জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'অম্বরাবনী' ৭ম পর্ব।

আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২২, ১৫:২৬

অম্বরাবনী- ৭ 

 

মমতাময়ী সিষ্টার রবিনসনের কথা মনে হতেই সেদিন অবনী মনে সাহস ফিরে পেয়ে
ইণ্টারভিউ বোর্ডের সবার মত করে অবনীও একটু হাসলো।
প্রথমত ওর ডান কপালের কাটা দাগটা সকলের চোখে পড়ল, তারপর ২৯ ফেব্রুয়ারির মত একটা অদ্ভুত জন্ম তারিখের কথা শুনে মিশেল বাদে বোর্ডের অন্যান্যদের মুখে মুচকি হাসির ঝলক বয়ে যাচ্ছিলো তখন অবনীর চোখে মুখেও হাসি ফুটল। তবে ও হাসলো সবার মাথার উপর দিয়ে দেখা যাওয়া জানালার পাশে নীরবে দাড়িয়ে থাকা গাছের ডালগুলোর ভিতর দিয়ে ভাবলেশহীন নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে।
সবাই অবাক হলো, একটু অপ্রস্তুতও বটে।
অবশেষে সব থেকে বেশী অবাক হলো অবনী নিজে, যখন ওর চাকরীটা হলো। পরে জেনেছিল মিসেল ওকে বিশেষ পছন্দ করায় ওর চাকরীটা হয়েছে।
বছর তিনেক কাজ করল মিসেলের সাথে। মিসেলের সঙ্গে কাজ করতে খুব ভাল লাগতো অবনীর। ও বলতো শুধু মাথা খাটিয়ে কাজ করলে চলবে না মাথার সাথে হৃদয়টাও লাগাতে হবে।
তারপর ঐ মিসেল নুভেলনের সক্রিয় সহযোগিতায় অবনী জাতিসংঘে চাকরী পেয়ে আপনজন বলতে যা বুঝায় তার সব ফেলে সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিল।

জাতিসংঘে চাকরিটা হয়েছে কেবল, এ্যপোয়েণ্টমেণ্ট লেটার হাতে পেয়েছে কিন্তু তখনো যোগ দেয়নি অবনী। কত ভাবনা কত স্বপ্ন ওর মাথার ভিতর ঘুর পাক খাচ্ছে।
সবাইকে ছেড়ে যেতে হবে এই প্রসঙ্গটা মনে আসলেই মনটা কেমন যেন মরূভূমির মত শুন্য শুন্য লাগে অবনীর।
মাল্টিন্যশনাল কোম্পানীর চাকরী ওকে ওর আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব থেকে বেশ খানিকটা দুরে সরিয়ে এনেছে। প্রথমদিকে কিছুটা ভালো লেগেছিল ওর কাছে, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পেরে। কারণ এখানে জানা শোনা মানুষ নেই বললেই চলে।
কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে নিজেকে একা একা লাগতে শুরূ করলো। মনে হতে লাগলো ওর বোধহয় কোথাও কেউ নেই। যাহোক অন্যান্য কলিগদের সাথে নিজের একটা আলাদা জগত গড়ে তুলতে মনোস্থির করে ভালই ছিল।
আর এখনতো সব ছেড়ে, যাকে বলে সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে ওকে যেতে হবে। ভালো চাকরী অনেক ব্যস্ততা। সুখ দুঃখের সংমিশ্রিত একটা ভাবাবেগে ওর মনটা ভরা।

জাতিসংঘে চাকুরী নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার কয়েকদিন আগে অবনী ওর জিনিসপত্রগুলো গোজগাজ করতে ব্যস্ত। কোনটা কোনটা নেয়া দরকার আর কোনটা কোনটা বাদ দেয়া দরকার সেগুলো বাছাই করছিলো।
জিনিসপত্রের ভিতর চাপা পড়ে যাওয়া ওর পরদাদা অর্থাৎ ওর বাবার দাদার ছবিটা হটাৎ করেই অবনীর নজরে পড়লো।
তিনি মারা গিয়েছেন একশো বছরের উপর হয়েছে। তিনিই ওদের বংশের প্রতিষ্ঠাতা। সে সময়ে সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, বৃটিশদের বিভিন্ন অন্যায়ের বিরূদ্ধে লড়াই করেছেন তিনি। সে সব সম্পর্কে কিছু বই পত্রও তিনি লিখেছিলেন। এসবের জন্য তাকে জেলও খাটতে হয়েছিল।
তখনকার দিনে সমাজের উপর যে অপসংস্কৃতির লোলুপ থাবা সবটা গ্রাস করছিলো তিনি সিংহের মত লড়ে সে অভিশাপ থেকে সমাজকে রক্ষা করেছিলেন।
কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় যে, এই মহতীপ্রাণ মানুষটির কীর্তিকে বাচিয়ে রাখার জন্য বংশের কেউই উদ্যোগী হয়নি। অনেকে মন্তব্য করে, ঐ বংশের বর্তমান বেহাল অবস্থার অন্যতম কারণ এমন একজন মহাপ্রাণকে সমাদর না করা।
তাকে অবনী খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখে। দাদুর ছবিটা অনেকক্ষন ধরে দেখলো অবনী । এই মহতী প্রাণ মানুষটির কল্যানে সে প্রায় দুই শত বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী একটা বংশ পেয়েছে। গর্বে বুকটা ফুলে ওঠে।
আজ হটাৎ অবনীর মনে হতে লাগলো যে ওর নিজের চেহারার সাথে দাদুর চেহারার কোথায় যেন মিল আছে।
থাকবে না কেন? অবনীর ধমনীতেতো তারই রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। ভাবলো অবনী।
অবনী আনমনে নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখছিলো আর দাদুর ছবিটার দিকে তাকাচ্ছিলো। কিছু একটা পাওয়ার আভাসে মনটা যেন আনচান করছিল। কোথায় যেন দাদুর চেহারাটার মধ্যে ও লুকিয়ে আছে।
মানুষের মন, হয়তো এই মুহুর্তে একাকী হয়ে যাওয়া অবনী তার বংশের ঐ মহতীপ্রাণ মানুষটার সাথে নিজের সাফল্য কিছুটা ভাগাভাগি করে মনে মনে শান্তি পাচ্ছিলো।
ইতিপূর্বে কত বার ছবিটা দেখেছে অবনী। কিন্তু আজ অজানা কারণে মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলো।
মনে হল যেন ঐ ছবিটার মধ্যে নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে।
লম্বাটে মুখটা, মুখ ভর্তি খাট করে ছাঁটা দাড়ি। মাথায় ঘন লম্বা চুল, বাপাশ থেকে ডান দিকে পরিপাটি করে আচড়ানো। ডান দিকের কপালের প্রায় অর্ধেকটা চুল দিয়ে ঢাকা।
বেশ পরিপাটি। ছবিটা আজ কেন জানি ওকে কোন এক অজানা আবেগে উদ্বেলিত করে দিতে লাগলো। কি যেন আছে ঐ ছবিটার মধ্যে!
অবনী নিজের মুখটা ভালো করে খুটিয়ে খুটিয়ে আয়নায় দেখছিলো। দাদুর মত ওর চুলগুলো অত লম্বা না। তবুও তার মত হওয়ার একটা সাধ মনকে দেলা দিতে লাগলো। আনমনে নিজের চুলগুলো দাদুর মত করে আচড়ানোর চেষ্টা করলো।
ওর চুলগুলো দাদুর তুলনায় বেশ ছোট তায় ঠিক তার মত করে মাথাটা আচড়ানো গেল না। তবুও অবনী দাদুর মত করে চুলগুলো আচড়ালে ওর চেহারাটায় অন্য রকম মনে হতে লাগল।
অবনী হটাৎ করেই আবিস্কার করলো যে ওই টুকু লম্বা চুল দিয়েই ওর ডান কপালের পোড়া দাগটার অধিকাংশই ঢেকে যায়।
চমকে উঠলো অবনী। আবার চেষ্টা করলো। চুলগুলো একটু লম্বা করে দাদুর মত করে আচড়ে কপালটার উপর ধরে রাখতে পারলে দাগটা আর দেখা যাবে না। স্বাভাবিক ভাবেই ওর দাগটা ঢেকে যাবে।
আহ কি আবিস্কার! কি প্রশান্তি, কি মুক্তি!
আনন্দে অবনীর চোখ দুটো অশ্রুতে টলমল করে উঠলো।
কি যত্রনা! কি অসহনীয় লজ্জা কপালে নিয়ে এতদিন অবনী জীবনটা কাটাচ্ছিলো। যে ব্যথা, যে লজ্জা ঢাকা যায় না। যে যন্ত্রনা কারো সাথে ভাগাভাগি করে নেয়া যায় না। এমন একটা যন্ত্রনা নিয়ে অবনী এতদিন বেচে ছিল।
কতবার ভেবেছে ও -আহ জীবনটা যদি পুনরায় শুরূ করা যেত, একদম গোড়া থেকে। তাহলে জীবনের কিছু জিানস যা মানুষের সাধ্যের মধ্যে সেগুলো ও নিজের মত করে সাজিয়ে নিতে পারতো।
মানুষ কোন মহা অপরাধ করলেও তার সাজা তাকে একবারই ভোগ করতে হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকেও একবারই দন্ড ভোগ করতে হয়। কিন্তু একি ধরনের দন্ড বিধাতা ওকে দিল যা প্রতি মুহুর্তে সারাজীবন ওকে ভোগ করতে হবে!

বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথরের বোঝা নেমে গেল।
অবনীর দুচোখ বয়ে এমনিতেই অশ্রুর বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। এ বাধ ভাঙ্গা বন্যা, কোন কিছু দিয়েই একে রোধ করা যাবে না। রোধ করতে চায়ও না অবনী আজ। ওর বুকে জমে থাকা আজন্ম যন্ত্রনার বরফ আজ গলতে শুরূ করেছে।
ওর যন্ত্রনার এতটুকু ভার লাঘব করার মত কোন দরদী অবনীর মেলেনি। ওর এ অসহনীয় যন্ত্রনাটা প্রকাশ করার মত একটা মানুষও খুজে পায়নি। কিন্তু আজ হটাৎ করেই এই মৃত বিস্মৃতপ্রায় মানুষটি কোথা থেকে এসে ওর যন্ত্রনা লাঘবের মহোঔষধ নিয়ে আসলো। শত বছর আগে যে কর্মবীর তার লিখনী দিয়ে, বাগ্মীতা দিয়ে সমাজকে বাচিয়েছিলো। যে মহাপ্রাণ ওর বংশপিতা তিনিই এতকাল পর আবার আর্বিভূত হয়ে অবনীকে এক মহাযন্ত্রনা থেকে পরিত্রানের রাস্তা দেখালো!
অবনী অনেকক্ষন ধরে আপন মনে কাঁদলো। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদলো। বিধাতার উপর, ওর আপন জনদের উপর জমে থাকা যত অভিমান তা কেঁদে কেঁদে নিঃশ্বেষ করতে চায়লো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটো ফুলিয়ে ফেললো। আজন্ম জমে থাকা যন্ত্রনা গলে গলে চোখের অশ্রুজল হয়ে বেরূতে লাগলো। হৃদয়টা একেবারে খালি করে কাঁদলো অবনী।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার লজ্জা আর যন্ত্রনা ঢেকে ফেলার প্রয়াস পেলো অবনী। একটুও যেন ত্বর সহ্য হচ্ছে না ওর। সারাদিন রূমের মধ্যে বসে চুলগুলো টেনে লম্বা করে বারবার আচড়ালো।
কিছুদিনের মধ্যে চুলগুলো একটু বড় হতেই অবনী দাদুর মত করে চুল আচড়াতে শুরূ করে নিজেকে ভিন্ন আঙ্গিকে নতুন করে আবিষ্কারের আনন্দে মেতে উঠলো।
নিজেকে অনেক করে আয়নায় দেখলো অবনী। কৌতুহল সংবরনের জন্য নতুন অচেনা মুখের সন্মুখিন হয়ে পরীক্ষা করে দেখলো, কেউ আর অযথা অবনীর কপালের দিকে মোটেই তাকাচ্ছে না।
আহ এ যেন এক নতুন অবনী, অন্য সবার মত স্বাভাবিক একজন মানুষ।
এখন চেনা মুখ গুলোই কেবল ওর দিকে একটু অবাক হয়েই তাকায়। ওদের কাছে যেন অবনীকে অচেনা লাগে। তাও ভালো, এ আপনজনদের কাছে অচেনা হয়েও যদি ওর যন্ত্রনা লাঘব হয় তবে তায় হোক।
আহ কি শান্তি, কি স্বস্তি। অবনী এখন অন্য সবার মত একজন। সুন্দর হয়ে বাচার কি আনন্দ। প্রথিবীটা কত সুন্দর!

অনেক বছর পর হটাৎ করেই অরপার কথাটা মনে পড়লো অবনীর। মনে পড়লো ওর সুন্দর মুখখানির কথা। ভারী সুন্দরী ছিল ও।
অজান্তেই বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা একটা ব্যাথা দীর্ঘশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসলো।
কোথায় আছে অরপা কে জানে! বড়লোক বাবার মেধাবী কন্যা। পড়াশোনা শেষ করে এতদিনে হয়তো ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে বা বড় নামকরা কোন কলেজে অধ্যপনা করছে। উচ্চ শিক্ষার জন্য হয়তো বা বিদেশেও চলে যেতে পারে।
অরপা রূপ মেধা আর সামর্থের এক অনন্য সমাহার, ও প্রকৃতই অনন্যা নিরুপমা। ভাবলো অবনী।
কি বলতে চেয়েছিলো অরপা ওকে। ও কি অবনীকে ভালোলাগার কথা বলতে চেয়েছিলো। ওরকম আকাঙ্ক্ষিত ভাবে একটি সুন্দরী মেয়ের ডাক কি নিষ্ঠুর ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলো অবনী সেদিন! নিজেকে বড় বেমানান লাগতো অমন একটা সুন্দরীর পাশে।
এত বছর পর এই প্রথম কথাটা ভেবে দেখতে ইচ্ছা হলো অবনীর।
অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটি। এতদিনে হয়তো ওর সাথে মানানসই কোন মানুষের সাঙ্গে বিয়ে হয়েছে ওর। অরপার সাথে মানানসই হতে হলে শুধু মেধাবী হলেই চলবে না, সুন্দর চেহারা আর ভীষণ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হতে হবে।
চমৎকার একটা সংসার হবে ওদের। একে অপরকে ওরা বুঝবে, অন্তর দিয়ে ভালবাসা দিয়ে। সব কিছুকেই ভাগাভাগি করে সুখটুকু বহুগুনে বাড়িয়ে আর দুঃখটুকুকে একদম পদদলিত করে সামনে এগিয়ে যাবে ওরা হাতে হাত ধরে।
ওদের বাচ্চাগুলো দেখতে নিশ্চয় রাজপুত্র রাজকন্যার মত হবে। দুজনের সব ভালবাসা নিঙ্গড়িয়ে দিয়ে ওদেরকে মানুষের মত মানুষ করে তুলবে।
প্রকৃতই একটি স্বার্থক জীবন অতিবাহিত করবে ওরা।
ভাবনার জগতে ডুবে ছিল অবনী।
হটাৎ করে কলিং বেলটা বেজে উঠায় সম্বিৎ ফিরে পেল।