটা আসছে সে সেখানেই উঠে পড়ছে। আবার প্রতিনিয়ত সবাই নেমে যাচ্ছে মহাশূণ্যের মহারণ্যে, যা কুয়াসা ঢাকা। কি আছে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
ট্রেনটা ঠিকই চলছে, তবে চলছে বলে যেন মনেই হয় না। অনেকটা সূর্য গড়িয়ে যাওয়ার মত।
ট্রেনটা থামছে না কোথাও এক মূহুর্তের জন্যও। যেন থামতে মানা। প্রতিনিয়তই দুপাশ থেকে মানুষ ট্রেনের এক একটা কামরায় উঠে আসছে, আবার নেমেও যাচ্ছে সময়ে অসময়ে সব কামরা থেকে।
এখানকার এটাই নিয়ম, চলছে আদি অনন্ত কাল। এর কোন হেরফের নেই।
উঠার সময় যেমন কারো জন্য ট্রেনটা থামে না, নামার সময়ও ঐ একই নিয়ম। কারো আসা যাওয়া যেন কোন ব্যাপারই না। চলাই যেন এর একমাত্র ব্রত, থামলেই সব শেষ।
এটা হলো ট্রেন আর তার বাইরের দৃশ্য।
ভিতরের দৃশ্যটা অন্যরকম!
পৃথক পৃথক হলেও কামরাগুলোর একটা থেকে অন্যটায় যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত দরজা আছে। কাঠামোগত কিছু প্রতিবন্দকতা ছাড়া, ট্রেনের প্রস্তুতকারী যে যাতায়াতের জন্য কোন অভেদ্য বাধা তৈরী করেনি তা বোঝা যায়। এক কামরা থেকে তাকালে লাগোয়া কামরাগুলো কম বেশী দেখা যায়। ঐ কামরাগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন কর্মরত মানুষগুলো মোটামুটি এ কামরাগুলোর মানুষেরই মত। পার্থক্যগুলো চাক্ষুষ, কারো বা রঙে আর কারো বা নাকে মুখে।
স্বাভাবিক নিয়মেই এক কামরার মানুষ পাশাপাশি অন্যান্য কামরার মানুষের সাথে কথাবার্তা বলছে যাতায়াত করছে, সকল আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি করেও নিচ্ছে।
প্রত্যেক কামরার মানুষের এক একটা আলাদা আলাদা ধরনের পরিচিতির ব্যবস্থা আছে। ওগুলো কামরার মালিকদের দেয়া। যার অনেকগুলো দেখা যায় শরীরে এবং সংস্কৃতিতে। আর বাকিটা বিশেষ বিশেষ আনুষ্ঠানিকতার সময়েই কেবল বোঝা যায়।
ভিন্নতায় ভরা সবকিছু। তবে একটা বিষয় সুস্পষ্ট তা হলো - ঐ পরিচিতিগুলো সবার জন্যই আদি অনন্তঃ কাল ধরে চলতে থাকা ট্রেনের অনেকগুলো কামরার মধ্যে উঠার মুহুর্তে অলৌকিকভাবে সামনে আসা কামরাটার সুবাদেই প্রাপ্ত।
দিনে দিনে অন্যান্য কামরাগুলো দেখে বা সে কামরার দু’চারজনের সাথে মেলামেশার সুযোগে কারো কারো মনে হয়েছে যে, তার নিজের কামরার তুলনায় অন্য কামরাটি ভালো। আর কিছু সংখ্যক মানুষ সাহস দেখিয়ে, আজন্ম পরিচিত কামরা আর পরিচিতদের ছেড়ে নিজের পছন্দের অন্য কামরায় যাওয়ার ঘটনাও কালেভাদ্রে ঘটছে।
এ ধরণের কামরা বদলের ঘটনায় বিভিন্ন কামরার নেতৃস্থানীয় মানুষের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বিভিন্ন ভাবে কামরা বদলের ঘটনাকে নিজেদের সুবিধার্তে ব্যবহারের জন্য, প্রথমতঃ অন্য কামরার মানুষ যেন এ কামরাই আসতে না পারে এবং নিজের কামরার মানুষ যাতে অন্য কামরায় না যেতে পারে তার জন্য নিজ নিজ কামরার দরজায় নানা প্রতিবন্দকতার সৃষ্টি করেছে।
আবার কোন কোন মালিক অন্য কামরার মানুষদের নিজের কামরায় আকৃষ্ট করার জন্য নিজ নিজ কামরার বিভিন্ন ভাল দিক এবং অন্যান্য কামরার খারাপ দিক গুলো তুলে ধরে বিভিন্ন প্রচারনাও চালাচ্ছে। কোন কোন কামরার নেতৃস্থানীয়রা অর্থ সম্পদের বিনিময়েও অন্য কামরার দরীদ্র মানুষকে তার আজন্ম বসবাসের কামরা ছেড়ে আসতেও অনুপ্রাণিত করছে।
নিজ নিজ কামরার প্রতি প্রকৃতিগত বিশ্বস্ত থাকার মনোভাবের পারস্পারিক দ্বন্দ, মূল্যবোধের দ্বন্দে পরিণত হয়ে ওরা একে অপরের বিরূদ্ধে পাশবিক শক্তি ব্যবহার করে আত্মনিধন যজ্ঞে মেতে উঠছে কখনো কখনো।
অজ্ঞানতার এই রেষারেষি তাদেরকে অন্ধ করে তাদের দৃষ্টিকে মূল ইস্যু থেকে অনেক দূরে সরিয়ে তারা আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে তারা তাদেরকে বহনকারী ট্রেনের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলেছে মাঝে মধ্যেই।
অন্য দিকে, যাদের জন্য এতকিছু অর্থাৎ সাধারণ যাত্রীরা তাঁরা ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে।
রেষারেষি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতৃত্বস্থানীয়রা এখন ট্রেনের মূল নক্সা পরিবর্তন করে নিজ নিজ ইচ্ছানুযায়ী পুরো ট্রেনটাকে এক কামরা বিশিষ্ট করে ফেলার পরিকল্পনাও করছে।
ট্রেনটা ভিন্ন ভিন্ন কামরা বিশিষ্ট হওয়াটাই যেন সকল সমস্যার মূল বলে আপাতঃ দৃষ্টিতে কারো কারো মনে হচ্ছে।
সমস্যার অন্য দিক হচ্ছে, একই কামরার ভিতরের ছোট বড় দল, যারা তাদের বিশ্বাস যা তারা মূলত কামরায় ওঠার সুত্রে প্রাপ্ত হয়েছে, নিজেদের পছন্দ অপছন্দের ভিত্তিতে নয়; সে সব বিষয় নিয়ে তোলপাড় করে আন্তকলহে লিপ্ত হচ্ছে।
তবে অনেক গুণিজনদের মতে- কামরার ভিতরকার গঠন বা বিন্যাসের যে পার্থক্য, যা পরিমাপ করা যায়, তার অনেকখানি ভাগা ভাগি করে দেয়া নেয়ার বিনিময়ে সমাধান করে সহাবস্থানের পথ বের করা সম্ভব।
কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা, সেটা ট্রেনের সম্পুর্ণ বাইরের ব্যাপার থেকে উদ্ভুত। যা দেখা যায় না ছোয়া যায় না। সেটা সমাধানের পথ যেন বের হওয়ার নয়।
সমস্যাটা এমন কিছু নিয়ে যার পরিমাপ করা যায় না। যা ভাগাভাগি বা দেয়া নেয়ার নিয়মে সমাধান করা যায় না। যেটা মুলতঃ এই ট্রেন, ভিন্ন ভিন্ন কামরা, ভিন্ন ভিন্ন কামরায় ওঠা আর নামার বিষয়াদি ইত্যাদি সব কিছুরই পরিকল্পকারী এবং তাঁর বিধি বিধানকে নিয়ে।
একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় যে, ট্রেন সম্পর্কে আর কামরা ভাগাভাগি সম্পর্কে সবারই চিন্তাভাবনার একটা মিল আছে। ট্রেনের গতি প্রকৃতি নির্ধারন, কামরা ভাগাভাগি ইত্যাদি ব্যপারে সবাই যে কোন এক মহাশক্তির কাছে অসহায় এমন অনুভূতি সবারই আছে।
শত পার্থক্য আর বৈশাদৃশ্যের ভিতর একটা ব্যাপারে সবার মতের বা উদ্দেশের অভিন্নতা হল- এই ট্রেন, এই কামরার সৃষ্টিকারী, বিভিন্ন কামরায় উঠা নামার ক্রম প্রস্তুতকারীর সন্তুষ্টি অর্জন।
কিন্তু সে লক্ষ্য অর্জনে যা করা হচ্ছে, সেটা যেন তাঁকে সন্তুষ্ট করার প্রয়াসে তাঁর সৃষ্টিকে ধ্বংস করার উম্মাদনা!
তিনিই তাঁর পরিকল্পনা মত বিভিন্ন কামরার সৃষ্টি করেছেন, আবার কামরার ভিতরকার বিভিন্ন সুবিধা অসুবিধা এবং বিভিন্ন কামরার মানুষগুলোর বাহ্যিক আকার, রং ইত্যাদিরও পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন।
মানুষে মানুষে ভেদাভেদের সৃষ্টিতো তাঁরই মূল পরিকল্পনার অংশ। তাহলে এই সব পার্থক্য- ভিতরে বাহিরে, মনে ও শরীরে এগুলো কি তাঁর পছন্দ নয়!
একটাই ট্রেন, আর এই ট্রেনেই সবাইকে থাকতে হবে -ট্রেনে প্রবেশ করা আর বের হয়ে যাওয়ার মাঝের সময় টুকুতে। কারো কিছু করার নেই এ ব্যাপারে। অসহায়ত্ববোধ থেকে এমন একটা মনোভাব সব কামরার বাসিন্দারা চেতন বা অবচেতন মনে মেনে নিয়েছে। তায়তো ক্ষেত্র বিশেষে, যা কিছু পরিমাপ করা যায় সে সকল সুযোগ সুবিধা অন্য কামরার সাথে একটা নির্দিষ্ট নিয়মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে নিয়ে এগিয়ে চলেছে সবাই।

অবনী অগনীত যাত্রীদের মধ্যে একজন। চলন্ত ট্রেনে উঠার সুত্র ধরে সেও একটা কামরার বাসিন্দা। আর আজন্ম বসবাসের সূত্র ধরে নাড়ীর অজেয় টানে ওর নিজের কামরার সব কিছুকেই আপন করে নিয়েছে অন্যান্য সবার মত।
অবনী স্বল্প পরিসরে অন্যানা কামরাগুলোর কোন কোনটাতে উঁকি দিয়ে, আবার কোনটার যাত্রীদের সাথে কথা বলে, অন্য সব কামরা আর মানুষগুলো সম্পর্কে যৎসামান্য জেনেছে।
তাতে অবনীর মনের গভীরে একটা ভাবনা জমেছে- আহ অন্য সব কামরার মানুষ যদি ওর নিজের কামরার মানুষের মতই সব চিন্তা চেতনাযুক্ত হতো তাহলে কতইনা ভালো হতো।
অবনী নিশ্চিতভাবে জানে যে, অন্য কামরাগুলোর যাত্রীরাও ঠিক ওর মত অন্যান্য সবাইকে ওদের নিজ নিজ কামরার মানুষের মত হওয়ার স্বপ্ন দেখে।
গুণিজনেরা আর গুরূজনেরা আবহমান কাল ধরে ওসব বৈশাদৃশ্য দূর করতে কত ভাবে চেষ্টা চরিত করছে। বৈশাদৃশ্যের স্রষ্টাকে বৈশাদৃশ্য দূর করতে সাহায্য করার প্রয়াসে, ধ্বংসযজ্ঞের যে হোলি খেলায় সবাই মেতেছে তাতে তারা প্রকারান্তে বিশ্বনিয়ন্তার শক্তিকে খাটো করে দেখছে!
কিন্তু কে বলবে সে কথা! বিধাতার সৃষ্টির রহস্য বোধহয় এখানেই!
জংলী মেয়েটি সামগ্রিক বিবেচনায় দেখতে যতই কুৎসিত হোক না কেন, বিধাতা প্রদত্ত চেহারায় রুক্ষ চুলে একটা জংলী ফুল গুজে ঝরনার জলে নিজের প্রতিচ্ছবীটা দেখে আনন্দে মনটা ভরিয়ে তোলে। নিজের চেহারাকে কদর্য ভেবে কেউ যদি তা থেকে মুক্তি পেতে চায়, তাহলে হয় তাকে আশে পাশের অন্য সকল ভালো চেহারার মানুষগুলোকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে, নয়তো নিজেকেই ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু সেটা না করে বিধাতা প্রদত্ত চেহারাটাকেই ঘসে মেজে সুন্দর করে অপরের কিছু প্রশংসা অর্জনের মধ্যেই সকলের যেন শান্তি।
সাদা বকের বাচ্চাটা দেখতে যতোই শ্বেত শুভ্র হোক আর তা দেখে পুরো বিশ্বের চোখ জুড়োক, তাতে কালো কাকের কিচ্ছু আসে যায় না। কাক তার কালো কুচকুচে বাচ্চাটাকেই বুকে জড়াতে পারলে ওর দেহ মন জুড়িয়ে যায়।

কি অপূর্ব দান বিধাতার!
তাহলে তো বিধাতায় চায়- একটাই ট্রেন কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কামরা, আবার কামরায় কামরায় বৈশাদৃশ্য আর বৈষম্য।
বিধাতার সৃষ্টি বৈচিত্রময় কামরা আর কামরার মানুষ আর তাদের কার্য্যকলাপ দেখতে দেখতে অনেক পথ পেরিয়ে অবনী উঠে এসেছে সবথেকে উঁচু পাহাড়ের চুড়ায়। এখানে আকাশের মেঘ মাটি চুম্বন করে। এটা যেন মহামিলনের মহাসম্মেলনের স্থল।
যা কিছু পৃথিবী তার সবকিছু নিচে, আর মাথার উপর অনন্ত উদার মহাশূন্য। আর সবার উপরে আকাশ। পৃথিবী কত বৈচিত্রে ভরা, পাহাড়, সমতল মরু, শ্যামল সবুজ, নদী সমুদ্র। কিন্তু আকাশটা একই রকম।
পাহাড়ের চুড়ায় হীমশীতল, আবার গোড়ায় গা’পোড়ানো গরম। মেরুতে জমা বরফ আর মরুতে জ্বলন্ত রোদ। গরমে প্রকৃতির শীতল বাতাস দেহে লাগানোর জন্য তা যথাসম্ভব খালি রাখতে হয়। আর শীতে প্রকৃতির শীতল বাতাস থেকে দেহকে বাচানোর জন্য আপদমস্তক যথাসম্ভব ঢাকতে হয়। বৈচিত্রে ভরা প্রকৃতি মানুষ ও প্রাণীকেও বৈচিত্রময় করে তুলেছে।
কিন্তু আকাশটা একই রকম! ভেদাভেদে যেন ও বিশ্বাসী নয়। এ যেন মানুষের বাহ্যিক বৈষাদৃশ্য চেহারার আড়ালে ভিতরকার অভিন্ন বিন্যাসের মত।
এ উচ্চতা থেকে নিচে তাকিয়ে যা কিছু দেখা যায়, তাতে মনে হয় বিশ্ব যেন মহানিয়ন্তার বৈশাদৃশ্যের এক মহাসমারোহ। সেই পৃথিবীতে আমাদের বাস। আর উপরে বিশাল সুদৃশ্য আকাশ, সেখানে কেবল বিশ্ব নিয়ন্তা আর কেবল তাঁরই আজ্ঞাবাহক দেবতাদের বাস।
মাটির পৃথিবীতে মাটির তৈরী মানুষের দেহ থেকেতো মাটির গন্ধ বেরোবেই। মর্তের বাসিন্দা হয়ে একে অপরের সে গন্ধ সহ্য করেইতো বসবাস করতে হবে। বিধাতার সৃষ্টির এ রহস্যের কাছে মাটির মানুষ কত অসহায়!
মাটির গন্ধমাখা শরীর বিধাতার সান্নিধ্যের জন্য মানানসই নয়। তায়তো তাঁর সান্নিধ্যে যেতে হলে মাটির গন্ধমাখা শরীরটাকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে যার যার সাধ্যানুযায়ী। ওখানে পৌছাতে হলে যা কিছু পার্থিব গন্ধ মাখা তার সব কিছুই ত্যাগ করতে হবে।
মর্ত ও স্বর্গের এই সন্ধিক্ষনে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বুক ভরে একটা নিশ্বাস টানলো অবনী।
তারপর বৈচিত্রময় পৃথিবীর দিকে তাকালো।
-পৃথিবীর সব মানুষকে যদি এই উচ্চতাই এনে আকাশ আর পৃথিবীটাকে দেখানো যেত।
স্ফিত বুকে ভাবলো অবনী।