Heading
আপডেট: ০৮ জানুয়ারী ২০২৩, ১২:১৭
অবনী তার নিজের হাতে গড়া ভুবনের সাথে সব বাধন ছিন্ন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। আয়নাতে নিজেকে খুব গভীর ভাবে দেখতে মন চায়লো।
এদিকে শান্তি রক্ষার কাজ ঠিক মত এগিয়ে চলেছে। একদিকে শান্তি রক্ষী সেনারা যেমন বিবাদমান গ্রুপদুটির আত্মসমর্পন করাচ্ছে অপরদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে ফিরে আসা অগনিত মানুষের বাসস্থান, খাবার চিকিৎসা ইত্যদি প্রদানে ব্যস্ত বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রম সমন্বয়ে তার লোকজনদের নিয়ে রাত দিন ব্যস্ত অবনী।
অবনী কাজে ডুবে থাকে একদম আত্মভোলা হয়ে। অপরকে সেবা করার কাজ নিজেকে ভুলার যেমন সুযোগ তৈরি করে দেয়, তার মত বোধহয় বিধাতার সৃষ্টিতে দ্বিতীয়টি আর হয় না।
পাওয়ার আনন্দ ক্ষনস্থায়ী আর সেটা ফুরাতে আরম্ভ করে পাওয়ার একদম শুরূ থেকেই। আর দেয়ার আনন্দ বা নিঃস্বার্থ ভালবাসা আর সেবা'র আনন্দ শুরূ হয় সে মানষিকতা মনে পোষন করা থেকে। আর সে আনন্দ হৃদয়ে লেপ্টে থাকে যা কখনো শেষ হয় না। এটায় একমাত্র স্বর্গীয় আনন্দ যা জীবিত অবস্থায় উপভোগ করা যায়।
এই মিশনটা বোধহয় জাতিসংঘের আওতায় সফল মিশনের একটা উদাহরণ।
মিশনটা সমাপ্তির শেষ পর্যায়ে অবনীর ডাক আসলো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে। অন্য একটা বড় মিশন শুরূ করার নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশ গ্রহনের জন্য। বর্তমান মিশনের সফলতা নিশ্চিতভাবে অবনীর নাম সর্টলিষ্টে আসার সুযোগ করে দিয়েছে।
এমন একটা ডাক যে কারো জন্যই রোমাঞ্চকর। অবনীর হাতে সময় নেই। তিন দিন পর রাজধানী মাপুতুতে অবস্থানরত লিয়ার জেটটি ওকে সরাসরি নিউইয়র্ক নিয়ে যাবে।
সংবাদটা আসার পর সবাই ওকে অভিনন্দন জানালো। ওর মত একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষের উপযুক্ত স্বীকৃতি বলে মন্তব্য করলো অনেকেই।
বিধাতার সৃষ্টি মানুষ বোধহয় এরকমই। অথৈই সমুদ্রের মাঝখানে আটকে থাকা বাতাসের অভাবে পাল নুইয়ে পড়া নৌকার মাঝি কত না কিছুই ভাবে -নিজের অপ্রতুল প্রস্তুতি, ভাগ্যের পরিহাস ইত্যাদি কত কিছু। কিন্তু অপ্রত্যাসিত ভাবে পালে বাতাস পেলে যেমন সব ভুলে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার নেশায় মেতে ওঠে, ঐ অপ্রত্যাসিত সুযোগটা তেমনি এক নেশায় যেন পেয়ে বসলো অবনীকে।
ওর প্রয়োজনটা আর্তমানবতার সেবার জন্য এতটা দরকারী যে, আলাদা প্লেনে করে ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোমাঞ্চকর এক অনুভূতী ওর বুকের মধ্যে।
এত দিনের জমে থাকা বুকের বোঝাটা হটাৎ করেই হালকা হয়ে গেল। নিজেকে অনেক প্রয়োজনীয় বোধ হলো। অম্বরের কান্নাটাও যেন থেমে গেল। মনে হলো ও খুশী হয়েছে।
অবনী ওর সব কাপড় চোপড় বের করে রং মিলিয়ে মিলিয়ে কাপড় গুলো বাছাই করলো। আয়নার সামনে নিজেকে বিভিন্ন ভংগিতে দেখে বিভিন্ন চালচলন ভাবভঙ্গি অবয়ব পরীক্ষা করলো।
সবকিছু ঝেড়ে ফেলে যখন লিয়ার জেটে উড়তে উড়তে জানালা দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা নজরে পড়লো তখন সেটাকে কুয়াসাচ্ছন্ন এক স্বপ্নীল জায়গা বলে মনে হলো। নিচের প্রথিবীকে কুয়াসাচ্ছন্ন রেখেই লিয়ার জেটটি বাতাসের গতীতে ওকে নিয়ে চললো।
নিউইয়র্কে নেমেই সরাসরি অবনী জাতিসংঘের সদর দফতরে গেল। সেখানেও চেনা জানা কিছু মুখের সাথে দেখা হওয়াই সবাই ওর কাজের প্রশংসা করলো। সবাই পরদিন সকালে অনুষ্ঠিতব্য ইণ্টারভিউতে ভালো করার জন্য আর্শিবাদ করলো।
মিঃ ডালবেহারার সাথে দেখা হলো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে।
প্রায় বছর পনেরো আগে মিঃ ডালবেহারা নামে ইন্ডিয়ার উড়িস্যা প্রদেশের এই বৃদ্ধ বয়সী ভদ্রলোকের সাথে অবনী মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কাজ করেছিল।
এমন কিছু মুখ থাকে যা প্রথমবার দেখলেও মনে হয় অনেক দিনের চেনা, কোথায় যেন দেখেছি। ডালবেহারাকে প্রথম দেখেই অবনীর সেরকমই মনে হয়েছিল। ঐ মুখটা নিয়ে অনেক সময় নিয়ে চিন্তা করেছে অবনী কিন্তু কোন কুল কিনারা করতে পারিনি।
বেশ হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিলো এই অসম বয়সের দুজনার মধ্যে। অসম্ভব কাজ পাগল লোকটা। সে বলতো হাতের কাজটা শুধু মেধা আর শরীর লাগিয়ে করলে তাতে ক্লান্তি আসে। কিন্তু সবকিছুর সাথে হৃদয় ছোয়ালে, ভয়, ক্লান্তি এ সবের কিছুই স্পর্শ করতে পারে না।
বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার জন্য বয়স একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু চিন্তা চেতনার বা মূল্যবোধের মিল থাকলে বয়সের গণ্ডি পেরিয়েও বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে পারে। তেমনটিই ঘটেছিল ডালবেহারার সাথে।
পিতৃ বয়সী ঐ ভদ্রলোক অবনীকে খুব পছন্দ করতো। কিন্তু কাজের বাইরে অন্য কোন কথা যেন ওর জানা ছিল না।
এই পনেরো বছরে মিঃ ডালবেহারা অনেক বেশী বুড়িয়ে গিয়েছে মনে হলো অবনীর। আগের মত আর উচ্ছলতা নেই। ওর মুখটা কেমন মলিন মনে হলো। একটু আত্ববিসৃতও লাগলো।
তবে আন্তরিকতায় কোন খাদ পড়েনি বোঝা গেল।
কতদিন পর আবার ওকে দেখে কোন এক অজানা কারণে অবনীর দেহ মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো।
খুব ভাল লাগলো অবনীর। মনে হল অতৃপ্ত মনটা ওর সান্নিদ্ধে কিছুটা তৃপ্ত হবে।
এতদিন পর দেখা হওয়াতে ওরা একে অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তার সাথে কথাবার্তায় অবনীর মনে হতে লাগলো ডালবেহারা যেন ওর মনের সব কিছু জানে। সব প্রশ্নের জবাব বোধহয় ওর কাছ থেকে পাওয়া যাবে।
ডালবেহারা অবনীর এই সিলেকসানে যার পর নেই খুশী হলো। ওর খুশী হওয়াটা অন্য সবার মত গতানুগতিক নয়। এই সিলেকশানটা পাওয়াই অবনীর মনে যে আনন্দের বন্যা বয়ে চলেছে, একান্ত আপন জনের মত তার অংশীদারও হলো ডালবেহারা।
কুল কিনারা বিহীন সাগরের মাঝখানে দীর্ঘদিন ধরে ভাসমান প্রমোদতরীর যাত্রি জাহাজের মধ্যে সব কিছু থাকা সত্বেও যেমন একটু কুলের সন্ধানে উন্মুখ হয়ে থাকে। আর হটাৎ করে কুলের ক্ষীন দৃশ্য চোখে পড়তেই যেমনি করে ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে যায়। ওর এই সৌভাগ্যটা ডালবেহারা আপন কারো মত করে ভাগ করে নেওয়াতে আবেগাপ্লুত অবনীর অবস্থাও অনেকটা সেরকম বোধ হলো।
ডালবেহারা অবনীকে ওর অফিসে বসালো। তারপর অনেকক্ষন ধরে বিভিন্ন কথা বলতে বলতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো।
অফিস ছুটির পর পড়োন্ত বেলায় ডালবেহারা নিজে গাড়ী চালিয়ে ওকে আল্টানটিকের পাড়ে নিয়ে গেল।
পাশাপাশি বসলো ওরা দুজনে।
-আমি চলতে চলতে জীবনের প্রায় সব পথ পাড়ী দিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমার এখনো অনেক খানি বাকি। জীবন মানে শুধু কেবল সামনে এগিয়ে যাওয়া নয় অবনী। অতীতের দিকে তাকিয়ে নিজেকেও দেখতে হবে চিনতে হবে।
ক্লান্তি আর অবসন্নতার ছাপ পরিস্কার ভাবে প্রতিভাত ওর কণ্ঠে। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালো অবনী।
-এই ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যা কিছু অনুভূত হয় তার পুরোটা সত্যি নয় অবনী। তাহলেতো মরিচিকাও সত্য হতো। তায়তো চোখ বন্দ করেও দেখতে হয়, কান বন্দ করেও শুনতে হয়। পঞ্চইন্দ্রিয়ের সবগুলো দরজা বন্দ করে কোন কিছুকে বিচার করলে তবেই সেটার আসলটা চেনা যায়।
আলো আধারীতে অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইলো অবনী ডালবেহারার দিকে। এলাকাটাও ধীরে ধীরে নির্জন হতে লাগলো। শুধু আকাশের তারাগুলো বোকার মত মিট মিট করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।
-আমরা যে কি চায় সেটাই আমরা বুঝিনা। তায়তো আমাদের জীবন মরিচিকার পিছনে ছোটা। আর আকাঙ্ক্ষা গুলো হচ্ছে টগবগে ঘোড়া, ছুটতেই থাকে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আর অটাকে ধরার প্রচেষ্টায় রত এক একটা জীবন টুপ টুপ করে ঝরে ঝরে শেষ হয়ে যায়।
একটু থেমে ও আবার শুরূ করলো -তবে ভেবনা এটা শুধু আমাদের জীবনেই ঘটছে, সবার জন্য একই নিয়ম, এটা মহানিয়ন্তার নিয়মেরই অংশ। যদি জিজ্ঞেস কর কেন? তার জবাবতো আমার কাছে নেই।
ডালবেহারাকে কিছুটা অচেনা লাগলো।
ওর নিজের জীবনের অনেক কথা বলতে লাগলো ডালবেহারা। আজ মনে হচ্ছে অন্য এক মানুষ এই ডালবেহারা। জীবিকার কোন গল্প নয় সব ওর জীবনের কথা। ও যেন নিজেকে উজাড় করে দেয়ার মত একজন মানুষ খুজে পেয়েছে।
বিশ বছর বয়স থেকেই ও দেশ ছেড়েছে। গত চল্লিশ বছরের বেশী সময় ধরে নানান দেশ আর মানুষ দেখেছে। দেখা জানা আর পাওয়ার আকাঙ্খা ওকে নেশাগ্রস্থ করে ফেলেছিল। নেশার ঘোরেই এতটা বছর কাটিয়ে দিয়েছে। জীবন কখনো না করেনি ওকে।
শুধু ওপরে উঠাতে অভ্যস্ত হয়ে ওর জন্য নির্ধারিত সময়ের প্রায় সবটুকু শেষ করে জীবনের এই প্রান্তে এসে দাড়িয়েছে আজ। বড় একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো ওর হাড্ডিসার বুক খালি করে।
-দেখার, জানার আর ভোগ করার কোন শেষ নেই অবনী। শেষ খুজতে খুজতে আমার সময়ের প্রায় সব টুকু শেষ হয়ে গেছে।
একটু থেমে বৃদ্ধ আবার বললো। -কোথাও বড় কোন হোচট কখনো খায়নি তায় চলার গতীতে একটু পজ দিয়ে নিজের অবস্থানটা দেখে নেয়া বা পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখার কোন সুযোগই পায়নি জীবনে।
-সুযোগটা যখন আসলো, অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে ততোদিনে। কথাটা বলতে ওর গলাটা ধরে আসলো। মুখটা বোধহয় আমার থেকে আড়াল করার জন্য আকাশের দিকে তাকালো।
-এই দুনিয়ার মানুষের সাথে মিশতে মিশতে, এদের মত করে চলা ফেরা কথাবার্তা বলতে বলতে আয়নাতেও নিজের চেহারাটা এদের মতই মনে হয়েছে।
-একটু মেধা আর চেহারার বদৌলতে নাটকের পরিচালক যদি তোমাকে রাজা সাজিয়ে মঞ্চে উঠায়, তারপর বাইরের সবাই তোমাকে রাজাবাবু বলে সন্মোধন করায় তুমি যদি নিজেকে আসল রাজা ভেবে বস তাহলে ব্যপারটা কেমন হয় বল? মজার না?
মৃদু হাসলো ডালবেহারা, বোধহয় নিজেকে উদ্দেশ্য করেই।
-নিজেকে রাজা ভাবার কারণে ছাপোষা স্ত্রীকে রানী, খেটে খাওয়া বাবা আর মাকে রাজপিতা আর রাজমাতা ভাবতে যেয়ে যখন দেখা যায় ওরা তা নয় বরং ওরা যা তায়ই, তখন যে কাপুরূষ সে পালিয়ে বাচে। নিজের গায়ে সব সময় রাজার পোশাকটা চাপিয়ে ঠুনকো রাজার প্রাসাদে লুকিয়ে রাখে নিজেকে।
মৃদু কাসতে কাসতে একটু থামলো ডালবেহারা।