জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে ছোট গল্প 'শৃঙ্গে আরোহন'।

আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২২, ১৩:১৩

শৃঙ্গে আরোহণ

 

ছয়জন সহযাত্রী, পর্বত শৃঙ্গে ওঠার যাত্রায় প্রস্তুত।
সুউচ্চ শৃঙ্গ, যেখানে মাটির পৃথিবীর সাথে আকাশের মেঘের মিলন হয় সারাক্ষন, যেন মর্তের সাথে স্বর্গের মিলন। সেখানে ওঠার ইচ্ছে সবারই দুর্নিবার। স্বর্গালোকে আরোহণের সোপান সেখান থেকে শুরু।
ছোট কাল থেকেই সবাই সে শৃঙ্গের কথা, সেখানে উঠার অনিবার্যতা, উঠবার সরঞ্জামাদি আর রাস্তার কথা ইত্যাদি শুনে আসছে যে যার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে। কি আছে সেখানে আর সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত শুনতে শুনতে বড় হয়েছে সবাই।
তাই সেখানে যাওয়ার ইচ্ছেটা সবারই মজ্জাগত।
পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে সেখানে যাওয়ার তাড়নাটা মোটামুটি সবাই অন্তরে অনুভব করতে শুরু করে শৈশব, কৈশর আর যৌবন ছেড়ে আসার পর। তার পূর্বে, পার্থিবতার তাড়নায় ব্যস্ত থেকে সবাই শৃঙ্গটাকে দেখে, তবে দূর থেকে আর মনে মনে স্বপ্ন দেখে সেখানে যাওয়ার। শৈশবে বাচ্চারা যে ভাবে বড়দের অনুকরণে কিছু করার জন্য মালা ঠুলি ধুলো কাদা ইত্যাদি নিয়ে খেলে বিষয়টা অনেকটা সেরকম।
তারপর একটা বয়েসে এসে সকলে খেলার ছলে করা ব্যাপারটা বাস্তবে করার জন্য ভিতর থেকে তাড়না অনুভব করে। আর তখন মালা ঠুলি ফেলে জীবনের যাত্রা শুরু হয়।
তেমনি বয়েসে পৌঁছানোর পর এ ছয় জনের এ যাত্রা।
জীবনভর যে যার মত প্রস্তুতি নিয়ে পর্বতের পাদদেশে ওরা। গন্তব্য অভিন্ন, কিন্তু প্রস্তুতি আর রাস্তা ভিন্ন ভিন্ন।
যাহোক, আলোচনার পর দেখা গেল ওদের মধ্যে পাচ জন বন্ধু শৃঙ্গে ওঠার পথ, পথের বিভিন্ন খাদ উপখাদ, ঢাল, অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু সুড়ঙ্গ ইত্যাদি সম্পর্কে ওয়াকেবহাল এবং নিশ্চিত। তারা সে অনুযায়ী নিজ নিজ চিন্তা চেতনা মত সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রয়োজনীয় সব কিছু সাথে নিয়েছে।
পাচ জন তাদের নিজ নিজ পথ ধরে এগুনোর সিদ্ধান্ত নিল।
কিছুটা বিহ্বল ষষ্ট বন্ধুটি দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেদিকে তাকিয়ে।
পর্বত শৃঙ্গে উঠার বাসনা অন্যান্য সবার মত তারও প্রবল। কিন্তু তার জানা শৃঙ্গে উঠার নির্দিষ্ট কোন পথ নেই আর অন্যের দেখানো পথে হাটতে সে ভিতর থেকে সাড়া পেল না।
পার্থিবতা নিয়ে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে থাকা এই মানুষটি এতকাল মানুষ, প্রাণী ও প্রকৃতির ভালবাসায় ডুবে থেকে আর এ সবের স্রষ্টাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে সময় শেষ করে ভেবেছিল পর্বতের পাদদেশে এসে পর্বতের অবস্থান ইত্যাদি অবলোকন করে তারপর রাস্তা ঠিক করবে।
সে চিরকাল অদৃষ্টে বিশ্বাসী এবং তাঁর সান্নিদ্ধ পাওয়ার অভিপ্রায়ে তাঁর সব সৃষ্টির সেবায় জীবন কাটিয়েছে।
কিন্তু অন্য পাচ বন্ধু যারা পার্থিবতার ঊর্ধ্বে ঐশ্বরিকতাকে স্থান দিয়ে জীবন কাটিয়েছে তারা তাদের শৈশব থেকে ঠিক করা পথে হাটার সিদ্ধান্তে অটল থেকে নিজ নিজ পথ ধরে পর্বতারোহণ শুরু করল।
শুরুর পূর্বে ওরা অবশ্য নিজ নিজ পথের বিষয়ে নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা করল। নিজ নিজ মত পথ নিয়ে তর্ক বিতর্কেও জড়িয়ে পড়ল। তারা আজন্মলালীত নিজ নিজ পথের সরলতা আর নির্ভুলতা সম্পর্কে একে অপরের কাছে বিভিন্ন ভাবে যুক্তি উপস্থাপন করল। কিন্তু তারা কোন একক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে ব্যর্থ হল।
তারা সবাই নিজ নিজ মত পথ সম্পর্কে অতি বিশ্বাসী। অন্য কারো দেয়া তথ্য যুক্তি দিয়ে যাচাই করতেও তাদের যেন অনীহা। তাই কারো দ্বারা কেউ প্রভাবিত না হয়ে নিজ নিজ পথ ধরে এগোনর সিদ্ধান্তে অটল থাকলো। কেউ কারো যুক্তি বা তথ্যতে বিশ্বাস করে কোন অভিন্ন পথে হাটার কোন সিদ্ধান্ত তারা বাতিল করে দিল।
ওরা পাচ বন্ধু নিজ নিজ পথে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পরও ষষ্ঠ বন্ধুটি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

অতি আত্মবিশ্বাসী মানুষের এটা একটা বৈশিষ্ট্য। তারা নিজেদের অজান্তেই কিছুটা একগুয়ে যেটাকে অহংভাবও বলা যায়। নতুন করে খুঁজে দেখার ব্যাপারে তারা ভীষণ বিমুখ।
জ্ঞান আর বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে; প্রথমটা প্রমানের উপর নির্ভরশীল আর পরেরটার জন্য প্রমাণের কোন অবকাস নেই। অনেকটা বনের বাঘ আর মনের বাঘের মত বিষয়। বনের বাঘকে মানুষ দেখে বিশ্বাস করে তার ভয় পায়। আর মনের বাঘ, যার ভয়টা ছোট কাল থেকেই কারো মনে গেঁথে গেছে সেটার জন্য দেখাদেখি বা প্রমানের কোন প্রশ্ন নেই, সে বাঘে তাকে সারা জীবন ধরে তাড়া করে ফেরে।
যা কেউ কখনো দেখেনি, দেখা সম্ভবও না, সেটাকে স্থূলভাবে অজ্ঞেয় বিষয় বলা যায়। সে বিচারে ষষ্ট জনকে অজ্ঞেয়বাদী বলা যায়। তাকে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখালেও তার নিজের উপর বিশ্বাসের কোন ঘাটতি পরিলক্ষিত হল না।

পাচ আরোহী নিজ নিজ পথ ধরে পর্বত শৃঙ্গে আরোহণে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
মাঝে মাঝে কোন কোন ঢালে নিজ নিজ পরিধেয় বা সরঞ্জামাদি আরোহণের জন্য বাধা হয়ে দাড়াতে লাগলো। কোন কোনটা ওজনের জন্য আবার কোন কোনটা আকার না আয়তনের জন্য সুড়ঙ্গ পথে ঢুকতে বাধা দিতে লাগলো।
সে বাধা অতিক্রম করার জন্য আরোহীরা এক এক করে তাদের সাথে নেয়া সরঞ্জামাদি কমাতে লাগলো। কিন্তু তাতেও তেমন ফল হল না। আরোহণের কোন কোন স্থান এত খাড়া আর কোন কোন সুড়ঙ্গ এত সরু যে কোন মানুষের পক্ষেই সশরীরে তা অতিক্রমের অযোগ্য বলে প্রতীয়মান হতে লাগলো তাদের কাছে।
মনে হতে লাগলো অতি মানবীয় কোন কিছু না করতে পারলে বোধহয় সে সব জায়গা অতিক্রম করা সম্ভব না।
কিন্তু তারা কেউই ছাড়ার পাত্র নয়। তাই কোন কোন খাড়া জায়গা পার হওয়ার প্রচেষ্টায় রত হয়ে কিছুটা সফলকাম হলেও পা পিছলে আবার যেখান থেকে শুরু সেখানেই ফিরে ফিরে আসতে লাগলো। তবুও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আরোহীরা একটু থেমে জিড়িয়ে নিয়ে সেগুলো শৃঙ্গ আরোহণের পথে অবধারিত বাধা বিবেচনায় নতুন করে উদ্যমী হয়ে উঠতে লাগলো।
গতি কিছুটি মন্থর হয়ে আসলেও কারো মধ্যে সাহস বা ধৈর্যের কোন কমতি পরিলক্ষিত হল না।
কিন্তু এবার সামনে এমন এক সরু সুড়ঙ্গ আসলো যেখানে কারো পক্ষে শরীর নিয়ে কোন ভাবে সেটা অতিক্রম করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তারা চেষ্টা করে করে কেবলই নিজেদেরকে রক্তাক্ত করতে লাগলো।

হটাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে ঝড় বৃষ্টি শুরু হল।
ষষ্ট বন্ধুটি প্রকৃতির রোষ থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য ওই আকাশ ছোঁয়া বিশাল পর্বতের পাদদেশে একটি গুহাই আশ্রয় নিল।
পর্বত শৃঙ্গে উঠার বাসনায় উজ্জীবিত হয়ে যেহেতু বেরিয়েছে তখন ফিরে যাওয়ার আর কোন অবকাস নেই সে বিষয়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকলো সে। প্রকৃতি যে কোন বাধা সৃষ্টি করুক না কেন তার সব কিছুকে মেনে নিয়ে সে শৃঙ্গের চিন্তা চেতনায় নিজেকে নিমগ্ন করল।

গুহার ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। নিজের শরীরটা পর্যন্ত দেখা যায় না। ইন্দ্রিয়গুলো সব যেন তাকে সামনে এগুতে সাহায্য করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল।
এখন নিজের অস্তিত্ব কেবলি অনুভবে।
এগোনর কোন উপায় না দেখে আন্দাজের উপর ভর করে কোনরকমে গুহার মেঝেতে আসন গেড়ে বসে পড়ল। চোখে যেহেতু কিছুই দেখা যাচ্ছে না তাই চোখ দুটো বন্দ করে মনের চক্ষু দিয়ে শৃঙ্গটা দেখে সেটার ভাবনায় নিমগ্ন হল পুরোপুরি।
এভাবে কতক্ষন বসে ছিল তা সে সঠিক ভাবে জানে না। হটাৎ গুহার শেষ প্রান্তে অনেক দূরে মনে হল আলোক বিন্দু চোখ পড়ছে। ভাবল ওটাই বুঝি মুক্তির দিশারী।
উঠে দাঁড়িয়ে ওই আলোক বিন্দু খেয়াল করে করে গভীর অন্ধকারের মধ্যেই এগোতে লাগলো সে।
অনেক পথ পেরিয়ে শেষমেস পৌছালো সে বিন্দুর কাছে।
সামনে আলো ঝলমল খোলা প্রান্তর। স্বর্গীয় আলোর দ্যুতিতে উদ্ভাসিত প্রশস্ত সে প্রান্তর।
এগিয়ে গেল সেখানে। অনেক মানুষকে দেখল চলাফেরা করছে। কিন্তু তারা কেউই তার উপস্থিতি যেন খেয়াল করছে না। কেবল নিজেদের মত চলাফেরা করছে।
কিছুক্ষন পর্যবেক্ষণ করে সে বুঝল যে মানুষ গুলো চোখে দেখছে না কিছুই, কানেও শুনছে না এমন কি কোন গন্ধও ওদের নাকে লাগছে বলে মনে হল না। ওদের গায়ে কিছুর ঘসা লাগলেও ওরা যেন টের পাচ্ছে না কিছুই। গাছ গাছালি পাহাড় ভেদ করে দেহ নিয়েই চলা ফেরা করছে সবাই। সবার দেহ থেকে খুশীর আলোকচ্ছটার এক দ্যুতি অবিরাম বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
মানুষগুলোর কোন ইন্দ্রিয়ই যেন কাজ করছে না। শরীরে থেকেও তারা অশরীরী।
এখানকার সবাই কোন দিক বিদিক, আলো আধারী, ক্ষুধা জ্বালা, ভুত ভবিষ্যৎ জ্ঞান শুন্য। এরা সবাই বর্তমান নিয়ে বেচে আছে।
আর কিছু সময় পর পর তারা অদৃশ্য হয়ে আলোক বিন্দুতে পরিণত হতে লাগলো।
ইন্দ্রিয়হীনদের দেশে সে যেন একমাত্র ইন্দ্রিয় জ্ঞান শক্তি সম্পন্ন মানুষ।
সেখানে চোখ দুটো বন্ধ রাখলে অন্য কিছু না কেবল কেবল ঝলমলে আলো দেখা যায়। চোখ বন্ধ করে থাকাতে সে নিজেকেও ওই আলোর অংশ হিসেবে অনুভূত হয়ে আনন্দ আর উল্লাসের বন্যাই ভাসতে লাগলো।
হটাৎ করে কারো অতৃপ্ততার আর্তনাদ কানে এসে লাগায় ধ্যান ভেঙ্গে চোখ খুলতে ইচ্ছে হল। তাতে সে বুঝল পঞ্চ ইন্দ্রিয় থেকে পুরোপুরি নিজেকে আলাদা করতে পারিনি এখনো।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে সে পরিষ্কার শুনতে পেল পিছন থেকে কারো আসার পদশব্দ।
ভাবল এতক্ষনে সকলে বোধহয় বুঝতে পেরেছে যে ইন্দ্রিয়ের আধার এই শরীর নিয়ে পর্বত শৃঙ্গে আরোহণ সম্ভব না।
সে ইন্দ্রিয় থেকে নিজেকে পুরোপুরি মুক্ত করে স্বর্গীয় আলোর সাথে একাত্ম হতে মনঃস্থির করল।