জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ছোট গল্প 'মালেকের মালিক'।

আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩:০২

মালেকের মালিক

 

শেষ পর্যন্ত হতভাগা মালেকের ভাগ্যমালিক যেন সুপ্রসন্ন হল।
বাবা ছিলেন সাধারণ কৃষক। তার কাছ থেকে পাহাড়ী অঞ্চলে পাচ বিঘার মত কৃষির অযোগ্য যে জমি খন্ড পেয়েছিল সেখানে সরকার গ্যাস ফিল্ডের সন্ধান পাওয়াই ওর সব জমি সরকারী অধিগ্রহণের আওতায় পড়লো। ছোট বড় উচু নিচু টিলা ভর্তি জংলী এলাকা তাই সেখানে ফসলও যেমন হত না তেমনি সে জমির মূল্যও নাম মাত্র ছিল।
সরকারী নিয়মে ওই জায়গার জমি খনিজ এলাকা হিসেবে শ্রেণীকরণের ফলে সরকার সেখানকার প্রায় একশ একর জমি অনেক গুন উচ্চ মূল্য দিয়ে অধিগ্রহণ করে নিল।
ফলে ওই অঞ্চলের অনেকের মত মালেকও বলতে গেলে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল।

বাবা বেচে থাকতেই মালেকের বড় ভাই বাবার সাথে চাষাবাদ করতো। বাবার অবর্তমানে সে ছোট ভাইকে লেখা পড়া শিখিয়ে মানুষ করার দায়িত্ব নেয়ার অঙ্গিকার করেছিল। সে ভাবেই বাবাকে বুঝিয়ে সমতল এলাকায় অবস্থিত ভাল চাষের জমিগুলো তার নিজের ভাগে নিয়ে টিলা জংলা অঞ্চলের জমিগুলো মালেকের ভাগে দিয়েছিল।
কৃষক বাবার তিন সন্তানের ছোট মালেক। মেয়েকে বিয়ে দিয়েই চোখ বুজেছেন ওর বাবা। বাবা বেচে থাকতেই ওর বড় ভাই সংসারের হাল ধরেছিল। মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছে। এখন বড় ভাই, তার স্ত্রী, ওদের ছোট একটা ছেলে আর মালেক মিলেই সংসার।
বাড়ীটা বাদে মাঠে বিঘা দশেক জমি। বাবা থাকতেই সব কিছু দু ছেলের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে গেলেও বড় ভাই সব জমি দেখাশোনা আর চাষাবাদ করে।
বাবার মৃত্যুর পর বছর পাচেক ওরা দু’ভাই একত্রে ছিল। বড় ভাই চাষাবাদ করতো আর মালেক স্থানীয় কলেজে পড়াশোনা করতো।
যাহোক, কি যেন একটা হল তারপর ওর ভাবী’র পিড়াপীড়িতে বড় ভাই মালেককে আলাদা করে দিল। মালেকের মাথাই যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তখন সে সদ্য বিএ পাশ করেছে, এ সময় ভাল চাকরী পাওয়া আকাশ কুসুম কল্পনা।
মালেক সেই প্রথম বুঝল যে তার চতুর ভাই বাবাকে ভুল ভাল বুঝিয়ে অনাবাদি জমিগুলো ওর ভাগে দিয়েছে। জমিতে কোন ফসল হয় না তাই কেউ যেমন বর্গা নিতে চায় না, তেমনি পতিত জমি কেউ ভাল দামে কিনতেও চায় না।
কোন উপায়ন্তর না দেখে মালেক ওদের স্থানীয় বাজারে অটো রাইছ মিলে খাতা লেখার কাজ নিয়ে কোন রকমে জীবন কাটানোর ব্যাবস্থা করল।
অগত্যা ওর বিধবা খালা ওর সাথে থাকার জন্য আসলো।

রাত দশটার দিকে কারখানা বন্দ হওয়ার পর মালেক তার অফিসের দরজা বন্দ করে। সেদিন রাতে অফিসের দরজা বন্ধ করার সময় মাঝ বয়স পার করা পাগল গোছের একজন ভিক্ষুক অফিসের বারান্দায় ঘুমাবে আর আলোতে তার ঘুম হয় না জানিয়ে বারান্দার লাইটের সুয়িচটা ভিতর থেকে বন্দ করে যাওয়ার জন্য তাড়া দিল মালেককে।
মালেক একটু বিরক্ত হল।
-আমি অফিসের ঠিক দরজার সামনেই বিছানাটা পাতি, চোর তালা ভাঙ্গতে পারলেও আমাকে ডিঙ্গিয়ে চুরি করতে পারবে না। তুমি নিশ্চিন্তে বাসায় গিয়ে ঘুমাও।
মালেক একান্ত অনিচ্ছাই তালাটা আবার খুলে ভিতর থেকে সুয়িচটা অফ করে তালা লাগিয়ে দিল।
সকালে এসে মালেকই অফিসটা খোলে, তখন অব্দি ভিক্ষুকটি ঠিক দরজার সামনে ঘুমিয়ে থাকে। মালেক কিছুটা বিরক্ত হয়ে ওকে ডাকাডাকি করে উঠিয়ে অফিসের তালা খোলে।
ঘুম থেকে উঠে ওর চটের বিছানাটা গুটিয়ে অফিস রুমের সাথের ষ্টোর রুমের ভিতর রেখে ভিক্ষুকটা বেরিয়ে যায়। বিছানা ভিতরে রাখার জন্য মালেকই তাকে অনুমতি দিয়েছে।
-বাবা, এই চটের পোটলা বারান্দায় রাখলে খারাপ দেখায়, আর তাই কেউ হয়তো আবর্জনা ভেবে লাথি মেরে ফেলেও দিতে পারে। বোঝইতো সারাদিন খাটাখাটনি করে এসে বিছানায় গাটা এলিয়ে না দিলে শরীরটা চালাব কি করে?
সারাদিন খাটাখাটনির পর অফিস বন্ধ করার সময় প্রতিদিনই ভিক্ষুকের বকবকানিতে মালেক বিরক্ত হয়।
ভিক্ষুকটি বেশ পরিষ্কার করে গুছিয়ে কথা বলে। বিরক্ত হলেও সেদিন ওর চটের বিছানা রাখার ব্যাপারে ওর কথায় মালেক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে।
-এমনিতে কোন কিছুকে তুচ্ছ মূল্যহীন মনে হলেও, স্থান কাল পাত্র ভেদে তা অতীব মুল্যবান হয়ে উঠতে পারে। কথাটা এখন না বুঝলেও একদিন ঠিকই বুঝবে বাবা।
সেদিন থেকেই মালেকই ভিক্ষুকের চটের বিছানাটা ষ্টোর রুমে রাখার অনুমতি দিয়েছিল।

সারা দিন রাইছ মিলের অবিরাম শব্দের মধ্যে কাজ করে মালেক রাতে বাড়ীতে ফিরে কোন রকমে কিছু একটু মুখে গুজেই অবসন্ন শরীরটা এলিয়ে দেয়। মনে মনে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আর হাহুতাস করে রাত কাটিয়ে আবার সকালে কাজে আসে।
মনটা সব সময় আফসোসে ভরে থাকে। ভাবে বন্ধুদের কথা। একই সাথে যারা পড়াশোনা করত তাদের অনেকেই পড়াশোনা শেষ করে বড় বড় শহরে অনেক টাকা বেতনে কাজ করে। ওদের অনেকের থেকে লেখাপড়াই মালেক ভাল ছিল, কিন্তু ভাগ্য দোষে আজ ওরা কোথাই আর সে পড়ে আছে কোথাই!
সেসব ভাবতে ভিতরটা ব্যথায় মোচড় দিয়ে ওঠে।
ঠিক এমনি সময় ওর ভাগ্যের এই আকস্মিক পরিবর্তন।

এত টাকা দিয়ে কি করবে মালেক! তা সত্যিই ও ভেবে পাচ্ছিল না। ওর ভাগ্যের এহেন পরিবর্তনে অটো রাইছ মিলের মালিক ওর পাশে দাঁড়ালো। মালেককে নিজের বাড়ীতে ডেকে মিল মালিক তার স্ত্রী আর কলেজ পড়ুয়া মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তিনি ওর খুব প্রশংসা করলেন। সরকারের কাছ থেকে পাওয়া সব টাকা ব্যাংকে রাখার ব্যাবস্থা করলেন। তাড়াহুড়ো না করে সব কিছু ধীরে সুস্থে পরিকল্পনা করে করার পরামর্শ দিলেন তিনি।
মিল মালিক মালেকের পদবী উন্নীত করে কয়েক দিনের মধ্যেই ওর বসার অফিসটা রং চং করিয়ে আধুনিক চেয়ার টেবিল সোফা দিয়ে সাজিয়ে এসি লাগানোর ব্যাবস্থা করলেন তিনি।
ওকে গ্রামের বাড়ী ছেড়ে শহরে মালিকের নিজের বাড়ীর পাশে একটা বড় বাসা ভাড়া করে সেখানে ওর খালাকে নিয়ে উঠার ব্যাবস্থা করলেন।
মালেককে অটো রাইছ মিলের সিইও করে ওর বেতন কয়েক গুন বাড়িয়ে দিলেন মালিক। কয়েক মাসের মধ্যেই মালেকের জীবনযাত্রার মান অনেক উচ্চ পর্যায়ে পৌছাল।

বিভিন্ন কাজের অছিলায় মিল মালিকের বাড়ীতে মালেকের যাতায়াত একটা নৈমত্তিক ঘটনায় পরিণত হল।
-মালেক তুমি খুব ভাগ্যবান। কিন্তু তোমার জমিটা যদি আর আধা কিলোমিটার পশ্চিমে হতো তাহলে তুমি যে টাকা পেয়েছ তার থেকে আরো দুগুন টাকা বেশী পেতে।
মালিকের কথায় মালেক ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
-তোমার জমি খন্ড মুল খনি অঞ্চলে পড়েনি, তোমার জমি সরকার অধিগ্রহণ করেছে খনির প্রশাসনিক এলাকার জন্য।
-সে যাই হোক তা নিয়ে এখন আর চিন্তা করা অযথা।
মালেকের হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে মিল মালিক তাকে আশ্বস্ত বললেন।
ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথম থেকেই মালেক কিছুটা হতবুদ্ধি হয়ে ছিল। খালাকে নিয়ে বড় লোক পাড়ার বাসায় উঠার পরও সে ভাবটা গেল না। একান্ত আপন জনের মত ওর পাশে দাঁড়ানো মিল মালিকের বর্ণনা মতে ওর নিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনা ওকে স্বস্তি দিলেও সেদিন তার মন্তব্যটা –‘কিন্তু তোমার জমিটা যদি আর আধা কিলোমিটার পশ্চিমে হতো তাহলে তুমি যে টাকা পেয়েছ তার থেকে আরো দুগুন টাকা বেশী পেতে’ মালেকের মনকে আবার আগের মত আফসোসে ভরে দিল।

গত দুদিন ধরে শরীর খারাপ থাকায় মালিককে বলে মালেক অফিসে যায়নি। বিকাল বেলা দারোয়ান এসে জানালো কেউ একজন ওর সাথে কথা বলার জন্য এসেছে।
মালেক তার ডুপ্লেক্স বাসার নিচে বসার রুমে নেমে আসলো।
একটু বিস্মিত হল রাইছ মিলের অফিসের বারান্দায় শুয়ে থাকা ভিক্ষুকটিকে দেখে।
ভিক্ষুকটিকে মালেক অপছন্দ করে তেমনটি না। তবে ওর নিজের জীবনের জন্য ওই ভিক্ষুকের অবস্থানটা নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। তাই ওকে নিয়ে ভাববার তেমন কোন তাড়না কখনো অনুভব করেনি মালেক।
ওর এখানে আসাটা মালেকের কাছে সাধারণ কোন ঘটনা মনে হল না।
এ বাড়ীর সব কিছুর সাথে চাক্ষুস ভাবে বেমানান ভিক্ষুকটি ড্রয়িং রুমে পাতা দামি কার্পেটের বাইরে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে।
-বাবা, তোমার মনটা দেখি আগের মতই চঞ্চল থাকে। এখনতো আগের সে অনিশ্চয়তা নেই, তাহলে সেই আগের মত মন মরা হয়ে থাক কেন?
ভিক্ষুকটির কথার তাৎপর্য ঠিক অনুধাবন করতে না পেরে মালেক তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলো।
-দুখী মানুষ যেমন উপরের দিকে তাকিয়ে সুখী মানুষদের সাথে তুলনা করে নিজের দুঃখটা বাড়িয়ে ফেলে, তেমনি সুখী মানুষও উপরের দিকে তাকিয়ে তার থেকে অধিকতর সুখী মানুষের কথা ভেবে নিজের সুখটাকে দুঃখে পরিনত করে।
মালেকের চোখে গভীর ভাবে তাকিয়ে কথা বলছিল ভিক্ষুকটি।
-যিনি সব কিছুর মালিক তিনি সদা জাগ্রত। নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী যা করণীয় সেটুকু করে তাঁর উপর ছেড়ে দিলেই হয়। নিশ্চিত থাক, মালিক তাঁর কাজ ঠিক সময়েই করবে।
মালেক হতবাক হয়ে শুনেই চলেছে ভিক্ষুকটির কথা।
-একটা কথা বলি বাবা। তুলনা করে জীবন কাটানো মানুষের স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এই জন্মগত প্রবৃত্তি পরিহার করা সাধারণের জন্য সহজতর কাজ না। তবে তুলনাটা উপরের সাথে না করে যদি নিচের দিকের মানুষের সাথে করা যায় তাহলে দুঃখীর দুঃখও যেমন কমে যায় তেমনি সুখীর সুখও বেড়ে যায়।
একটু থেমে হতবাক হয়ে দাঁড়ানো মালেকের চোখে চোখ রেখে ভিক্ষুকটি ভাল করে দেখে নিয়ে বলল -বিধাতার এ দুনিয়াই সব সময় তোমার থেকে সুখী মানুষ যেমন পাবে তেমনি দুখী মানুষও পাবে নিশ্চিত।

-কিরে বাবা, একা একা বসে কি করছিস, সন্ধ্যা যে হয়ে এল তোকে চা দেব?
সুয়িচ টিপে লাইট জ্বালতে জ্বালতে খালার কথায় সম্বিত ফিরে পেয়ে নিজেকে ড্রয়িং রুমে সোফার উপর উপবিষ্ট অবস্থায় আবিষ্কার করলো মালেক। সে অনেকটা চমকে উঠে এদিক ওদিক তাকাল।
-কিছু খুঁজছিস বাবা?
মালেক খালার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কিছুক্ষন।
-না খালা কিছু না, তুমি চা দাও।
ভিক্ষুকটা কখন আসলো আর গেলই বা কখন! সেকথা ভাবতে লাগলো মালেক।
ওর কথা গুলো এখনো পরিষ্কার ভাবে কানে বাজছে। কিন্তু খালার কথাবার্তা বা আচরনে ভিক্ষুকের আগমন বা চলে যাওয়া কোনটাই বোঝা গেল না।

ততোক্ষণে সন্ধ্যার আঁধার চারদিক গিলতে শুরু করেছে। শরীরটা খারাপ লাগায় সেদিন দুপুর থেকে মিল মালিককে জানিয়ে সে বাড়ীতে চলে আসে। এখন হটাৎ মনে হল গত দু দিন ভিক্ষুকটির চটের বিছানা অফিসের ষ্টোর রুম থেকে বের করে দেয়া হয়নি।
একটা অপরাধ বোধে ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো মালেকের।
তাড়াহুড়ো করে খালাকে আসছি বলে বেরিয়ে একটা গাড়ী ভাড়া করে অফিসে পৌঁছালো মালেক।

বারান্দাটা অন্ধকার, দুদিন ধরে লাইটটা জ্বালানো হয়নি। অফিস খুলে লাইট জ্বালিয়ে দিল মালেক। বসলো অফিস রুমে।
-তাহলে এ দুদিন কোথায় ঘুমিয়েছে ভিক্ষুকটি! আর আজ কথা বলার সময় একটি বারের জন্যও সে কথাটা বলল না কেন! আর আজ কেনই বা ওর বাসায় এসেছিল সে!
ওর সেল ফোনটা বেজে উঠলো। চিন্তার জগতে ডুবে ছিল মালেক, তাই যেন চমকে উঠলো।
-এ অসময়ে অফিসে কেন তুমি, মালেক? তোমার শরীরের কি অবস্থা? মিল মালিকের কন্ঠ।
এ দুদিন বেশ কয়েকবার বাসায় টেলিফোন করে মিল মালিক এবং তার স্ত্রী মালেকের শরীরের খবর নিয়েছেন। এখন তিনি নিশ্চয় গার্ডের কাছ থেকে খবর পেয়ে ফোন করেছেন। ভাবল মালেক।
রাত প্রায় এগারোটা বাজলো। ভিক্ষুকটি আসলো না।
মিল মালিক তার গাড়ী পাঠালেন এত রাতে মালেককে বাসায় পৌঁছানর জন্য।
-যিনি সব কিছুর মালিক তিনি সদা জাগ্রত। নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী যা করণীয় সেটুকু করে তাঁর উপর ছেড়ে দিলেই হয়। মালিক তাঁর কাজ ঠিক সময় মত করবে।
ভিক্ষুকের কথাটা মালেকের কানে বাজতে লাগলো।