জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'শূন্য দিয়ে শুরু শূন্যতেই শেষ'। ।

আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২২, ১৫:০৬

শূন্য দিয়ে শুরু শূন্যতেই শেষ

 

জঙ্গলের বুক চিরে রাস্তাটা চলেছে। কাঁকরে ভরা রাঙা মাটির রাস্তাটি জঙ্গলে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত বসবাসরত মানুষের একমাত্র চলালের উপায়।
এ রাস্তার ধার ঘেঁসেই কিছুটা ফাকা জায়গা আর একটি মাত্র দোকান। লৌহকারের দোকান সেটা। লোহা পুড়িয়ে দা কাচি খোন্তা বল্লম বানায় আবার সেগুলো ধার বা মেরামত করারও কাজ হয় সেখানে।
সাপ্তাহিক হাটের দিনে ফাঁকা জায়গাতে মানুষ জন তাদের আঙিনাতে ফলানো শাক সবজি সহ নানা পসার নিয়ে বসে।
ছনের ছাউনি দেয়া দোচালা লৌহকারের দোকানের ছোট্ট একটা অংশে অল্প বয়সী একটা ছেলে নিম আর লেবু পাতা দিয়ে চা তৈরী করে। বৃদ্ধ বয়সী লৌহকারের নাতি বলে সবাই জানে ওকে। এখানে যারা দা কাচি খোন্তা বানাতে বা ধারাতে আসে ওরাই চা খায়। এর জন্য বাড়তি কোন পয়সা দিতে হয় না কাউকে।
আমি লৌহকারের দোকানে বসে নিম পাতার চা খাচ্ছি। না, কামারের কাছ থেকে কোন কিছু বানানোর জন্য বসে নেই, এমনিতেই বসেছি। আর বসে বসে কিই বা করবো তাই নিম পাতার চায়ে চুমুক দিচ্ছি।
কদাচিৎ দু একটা মোটর সাইকেল আর টম টম গাড়ী যাচ্ছে রাস্তা ধরে। তাতেই মনে করিয়ে দিচ্ছে এটা একদম জনমাননহীন জায়গা না।
চায়ে চুমক দিতে দিতে দেখছি দূর থেকে আসা কোন গাড়ীর শব্দ পেয়েই দোকানের উল্টো দিকে শুয়ে শুয়ে একটা কুকুর কান খাড়া করছে আর গাড়ীটা পার হওয়ার সময় ঘেউ ঘেউ করে সেটাকে তাড়া করে কিছু দূর অব্দি গিয়ে আবার ফিরে এসে নিজ জায়গায় শুয়ে বা দাঁড়িয়ে বাকি সময় কাটাচ্ছে।
-ওটা কি তোমার কুকুর?
জিজ্ঞেস করলাম লৌহকারকে।
কাজ থেকে মুখ না উঠিয়েই মাথা নাড়াল, কিন্তু হ্যাঁ না ঠিক বুঝলাম না।
কুকুরটার কথা ভাবছি, কোন কাজ না থাকলে যা হয়। কিছু একটা করে সময় কাটানো। আমারও কিছু করার নেই, তাই আমিও নিম পাতার চা চুমুক দিতে দিতে অবিরাম নির্জনতা ভঙ্গ করে লৌহকারের হাপর টেনে বাতাস দিয়ে জ্বালানো গন গনে আগুনে লাল হয়ে যাওয়া লোহা পিটানোর শব্দ শুনে, আর মাঝে মধ্যে কুকুরটির অযথা দৌড়াদৌড়ি দেখে দেখে সময় কাটাচ্ছি।
দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেল। লৌহকার তার কাজে একটু বিরতি দিয়ে একটা টিনের গামলায় রাখা কিছু খাবার লোহার ভাঙ্গা একটা কড়ায়ের উপর ঢেলে দিয়ে ওই হাপরের আগুনেই গরম করে নিল।
ছেলেটা পাশের ঝরনা থেকে চারটে টিনের প্লেট ধুয়ে এনে দোকানের মধ্যে এক পাশে একটা শীতল পাটি বিছিয়ে তার উপর সাজিয়ে রাখল।
লৌহকার কড়ায়ে গরম করা খাবার এনে পাটির উপর রেখে আসন গেঁড়ে বসলো।
সে প্লেটে খাবার পরিবেশন করতে করতেই ছেলেটা এসে বসলো।
আমি সেদিকে তাকিয়ে দেখছি।
তখনি কুকুরটাও এসে পা গুলো বুকের নিচে ভাঁজ করে ছেলেটার পাশেই বসলো।
লৌহকারের হাতুড়ের বাড়ির ঠুক ঠুকানি আর রাস্তা দিয়ে চলা কোন গাড়ীর আওয়াজ না থাকাতে এই দিন দুপুরে এলাকাটা একদম শুনসান নীরবতায় ডুবে গেল।
আমি এতক্ষণ বসে আছি কিন্তু বৃদ্ধ বয়সী লৌহকার বা ওই ছেলেটা কেউই আমি কেন এসেছি বা কোথায় যাব এ সব কোন ব্যাপারেই কিছু জিজ্ঞেস করল না।
একটু আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এখানে সকলেরই আলাদা আলাদা কাজ ছিল, ব্যস্ততা ছিল। কিন্তু এখন শারীরিক তাড়না তাদের সকলকে খাবার থালার চারপাশে এক স্থানে এনে জড় করল।
ভাবছি জনপদ থেকে অনেক দূরে এই গভীর জঙ্গলেও মানুষ পশু কারোরি সময় কাটানোর উছিলার কোন ঘাটতি নেই। সভ্য জগতের মানুষ যখন বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপায় উদ্ভাবন করে মানুষ ও প্রাণীর জীবন ধারনের নানা উপায় বের করতে ব্যস্ত সে সময় এই জন বিচ্ছিন্ন গভীর জঙ্গলে মানুষ বা পশুর কাজের কোন ঘাটতি নেই। জীবন এখানেও স্বাভাবিক গতিতে চলছে।
আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বৃদ্ধ লৌহকার ওর গলাটা একটু পরিষ্কার করে নেয়ার ছলে একটু শব্দ করতেই আমার মনোযোগ সেদিকে আকর্ষিত হল।
দৃষ্টি বিনিময় হল। সবাই ওরা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কেউ খাবার শুরু করেনি। তিনটে থালা তিন জনের সামনে আর একটা থালা খালি।
সবার মুখের উপর হাসির ঝলক বয়ে যাচ্ছে।

গত পরশু এ সময়ের কিছু আগে অর্থাৎ বেশ সকালে নিজের সব উপার্জন ছেড়ে নিজের বলতে যাদেরকে বুঝাই তার সবাইকে ছেড়ে রেল স্টেশানে এসে প্রায় চলতে শুরু করা একটা ট্রেনে উঠে নিরুদ্দেশ যাত্রা করে আজ সকালে একটা নাম না জানা স্টেশানে নেমে একটা টেম্পু ধরে এখানে এসে নেমেছি।

আমার দুটো ছেলে আলাল আর দুলাল। ওরা বড় হয়েছে সংসারও আলাদা। আমি মুখে মুখে দুভায়ের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে দিয়েছিলাম নিয়ম অনুযায়ী।
দু ছেলের পাশা পাশি বাড়ী। মা ছোট ছেলের সংসারে আর আমি বড় ছেলের সংসারে থাকতাম। আগের দিন রাতে আমার স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে।
মায়ের অসুস্থতার বিষয়টি ছোট ছেলে আর তার পরিবার গোপন রেখেছিল। ওদিন গভীর রাতে মা মারা যাওয়ার পর সকালে ওরা সবাইকে খবরটা জানিয়েছে।
বেশ সকালে আলাল আর দুলালের উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটিতে মহল্লার লোকজন জড় হওয়ার পর আমি স্ত্রী বিয়োগের কথা জানতে পারলাম।
দুভায়ের কথা কাটাকাটির কারণ হচ্ছে- ছোট ভাই নাকি মা মরার আগে জোর করে তার হাতের বৃদ্ধ আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে মায়ের ভাগের সব সম্পত্তি লিখে নিয়েছে।
ছোট ভাই যদিও প্রতিবাদ করে তা অস্বীকার করে -মা নিজের ইচ্ছাই ওকে সব লিখে দিয়েছে বলে দাবী করতে লাগলো। কিন্তু বড়টা তা মানতে রাজী নয়।
মায়ের লাস পাশে পড়ে রইল। আমাকে দেখে দুভাই তেড়ে এসে মায়ের মৃত্যু নিয়ে পাল্টাপাল্টি নালিশ করতে শুরু করে দিল।
ঘটনা দৃষ্টিতে আমি দুপায়ের জোর হারিয়ে স্ত্রীর লাশের পাশে ধপ করে বসে পড়লাম।
মা ছোট ছেলেকে সম্পত্তি নিজের ইচ্ছাই স্বজ্ঞানে লিখে দিয়েছে বলে ছোট ভাই উচ্চস্বরে দাবী করেই চলেছে আর বড় ভাই তার প্রতিবাদ করছে।
মায়ের লাসের সামনেই দুভাই ঠেলাঠেলি হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল।
তা দেখে আমার মরে যেতে ইচ্ছে হল। অনেক কষ্টে অর্জিত সম্পত্তির মত নিজের জীবনের উপরও ঘৃণা এসে গেল।
আমি জ্ঞান হারিয়ে স্ত্রীর লাসের পাশেই মেঝেতে ধপ করে শুয়ে পড়লাম।

এ ব্যাপারটিতেও মানুষ খুব অসহায়! চাইলেই দেহ ত্যাগ করা যায়না।
কতক্ষণ এভাবে ছিলাম ঠিক জানি না। তার পর কি হল কি ভাবে ওরা মায়ের লাস দাফন কাফন করল তার কিছুই আমি টের পায়নি।
পরদিন যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি নিজেকে শহরের সরকারী হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করলাম।
রাত তখন গভীর, বাইরে রাস্তাই ল্যাম্প পোষ্টে লাইট গুলো জ্বলছিল।
রুমের মধ্যে অন্যান্য কিছু রোগীর নড়া চড়া ছাড়া আর কিছুই চোখ পড়ল না।
আগের দিন ঘটে যাওয়া সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
মনে হল দুনিয়াই আমি কেবল একা। আপন বলতে কেউ নেই আমার। স্ত্রীর মৃত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই চোখ দুটো অশ্রুতে ভরে গেল।
কিছুক্ষণ নিরবে অশ্রু সংবরণ করে ভোর হতেই আমি বেরিয়ে পড়েছিলাম।

কুকুরের ঘেউ করে ওঠা শব্দে আমি সম্বিত ফিরে পেয়ে সেদিকে তাকালাম।
কেউই খেতে শুরু করেনি, এমনকি কুকুরটাও না!
ভাবলাম -মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা প্রাণীরাও বোঝে নাকি!
আমি নিঃশব্দে কুকুরটির পাশে পাতা খালি থালাটা সামনে করে আসন গেঁড়ে বসলাম।
সবাই বিনা বাক্যে খেতে শুরু করলো।
আমিও খাবার থালাতে হাত লাগালাম। কিন্তু কিছুতেই খাবার মুখে তুলতে পারছিলাম না। অঝরে অশ্রু ঝরে তার দু চোয়াল ভিজে যেতে লাগলো।
-এখানে আমরা সবাই অনাথ।
বৃদ্ধ লৌহকার পরিষ্কার উচ্চরনে কথা বলতে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে তাকালাম তার দিকে।
-আমি এখানে প্রায় দশ বছর। সব ফেলে সবাইকে ছেড়ে এখানে এসেছিলাম। ছেলেটির বয়স প্রায় বার বছর। যে স্টেশানে আপনি নেমেছেন আমিও একদিন ওখানেই নেমেছিলাম। আর সেখানেই এই ছেলেটিকে কুড়িয়ে পায়।
স্টেশানে এক রাত ঘুমিয়েছিলাম। ওখান থেকেই কুকুরটা আমার পিছু নেয়। ও বুঝেছিল ওর মত আমাদেরও কোনও ঠিকানা নেই। সকলের মত ওরও বোধহয় একদিন কোন ঠিকানা ছিল। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় ও রাস্তার কুকুরদের মত না।
লৌহকার একটু থামল, একগাল ভাত মুখে দিয়ে চিবালো কিছুক্ষণ।
-সবারই বলার মত একটা অতীত আছে, আমাদের মত বলার ক্ষমতা থাকলে কুকুরটাও সে কথা বলত। খোকার বলার ক্ষমতা থাকলেও ওর বলার মত কোন স্মৃতি নেই। কারণ আমার সাথেই ও গত দশ বছর ধরে এখানে।
-এখন আমাদের আর কিছু হারানোর কোন ভয় নেই, কি বল?
-এই জঙ্গলের মধ্যেই পুরনো একটা পড়ো বাড়ী আছে। এককালে ওটা কোন এক জমিদারের বাগান বাড়ী ছিল। জমিদার মাঝে মধ্যে শিকারে আসলে লোক লস্কর পাইক পেয়াদা নিয়ে থাকতেন কিছু দিন। জমিদারের কোন বংশধর আর এদেশ নেই। আমরা রাতে ওখানেই ঘুমাই।
-আমারা তিনটি প্রাণী বাদে ওটা পোকা মাকড়ের অভয়ারান্য। আমাদের কাছ থেকে এই শরীর আর তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবনটা বাদে কেড়ে নেয়ার মত আর কিছু নেই। তাইতো কোন চোর ডাকাত তাদের সময়ের অপচয় করে না। আর এই জীবন! সেটা তো একদিন চলে যাবেই সে সুরম্য অট্টালিকায় থাকলেও যাবে।
মুখের খাবার গুলো চিবাতে চিবাতে বৃদ্ধ বয়সী লৌহকার মৃদু হেসে কথা বলছিল।
-বরাদ্দকৃত সময় কাটিয়ে শেষ করাই হল জীবন। যে ভাবেই হোক সময় কেটে যায়। আর সময় শেষে সব শূন্য। আমরা সবাই সেই শূন্যের দিকে সারাক্ষণ এগোচ্ছি। যার যত টুকু বাকি আছে সেটুকু না হয় এক সাথে এগোয়।
-কত হিসেব করলাম, কত কিছু দেখলাম কিন্তু বুঝলাম শূন্যতে শুরু শূন্যতেই শেষ।
বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাওয়া নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা চাপা নিঃশ্বাস টেনে কথাটা বলল লৌহকার।