জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'প্রকৃতির বিচার'।

আপডেট: ৩০ মে ২০২৩, ১৫:৫৩

প্রকৃতির বিচার

 

বাড়িতে পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা লেগে গেল। প্রায় দু বছর পর আসা। ঘরগুলো তালা বদ্ধ থাকে। এসেই মেরু মিয়ার সাহায্য নিয়ে বিছানা একটু ঝাড়া ঝুড়ো করে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে বেশ রাত হল। তারপর বিছানায় গাটা এলিয়ে দিতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

এটা আমার পিতৃপুরুষের ভিটা। আমার ছেলেবেলার পুরোটা লুকিয়ে আছে এর আনাচে কানাচে। দূর শহরে সংসার পাতলেও সময় পেলেই চলে আসি। কিন্তু এবার দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরে থাকাই আস্তে এত এত দেরী হল।
মেরু মিয়াই ডেকে উঠাল সকালে। সকাল মানে প্রায় আটটা।

মেরু মিয়ার বয়স আশি ছাড়িয়েছে। ছোট বয়স থেকেই মেরু মিয়া আমাদের এখানে থাকে। বাবা ওকে পাহাড়ের কোন এক অঞ্চল থেকে এনেছিলেন, ওর বয়স তখন দশ পনের। আমার জন্মের সময় বলা চলে। ছোটকালে মেরু মিয়া আমাকে কোলে পিঠে নিয়েছে। সে ভাবেই আমার উপর ওর অনেক অধিকার, যেটা আমার প্রতি ওর আচার আচরনে বোঝা যায়।
-খোকা উঠে পড়, আর কত ঘুমাবে।
কেন জানি বাড়ীতে আসলে আমার ভাল ঘুম হয়। মেরু মিয়া আমাকে ডেকে উঠিয়েছে, না হলে কখন ঘুম ভাঙ্গত কে জানে?

চার দিকে প্রায় পাচ ফুটের মত উচু প্রশস্ত বারান্দা ঘেরা দোতলা বাড়ী আমাদের। দাদুর আমলে তৈরী হলেও ঠিকঠাক মত রক্ষণাবেক্ষণ করাতে বেশ ভাল অবস্থায় আছে।
বাড়ী আসলে আমি দোতলার একটা রুমে থাকি। হাত মুখ ধুয়ে নেমে উত্তর মুখী বাড়ীটার পশ্চিম পাশের বারান্দায় এসে বসলাম। প্রায় এক একর জমির উপর পাচিল ঘেরা বাড়ীর আঙ্গিনা, সবুজ ঘাসের লনের মাঝে পরিকল্পনা করে লাগানো বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ।

আকাশটা মুখ ভার করে আছে, রাতে বোধহয় একটু বৃষ্টিও হয়েছে, টের পায়নি।
প্রকৃতি নির্ভর মানুষের ভাবনা, চাল চলন। প্রকৃতির সাথে মানুষের দেহ মনের সরাসরি একটা সম্পর্ক আছে। মনটা কেন জানি ভাল না।
পিছনের বাউন্ডারি দেয়ালের ওপাশের বাড়ীর একটা গাছের ডাল পাচিল টপকে আমার বাড়ীর আঙ্গিনায় অনেক খানি প্রবেশ করাতে রোদের অভাবে সে পাশটা স্যাতস্যেতে হয়ে আছে। ডালটা বাউন্ডারি পাচিলের উপর ঠেস দিয়ে থাকাতে দিনে দিনে ডালের ভরে পাচিলটাও খানিকটা ফেটে গিয়েছে।
আগে তেমন ভাবে চোখে পড়িনি। সকালে বারান্দায় বসে সেদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।

-খোকা, কত করে বলেছি খালেক, ওর বঊ আর ছেলেটাকে, ডালটা কেটে নেয়ার জন্য কিন্তু কিছুতেই কাটল না। এখন দেখ কি অবস্থা।
টেবিলে নাস্তা রাখতে রাখতে মেরু মিয়া বলল।
-খালেক বলে, ডাল নিজের থেকে পাচিল টপকালে আমি কি করব? আর ছেলেটাও হয়েছে বাপের মত, বলে পারলে কেটে দেন না কেন?
খালেক আমার চাচার ছেলে, বয়সে আমার থেকে অনেক ছোট। পাচিলের ওধারে ওর বাড়ী। আমি বাবার একমাত্র ছেলে হিসেবে এক একর ভিটে জমির পুরোটাই আমার। কিন্তু ওরা পাচ ভাই তাই ওদের বাড়ীর জমিগুলো ছোট ছোট।
পাচ ভায়ের মধ্যে খালেক একটু খারাপ প্রকৃতির। তেমন কিছু করে না, এক দলিল লেখকের সাথে কাজ করতে করতে নিজেও দলিল লেখক হয়েছে। তাও নিয়মিত কাজ কর্ম করে না।
ওর চার ছেলে মেয়ে, বড় মেয়েটা কয়েক বছর হল ম্যাট্রিক পাশ করে বাড়ীতে বসে আছে। বিয়ে দিতে পারিনি এখনো। বড় ছেলেটাও এক বছর হল ম্যাট্রিক পাশ করেছে। আর নাকি পড়তে চায় না ছেলেটা। পিঠাপিঠি বাকি দুটো ছেলে হাই স্কুলে পড়ে।
মেয়েটার ভাল জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা করা আর ছেলেটার একটা চাকরীর ব্যাপারে খালেক আমাকে বলেছে, তা আমার মনে আছে।

খালেকের এহেন আচরনে মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।
ও যে অন্যায় আচরন আমার সাথে করছে সেটা বোঝার জন্য মাপামাপি বা বিচার বিবেচনার দরকার নেই। বিষয়টা একেবারে চাক্ষুষ।
নাস্তা সেরে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে সব কথায় ভাবছিলাম। এরই মধ্যে আবার কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে খেয়াল করিনি। হটাৎ বিদ্যুৎ চমকে বিকট ভাবে মেঘের গর্জনে সম্বিত ফিরে পেলাম।
কোথাও বোধহয় বাজ পড়ল। আজকাল বাজ পড়ে অনেক কৃষকের প্রাণহানির কথা শোনা যায়।
খুব ভারী বৃষ্টি হচ্ছে, দেখতে দেখতে বাড়ীর চারপাশে পানি জমে যেতে লাগলো।
বৃষ্টি আমার খুব পছন্দ। বৃষ্টির সাথে সৃষ্টি কর্তার একটা সরাসরি যোগাযোগ আছে বলে আমার কাছে অনুভুত হয়। কিন্তু আজ কেন জানিনা বৃষ্টিটা ঠিক মত উপভোগ করতে পারছি না। মনটা কিছুতেই ভাল করতে পারছি না। কোথায় যেন কিছু একটা মনের স্বতঃস্ফূর্ততাকে টেনে ধরে রেখেছে।
সেটাই ভাবছিলাম। হটাৎ করে খালেকের বাড়ীর দিক থেকে মেয়ে গলাই কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগলো।
-কি হল? আর কোথা থেকেই বা কান্নার শব্দটা আসছে? তা খেয়াল করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
সামনের গেটে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ হতেই সেদিকে নজর গেল। ছাতা মাথায় মেরু মিয়া ঢুকছে।
অনেক দিন মেইন গেটটা খোলা হয়না, বন্দই থাকে, আমি আসলে মেইন গেটটা খোলা হয় তাই জং পড়েছে। মেরু মিয়া দেয়ালের এক কোনে একটা পকেট গেট দিয়ে যাতায়াত করে। বাড়ীতে আসলে প্রতিবার এরকম হয়। আমি সপ্তাহ খানেক থাকা অবস্থায় মেরু মিয়া গেটটা খোলা বন্দ করে তেল লাগালে ওটা আর শব্দ করে না।
শব্দটা খুব কর্কশ লাগলো কানে।
-খোকা, মাঠে বাজ পড়ে খালেকের হালের একটা গরু মারা গিয়েছে, চাষির অবস্থাও ভাল না, তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে।
মেরু মিয়ার কথায় বুঝলাম খালেকের বউটা সে জন্যই কাঁদছে।
-অনেক কষ্টে খালেক হালের গরু দুটো কিনেছে কিছু দিন হল, নিজে তদারকি করে চাষি দিয়ে চাষ করাবে বলে। ওর খুব ক্ষতি হয়ে গেল। এখন কি করবে কে জানে?
ছাতাটা বন্দ করে বারান্দার দেয়ালে হেলান দিয়ে বসতে বসতে কথাগুলো বলল মেরু মিয়া।
-ওপাড়ার বদর বিশ্বাস সেখানে উপস্থিত ছিল, সেই রাগে গরগর করতে করতে বলছিল –ওকে তো কেউ কিছু করতে পারবে না, তাই এটা আল্লার বিচার। বদর বিশ্বাসের জমির অনেক খানি নাকি খালেক টাকা খেয়ে অন্যের নামে রেস্ট্রি করে দিয়েছে তাই খালেকের উপর তার রাগ।
আমি অবাক হয়ে শুনছি মেরু মিয়ার কথা। তার অঙ্গ ভঙ্গিমায় বোঝা যায় খালেকের এই ক্ষতি হওয়াতে সেও খুব একটা দুঃখ পায়নি।
-সেদিন বদরের স্ত্রীও এমনি ভাবেই কেঁদেছিল।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে মেরু মিয়ার কথা শুনছিলাম।

হটাৎ করে মড়মড় শব্দে আমারা দুজনই চোখ তুলে তাকালাম।
খালেকের গাছের যে ডালটা আমার বাড়ীর আঙিনায় ঢুকেছিল সেটা গোড়া থেকে ভেঙ্গে পড়ল।
ফাকা লনের ওই দিকটা খালেকের গাছের ডাল ঢুকে ছায়া হয়ে থাকতো আর তার নিচে কোন কিছুই জন্মাত না। ডাল ভেঙ্গে পড়ে ওই পাশ থেকে অন্ধকার কেটে গেল।
সমানে বৃষ্টি ঝরছে। আমরা দুজনই সেদিকে তাকিয়ে দেখছি। ভাবছি, কি হল?

একটু পরে বৃষ্টি থামল। আকাশটাও পরিষ্কার হয়ে রোদ উঠল। আমার লনের ওপাশটা কত বছর পর রোদ পেয়ে যেন ঝলমল করে উঠলো।
-প্রকৃতির বিচার!
মেরু মিয়ার কথায় তাকালাম ওর দিকে।
-কোনটাকে প্রকৃতির বিচার বলছে মেরু মিয়া! বাজ পড়ে খালেকের হালের বলদ মারা যাওয়াটা, না ওর গাছের ডাল আমার যায়গার ভিতর ঢুকে যাওয়াটা, নাকি ঝড়ে ডালটা ভেঙ্গে পড়াটা? নিরপেক্ষ বিচারে সবগুলোই প্রকৃতির কাজ।
-বদর বিশ্বাসের জমি অন্যের নামে রেকর্ড করাটা অন্যায় সেটা ঠিক, কিন্তু তার জন্য ওর হালের গরুটার জীবন যাওয়া, সাথে কৃষকের আহত হওয়াটা কি প্রকৃতির বিচার? সর্বোপরি খালেকের চাষের ক্ষতি হওয়াতে ওর পরিবার যে কষ্ট পাবে সে বিষয়ের ব্যাখ্যা কি?
কথা গুলো ভাবতেই মনের ভিতর কষ্ট অনুভব করলাম।
-খালেকের গাছের ডাল পাচিল টপকিয়ে আমার সীমানায় প্রবেশ করেছে, ফলে সেই জায়গাটাতে রোদ পড়ছে না, তাতে আমার কি তেমন কোন ক্ষতি হচ্ছে! কয়েক বছর আগে ব্যাপারটা আমার নজরে আসলে মেরু মিয়াকে বলেছিলাম –ঠিক আছে, এর জন্য তো খালেক দায়ী না আর আমাদের তেমন কোন ক্ষতিও হচ্ছে না। বললে নিশ্চয় খালেক ও ডাল কেটে নেবে।
কিন্তু আজ সকালে যে মুহূর্তে মেরু মিয়া সেটা আমার নজরে এনে খালেক কে দোষারোপ করল তখন থেকে মনে হতে লাগলো খালেক আমার উপর সত্যিই অন্যায় করছে। মেরু মিয়া বারবার বলার পরও ডালটা কেটে নেয়নি খালেক।
বুঝতে পারলাম সে জন্যই তখন থেকে মনটা খারাপ হয়ে আছে।

মেরু মিয়াকে নিয়ে খালেকের বাড়ীতে ঢুকতেই দেখি খালেক ওর টিনের চালা ঘরের বারান্দায় একটা খুটির সাথে হেলান দিয়ে বসা। গা মাথা ভেজা, পরনের লুঙ্গি গেঞ্জিও ভেজা। পাশেই গোয়ালে অন্য গরুটাকে ওর বড় মেয়েটা খড় খেতে দিচ্ছে। দেখলাম মেয়েটা বড় হয়েছে, ওর বিয়ের বয়স হয়েছে। বুঝলাম খালেক এই মেয়েটার বিয়ের কথা বলেছিল।
ঘরের ভিতর থেকে ওর বউয়ের কান্নার আওয়াজটা আসছে তবে স্বরটা আগের থেকে ক্ষীণ।
আমাকে দেখে খালেক অবাক হল, হওয়ারই কথা, কারন আমি বাড়িতে আসলে ও নিজে গিয়ে দেখা করে আসে, আমি কখনো আসিনা ওর বাড়ীতে।
আমাকে দেখে উঠে দাড়িয়ে ঘাড়ের গামছা দিয়ে গা মাথা মুছতে মুছতে ডুকরে কেঁদে উঠল খালেক।
-বদর চাচা ঠিকই বলেছে ‘এটা আল্লার বিচার’। না হলে আমার এ ক্ষতি হবে কেন?
কথাটা বলে কাঁদতে লাগলো খালেক। আমি কাছে যেয়ে ওর মাথায় হাত রাখলাম।
ততোক্ষণে ওর মেয়েটা বারান্দায় একটা মাদুর বিছিয়ে দিল।
খালেকের পাশে পা ঝুলিয়ে বসলাম পাশাপাশি।
-মিয়া ভাই, আমি তোমারও ক্ষতি করেছি। সেটার বিচারও প্রকৃতি করেছে।
অনুশোচনায় কাঁদতে লাগলো খালেক।
ততোক্ষণে খালেকের বড় ছেলেটাও বাইরে থেকে ভেজা কাপড়ে আসলো। ওকে দেখে মনে হল এই ছেলেটার চাকরীর কথা বলেছিল খালেক। আমার আগমন টের পেয়ে কান্না থামিয়ে খালেকের বউ অন্য দুটো ছেলে সাথে করে বারান্দায় এসে দাড়াল।
উপরে মেঘমুক্ত আকাশ, গুমটে ভাবটা কেটে গিয়েছে। ডুবে যাওয়ার আগে পশ্চিম দিগন্তে বৃষ্টি ধোয়া সূর্য কিরণ গাছের ফাঁক ফোকড় দিয়ে খালেকের আঙ্গিনাকে যেন চুম্বন করছে। আর গাছের সবুজ পাতার উপর সে কিরণ পড়ে চক চক করছে।
মনে হল আমার সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব তা দিয়ে খালেক আর ওর পরিবারের পাশে দাঁড়ানো দরকার।