জীবনের অর্থ খোঁজার প্রয়াসে জীবন থেকে নেয়া ছোট গল্প 'কবুতরের বাসা'।

আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, ১১:৫৮

কবুতরের বাসা

 

সাগর তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান।
অকালে বাবা মা ওকে ছেড়ে বিদায় নিলেও তারা যে সহায় সম্পত্তি ঘর বাড়ী ওকে দিয়ে গিয়েছে, কোন কাজ কর্ম আয় রোজগার না করেও তা দিয়ে খুব ভাল ভাবে তার জীবন কেটে যায়।
বাবা মারা যাওয়ার পর প্রায় বাবার বয়সী তাদের বাড়ীতে থাকা খুব বিশ্বস্ত কর্মচারী খোদাবক্স ওদের সব জমিজমা ইত্যাদি দেখাশোনা করে। সংসার কর্ম বলতে যা বোঝায় তার সব সেই সামলাই।
আর আক্ষরিক অর্থে সাগর কিছু না করেই উদ্দেশ্যহীন ভাবে জীবন অতিবাহিত করে। সারাদিন বন্ধু বান্ধবের সাথে ইচ্ছে মত সময় কাটিয়ে রাতে এসে বাড়ীতে ঘুমায়।
প্রায় পাচ একর জায়গার জুড়ে ওদের বসত ভিটার এক ধার ঘেঁসে ওর দাদার আমলে জমিদার বাড়ীর আদলে তৈরি প্রাচির ঘেরা একটা বিশাল দোতলা বাড়ীর উপর তলায় সাগর থাকে। নিচ তলাতে স্টোর রুম, রান্না ঘর আর কাজের লোকজন থাকার ঘর।
বলা যায় ঘুম ভাঙ্গলে সকাল হয় সাগরের। নাস্তা শেষে বেরিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে বাড়ী ফিরে দুপুরে খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেয় তারপর আবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে রাতে ফেরে।

সেদিন দুপুরে ফিরে নিচে থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়ী সংলগ্ন আঙ্গিনায় বাগানে একটু পায়চারী করার সময় সাগরের নজরে পড়ল দুটো কবুতর নিচ তলার একটা স্টোর রুমের কাঠের জানালা দিয়ে উড়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সাগর খেয়াল করল জানালার একটা কপাট ভাঙ্গা আর সে পথ দিয়েই কবুতর দুটো ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
কবুতর দুটো কোথা থেকে আসলো তা দেখার জন্য সাগর সে রুমে ঢুকে দেখতে পেল পরিত্যাক্ত কিছু আসবাব পত্রের ভিতর ওরা বাসা বেঁধেছে।
দৃশ্যটা ওর হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব পুলকিত ভাবের সৃষ্টি করল।
এমনটাই বোধহয় মানুষের হৃদয়, নিজের কোন স্বার্থের কথা চিন্তা না করে অসহায় কোন জীবকে সাহায্য করলে অবচেতনে মন পুলকিত হয়। এরকম স্বর্গীয় অনুভব।
দেহ মনে এক অভাবনীয় প্রশান্তি নিয়ে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসলো সাগর। এমন অনুভব অনুভূতি ওর দেহ মনকে আগে কখনো আস্বাদিত করেনি।
আশ্রয়হীন দুটো কবুতর তার পরিত্যাক্ত ষ্টোর রুমে আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছে! কথাটা ভাবতেই নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল সাগরের।
দাদার আমল থেকে ওদের এ প্রাসাদতুল্য বাড়ী। বলতে গেলে বেশীর ভাগটাই অব্যবহৃত থাকে। সম্পত্তি দেখাশোনা করা অশীতিপর কর্মচারী খোদাবক্সকে ডেকে কবুতর দুটোকে কোন ভাবেই কেউ যেন বিরক্ত না করে সে নির্দেশ দিল সাগর। আপাতত ও ঘরটাতে কারো প্রবেশও নিষেধ করল।
আশ্রয়হীন কবুতর দুটো ওর ঘরে বাঁধা বাসায় ডিম পাড়বে, বাচ্চা ফুটাবে সে সব কথা কল্পনা করে সাগরের দেহ মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠতে লাগলো। সেদিন চিরাচরিত অভ্যাস ভঙ্গ করে দুপুরে উপরে শোয়ার জন্য গেল না সাগর। সারা বিকেলটা কবুতর দুটোর দিকে নজর রেখে পার করে দিল। সন্ধ্যার আগে কবুতর দুটো ফিরে সে জানালা দিয়ে ঘরে ঢোকার পর সাগর উপর ঘরে গেল।
সেদিন সন্ধ্যায় বের হল না সাগর। সন্ধ্যার একটু পর নিচে নেমে খাওয়া দাওয়া সেরে কবুতরের ঘরের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে একটু পায়চারী করে তারপর শুতে চলে গেল।
সাগরের চালচলন, চিন্তা চেতনায় যেন এক আমুল পরিবর্তন আসলো।

খোদাবক্স যথাযত ভাবে সাগরের নির্দেশ তো পালন করলোই অধিকন্ত পশ্চিম দিকের সে ষ্টোর রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় সকাল বিকেল ধান ছিটিয়ে দিয়ে ওদের নিয়মিত খাবার সরবরাহ করতে লাগলো।
মাস খানেকের মধ্যে ওরা ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটাল। কবুতর দুটো খোদাবক্সের দেয়া ধান খেতে খেতে পশ্চিমের বারান্দায় বাকবাকুম শব্দে নৃত্যে মেতে উঠা দেখে দেখে সাগরের অখন্ড অবসর ওদিকটাতে পায়চারী করে কবুতরদের দেখে দেখে কাটতে লাগলো।
একটু বড় হতেই কবুতরের বাচ্চা দুটো বাইরে এসে বারান্দায় হাটা হাটি করা শুরু করল। কবুতরের বাচ্চা যে দেখতে এত সুন্দর হয় তা সাগর আগে জানত না।
ধীরে ধীরে ওদের বাচ্চা বাদেও বাইরে থেকে আরো কিছু কবুতর এই নিশ্চিত আশ্রয়ে এসে থাকতে শুরু করল। তারপর দিনে দিনে পশ্চিম দিকের ও ঘরটা কবুতরে ভরে গেল।
কবুতরদের বিভিন্ন কার্যকলাপ, তাদের জীবন প্রবাহ, বাচ্চাদেরকে খাওয়ানো ইত্যাদি দেখতে দেখতে বাউন্ডেলে স্বভাবের সাগর ধীরে ধীরে একদম ঘর লাগা হয়ে উঠল।
নিচে বসবাসরত তার সব লোকজনদেরকে পূর্ব দিকের ঘরগুলোতে সরিয়ে এনে পশ্চিম দিকের সব ঘর ধীরে ধীরে কবুতরদের জন্য ছেড়ে দেয়া হল।
কবুতরদের ভালবাসায় মজে সাগর ধীরে ধীরে সংসারী হয়ে উঠল। তারপর পিতৃতুল্য খোদাবক্সের পরামর্শে ওর পছন্দের একটা মেয়েকে বিয়ে করে পুরোপুরি সংসারী হয়ে উঠল সাগর।

একদিকে যেমন কবুতরের সংখ্যা অনেক গুন বেড়ে গেল, সাথে সাথে সাগর সংসারের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠার ফলে বছর বছর সংসারের আয় উন্নতি বাড়তে লাগলো।
অবশেষে সে ঠিক করল যে দাদার আমলের এ পুরনো বাড়ীটা পুরোপুরি কবুতরদের জন্য ছেড়ে দিয়ে দেয়ালের বাইরে নতুন করে আধুনিক ডিজাইনের বাড়ী তৈরি করে সাগর নিজ পরিবার আর লোকজন নিয়ে সেখানে চলে যাবে।
সে ভাবে ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে প্লান করে রাজ মিস্ত্রির দল লাগিয়ে নতুন বাড়ী তৈরির কাজও জোরেশোরে শুরু হয়ে গেল।
প্রাথমিক ভাবে দুটো কবুতরকে দেখে যেমন ভাবে অন্যান্য কবুতরেরা আকর্ষিত হয়ে দলে দলে সাগরের পুরনো বাড়ীর নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঘর বেধে প্রাকৃতিক নিয়মে ওদের সংখ্যা অনেক গুণে বেড়ে গেল। তেমনি ভাবে সাগরের সংসারে ক্রমাগত বর্ধিত আয়ের ফলে ওর সচ্ছলতাও বেড়ে গেল। আরো অধিকতর উন্নতির জন্য সাগরের মনে নতুন নতুন আয় রোজগারের বিভিন্ন পরিকল্পনা মাথায় আসতে লাগলো।

মানুষ মাত্রেই বোধহয় এরকমই হয়, আয় রোজগার যত বেশী হয় মানুষ যেন পাল্লা দিয়ে তত বেশী হিসেবী হয়ে ওঠে। অধিক সম্পদ মানুষের মনে তা আরো অধিকতর করার প্রেরণার জন্ম দেয়। আর সেক্ষেত্রে মানুষ অধিকতরের সীমা সম্পর্কে ভ্রমের ফাঁদে পড়ে যায়। একই সাথে অধিক সম্পদ মানুষের মনে তা হারানোর ভয়েরও জন্ম দেয়।
কৃষি জমির ফসলের উৎপাদন বাড়ানোর সাথে সাথে সাগর কৃষি পণ্য দিয়ে ব্যবসা শুরু করল। কৃষক পরিবারের ছেলে সাগর ধীরে ধীরে সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠল। তার এই ক্রমাগত উন্নতি দেখে তার সুপ্রসন্ন ভাগ্য নিয়ে এলাকার সবাই বলাবলি করতে লাগলো। সাগর যে ব্যবসায় হাত লাগাই সে ব্যবসারই উন্নতি হতে লাগলো।

বছর চারেকের মধ্যে পুরনো বাড়ীটা পুরোপুরি কবুতরদের অভয়ারণ্যে পরিণত করে সাগর তার পরিবার আর লোকজনদের নিয়ে পাশে তৈরি নতুন বাড়ীতে উঠল।
সাগরের জমিতে ফসলের উৎপাদন অনেক গুন বেড়ে যাওয়ার ফলে সব কবুতরদের খাদ্যের কোন ঘাটতি থাকল না। সাগরের নির্দেশে খোদাবক্স একজন আলাদা লোক নিয়োগ করল কেবলমাত্র পুরাতন বাড়ীর আঙ্গিনায় কবুতরদের খাবার ছিটানোর জন্য।
এর মধ্যেই সাগরের স্ত্রী দুটো সন্তানের জন্ম দিল। সাগরের সংসারের কলেবর ও খরচ ধীরে ধীরে বেড়ে চলল। কিন্তু সাগরের আর্থিক সচ্ছলতার কাছে সেটা অতি নগন্য বলে পরিগণিত হল।

সফল ব্যবসায়ী সাগরের নজর অবশেষে কবুতরের দিকে পড়ল। সে কবুতরগুলোকে ব্যবসায়িক পণ্যে পরিণত করে তা থেকে কিছু বাড়তি আয় রোজগারের পরিকল্পনা করল। কবুতরদের থাকার জন্য অত বড় বড় ঘর, ওদের খাবার, তার উপর ওদের দেখাশোনার জন্য আলাদা কাজের লোক এসবের খরচ হিসেব করে তার বিনিময়ে তা থেকে কিছু ইনকাম করার চিন্তাটা ওর মাথায় ভর করল।
তারপর যা হল তা সাগরের কোন ব্যবসায়িক হিসেবে মিলল না।
বাজারে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে কবুতর ব্যবসায়ীর লোকজন পরিত্যাক্ত বাড়ী থেকে কবুতর ধরতে গেলে একটা ঘরের ভিতর ওদের একজন কর্মচারীকে সাপে কেটে মারল। অন্যান্যরা দৌড়ে বেরিয়ে এসে প্রাণ বাচাল। তারা বর্ণনা করল যে, ও বাড়ীর সব ঘরে সাপ ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
কিছুটা অবাক হলেও, ব্যবসায়ীক জ্ঞানসম্পন্ন সাগর দমার পাত্র না।
অশীতিপর খোদাবক্স কবুতরগুলো সাগরের ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে জড়িত সেটা অনুধাবন করলেও বিষয়টি সাগরের দৃষ্টিকে আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হল। আর তাই কবুতর নিয়ে ব্যবসা শুরু না করার জন্য খোদাবক্সের পরামর্শের প্রতি সে কোন কর্ণপাত করল না।
এ ঘটনার পর সাগর পুনরায় খোদাবক্সের পরামর্শ না মেনে বাড়ীটা সাপ মুক্ত করে কবুতরগুলোকে পণ্য হিসেবে বিক্রয়ের প্রচেষ্টায় সে অঞ্চলের নামকরা ওঝার দল নিয়োগ করল।
তাতে কোন ফল হল না। বরং কবুতরদের ঘর ছেড়ে সাপগুলো দুএকটা করে পাচিল টপকে সাগরের নতুন বাড়ীতে ঢুকতে শুরু করল। ভয়ে প্রাণ বাচাতে ওর কর্মচারীরা এক এক করে ওকে ছেড়ে চলে যেতে লাগলো।
গত পাচ বছরে সাগরের ব্যবসা ফুলে ফেপে যে ঈর্ষনীয় পর্যায়ে উঠছিল এক বছরের মাথায় তা যেন একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল।

এ দুনিয়াই সব মানুষই দুভাবে অন্যকে উপকার করে থাকে। নিঃস্বার্থ ভাবে উপকার করা আর নিজের কোন স্বার্থের কথা মাথায় রেখে উপকার করা। তবে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দু ক্ষেত্রেই নির্ভুল ভাবে প্রতিদান ফিরে আসে উপকারীর কাছে।
এ দুটোর পার্থক্য বুঝাতে মানুষের শরীরে উপস্থিত জীবাণুর কার্যক্রমের সাথে তুলনা করা যায়। একদিকে উপকারী জীবাণু যেমন মানুষের জীবনধারণ, শরীর বর্ধন ও সুস্থ রাখার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে তেমনি ক্ষতিকারক জীবাণু মানুষের জীবন নাশেরও কারণ হয়।
আশ্রয়হীন বুনো কবুতরকে সাগর আশ্রয় দিয়েছিল হৃদয়ের টানে, একদম নিঃস্বার্থ ভাবে, নিরেট জীবে দয়া বা ভালবাসা থেকে। হৃদয়ের সাথে সরাসরি স্বর্গের সম্পর্ক, হৃদয়ের টানই স্বর্গের টান। আর সে ভালবাসা উজাড় করে দেয়ার টানই প্রকৃতই সংসার বিরাগী সাগরকে সংসারী হতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তার আয় উন্নতি বেড়ে সে নিজেকে সমাজের উচ্চ শিখরে উন্নীত করেছিল।
অন্যদিকে মানুষের মনের সাথে পার্থিবতার সরাসরি সম্পর্ক যা নিচক অঙ্কের হিসেবে বাধা। তাই পরবর্তীতে সাগর তার পরিত্যাক্ত ঘরে আশ্রিত কবুতরদেরকে আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে হৃদয়ের টানের উপর যখন মনের টানকে প্রাধান্য দিল, তখন তার উদ্দেশ্যের পরিবর্তন হল। আশ্রিত কবুতরদের নিজের ব্যবসায়ের পণ্য বানানোর লোভের কাছে বশীভূত হয়ে সেগুলোকে ধরে বাজারে বিক্রির করার কাজে যখন হাত দিল, তখন তার নিঃস্বার্থতা স্বার্থ সিদ্ধিতে পরিণত হল।
আর প্রাকৃতিক নিয়মেই তার বাগানবাড়ীতে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য সর্পকুল সে কবুতরের ডিম খাওয়ার জন্য কবুতরদের ঘরে আশ্রয় নিয়ে সাগরের সব স্বপ্নকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিল।

সাগরের সব লোকজনদের মত কবুতরেরাও এক এক করে সাগরের আশ্রয় ছেড়ে চলে গেল। খাবারের উৎস হারিয়ে সর্পকুলও জঙ্গলে ফিরে গেল। সাগরের পুরনো বাড়ীটা একেবারে পরিত্যাক্ত হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়তে লাগলো।

দপ করে জ্বলে উঠা তেলের প্রদীপ তেল ফুরিয়ে গেলে নিভার আগে যেমন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকে, তারপর হটাৎ করে আসা বাতাসের একটা ফুঁৎকারে যেমন শেষ হয়ে যায়, সাগরও সব জীবনী শক্তি হারিয়ে তেমনি ভাবে ম্রিয়মাণ হয়ে রইল।
বৃদ্ধ খোদাবক্স অতিবৃদ্ধ হয়েও সন্তান তুল্য সাগরের মুখের দিকে তাকিয়ে দিনাতিপাত করতে লাগলো।