Heading
আপডেট: 2022-12-28 15:50:30
বাবার সাথে অর্ণবের সম্পর্কের দূরত্বটা বলা যায় আজন্ম। যদিও জীবন কি তা বুঝার বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই মাতৃহারা অর্ণব সব সময় ভেবেছে যে বাবাই ছিলেন এ বিরাট পৃথিবীতে তার একমাত্র আপন কেউ। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বুঝেছে যে বাবার সাথে তার সম্পর্কের মাঝখানে কোথায় যেন একটা দেয়াল আছে যেটা টপকানো ছিল তার সামর্থ্যের বাইরে।
প্রকৃত অর্থে অর্ণব ওর মাকে দেখেনি। যদিও কথাটা কেমন যেন মিথ্যে মিথ্যে মনে হয়, কিন্তু এটা আপাতবিরোধী সত্য। যে বয়েসে শিশু কিছু দেখে মনের পর্দায় ছবি একে রাখতে পারে সে বয়সে পৌছনোর অনেক আগেই ও মাকে হারায়।
বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই যাকে মা হিসেবে পেয়েছে তার ছবিটা দেখেই দুনিয়ার মায়েরা সে রকমই হয় তা ভাবতে শিখেছে। কিন্তু আরেকটু বড় হওয়ার পর বন্ধুদের মাকে দেখে ধীরে ধীরে পার্থক্যটা বুঝে নিজের মা আর সৎ মায়ের মধ্যে তফাৎটা বুঝেছে অর্ণব। তারপর বেশ বড় হয়ে ওর সাথে বাবার দূরত্বের ব্যাপারে বাবার অসহায়ত্বটা বুঝে বাবার কষ্টের কাছে নিজের কষ্টটা মলিন হয়ে গেছে ওর কাছে।
প্রকৃতই শিশু অর্ণবকে মায়ের স্নেহে বড় করার উদ্দেশ্যে বাবাকে দ্বিতীয় বিয়েটা করতে হয়। কিন্তু সৎ মায়ের গর্ভে সন্তান জন্ম গ্রহন করার পর বাবার সে চিন্তা তার নিজের কাছেই ভুল প্রমাণিত হয়।
বাবাকে যখন একাকী অসহায়ের মত অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকতে দেখত বাবার জন্য অর্ণবের তখন খুব কষ্ট হত।
তারপর অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে অর্ণব একটা ভাল চাকরীর বদৌলতে নিজের স্নেহহীন পারিবারিক পরিমণ্ডল ছেড়ে অনেক পথ অতিক্রম করে নিজের মন মত একটা জীবন গড়ে নিল।
তারপর ধীরে ধীরে জীবনের ব্যস্ততা কমে আসলে, সকলের কাছে নিজের উপযোগিতা একটু একটু করে কমে আসাতে নিজেকে নিয়ে যখন ভাববার অবকাস পেল তখন নিজেকে আপন মানুষ জন বিবর্জিত গোড়া আগলা হওয়া মানুষের মত মনে হল অর্ণবের।
বাবা অনেক আগেই গত হয়েছেন। তিনি বেচে থাকতেই অর্ণব নিজের গড়া বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে বসবাস শুরু করে। আর এখন মাঝ বয়স ঘুরে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে পিছনে তাকাতে যেয়ে দেখল মূল ভূখণ্ড থেকে সে দ্বীপের দূরত্ব যেন যোজন যোজন দূর।
তার গড়া এ ভুবনটা আলো ঝলমলে। সামনে এগিয়ে যাওয়াই যেন জীবনের সফলতার মাপকাঠি। কিন্তু ঝলমলে আলোই বাস করা মানুষগুলোও দিন শেষে যখন বিশ্রাম নিতে যায় তখন আলো নিভিয়ে বা নিস্প্রভ আলোর নিচে আশ্রয় নিতে মনটা আনচান করে।
তেমনি দীর্ঘ কর্মব্যস্ত জীবন শেষ করে এখন অবসরে এসে অর্ণবের মনও ঝলমলে আলো ছেড়ে একটু নিস্প্রভ আলোর নিচে বিশ্রাম নেয়ার জন্য ছটফট করে।
এক কর্মক্লান্ত জীবন শেষে যখন সমাজের কাছে তার প্রয়োজনিতা ফুরিয়ে আসলো তখন পিছন ফিরে তাকাতে যেয়ে অর্ণব বাবার জীবনের সাথে নিজের জীবনের হুবুহু মিল খুঁজে পেল। ভিন্ন পথপরিক্রমাই এগোনো দুটো জীবন, দুটি জীবনের গল্পগুলোও ভিন্ন কিন্তু মনে হল বেলা শেষে সব জীবনের গল্প যেন একই রেখায় শেষ হয়।
নদীর বাঁক অর্ণবের খুব পছন্দের একটা জায়গা। কিন্তু নদীটা খুব প্রশস্ত হলে চলবে না, ওরকম নদীকে সব সময় কূল কিনারা বিহীন সমুদ্রের মত মনে হয়। সেখানে নিজেকে আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। নদীটা এমন হতে হবে যার এপার ওপার ভাল ভাবে দেখা যায়।
এমনি একটা নদী বাধাহীন ছন্দে সমতলের বুক চিরে একেবেকে নিজ ছন্দে বয়ে চলেছে ওদের গ্রাম ছুঁয়ে। শুনেছে এককালে নদীটা অনেক বড় ছিল, নদীতে অনেক স্রোত ছিল, জোয়ার ভাঁটা হত, দূর দুরান্ত থেকে মহাজনের নৌকা ভিড়ত। কিন্তু কালে কালে সে নদী গাঙে পরিণত হয়েছে।
শুষ্ক মৌসুমে নদীটা এখন আরো সরু হয়ে নিজেকে একদম গুটিয়ে নেয় আর পট কচুরিপনা তাকে ঢেকে ফেলে। নিচ দিয়ে ধুকধুকিয়ে বয়ে যাওয়া প্রবাহ ঢেকে ফেলে তাকে মৃতপ্রায় করে দেয়। তখন গাড় সবুজের মাঝে হালকা ধূসরের উপর বেগুনী ছোপে ভরা পটকচুরি ফুলগুলো অর্ণবকে দারুন ভাবে আকর্ষণ করে। ভরা বর্ষায় কালেভদ্রে শীর্ণ নদীটি ভরপুর হয়ে দুকূল ছাপিয়ে তার বুকে জমে থাকা সব পটকচুরি ভাসিয়ে নিয়ে নিজেকে জঞ্জাল মুক্ত করে নেয়।
অর্ণবের ছোট বেলা পুরোটা কেটেছে নিজ গ্রামে। তখন বিকেলে বা স্কুল ছুটির দিনে নদীর ধার দিয়ে হেটে অনেক দূর অব্দি যাওয়া আর কিছু দূর পর পর বাশের সাকো দিয়ে পার হয়ে ওপারটা ঘুরে আসার ব্যাপারটি ওকে এখনো খুব টানে।
কিছু দূর পরপর নদীটা বাঁক নিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ছোট কাল থেকেই ওই বাঁকগুলোই অর্ণবের মনকে দারন ভাবে ছুঁয়ে যেত। তখন তেমনটা বুঝত না, তবে নদীর বাঁকের সাথে মানুষের জীবন প্রবাহের একটা মিল আছে বলে মনে হত ওর।
নদী যেমন শত বাঁক ঘুরে বড় নদীতে মিলিত হয়ে তারপর কম বেশী পথ সোজা চলে শেষে সমুদ্রে মিশে বিলীন হয়, প্রতিটি মানুষের জীবনও ঠিক যেন তেমনি।
সব মানুষের জীবন চলার প্রবাহ ছোট কাল থেকে বারবার বাঁক খেতে খেতে এগিয়ে যায়। পরিণত বয়েসে এসে জীবন কিছুটা স্থিরতা পেয়ে জীবনটা অনেক প্রসারিত মনে হয়। এ সন্ধিক্ষণে মানুষ সময়ে অসময়ে পিছে তাকিয়ে সব মেনে নিয়ে মোটামুটি কিছুটা সাবলীল গতিতে চলে।
সব মানুষই নিজ নিজ জীবনে শত বাঁক ঘুরে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
অর্ণব ওর নিজের জীবন পরিক্রমাই শত বাঁক ঘুরে, টগবগে যৌবনে জীবন জোয়ারের প্রতিকূলে দাড় বেয়ে সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে। কিন্তু এখন সেসব ব্যস্ততা শেষ হওয়ার পর ভাটির টানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে মনটা আনচান করে ওঠে।
তাইতো সে এখন অখন্ড অবসরে পিছন ফিরে তাকালে তার গ্রামের ওই শত বাঁক খাওয়া নদীটি ওর মনকে দোলা দেয়। যাপিত জীবন যাত্রার বিভিন্ন টানাপোড়নের কথা ভাবলে নদীর ওই বাঁক গুলোর কথা মনে পড়ে।
ছোট কালে নদীর ধার ধরে উজানে যখন হাটত তখন অর্ণবের ইচ্ছে করতো এর উৎপত্তি স্থল প্রত্যক্ষ করবে বলে। কিন্তু এখন উজানে আর না, কারণ তার কোন শেষ নেই, তাই ভাটির দিকে হেটে বেলাভূমিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করবে বলে ঠিক করেছে।
অর্ণব ওর গ্রামে ফিরে ওর সম বয়সী পাচ বন্ধুকে সাথে নিয়ে নদী ধরে ভাটির দিকে হেটে মোহনা পর্যন্ত পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলার পথে প্রতিটা বাঁকে থেমে বোঝার চেষ্টা করবে এই সমতলের বুক চিরে বয়ে যাওয়া নদীটা বিভিন্ন স্থানে কেন বাঁক নিতে হয়েছে।
বেলাটা তখন প্রায় মাথার উপর। কাঠফাটা রোদে নিজের ছায়াটাও এসে ওর পায়ের নিচে আশ্রয় নিয়েছে রোদের তীব্রতা থেকে বাচার জন্য। চারদিক একদম ফাঁকা, দূরে একটা ছায়াগাছ নজরে পড়াই ওটার নিচে আশ্রয় নেয়ার মনস্ত করল অর্ণব।
আরো কিছুক্ষণ হাটার পর নদীটা যেখানে তীক্ষ্ণ বাঁক নিয়েছে সেই বাকের উপর দাঁড়িয়ে শত বর্ষী একটা অশ্বত্থ গাছ বেশ কয়েক একর জায়গা জুড়ে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এটাকে মরুদ্যানের মত মনে হল অর্ণবের। এই কাঠফাটা রোদে গাছের ছায়াই বসে শরীরটা ক্লান্তিতে ভেঙ্গে এসে নিজের মধ্যে একটা অলসতা বোধের জন্ম নিল।
মানুষের শরীর মন এরকমই, ক্লান্তির পর একটা আরামদায়ক স্থান পেলে সেটা ছেড়ে যেতে মন একদম সাঁই দিতে চায় না।
চোখ দুটো নিজ থেকেই বুজে তন্দ্রার ভাব আসলো।
কতক্ষণ এভাবে তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল বা আরো কতক্ষন থাকতো সেটা সঠিক ভাবে বলা মুশকিল। একটা বটফল ওর মাথায় পড়ে ব্যথা পেয়ে ওর তন্দ্রা ভঙ্গ হল। চোখ মেলে দেখে ততোক্ষণে বেলা গড়িয়ে গিয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে অর্ণব বুঝল এটা পুরনো একটা ঘাট লম্বা লম্বা অনেকগুলো সিড়ি নদীতে নেমেছে। দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে সিঁড়িগুলোকে লতাপাতায় ঢেকে ফেলেছে।
ঘাটের উপরে অদূরেই নজরে পড়ল বটের ছায়াই ডাল পালার আড়ালে পুরনো জরাজীর্ণ একটা দালান। কোন পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ীর ঘাট এটা। ভাবল অর্ণব।
এককালে কত কর্ম চাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল জায়গাটা। গাঙটা তখন পুরো যৌবনা নদী ছিল নিশ্চয়। ঘাট দেখে বুঝতে কষ্ট হয় না যে এই ঘাটেই দেশ বিদেশ থেকে বড় বড় নৌকা ভিড়ত। এটা একটা তীক্ষন বাঁক হওয়াই জমিদার তার প্রাসাদ নির্মাণের জন্য বোধকরি এ জায়গাটা বেছে নিয়েছিলেন।
কালের স্রোতে জীবন জীবিকার সব স্রোত বন্দ হয়ে এখন এটা মৃত জনপদে পরিণত হয়েছে।
অর্ণবের মনে হল তার বাবার জীবনও তার মত অতৃপ্ততায় শেষ হয়েছে। আর এই জমিদার যারা বংশ পরস্পর কত আশা নিয়ে নদীর এ বাঁকে তাদের স্বপ্নের সৌধ গড়েছিল, তাদের জীবনও অর্ণব আর ওর বাবার জীবনের মত কোন অদেখা শক্তি দ্বারা নির্মিত বাঁকে আটকে যেয়ে ধিকি ধিকি করে প্রবাহিত হয়ে জীবন মোহনায় মিশে শেষ হয়েছে।
শত বাঁক ঘুরে মোহনায় পৌঁছানোই সব জীবনের উদ্দেশ্য।
নদী এখানে এরকম একটা বাঁক সৃষ্টি করার জন্যই নিশ্চয় জমিদার এ জায়গাটা বেছে নিয়েছিল সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু নদীটা এখানে কেন বাঁক নিল আর সে জন্যই তার যৌবনা স্রোত আঘাতের পর আঘাত করে করে বাঁকটাকে অনেক খানি চওড়া করে বড় বড় নৌকা ভিড়ার ব্যবস্থা করল এ সবের পিছনে কারণ খুঁজতে চিন্তায় ডুবে গেল অর্ণব।
কিন্তু কিছুতেই তার কোন কূল কিনারা করতে পারল না। নদীটা বাঁক নিয়েছিল বলেই এ জায়গাটা জুড়ে এত কিছু কর্মযজ্ঞ গড়ে উঠেছিল সেটা বোধগম্যের বিষয়। কিন্তু এই বাধাহীন সমতল প্রান্তরে নদীর গতি কেন ঘুরাতে হল সেটা বোধহয় মানুষের বোধের বাইরে। বিষয়টা কল্পনা করা যায় অনেক ভাবেই কিন্তু স্বতঃসিদ্ধতা প্রতিষ্ঠা করা বোধকরি সম্ভব না।
জীবনের এই পড়ন্ত বেলাই এসে অর্ণব এটা বুঝল যে কোন একটা প্রচ্ছন্ন শক্তি এটা করেছে কিন্তু সে শক্তিটার স্বরূপ বোঝা পুরোপুরি সম্ভব না।
একই শক্তি অর্ণবের জন্মের পর পরই এরকম একটা বাঁকের সৃষ্টি করেছিল। তারপর যাপিত জীবন প্রবাহের পথে সৃষ্ট ছোট বড় শত জীবনের বাঁক তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। কিন্তু সে বাঁকগুলো তার নিজের সৃষ্টিতো ছিলই না, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তার চিন্তা চেতনার মধ্যেও ছিল না।
মানুষ একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারে যে, প্রতিটি জীবনেই এ ধরনের অজস্র বাঁকের সৃষ্টি হয়, যে বাঁকগুলো মেনে নিয়ে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারলে জীবনে সফলতা আসে আর তা না পারলে বাঁকগুলো তার জীবনে বাঁধা হয়ে জীবনের গতিকে স্তিমিত করে দেয় এমনকি থামিয়ে দিয়ে জীবনের সমাপ্তি টেনে দেয়।
বাঁক সৃষ্টিকারী শক্তির সামনে মানুষ প্রকৃতই অসহায়। তবে সে শক্তিকে জীবন চলার সহযোগী করতে পারলে জীবনটাকে সুন্দর আর সার্থক করা যায়।
বিশাল বটবৃক্ষের শাখা প্রশাখার ফাঁক ফোকড় দিয়ে অস্তায়মান সূর্য উঁকি দিয়ে তার মুখের উপর পড়াই সে সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো সেদিকে। মনে হল যেন বিদায় নেয়ার সময় হয়েছে সেটা জানানোর জন্য সে উঁকিঝুঁকি মেরে নিচ্ছে।
গাঙের দিকে তাকিয়ে দেখল বট গাছটার ছায়া যেটা ভরা দুপুরে নিজের শরীরের নিচে গুটিয়ে ছিল সেটা অনেক গুন লম্বা হয়ে গাঙটার ওপারটা ঢেকে ফেলেছে।
অবাক হল উঠে দাড়াল অর্ণব! দেখল তার নিজের ছায়াটাও অনেক অনেক গুনে প্রসারিত হয়ে গাঙ পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে গিয়েছে।
ঠান্ডা হাওয়া এসে চোখে মুখে লাগতে লাগলো।
ভাবল ক্লান্ত দিনমণি ডুব দেয়ার সময় হয়েছে, আর মোহনাও বেশী দূরে নয়। সময় হয়েছে অন্ধকারে বিলীন হয়ে নিজের আলাদা অস্তিত্ব হারিয়ে সে শক্তির সাথে একাত্ম হওয়ার।