জীবন থেকে নেয়া কাহিনী অবলম্বনে রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'জীবনের অন্যপিঠ' পর্ব -২৩।

আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:১৭

জীবনের অন্যপিঠ-২৩ 

 

আকাশটা মেঘলা হয়ে মুখ ভার করে আছে কয়েকদিন ধরেই। অল্প অল্প করে জমতে জমতে আকাশ এখন ঘন কালো মেঘে ঢেকে গিয়েছে।
প্রথমে কিছু বাতাসের ঝাপটা ছিল। তাতে গুমট গরম থেকে একটু নিষ্কৃতি পাওয়া যাচ্ছিল, আর সে বাতাসের ঝাপটা মেঘ সরিয়ে মাঝে মধ্যে সুর্য্য কিরণ উঁকি ঝুঁকি দিতে সাহায্য করতো।
কিন্তু আজ সকাল থেকে হাওয়াটা একদম বন্দ। চারিদিকে জমাট বাধা গুমোট ভাব। আকাশে কালো মেঘগুলো পাথরের মত হয়ে আছে।
চৌধুরী এস্টেটের কোন গাছের কোন একটা পাতাও যেন নড়ছে না। মরার আগে শরীর যেমন নিস্তেজ হয়ে যায় অনেকটা তেমন। একটা শেষ ঝাঁকুনি দিয়েই সব যেন শেষ হওয়ার প্রতীক্ষায়।
প্রকৃতির মহা মাতনের যেন পূর্বাভাস।

হটাৎ করে ফোটা ফোটা বৃষ্টি পড়তে শুরূ করলো। বাগান থেকে রামদয়াল কোনমতে কাচারী ঘরের বারান্দায় দৌড়ে উঠতে উঠতে বৃষ্টিটা ধরে আসলো।
শুকনো মাটিতে বৃষ্টির ফোটা পড়ে মাটির একটা গন্ধ নাকে এসে লাগতে লাগলো। মনে হচ্ছে কাঠফাটা রোদে পুড়ে যন্ত্রনা কাতর মূক চৌধুরী এষ্টেটের মাটি যেন কথা বলতে শুরু করেছে।
গাছের বিবর্ণ পাতাগুলো বৃষ্টিতে অবগাহন করে সমস্ত ধুলো ময়লা ধুয়ে সতেজ হয়ে উঠতে লাগলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই বৃষ্টির পানি জ্বরা জীর্ণ সব কিছু ধুয়ে মুছে কুল কুল শব্দে সেগুলো বয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
মুসলধারে বৃষ্টির সাথে মৃদু হাওয়া বইতে লাগলো।

ভালো লাগলো রামদয়ালের। শরীর মন শীতল হয়ে আসতে লাগলো।
রামদয়াল কাচারি ঘরের বারান্দায় বসলো দেয়ালে হেলান দিয়ে। বৃষ্টির ফোটা আর সেই সাথে শীতল বাতাসে ওর গায়ের ঘাম শুকিয়ে শরীরটা জুড়িয়ে যেতে লাগলো।
সা সা বৃষ্টির একটানা শব্দ চৌধুরী এষ্টেটের সকল কাজ কর্ম থামিয়ে সবাইকেই ঘরের কোণে বন্দি করলো।
কাচারী ঘরের বারান্দাটা প্রায় ছয় ফুটের মত উচু। ওখানে বসলে সামনে খোলা মাঠ পেরিয়ে দিগন্ত দেখা যায়। আজ বৃষ্টির দিনে সামনের খোলা মাঠটা ঝাপসা হয়ে এক অভেদ্য রহস্যময় প্রান্তরের মত মনে হচ্ছে।

সারা দিন সারা রাত ধরে বৃষ্টি হতে লাগলো। এ বৃষ্টি যেন আর থামবে না।
ইচ্ছে না হওয়াই রামদয়াল রাতে আর গেল না ওর ঘরে, এখানেই বসে রইলো।
শেষ রাতের দিকে বৃষ্টি কমে আসলো, শুরূ হলো ঝড়।
আকাশে মেঘের গুড়গুড়ুনি আর প্রচন্ড ঝড়ে চৌধুরী এষ্টেটের বাগানে সব গাছের ডালপালা মড়মড় করে ভেঙে পড়ছে। মনে হচ্ছে ক্ষীপ্ত প্রকৃতি প্রবল চাপা রোষে ফেটে পড়ে সব লন্ড ভন্ড করে দেয়ার নেশায় মেতে উঠেছে। কড় কড় শব্দে চৌধুরী এষ্টেটের শত বছরের পুরানো সব গাছের ডাল পালা ভেঙে পড়ছে। একি রুপ প্রকৃতির! শত বছরের ইতিহাস গোড়া সমেত উৎপাটনে যেন মেতে উঠেছে প্রকৃতি।
মনে হচ্ছে শত বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা রোষ নিয়ে কাল বৈশাখী ঝাপিয়ে পড়েছে সব লন্ডভন্ড করে দেবার নেশায়।
থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। যেন ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা দৈত্য দানব দাত বের করে করে ওর করা ধ্বংসযজ্ঞ সবাইকে দেখাচ্ছে।
শীর্ণ দামোদরের দুপাড় ছাপিয়ে বৃষ্টির পানি গ্রামে গঞ্জে ঢুকছে। সামনের খোলা প্রান্তর পানিতে একাকার হয়ে নদী একদম চৌধুরী এষ্টেটের দোর গোড়ায় হাজির হয়েছে।
শান্ত শীর্ণ দামোদরের একি রূপ! আরেকটু হলেই বিষধর সাপের মত ফনা তুলে ফোস ফোস করে দামোদরের পানি ঢুকতে শুরূ করবে চৌধুরী এষ্টেটের ভিতর।
কেন এ ধ্বংসযজ্ঞ! ভাবলো রামদয়াল।

-রামদয়াল, রামদয়াল!
ওকে ডাকতে ডাকতে অমর ছুটে আসলো।
ছুটে আসলো অনিরূদ্ধও।
ঘড়ির কাটায় সকাল হলেও তখনও সূর্য্য ওঠেনি, চারিদিক অন্ধকারে ঢাকা। ওদের দুজনেরই আজই সকালে চৌধুরী এষ্টেট ছেড়ে যাওয়ার কথা।

দেয়ালে হেলান দিয়ে নির্লিপ্তে বসে রামদয়াল। ওদের ডাকার শব্দ কানে গেলেও উঠলো না রামদয়াল, তাকালোও না সে দিকে। মনে হচ্ছে অভিমান করে আছে।
-একটা গাছের বড় ডাল ভেঙে পড়েছে হাসপাতালের ছাদে। কি অবস্থা কে জানে।
আহত কণ্ঠ অনিরুদ্ধর।
-একি হচ্ছে রামদয়াল! সব কি শেষ হয়ে যাবে!
আহত কণ্ঠ অমরের।
বিদ্যুতের ঝলকে ওরা ভালো করে দেখলো একে অপরকে।
ছুটে আসলেন নীলিমা চৌধুরী।
সবাই তাকিয়ে রামদয়ালের দিকে।
ওরা কেউই চৌধুরী এষ্টেটের এই রূপ কখনো দেখেনি ইতিপূর্বে।
হতবাক ওরা সবাই। ওরা সকলে নতুন এখানে, তায়তো চৌধুরী এষ্টেটের এ চেহারা ওদের অপরিচিত।
শংকিত ওরা সবাই।

নীরবে উঠে দাড়ালো রামদয়াল।
ভোরের আলো ফুটতে লাগলো ধীরে ধীরে। ঝড়ের দাপটও স্তিমিত হয়ে আসলো।
সামনে শুধু পানি আর পানি, বাতাসে ঢেউ খেলছে। যতদূর চেখ যায় শুধু ধ্বংসলীলা। মনে হচ্ছে চৌধুরী এষ্টেটের সবাই পুরো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দ্বীপবাসীতে পরিণত হয়েছে।
হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রামদয়াল।

ঝড়ের ঝাপটা থামলো ধীরে ধীরে। বৃষ্টি পড়াও যেন থেমে গেল প্রায়।
চৌধুরী এষ্টেটের মধ্যে পানি ঢুকতে শুরূ করেছে। বসত বাড়ী আর হাসপাতালের জায়গাটুকু বাদে বাকিটা সব ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
মাথা নত করে দাড়িয়ে রামদয়াল। একটা কথাও সরছে না ওর মুখ দিয়ে।
রামদয়াল যদিও হতবাক চৌধুরী এষ্টেটের এ চেহারায়। কিন্তু ওর মধ্যে কোন শঙ্কা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
- ঝড় বৃষ্টিতো থামলো, কিন্তু এখন কি হবে রামদয়াল?
কথাটা বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন নীলিমা চৌধুরী।
-ও নিয়ে আপনি একটুও ভাববেন না চৌধুরী মা।
সৌম্য শান্ত কণ্ঠ রামদয়ালের।
শান্ত দৃষ্টিতে রামদয়াল তাকালো অমর আর অনিরূদ্ধর দিকে।
এত প্রতিকুলতার মধ্যে রামদয়ালের অবিচলিত মনোভাব সবাইকে অবাক করলেও যেন আশ্বস্ত করলো।
অমর রামদয়াল আর অনিরুদ্ধকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
চেনার উপায় নেই চৌধুরী এষ্টেটকে। এ এক অচেনা রূপ ওর। অন্যান্য সব মানুষদের কি অবস্থা কে জানে। সব কিছুকেই আবার ঢেলে সাজাতে হবে।
শুধু আযুর্বেদ বাগানটা ছাড়া। ঔষধি গাছগুলো ছোট ছোট আর লকলকে হওয়াই বাতাসের ঝাপটা থেকে রেহায় পেয়েছে।

ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন নীলিমা চৌধুরী।
কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে ছিলেন তা তার খেলাল নেই। ভেতর থেকে কান্নার শব্দে হতচকিত হয়ে উঠলেন তিনি।
নীলিমা চৌধুরী দৌড়ে গেলেন সেদিকে।
হাউমাউ করে কাদছে ডাঃ লাবনী। মেঝের উপর পড়ে আছে তার ছেলে পরশের অচেতন দেহটা।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে চৌধুরী এষ্টেটের এ রূপ ওকেও বোধহয় অবাক করেছিল। তায়তো অতটুকু ছেলেও দৌড়ে গিয়েছিল সব দেখতে। বন্যার পানিতে ডুবে অনেক খানি পানি গিলে ফেলেছে। ভাগ্যিস নায়েবের নজরে পড়েছিল। সেই হাবুডুবু খাওয়া আধমরা অবস্থায় ওকে পানি থেকে তুলে নিয়ে এসেছে।
তাড়াতাড়ি করে নায়েব পরশকে চিৎ করে শুইয়ে ওর বুক চাপ দিয়ে দিয়ে পেটের পানি বের করতেই খক খক করে কেসে কেদে উঠলো পরশ।
লাবনী ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঢুকরে কেদে উঠলো।
নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ছেলের প্রতি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ায় নিজেকে দোষারোপ করতে লাগলো লাবনী।
কয়েকদিন ধরে নানা কিছু নিয়ে চিন্তাগ্রস্থ থাকায় পরশের দিকে খেয়াল করা হয়নি তায় মনে মনে নিজেকেও দোষারোপ করলেন নীলিমা চৌধুরী।
এখানে থাকলে পরশকে হয়তো বাচানো যাবে না। ময়লা পানি পেটে ঢুকায় ওর ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা। তায় ওকে ভালো ডাক্তার দেখানো খুবই জরূরী।
কালক্ষেপন না করে পরশকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো লাবনী।
লাবনীর অনুরোধে নীলিমা চৌধুরী অনতিবিলম্বে একটা ডিঙি নৌকার ব্যবস্থা করলেন।
মনস্থ করল, ছেলেকে নিয়ে প্রথমে মফঃস্বল শহরে চাচার ওখানে পরে একদম সোজা বাড়ীতে ফিরে যাবে লাবনী। আর না, নিজের কিছু ভালো লাগা নালাগা বা পছন্দ অপছন্দের জন্য ছেলেকে ওর পাওনা থেকে এভাবে বঞ্চিত করা খুবই অন্যায়।
ভাবলো লাবনী।
আরেকটু হলে ছেলেকে হারাত লাবনী।
-এখানে আর এক মুহুর্তও না। ভাবল লাবনী।
লাবনীর যেন মোহ ভঙ্গ হয়েছে। ডিঙ্গিটা আসলেই চারপাশ পানিতে ডুবে থাকা চৌধুরী এস্টেট ছেড়ে চলে গেল লাবনী।